বাংলাদেশের ‘এনজিও সরকার’ ৮টি জাতীয় দিবস (National Holidays) বাতিল করেছে। এর মধ্যে ৬টি দিবস শেখ হাসিনার মা’র, ভাইয়ের জন্মদিন বা বিশেষ দিন উদযাপন করার দিবস। সেসব বাদ দেওয়াই উচিত। শেখ হাসিনা যেহেতু দেশটাকে তাঁর ‘’বাপের দেশ’’ ভেবেছিলেন, তাই দেশে বসে নিজের আত্মীয়স্বজনের সেবা করতেই ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশে রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র বৈধ নয়। এক গণতন্ত্রই বৈধ। বাতিল করা ৮টি দিবসের মধ্যে ২টি দিবস বাতিল করা, আমি মনে করি, উচিত হয়নি। (National Holidays) ৭ই মার্চ আর ১৫ই আগস্ট। ১৫ই আগস্ট ছিল জাতীয় শোক দিবস, কারণ সেদিন নৃশংসভাবে জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়েছিল।

আমার ঘোরতর আপত্তি, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবস ৭ই মার্চকে বাতিল করা নিয়ে। (National Holidays) ৭১’এর ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক যে ভাষণ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান, সেই ভাষণটি না শুনলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো না, দেশের কোটি কোটি মানুষকে বর্বর পাকিস্তানি সেনা আর বিশ্বাসঘাতক রাজাকাররা মিলে হত্যা করতো। বিজয়ের মুখ হয়তো আমরা দেখতাম না। বাংলাদেশ নামের একটি দেশই হয়তো পেতাম না। হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানের গোলামী করেই যেতে হতো বাঙালিকে। এই ভাষণের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্মের সম্পর্ক। এটিকে অস্বীকার করা মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা। এই দিনটিকে জাতীয় দিবসের মর্যাদা না দেওয়া মানে বাঙালির অস্তিত্বকে মর্যাদা না দেওয়া। (National Holidays)

(National Holidays) ৭ই মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় অর্জন, পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া, নতুন দেশ বাংলাদেশের জন্ম হওয়া — এসব কাদের সহ্য হয় না? পাকিস্তানি সেনাদের বাঙালি বিশ্বাসঘাতক সহযোগী রাজাকারদের, রাজাকারের বাচ্চাদের, আর রাজাকারের নাতিপুতিদের। এদের রাগ ভারতের ওপরও। কারণ দেশ স্বাধীন করতে ভারত আমাদের সাহায্য করেছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও গাড়লগুলো এখন মুখের লাগাম টেনেছে। কারণ বুঝতে পেরেছে ভারতকে ক্ষেপিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। (National Holidays)
অগত্যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ক্ষেপালে ক্ষতি নেই বলে ক্ষেপাচ্ছে। তারা ভুলে গেছে যে শুধু আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক নয়। রাজাকার এবং তাদের গোষ্ঠী ছাড়া দেশের সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক, ৭ই মার্চের ভাষণ শুনলে এখনও তাদের চোখ জলে ভরে ওঠে। (National Holidays)

রাজাকারের বাচ্চা আর নাতিপুতিগুলো এখন যদি ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ আর ১৬ই ডিসেম্বরকে বাতিল ঘোষণা করে, অবাক হবো না। যদি শহীদ মিনার আর স্মৃতিসৌধ ভেঙ্গে গুঁড়ো করে, অবাক হবো না। যদি দেশের নাম বদলে ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাস্তান বা পূর্ব পাকিস্তান রাখে, অবাক হবো না। যদি ১৪ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করে, অবাক হবো না। যদি জাতির পিতা হিসেবে জিন্নাহর ছবি টাঙায়, অবাক হবো না। যদি শরিয়া আইন জারি করে, অবাক হবো না। দেশকে যদি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়, অবাক হবো না। (National Holidays)

দেশের সর্বময় ক্ষমতা যার হাতে, মাহফুজ আলম, তথাকথিত বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড, মুহম্মদ ইউনুসের সহযোগী, — এই প্রথম আমি তার কোনও ফেসবুক পোস্ট দেখলাম, দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। এ তো বিরাট হুমকি! দেশের এক ইঞ্চি জমিও নাকি আওয়ামী লীগের বা মুজিববাদীদের জন্য নয়। সে বলতে চাইছে, আওয়ামী লীগ গণহত্যা করেছে, বিপ্লবী ছাত্রদের হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে। বিচার তো আসলে সবারই হওয়া উচিত। জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত ছিল যে জঙ্গি জিহাদিরা, তারা তো তিন হাজার পুলিশকে গলা কেটে খুন করেছে, উলটো করে ঝুলিয়ে রেখেছে রাস্তায়। পুলিশ হত্যাও তো গণহত্যা, এই গণহত্যার বিচার হবে না কেন? গণহত্যা বলতে সে বোঝাতে চাইছে ছাত্ররা যে খুন হলো, সেটি। পুলিশরা যে খুন হলো, সেটিকে সে গণহত্যার মধ্যে ধরছে না। (National Holidays)

