পূর্ব উপকূল সফর শেষ। পাসিকুডার নীল রঙ দু’চোখে মেখে আবার মধ্য শ্রীলঙ্কার পথে। বেলা একটার কাঁটা পেরিয়েছে। এখনকার গন্তব্য উত্তরমধ্য প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক শহর পোলোন্নারুয়া। সকালের ৩৮ ডিগ্রি বোধহয় এখন চল্লিশকে ছাড়িয়ে গেছে। ভরদুপুরে খাঁ খাঁ করছে গোটা রাস্তা, যেন ঘুমন্ত দেশ। ঘণ্টা দেড়েক পর এক স্নিগ্ধ নদীর দেখা পেলাম, মহাভেলি। প্রবাহ পথের মাঝে লম্বা সবুজ চড়ায় ধাক্কা খেয়ে দুটি শাখায় ভেঙেছে। অনেক দূরে নীল আকাশ এসে মিশেছে আবছা ছাইরঙা পাহাড়ের মাথায়।
বিঘার পর বিঘা ধানের খেত। সাহান বলছিল, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চাল এ অঞ্চলে চাষ হয়। দীর্ঘ সময় কোনও হোটেল-রেস্তোরাঁ-ধাবার দেখা মেলেনি। কাদরুওয়েলা যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় পৌনে তিনটে। হাইওয়ের ধারে ‘হোটেল চিলিজ়’। ফুডকোর্টের মতো ব্যবস্থা। সেলফ সার্ভিস। বেশ ভিড়। কোনও টেবিল ফাঁকা নেই। একতলা-দোতলায় ভাগাভাগি করে টেবিল দখলের চেষ্টায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসার একটা ব্যবস্থা হল। এরপর আবার কুপন নিয়ে কাউন্টারে লাইন। আর তর সইছে না। অনেকটা ধৈর্য্য খরচ করার পর লঙ্কান ফিশ থালিটা হাতে পেলাম। ভাতের সঙ্গে অড়হর ডাল, উচ্ছেভাজা, স্যালাড, পাঁপড়ভাজা, তরকারি, স্থানীয় নদীর মাছ, আমড়ার চাটনি। তরকারিটা মুখে দিয়ে অবাক হওয়ার পালা! বাংলার বাইরে বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে গাঁঠিকচু! এবারও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি… পদগুলো শুনে বাঙালি গেরস্থ বাড়ির দুপুরবেলার কাঁসার থালা মনে হলেও, রেসিপিগুলো সব শ্রীলঙ্কান।
খাওয়াদাওয়া সেরে বেরতে সাড়ে তিনটে বাজল। দশ মিনিট এগোতেই বড় শহর। বাঁদিকে একটা বিশাল লেক দেখিয়ে সাহান বলল, “পরাক্রমসাগর, এই কৃত্রিম লেকটা রাজা পরাক্রমবাহুর আমলে তৈরি হয়েছিল, আয়তন প্রায় ৬ হাজার একর।” বুঝলাম, পোলোন্নারুয়া পৌঁছে গেছি। গাড়ি একটা মিউজিয়ামের সামনে এসে থামল। প্রাচীন পোলোন্নারুয়া শহরকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই মিউজিয়ামের অফিস থেকেই টিকিট কেটে দেখে নিতে হবে প্যালেস এরিয়া, রিলিজিয়াস এরিয়া, গল বিহার। টিকিটমূল্য মাথাপিছু ২৫ ডলার, ভারতীয় হওয়ার সুবিধা, ১২.৫ ডলার ছাড়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে এগারো খ্রিস্টাব্দের গোড়া পর্যন্ত অনুরাধাপুরা ছিল সিংহলের রাজধানী। এরপর চোল রাজারা অনুরাধাপুরা দখল করে এবং রাজধানী পোলোন্নারুয়ায় স্থানান্তরিত হয়। ৫৩ বছর শাসন করার পর রাজা প্রথম বিজয়বাহু অবশেষে চোলদের পরাজিত করে সিংহলি রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর রাজা প্রথম পরাক্রমবাহু ১১৫৩ সালে শাসনক্ষমতা অর্জন করেন এবং ১১৮৬ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনিই ছিলেন রাজা। এই সময়কালকে সিংহলের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা হয়। সেচ ব্যবস্থা, বৌদ্ধ চর্চা, দেশের সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন, শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছেছিল। এছাড়াও হাসপাতাল, সমাজকল্যাণ ইউনিট, খাল ও বড় জলাধার (যেমন পরাক্রমসাগর) নির্মাণ করেছিলেন। এরপর ১২৩২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পোলোন্নারুয়া ছিল সিংহলের রাজধানী।

একজন গাইডও জোগাড় হয়েছে। মিউজিয়ামটা এক চক্কর ঘুরে নিয়ে গাড়িতে উঠে প্রথমে চলে এলাম প্রাসাদ এলাকায়। এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য রাজা পরাক্রমবাহুর সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল বৈজয়ন্ত প্যালেস। রাজা পরাক্রমবাহু তাঁর রাজত্বকালে একটি বিশাল সাততলা প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রথম তিনটি তলা ছিল ইটের তৈরি। আর ওপরের চারটি তলা কাঠের। অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি। সাততলা এই প্রাসাদে রিসেপশন হল, ডাইনিং হল, অনুষ্ঠান মঞ্চ, রসুইঘর ইত্যাদি নিয়ে মোট এক হাজারটা ঘর ছিল। রাজা-রানির ঘর ছিল একদম উপরে সাততলার কাঠের ঘরে। গ্রানাইটে তৈরি সিঁড়ির অস্তিত্ব এখনও রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে আঁকা থাকত নানা ছবি। শত্রু আক্রমণে এই অসামান্য স্থাপত্য আগুনে পুড়ে গেলেও অতীতের শিল্পকীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে।

প্রাসাদ এলাকার অপর প্রান্তে রাজা পরাক্রমবাহুর রাজসভার ভগ্নাবশেষ। ভবনটির নাম ‘বৈশ্যভুজঙ্গ মণ্ডপ’। এখানে রাজা তাঁর মন্ত্রী, সেনাপতি, রাজকর্মচারীদের সঙ্গে দেখা করতেন ও রাজকার্য পরিচালনা করতেন। তীব্র সূর্যতাপ থেকে রক্ষা পেতে পাথরের স্তম্ভের উপর নির্মিত ছাদটিতে কাঠ ও মাটির টালি বসানো থাকত। প্রচণ্ড গরমে রাজসভা ঠান্ডা রাখার জন্য অভিনব প্রয়োগকৌশল। থামের নীচে সভাসদদের বসার জায়গা। তাঁদের নামধাম, দায়িত্ব সব লেখা থাকত থামগুলোর গায়ে। সভায় প্রবেশের সিঁড়ির ঠিক সামনে মাটিতে রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরের ওপর নকশাকাটা মুনস্টোন, যা প্রবেশদ্বারের সামনে অনেকটা গালিচার মতো গণ্য হতো। হাতি, ঘোড়া, ষাঁড়, হাঁস, সিংহ প্রভৃতি খোদিত মুনস্টোনের কারুকার্য এককথায় অনবদ্য।

সিঁড়ির শেষ ধাপে দু’পাশে প্রহরীর মতো দুটি বড় সিংহমূর্তি। এরপর সবুজ ঘাসে পা ফেলে ফেলে পরাক্রমবাহুর আমলের তৈরি রাজবাগানে অর্থাৎ ‘নন্দন উদ্যান’-এ বৈকালিক বিহার। এখানেই আছে রাজার স্নানের পুকুর ‘কুমারা পকুনা’। চারপাশটা বাঁধানো, শ্যাওলা-সবুজ সরপড়া জল। লাগোয়া স্টলটায় চায়ের লিকারের গন্ধ। ধোঁয়াওঠা কাপটা নিয়ে পুকুরঘাটের ছায়ামাখা সিঁড়িতে বসলাম, ক্ষণিকের বিশ্রাম। একটু দুরেই ‘দালাদা মালুওয়া’ অর্থাৎ মন্দির এলাকা। আবার জুতো খোলার ব্যাপার। সারাদিন ধরে রোদে তেতে থাকা পাথুরে স্ল্যাবের ওপর দিয়ে হাঁটার কষ্ট। তবে গনগনে রোদের আঁচ এখন অনেকটাই স্তিমিত। তাই হয়তো ওই ছ্যাঁকাটা কিছুটা সহনীয়।
পোলোন্নারুয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থাপত্য হল ভাতাদাগে। কথিত আছে, দ্বাদশ শতকে রাজা প্রথম পরাক্রমবাহুর আমলে বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত রাখার জন্য একটি স্তূপ নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই স্তূপের সুরক্ষার জন্য রাজা নিশাঙ্কমল্লের আমলে (শাসনকাল ১১৮৭-১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ) কিছু সংস্কার ও পুনর্গঠন হয়। ইটের তৈরি বৃত্তাকার স্থাপত্য। চারটে প্রবেশদ্বার। চারপাশে কিছু মূর্তি। দেওয়ালে নজরকাড়া ভাস্কর্য। সিংহলী নির্মাণশৈলীর প্রথা মেনেই এখানেও সিঁড়ির মুখে মুনস্টোন আর গার্ডস্টোন। উপরে উঠে বড় চাতালের মতো সমান জায়গা। সেখানে বুদ্ধের চারটে মুর্তি, চাররকম ভঙ্গিমায়। ভাতাদাগের ঠিক উল্টোদিকেই হাতাদাগে। এটি রাজা নিশাঙ্কমল্লের বানানো দন্তসৌধ (toothrelic) মন্দির। ‘হাতা’ শব্দের অর্থ ষাট। ষাট ঘণ্টার মধ্যে নির্মিত হয়েছিল বলে একে হাতাদাগে বলা হয়, এমনই মনে করা হয়। দোতলা মন্দিরের ওপরতলাটি ধ্বংস হয়ে গেছে। দেওয়ালে পাথরের স্ল্যাবগুলির মধ্যে রাজা নিশাঙ্কমল্লের তিনটি শিলালিপি রয়েছে যার একটিতে “নিশাঙ্ক হাতাদাগে” শব্দটি রয়েছে। অন্যান্য শিলালিপিতে বৌদ্ধভিক্ষু সম্প্রদায়ের প্রতি রাজার পরোপকারী কার্যকলাপ এবং উপদেশ রয়েছে। অন্দরে কয়েকটা মূর্তি আছে যা বহুলাংশেই ধ্বংসপ্রাপ্ত।

পাশেই গলপোতা, বিস্ময়কর পাথরের বই। এখনও পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় পাথরের শিলালিপি। মূলতঃ রাজা নিশাঙ্কমল্লের বংশের বীরত্বপূর্ণ ও কল্যাণকারী কাজের প্রশস্তি, রাজনির্দেশ, নীতি এবং প্রজাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের রূপরেখা খোদিত আছে। শিলালিপিতেই বর্ণিত আছে যে, সুদূর মিহিনতালে থেকে ১৫ টন ওজনের এই বৃহৎ গ্রানাইট পাথরের ব্লকটি নিয়ে আসা হয়েছিল। মন্দির চত্বর থেকে বেরোনোর আগে শেষ দ্রষ্টব্য সাতমহল প্রাসাদ। ধাপ পিরামিড শৈলীতে তৈরি সাততলা স্তূপ। ইট এবং প্লাস্টারের স্তর দিয়ে তৈরি। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। নিচতলায় একটি প্রবেশদ্বার আছে বটে কিন্তু প্রবেশ করা যায় না। উপরের তলায়, প্রতিটি দেয়ালের কেন্দ্রে একটি ভাস্কর্য রয়েছে, যার চারপাশে একটি খিলান এবং কুলুঙ্গির মতো গর্ত রয়েছে।

দিনের অন্তিম লগ্নে গলবিহার পৌঁছলাম। মন্দির থেকে বেশি দূর নয়। অল্প সময়ের জন্য গাড়িতে উঠতে হয়েছিল। রাজা প্রথম পরাক্রমবাহুর এও এক অনন্য কীর্তি। মন্দিরের মুখ্য বৈশিষ্ট্য হল বুদ্ধের চারটি শিলা মূর্তি, যেগুলি একটি বড় গ্রানাইট পাথরের গায়ে খোদাই করা হয়েছে। একটি বড় বসা মূর্তি, গুহার ভিতরে তুলনামূলকভাবে ছোট আর একটি বসা মূর্তি, সাত মিটার লম্বা দাঁড়ানো মূর্তি এবং নির্বাণলাভ করার পর বুদ্ধের শায়িত মূর্তি। এই প্রাচীন সিংহলী ভাস্কর্য, অনবদ্য শিল্পসুষমা দেখে তাক লেগে যায়। প্রায় পৌনে সাতটা বাজলে মৃদু আলো জ্বলে উঠল বুদ্ধমূর্তির গায়ে। কয়েক শতক আগের ঐতিহাসিক রহস্যময়তা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। গলবিহার থেকে বেরিয়ে এলাম। রাত্রিবাস সিগিরিয়ায়। সাহান অনেকক্ষণ ধরেই তাড়া দিচ্ছে। এখন আরও ৫৫ কিলোমিটার পথ যেতে হবে।
চল্লিশ ছোঁয়া গরম, সারাদিনের অক্লান্ত ভ্রমণ… চোখের পাতা লেগে এসেছিল। হঠাৎ সজোরে ব্রেক। তন্দ্রা কাটতে দেখি রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হেড লাইট বন্ধ করে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সাহানের দিকে তাকাতেই ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে চাপাস্বরে আওয়াজ করল “শসসসসস!…”।তারপর সামনের দিকে ইশারা করল। ততক্ষণে অন্ধকারটা কিছুটা সয়ে গেছে। ভর সন্ধ্যাবেলা বুনো হাতির পারাপার দেখে নীরব উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। রাস্তা ফাঁকা হলে আবার চলা শুরু। সাহান বলল, “আমরা এখন মিনারিয়া ন্যাশনাল পার্কের পাশ দিয়ে যাচ্ছি”। এর পরই পথের ধারে বসে থাকা দুটো বন্য শেয়ালের দেখা মিলল। হেডলাইটের আলো তাদের মুখে পড়তেই এক ছুট্টে পালিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। হাবারানা জংশন পৌঁছলাম, রাত আটটায়। একটু চা-বিরতি নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সময়াভাবে সম্ভব হল না। সাহান জানাল, আর মিনিট কুড়ি লাগবে। ক্যান্ডি রোড ধরে চলছিলাম। কিছুক্ষণ পর গাড়ি বাঁ দিকে নির্জন, অন্ধকার রাস্তায় ঢুকে পড়ল। কুড়ি মিনিট তো হয়ে গেল, পথ শেষ হচ্ছে না। শর্টকাট নেবে বলে এপথে ঢুকেছিল, কিন্তু এখন সাহানকে বেশ অপ্রস্তুত লাগছে। লোকালয়ের বদলে ক্রমে অরণ্য প্রকট হচ্ছে। প্রায় সাত কিলোমিটার এ পথে চলার পর আমাদের সবারই কেমন সন্দেহ হল। উল্টোদিক থেকে আসা একটা গাড়ি দেখে হাত নেড়ে দাঁড় করাল সাহান। যা ভেবেছি! আমরা ভুল রাস্তায় চলেছি। আবার ফিরে এলাম ক্যান্ডি রোডে। আর কোনও ঝুঁকি নেওয়া নয়, জিপিএস চালিয়ে এগিয়ে চললাম সিগিরিয়ার পথে। (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: লেখক
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।
2 Responses
খুব ভাল।
Darun laglo