বইয়ের নাম: কথার উপরে তথাস্তু বসে থাকে
কবি: সুকান্ত সিংহ
প্রকাশক: ধ্যানবিন্দু
প্রচ্ছদ: সুকান্ত সিংহ
প্রকাশকাল: এপ্রিল,২০২৪
বিনিময় মূল্য: ১৫০.০০
বাংলা ভাষার অধিকাংশ পাঠক জানেন না সুকান্ত সিংহ কবিতা লেখেন। এমনকি সুকান্ত সিংহ নিজেও তা জানেন না। জানান দিতে তাঁর বিপুল অনাগ্রহ এবং নির্দ্বিধ আলস্য অনতিক্রম্য এক সেতু রচনা করেছে দীর্ঘদিন। তাঁর আমিত্ব ধুলোবালির এক বিস্মৃত উঠোন, সেখানে পূর্বপুরুষের ছায়া আছে কিন্তু নিজের কোনও দাবি নেই। হয়তো কবিতাই তাঁর যাপিত জীবন, না- লেখাই সেখানে জীবনধর্ম। কারণ তাঁর অদৃশ্য কবিতা ছড়িয়ে আছে বীজতলায়, মোরামপথে, হল্ট স্টেশনে, বিকেলের রোদে, পাখির বাসায় কিংবা বাবার বন্ধুত্বসুলভ হারানো ছাতার অস্পষ্ট নানা রেখায়। (Book Review)
তাঁর আমিত্ব ধুলোবালির এক বিস্মৃত উঠোন, সেখানে পূর্বপুরুষের ছায়া আছে কিন্তু নিজের কোনও দাবি নেই।
সেখানে দৃশ্যের মহিমার উপর নিবিড় হয়ে আসে রূপকথার অদৃশ্য। সেখানে কাব্যগ্রন্থ তুচ্ছ, শিল্প নেহাতই বাতুলতা। তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ’ কথার উপরে তথাস্তু বসে থাকে’ (এপ্রিল, ২০২৪) হাতে নিয়ে মনে পড়ে ‘যোগিয়া’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ কাব্যপুস্তিকা বা ‘অনুপম শোনো’র মতো কৃশকায় আশ্চর্য গদ্যগ্রন্থের কথা যা লোকাল ট্রেনে গোপালভাঁড়ের গল্প, লক্ষ্মীর পাঁচালী, কোন গাছে কোন রোগ মুক্তি, অঙ্কের মজা, পঞ্জিকার মতো পুস্তিকার ভিতর অনায়াসে চালান করে দেওয়া যায়, এমনই স্বভাবে লৌকিক, মেজাজে আটপৌরে।

এহেন সুকান্ত সিংহর এই কাব্যগ্রন্থ যখন বোর্ড বাঁধাই হয়ে সম্পূর্ণ একটি বইয়ের অভিজাত্যের তালিকায় ঢুকে পড়ে তখন অপেক্ষার দশ বছরের পিপাসা অপ্রত্যাশিত মুগ্ধতা এবং মধুর বিরহ তৈরি করে। যেন এই প্রথম তিনি কলেজস্ট্রিটের জাতে উঠলেন এবং আমরা যাঁরা নিভৃতে তাঁকে ভালোবেসেছিলাম এবার ব্রাত্য হওয়ার পালা। ভয় পুরস্কারের মনোবিকার নিয়ে। জনপ্রিয়তার অনিবার্য পুতুলনাচ নিয়েও। উঁচু লোকদের দাবি তো অনেক দেখেছি বাংলা কবিতায়, তাই উৎকণ্ঠা। (Book Review)
জনপ্রিয়তার অনিবার্য পুতুলনাচ নিয়েও। উঁচু লোকদের দাবি তো অনেক দেখেছি বাংলা কবিতায়, তাই উৎকণ্ঠা।
সুকান্তর অবশ্য সে বয়স নেই। এমনকি এই বইয়ের লেখককৃত অসামান্য প্রচ্ছদ এবং বিয়াল্লিশটি কবিতা পড়ে বুঝতে পারি অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে, অবিশ্বাসের কাদা ঘেঁটে তিনি এখানেও যে জীবনধর্মে পৌঁছেছেন তা আমর্ম জলের গভীরে এক তরল তানে মেতে ওঠে। সেখানে বেড়ে ওঠাটাই সত্য, বড় হওয়ার কোনও অবদমিত আয়োজন নেই। এই বিয়াল্লিশটি কবিতা উঠে এসেছে অনন্ত কুয়োতলা থেকে, দিনান্তের আল, কুপির নিরুপায় ছায়া আর বটগাছের নিচের সন্ধ্যার বাঁশের মাচা থেকে। এইসব কবিতা মাটির বাঁশি থেকে গানের মতো উঠেছে।
অবিশ্বাসের কাদা ঘেঁটে তিনি এখানেও যে জীবনধর্মে পৌঁছেছেন তা আমর্ম জলের গভীরে এক তরল তানে মেতে ওঠে।