(National Holidays) ১৫ই জুলাই থেকে ৮ই আগস্ট অবধি যে যত খুন-খারাবি করেছে, সেসবের বিচার হবে না বলে যে একখানা আইন জারি হয়েছে, সে আইনটি তারা মুজিববাদীদের ওপর খাটাবে না। শুধু শিবিরবাদী আর হিযবুতবাদীদের ওপরই খাটাবে। যারা ছাত্রদের খুন করেছে, তাদের ক্ষমা নেই। তিন হাজার পুলিশ যারা খুন করেছে, শুধু তাদের ক্ষমা আছে। মাস্টারমাইন্ড বলেছে, নির্মূলের রাজনীতি সে করতে চায়নি, কিন্তু করতে বাধ্য হচ্ছে, এর মানে মুজিববাদীদের হত্যা করতে চায় ছেলে। মুজিববাদীদের নাকি স্বদেশের এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেওয়া হবে না।
এর মানে সব মুজিববাদীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। কিন্তু দেশ ছাড়তেও তো কাউকে দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে মুজিববাদীদের নির্বিচারে খুন করা হবে, অথবা যাবজ্জীবন দেওয়া হবে, অথবা ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। যে মুজিববাদী খুন করেনি কাউকে, সমর্থন করেনি কোনও খুনের, তাকেও শাস্তি দেওয়া হবে, কারণ সে মুজিববাদে বিশ্বাস করে। (National Holidays)

তাহলে কী দাঁড়ালো? এই সরকার মানুষের বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার, ভিন্ন রাজনীতিতে বিশ্বাস করার অধিকারে বিশ্বাস করে না, অর্থাৎ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না। সেক্যুলারিজমে যে বিশ্বাস করে না, আগেই জানিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাস করে ঘৃণায়, হিংসায়, প্রতিহিংসায়, প্রতিশোধে, নির্মূল করায়। এ তো স্বৈরাচারী হিংস্র হাসিনার চেয়েও শতগুণ বেশি হিংস্র, শতগুণ বেশি স্বৈরাচারী!! (National Holidays)
এর মধ্যে মারা গেলেন বাংলার অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী। বাংলার মাটিতে তাঁর জায়গা হয়নি। মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে জায়গা দেওয়ার বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে আসতে হয়। আবেদন করেও কার্যালয় থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি। অগত্যা তাঁর স্বামী প্রয়াত সাংবাদিক বজলুর রহমানের কবরে তাঁকে দাফন করা হয়। (National Holidays)

১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার যে সংগ্রাম শুরু হয়, তাতে মতিয়া চৌধুরী সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আইয়ুব খানের আমলে চারবার কারাবরণ করেন। ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি মতিয়া চৌধুরীকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়।
তবে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম বেলায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও মতিয়া চৌধুরীর ক্ষেত্রে তা হয়নি। একদিক থেকে ভালো যে তিনি মৃত, তাঁকে দেখতে হয়নি, যে, যে মাটিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তিনি একদা যুদ্ধ করেছিলেন, সেই ৫৫ হাজার বর্গমাইলের মাটিতে তাঁকে সমাধিস্থ করার জন্য চার ফুট জায়গা জোটেনি।
বাংলাদেশের কুয়ো থেকে জন্ম নেওয়া আকাট মূর্খরা যে দেশটি নতুন বানিয়েছে, তাকে জিহাদিস্তান বলতেই আমি পছন্দ করি। এই দেশটায় আমার জন্ম হয়েছিল। এই দেশটায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম। অবিশ্বাস্য মনে হয়! আমার দেশটা এখন নিতান্তই উগ্র, অসভ্য, কট্টর, হিংসুক, আর প্রতিশোধপরায়ণ মানুষের দেশ। দেশটা দিন দিন হিংস্র মানুষের জঙ্গল হয়ে উঠছে।
২৫শে মার্চের কালো রাতে বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছিল পাকিস্তানি আর্মি। শুরু হয়েছে স্বাধীন দেশে নতুন ২৫শে মার্চ, দীর্ঘ কালো রাত, পাকিস্তান-প্রেমী রাজাকারবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হেনস্থার নিকষ কালো রাত। প্রখ্যাত সাংবাদিকদের হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হলো, লেখক বুদ্ধিজীবী মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। উনি নাকি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। কিছু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এখনো মনে করে বাংলাদেশ সংস্কার হয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের দিকে যাবে। এইভাবে আইন আদালতকে আগের মত চালিয়ে মানুষকে হয়রানি করা, সন্মানিত ব্যক্তিকে অপদস্ত করার নাম সংস্কার?

