বইয়ের নাম: সুরের পথের হাওয়ায় হাওয়ায়
লেখক: বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
প্রকাশক: চিন্তা প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: রাজীব চক্রবর্তী
প্রকাশকাল: ২০২২
বিনিময়: ৩০০ টাকা
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থ ছাড়াও বাংলায় সঙ্গীত নিয়ে অনেক বই-ই লিখিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে প্রাতঃস্মরণীয় ‘রাগে-অনুরাগে’। কিন্তু সংগীত নিয়ে এমন ভাবনার গ্রন্থ বিশ্লেষণের অংশটুকু বাদ দিলেও মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে আজীবন। প্রাসঙ্গিক যে গ্রন্থের কথা বলছি, তা বৈজয়ন্ত চক্রবর্তীর ‘সুরের পথের হাওয়ায় হাওয়ায়’।
লেখক একটি প্রসিদ্ধ সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও সম্পাদক। সংগীতের সঙ্গে যাঁর জীবন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। মননে তিনি যুক্তিবাদী, কিন্তু বোধে যুক্তিকে অতিক্রম করে যাওয়া অনুভূতিমালা। সংগীতের একটা বাইরের অর্থ থাকে এবং একটা অর্থ-পেরিয়ে থাকা অর্থ। হয়তো তাকে আপাতভাবে অর্থ না বলাও চলে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে ‘অনুরণন’ বলি। অর্থ নয়, অনুরণনের এক জগৎ তৈরি হয় বৈজয়ন্তর এই গ্রন্থ পড়তে পড়তে।
কিন্তু কেন এই গ্রন্থ পড়ব আমরা? তার ইশারা হয়তো এই গ্রন্থের ‘কৈফিয়ত’ অংশেই রেখেছেন লেখক। তিনি লিখছেন, “কিছু লেখা প্রশ্ন করার জন্য, কিছু জানানোর জন্য, কয়েকটি আবার নিছক সুখস্মৃতি রোমন্থন। অতএব বিবিধ ব্যঞ্জনে ভরা এ থালা। বা এমন নয় যে, লেখাগুলির মধ্য দিয়ে আমি সঙ্গীতের যুক্তি দিয়ে গাঁথা কোনও এক আখ্যান গড়ে তুলতে চেয়েছি।” লেখাগুলি পড়া শুরু করলেও টের পাওয়া যায়, লেখক সংগীতকে ব্যবচ্ছেদ করছেন না। অকারণ ব্যাখ্যা করার তাড়া নেই তাঁর মধ্যে। শুধু, এই বই পড়তে পড়তে পাঠক হিসেবে আপনার সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে অনুভূতিপ্রদেশের কিছু অঞ্চল। আপনি হয়তো আবার সংগীতে ফিরে আসতে পারেন, যে অঞ্চল ছেড়ে আপনি হয়তো মেতে আছেন বাহ্যিক কোনও ব্যস্ততায়। এমন একধরনের প্রবেশক পড়ার পর আপনি যখন মূল লেখার মধ্যে প্রবেশ করবেন, তখন আপনার মন তৈরি হয়ে গেছে।

সংগীত বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। শিক্ষার্থীও নই। শুধু সংগীতের রস অনুভব করার চেষ্টা করি মাত্র। সেভাবে বলতে গেলে, আকাশের দিকে যেমন আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি, ঠিক কতটা দূরে থাকা নক্ষত্র থেকে আলো আসছে, ঠিক কতটা দূরে চলে যাচ্ছে এই অন্ধকার— তার কিছুই বুঝতে পারি না, তেমনই, সংগীতের সামনে বা অনেকটা দূরে আমি বসে থাকি। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। কিছুই বুঝতে পারি না। শুধু তার প্রতি আমার বিস্ময়বোধ ফুরোয় না। সংগীত সম্পর্কে ভাবনা বা লেখাও পড়ি তেমনই বিস্ময়ে। বৈজয়ন্তর এই গ্রন্থের লেখাগুলির বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই গ্রন্থের প্রতিটি লেখাই সংগীতের ভিতরের কথাগুলিকে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপিত করেছে। তাঁর লেখনীর একটা বড় গুণ হল কথকতার ধর্ম। প্রবন্ধ যদি কঠিন এবং নীরস হয় তাহলে সংগীত-সংক্রান্ত হলেও তা বেজে ওঠে না মনের মধ্যে। যে কোনও ভাবনা মনের মধ্যে বেজে উঠছে কিনা সেটাই প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: বইয়ের কথা: বসন্ত চৌধুরী- কিংবদন্তি নায়ক, আভিজাত্য আর ঐতিহ্য সচেতন বাঙালি
বৈজয়ন্ত-র লেখাগুলির কোনওটিতে আলাপ, কোনওটিতে পঞ্চমের সুর আবার কোনোটিতে রয়েছে দীর্ঘ এক গমক। নির্ভর করছে কী বিষয় নিয়ে তিনি লিখছেন তার উপর। যেমন, ‘কোন বসন্তের বাণী’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “বরং রবীন্দ্রসঙ্গীতের একদম গোড়ার কথাটি বুঝতে গেলে হেমন্তই আশ্রয়। একমাত্র আশ্রয় অবশ্যই নন, কিন্তু অন্যতম তো বটেই। সেই গোড়ার কথা হল বাহুল্যবিহীন সহজ সাবলীলতা। ‘আর্ট অফ সিমপ্লিসিটি’।” এই ভাবনার সুরে প্রবন্ধটির ভাষাও সহজ সাবলীলতাকেই আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। ‘সুধীর সাগরে’ প্রবন্ধটি তেমনই সুধীর চক্রবর্তীর গান বিষয়ক ভাবনা নিয়ে অল্প পরিসরে লেখা অন্যতম সেরা একটি রচনা। হয়তো সংবাদপত্রে প্রকাশযোগ্য একটি লেখা হিসেবে লেখা বলেই, শব্দ ও ভাবপ্রকাশের মণিমুক্তোগুলিকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন এই সব লেখা লেখার সময়। যার জন্য একটি ডালপালা বিস্তার করা বনস্পতি-সুলভ লেখার হলোগ্রাম হিসেবে এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি পড়া যায়। এ কথাও হয়তো বলা যায়, এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলির প্রত্যেকটি লেখাই পরবর্তীকালে আলাদা আলাদা গ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে। যেমন, ‘কথা: রবীন্দ্রনাথ, সুর: পশ্চিমী’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। পশ্চিমের বিভিন্ন সুরকার রবীন্দ্রনাথের কথ্য সুর দিয়েছিলেন। সেই সংগীত-সৃষ্টির ইতিহাস, তাঁদের কথা— এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদে পশ্চিমী সুরের ইতিবৃত্ত। এই ইতিহাস আমাদের রবীন্দ্রচর্চাকে সমৃদ্ধ করবে আরও। এ প্রসঙ্গে লেখককে আইডান সডার, এক দীর্ঘদিনের গবেষক বলছেন একটি জায়গায়,“বহু রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা হয়েছে, যাঁরা পেশাদারিভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কিন্তু প্রায় কেউই এই ধরনের গানের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন। সবাই রবীন্দ্রনাথের উপর পশ্চিমের প্রভাবের কথা জানেন। কিন্তু আমি জানাতে চেয়েছি, পশ্চিমও এক সময়ে কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছিল।”

ঠিক এমনই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘সত্যজিতের বিটোফেন’। সত্যজিতের বিটোফেন চর্চার ইতিহাসটিকে ধরতে এ গ্রন্থ আমাদের কাছে এক আকর-প্রবন্ধ হিসেবেই ধরতে হবে। এমনই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘মাঠের গান’, ‘বলিউডে রবিশঙ্কর’ এবং ‘বাপুরাও’। এই প্রবন্ধগুলি ছাড়াও রয়েছে বৈজয়ন্তর বিশ্লেষণ এবং আদরে লেখা আরও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ, যা পড়তে পড়তে আপনি সংগীত বিষয়ে সামান্য হলেও দীক্ষিত হওয়ার দিকে কয়েককদম এগিয়ে যেতে পারেন।
এগোনো বা পিছোনো-র ব্যাপারটিকে যদি আমরা সরিয়েও দিই, তাহলেও, লেখকের মনোজগতের এক গোপন বিস্তারের খোঁজ আমরা পেয়ে যাই এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের মধ্যে। চিন্তা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের প্রচ্ছদ (রাজীব চক্রবর্তী) এবং ভূমিকা (সুগত মারজিৎ) গ্রন্থটির সুরকে বজায় রেখেছেন।
বৈজয়ন্ত আসলে শিল্পের যে অঞ্চলটিকে নিয়ে রেখেছেন, তার মতো বিমূর্ত অথচ মূর্ত এক শিল্পমাধ্যম সম্ভবত হয় না। ব্যক্তিগতভাবে তো আমি বিস্ময়ে ভাবি, আমরা তো কিছুই আবিষ্কার করছি না, শুধুই খুঁজে পাচ্ছি মাত্র। এক এক করে আমাদের চোখের সামনে, আমাদের মনের ভিতর ফুটে উঠছে সংগীতের অশ্রুত ধ্বনি। কোথা থেকে এল? চর্চা থেকে কি আসে? না কি রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, মুক্তিকে বন্ধনের মধ্যে নিয়ে আসেন তিনি, যিনি গান করেন, আর বন্ধন থেকে মুক্তির দিকে যান তিনি, যিনি গান শোনেন। আবার এই রবীন্দ্রনাথই এক জায়গায় বলছেন, ‘মাঝেমাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কী কথা’! তার জন্য কান পেতে বসে থাকতে হয়। দীর্ঘকালীন চর্চার মধ্যে থাকতে হয় অনেকটা এই কারণেই, যে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে। কারণ কখন তিনি আসবেন, তা আমরা কেউ জানি না। আবার কখন তিনি এসেও আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন, তাও জানি না। মধ্যবর্তী সংগীতের সঙ্গে মনের যে বিবাহের কথা জানি, তা-ই ক্ষণকালের মধ্যে অনন্ত লাভের অনুভূতি।
বৈজয়ন্ত চক্রবর্তীর ‘সুরের পথের হাওয়ায় হাওয়ায়’ এমনই একধরনের গ্রন্থ, যা আমাকে প্রস্তুত করে বৃহতের কাছে আত্ম-অবগাহনের আগে।
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।