যেন কুড়িয়ে পাওয়া। এখানে কবিকে মনে হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর পদকর্তা। এই একটি কাব্যগ্রন্থ ধরেই আপনি অনায়াসে চলে যেতে পারেন মাটির গভীরে কয়েক শতাব্দী পিছনে। হয়তো দেখা দেবেন মঙ্গল কাব্যের দেব দেবী। ফুল্লরার সন্দেহ ঈর্ষার ফুল হয়ে ফুটবে বেড়ার ধারে। গল্পগুজবে মাতিয়ে রাখবেন ভাঁড়ুদত্ত, সকালেই যিনি বাজারে মেছুনীর হাতে অপদস্থ হয়েছেন। এখানেই দেবী অন্নপূর্ণার অপ্রত্যাশিত খেয়া পারাপার। তখন লটারি ছিল না, ছিল স্বপ্নাদেশ। বাগদেবী তথাস্তু না বললে সুকান্ত হয়তো এই কবিতাগুলি লিখতে পারতেন না।
এই একটি কাব্যগ্রন্থ ধরেই আপনি অনায়াসে চলে যেতে পারেন মাটির গভীরে কয়েক শতাব্দী পিছনে। হয়তো দেখা দেবেন মঙ্গল কাব্যের দেব দেবী।
স্মৃতি বিস্মৃতির পরম মমতায় বোনা এই কবিতা যতখানি আলোর, ততখানি অন্ধকারের। এখানে অন্ধকার বিমূর্ত নয় সে, গৃহস্থের জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জড়িয়ে নেয় ধানের গোলা, খড়ের বাছুর আর মেঠো গবাক্ষের ঠোঁট, তৈরি করে ঘরে ফেরার, বাইরে যাওয়ার অজস্র ভঙ্গিমা। এই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আরও কয়েকটি কথা বলার আগে পাঠক আসুন আমার কথার সমর্থনে তিনটি কবিতা আপনাকে পড়াই-
এখানে অন্ধকার বিমূর্ত নয় সে, গৃহস্থের জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জড়িয়ে নেয় ধানের গোলা, খড়ের বাছুর আর মেঠো গবাক্ষের ঠোঁট, তৈরি করে ঘরে ফেরার, বাইরে যাওয়ার অজস্র ভঙ্গিমা।
১.
ফুটেছে ধানজন্ম
তার ঘ্রাণ ভেসে আসে
সন্ধ্যা নেমে আসে গ্রামদেশে
আকণ্ঠ খিদে নিয়ে বসে আছে বীজতলা নয়ানজুলির থেকে ভেজা কাপড়ে উঠে
তাদের স্তন দিয়ে আসেন অন্নকূটের দেবী’
(৩ সংখ্যক)
২.
কিছু কিছু মানুষের সাথে দেখা হলে মনে হয়
এক আশ্চর্য দিঘির কাছে এসেছি!
যেন তারা জানে- মেষপালকের দল থেকে
আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আমি পাহাড় ডিঙিয়ে এসে পড়েছি হারিয়ে যাওয়া সাদা ভেড়ার খোঁজে, আমার পরনের কাপড়ে চোরকাঁটা,
হাঁটু ছড়ে গেছে, ডান পায়ের কড়ে আঙুল ভাঙা, আর আমার তেষ্টা পেয়েছে খুব… ( ৪ সংখ্যক)
৩.
বাবাকে নিয়ে লিখব বলে ভাবি। সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ঝুপ্পুস ভিজে এক হাতে বাজারের ব্যাগ
অন্য হাতে আমাদের নিয়ে রেল ইয়ার্ড পেরিয়ে
ঘরে ফিরছে বাবা।
ঘর যত কাছে আসছে বাবা তত বলছে,
মাকে কিছুতেই বলা যাবে না
আমাদের একমাত্র ছাতাটি
আমরা দিয়ে এসেছি বিশ্বাসকাকুকে…( ৫সংখ্যক)
এই কাব্যগ্রন্থের নাভিকেন্দ্রে আছে যে শব্দটি তাকে আমরা বলতে পারি বীজতলা। শস্য এবং শস্যবাহক এর চরাচর। সকালের ঘাসের হিম আর সন্ধ্যার শ্রীখোলের শব্দে ভরে ওঠে যাপিত জীবন। কিছুদূরে একটি গ্রাম্য স্টেশন। সিগন্যাল না পেলে দৈবাৎ দূরের ট্রেন থামে। এর থেকে খুব বেশি দূরে নয় অন্নকুটের দেবী, বরাভয়, স্বপ্নাদেশ।
যেন একটি কবিতাই বিয়াল্লিশটি টুকরোয় লিখেছেন কবি। একে অপরের পরিপূরক। ভাঙতে ভাঙতে সর্বত্র একই মৌল কণা। আশ্চর্য নিরাভরণ। সহজ, তারচেয়েও বড় কথা সহজাত। কষ্টকল্পিত নয়। শ্রমসাধ্য উপমায় অবিশ্বাসী। পথ চলতে চলতেই দেখা যায় যে দৃশ্যটি তা ই কবিতা হয়ে ওঠে। কোনও পরিমার্জনা অপ্রয়োজনীয়। দেখুন দৃশ্য কীভাবে সহজ ভঙ্গিমায় একটি সার্থক কবিতা লিখছে-
এই কাব্যগ্রন্থের নাভিকেন্দ্রে আছে যে শব্দটি তাকে আমরা বলতে পারি বীজতলা। শস্য এবং শস্যবাহক এর চরাচর।
‘সবকিছুই কেন সাজানো থাকবে!
একটু এলোমেলো থাকা ভালো।
মায়ের জপের মালার পাশে যেমন
পড়ে থাকে বিস্মৃতি ও ঘুমের ওষুধ,
রাগারাগি- এইরকম।
সাজিয়ে রাখলেই সব খুঁজে পাওয়া যায়!
সাজানো লোহার গেট,
তাতে ফুটে আছে চমৎকার লতাপাতা
ফুলফল ভর্তি গাছ
কিন্তু, ওখানে জল দেওয়া বারণ!’। (১৩ সংখ্যক)
এই কাব্যগ্রন্থ শেষপর্যন্ত একটি গ্রামদেশের জনজীবনের লৌকিক আখ্যান। সেখানে ঘটনার বদলে রয়েছে রটনা। মানুষের ছায়ার চেয়েও ব্যপ্ত হয়ে আছে ভঙ্গিমা। ফলত কথা ছাড়াই পৌঁছনো যায় সেখানে। সব শব্দ নিঃশেষ হলেই জন্ম নেয় এমন অসামান্য গ্রন্থ। আর নাম- হারা একটি ছেলের বসন্তদিনের লুপ্ত হাওয়াই চটির কথা মনে পড়ে। বই বন্ধ করে আমি তাকে দেখি-
‘কেউ চলে যেতে চাইলে
আমি চলে যেতে দিই
তাদের জুতোর থেকে ঝরে পড়া
ধুলোপথের কথা আমি লুকিয়ে রাখি
তারপর একদিন সেই ধুলোপথের
খোঁজে বেরিয়ে পড়ি
বলি, গত বসন্তে যে-ছেলেটি পলাশ কুড়িয়ে এনেছিল
এই বসন্তে সে না এলে আমাকে রাখবেন?
(৩৯সংখ্যক)
এই কাব্যগ্রন্থ শেষপর্যন্ত একটি গ্রামদেশের জনজীবনের লৌকিক আখ্যান। সেখানে ঘটনার বদলে রয়েছে রটনা।
এই বইয়ের প্রচ্ছদের আলপনা এমনকি রঙটিও এমনই আটপৌড়ে যে দৃশ্যত কবিতা শুরু হয় মলাট থেকেই। যদি জীবনে লোকধর্ম না থাকে, বিশ্বাসে নির্লিপ্ত সন্ন্যাস না আসে তবে এই প্রচ্ছদ নির্মাণ সম্ভব নয়। সুকান্ত ছাড়া কে ই বা করবেন? এইসূত্রে কৃতজ্ঞতা ‘ধ্যানবিন্দু’ প্রকাশনীকেও। ইতিপূর্বে তাঁদের প্রকাশনার সমস্ত কাব্যগ্রন্থ থেকেই স্পষ্ট ছদ্মকবিতার অগণন ভিড়ে তাঁরা প্রকৃত কবিকে ঠিক চিনে নেন। বিপন্ন বাংলা কবিতার পথে কয়েকটি অনিবার্য মাইলস্টোন তাঁরা রচনা করেছেন। এই কাব্যগ্রন্থটি একটি মাইলস্টোন। আমাদের অবান্তর স্মৃতির ভিতর, অবচেতনের ডালপালায় এই কাব্যগ্রন্থ নিরুচ্চার হয়ে বাজবে। হয়তো আগামীর কোনও বিবাহসভায় নরসুন্দরের কণ্ঠে উঠে আসবে এইসব লেখা। শেষে বলি এই কাব্যগ্রন্থের কপিরাইট স্বয়ং কবির। হয়তো ব্যবসায়িক এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনে। কিন্তু আমার মনে হয় এই কবিতার লিপিকর সুকান্ত, আসলে স্বপ্নাদেশে পাওয়া এইসব কবিতার দাবিদার অখণ্ড বাংলার গ্রামদেশ, ব্যক্তি নয় গোষ্ঠী।
জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা। গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।