জাফর ইকবাল কী অপরাধ করেছে? গণহত্যা করেছেন তিনি? করেননি। ইউনুস সরকারের রাগ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর। কারণ তিনি রাজাকার বিরোধী, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। এই অপরাধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। শেখ হাসিনা মৌলবাদিদের আদর পাওয়ার জন্য মাদ্রাসার ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সমমানের করে দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কওমি মাদ্রাসার বিষ ঢুকিয়েছিলেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি, এই অপশক্তিই দেশ দখল করেছে। এখন জাফর ইকবালকে তো জেলে ঢোকাবার ব্যবস্থা হবেই।
বাংলাদেশের কুয়ো থেকে জন্ম নেওয়া আকাট মূর্খরা যে দেশটি নতুন বানিয়েছে, তাকে জিহাদিস্তান বলতেই আমি পছন্দ করি। এই দেশটায় আমার জন্ম হয়েছিল। এই দেশটায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম। অবিশ্বাস্য মনে হয়! আমার দেশটা এখন নিতান্তই উগ্র, অসভ্য, কট্টর, হিংসুক, আর প্রতিশোধপরায়ণ মানুষের দেশ। দেশটা দিন দিন হিংস্র মানুষের জঙ্গল হয়ে উঠছে। লাল গালিচা বিছিয়ে দিলেও এই দেশটায় আমার কোনওদিন ফিরতে ইচ্ছে করবে বলে মনে হয় না।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, theSpace.ink, Flickr, Flickr, Wikimedia
____________________________________________________
পড়ুন:
- সব ধর্মের সব জাতের পুরুষই নারীহত্যা করে
- শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হয় কি?
- ভ্যালেন্টাইন’স ডে
- ধর্ষণহীন দিন
- নারী দিবসে
- রোজায় আমি কী ভাবছি,
- বাঁধ ভেঙে দাও
- টাঙ্গাইল শাড়ির জি আই বাংলাদেশের প্রাপ্য কেন?
- তারকাময় রাজনীতি ভাল নয়
- ধর্মানুভূতি নয়, এ ধূর্তদের কৌশল
- লিঙ্গসূত্র (১)
- লিঙ্গসূত্র (২)
- হিন্দু-মুসলমানের বিয়ের পরিণতি
- বাংলাদেশ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন
- ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের উপসর্গ
- বাংলাদেশ দখল করে নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামী সন্ত্রাসী
- হারাম হালালের সংজ্ঞার বদল দরকার
____________________________________________________
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী মুখ তসলিমা নাসরিন। বাঙালি হয়েও তিনি আন্তর্জাতিক। গদ্য ও কবিতার সব শাখাতেই অনায়াস বিচরণ তসলিমার। সাহিত্য-সাধনার পাশাপাশি তাঁকে আমরা চিনি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী ও নারীবাদী একজন চিন্তাশীল হিসেবেও। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, মানববাদ, বিজ্ঞান ও সহনশীলতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন তিনি। লেখালিখির পাশাপাশি তাঁর বিশ্বব্যাপী উদার ও মুক্তচিন্তার জন্য দেশে-বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন একগুচ্ছ পুরস্কার ও সম্মাননায়। 'নির্বাচিত কলাম' ও আত্মজীবনী গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন দু'দুবার আনন্দ পুরস্কার। পেয়েছেন ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারভ পুরস্কার। ফ্রান্স সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার, কার্ট টুকোলস্কি পুরস্কার সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। লিখেছেন 'ফেরা', 'লজ্জা', 'ফরাসি প্রেমিক'-এর মতো অসামান্য উপন্যাস; বেশ কিছু ছোটগল্প, আত্মজীবনীমূলক রচনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক নানা বিষয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ।