বছর দুয়েক আগেকার কথা! এই শহরের একটি ছোট্ট হলঘরে নববর্ষ উপলক্ষে এক ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, যার বেশিরভাগ কুশীলবের বয়স ষাট থেকে নব্বুইয়ের মধ্যে। প্রদীপ জ্বালিয়ে যিনি অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করলেন তিনি ‘কেয়ার আনলিমিটেড’ সংস্থার প্রবীণতম সদস্য। এর পরে নাচের ভঙ্গিতে কাঁচের চুড়ি ঝমঝমিয়ে, ওড়না দুলিয়ে যিনি প্রবেশ করলেন তিনি আশি বছরের মুক্তি গুহ, এক কালের পেশাদার মঞ্চের নিয়মিত অভিনেত্রী, বর্তমানে ‘কেয়ার আনলিমিটেড’ সংস্থার সদস্য, ওদের আদরের মাসিমণি!
গত কয়েক দশকে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বৃহদংশ জীবিকার সন্ধানে বিদেশগামী, বা অন্য শহরবাসী। বহুতল আবাসনের বেশিরভাগ আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িগুলিতে রয়ে গিয়েছেন নিঃসঙ্গ বাবা-মায়েরা। বাড়ির কাজের জন্য রয়েছেন বিশ্বস্ত সহায়িকা। প্রবাসী পুত্র কন্যার সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় ভিডিও কলে- এভাবে চোখের দেখাও একটু মেলে। এক বা দু’বছর অন্তর দেশে এলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু সে সবই তো সাময়িক সুখ। জীবনের উপান্তে পৌঁছনো মানুষগুলোর দিন কাটে একলা ঘরেই। কলকাতা এখন এক শহুরে শৌখিন বৃদ্ধাশ্রম বলে মনে হয় আমার।
‘কেয়ার আনলিমিটেড’ সংস্থার কর্ণধার সূর্যাশিস গুপ্ত পেশায় একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতার নিঃসঙ্গ বৃদ্ধদের সেবা ও সঙ্গ দিতে গড়ে তোলা এই সংস্থাটি তাঁরই মস্তিস্কপ্রসূত। কিন্তু হঠাৎই মস্ত চাকরি ছেড়ে মাত্র মধ্য-চল্লিশে সূর্যাশিস কেন এরকম একটি কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন, সে অবশ্য আর এক গল্প।
সূর্যর কাছে শুনেছি, কয়েকটি নির্দিষ্ট নীতিকে পুঁজি করে তিনি বয়স্কদের নিয়ে তাঁর ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। একাজে তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন কিছু সমমনস্ক বন্ধু ও এক ঝাঁক সহৃদয়, পরিশ্রমী, তরুণ তরুণীকে। দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ,সুখদুঃখ ভাগের পাশাপাশি বার্ধক্যের দিনগুলি যাতে আনন্দময় করে তোলা যায়, সেব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল কেয়ার আনলিমিটেডের সহযোগী কর্মীরা। ছেলেমেয়েরা যেভাবে বৃদ্ধ বাবামায়ের দেখাশোনা করেন, বলতে গেলে ওঁদের প্রয়াস অনেকটা সেরকমই। চেষ্টা করেন সন্তানতুল্য হয়ে বয়স্ক সদস্যদের তত্ত্বাবধান করতে।
গত কয়েক দশকে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বৃহদংশ জীবিকার সন্ধানে বিদেশগামী, বা অন্য শহরবাসী। বহুতল আবাসনের বেশিরভাগ আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়িগুলিতে রয়ে গিয়েছেন নিঃসঙ্গ বাবা-মায়েরা। বাড়ির কাজের জন্য রয়েছেন বিশ্বস্ত সহায়িকা। প্রবাসী পুত্র কন্যার সঙ্গে নিয়মিত কথা হয় ভিডিও কলে- এভাবে চোখের দেখাও একটু মেলে। এক বা দু’বছর অন্তর দেশে এলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
সপ্তাহে এক-দু’দিন প্রবীণদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের সঙ্গে নানাভাবে সময় কাটান সঙ্গীতা, পাপিয়া, দেয়া, বাপ্পার মতো একনিষ্ঠ কর্মীরা। তাঁদের ইচ্ছেমতো কখনও বই পড়ে শোনান, সিনেমা দেখেন বা লুডো, ক্যারম খেলেন। অচিরেই ওই প্রবীণ সদস্যরা হয়ে ওঠেন কাকু, মাসিমণি, কাকিমা আবার কেউ দাদু অথবা দিদা। হেলথ চেকআপ থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কের কাজ- সব প্রয়োজনে পাশে থাকেন সূর্য ও তাঁর সঙ্গীরা। আংশিকভাবে হলেও বয়স্কদের জীবনের মূলস্রোতে অঙ্গীভূত করতে সদাসচেষ্ট ‘কেয়ার আনলিমিটেড।’ মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখতে তাই কত রকমের আয়োজন। কেউ এককালে ছবি আঁকতে ভালবাসতেন, কেউ গানের চর্চা করতেন, কেউ লেখালিখি করতেন। কারুর নেশা ছিল ক্রসওয়ার্ড বা সুদোকু খেলার। সে সবই সাংসারিক কাজ বা জীবিকার চাপে, আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। সংস্থার কর্মীরা গল্পচ্ছলে সেসব জানতে পেরে আবার তাঁদের মধ্যে সেই সব ইচ্ছে ও শখ পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে সাহায্য করেন।
যেমন মুক্তিদির কথাই ধরা যাক। এক সময়ে চার্বাক নাট্যগোষ্ঠীর নিয়মিত অভিনেত্রী মুক্তি গুহ স্বামীর কর্মসূত্রে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন বিদেশে। সেখানেও বাঙালিদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুক্তি অংশগ্রহণ করেছেন নিয়মিতভাবে। দেশে ফিরে আসার পরেও সংস্কৃতিমনস্ক এই দম্পতি সক্রিয় অংশ নিয়েছেন তাঁদের আবাসনের নানাবিধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। অতিথিবৎসল গুহ দম্পতির বাড়িতে নিয়মিত বন্ধু, প্রতিবেশীদের আসা যাওয়া লেগেই থাকত।

ইতিমধ্যে বয়স বেড়েছে, দু’জনেরই শারীরিক নানা সমস্যা। স্বামী একটু বেশি অসুস্থ হলেন। দুই পুত্রই কর্মসূত্রে বিদেশে থিতু। স্বামীকে হারালেন মুক্তি। একেবারে একা হয়ে পড়লেন। বয়সজনিত কারণে কিছু রোগব্যাধি তো ছিলই, কিন্তু তার সঙ্গে প্রবল একাকিত্ববোধ ওঁকে ঘিরে ধরল। সদাহাস্যময়ী উচ্ছ্বল জীবনপ্রেমী মুক্তির এই পরিবর্তন আমেরিকাবাসী পুত্রের নজর এড়িয়ে গেল না।
সেবার কলকাতায় এসে তিনি সন্ধান পেলেন ‘কেয়ার আনলিমিটেড’ সংস্থার। বেশ কয়েকবার দু’পক্ষ আলোচনায় বসলেন। শুরু হল মুক্তি গুহর সঙ্গে কেয়ারের পথ চলা। সদালাপী মুক্তির সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলতে তেমন সমস্যা হয়নি কেয়ার আনলিমিটেড সংস্থার কর্ণধার সূর্যাশিস ও তাঁর সহকর্মী পাপিয়ার। অচিরেই তিনি হয়ে উঠলেন ওঁদের প্রিয় মাসিমণি। মুক্তি গুহকে দিয়ে নববর্ষের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করানো মোটেও সহজ ছিল না। একদিন যিনি নাটকের মঞ্চে ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল, যাঁর সুরেলা কণ্ঠে ও নাচের ছন্দে শ্রোতা-দর্শকেরা ছিলেন মুগ্ধ, আজ তাঁর মধ্যে বাসা বেধেছে অনেকটা মানসিক স্থবিরতা। উপরন্তু দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে কঠিন ছিল মুক্তির পক্ষে দর্শকের সামনে এককভাবে কিছু পরিবেশন করা। পুরো ব্যাপারটি করা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র সূর্য ও তাঁর সহকর্মীদের একান্ত প্রচেষ্টায়।
আবার ডাঃ গীতা সেনের কথাই ধরুন না! এককালে তিনি কলকাতার একজন বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সরকারি হাসপাতাল থেকে অবসর গ্রহণের পরেও বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেছেন নিয়মিত। কিন্তু সময় তো কারও জন্য থেমে থাকে না। ক্রমশ শারীরিকভাবে অশক্ত হয়ে পড়লেন গীতা। বাইরে বেরুনো দূরের কথা, ঘরের মধ্যেও চলাফেরা অসম্ভব হয়ে উঠল। সারাজীবন সক্রিয়ভাবে কাটিয়ে এসেছেন যে মানুষটি, এই অক্ষমতা কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। একমাত্র পুত্র বিদেশবাসী। তিনি দেশে এসে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি তাঁদেরই পরামর্শে যোগাযোগ করলেন ‘কেয়ার আনলিমিটেড’-এর সঙ্গে।
সেন মাসিমার সঙ্গে নিভৃত আলাপে সূর্য বুঝতে পেরেছিলেন, যে কোনও একটা সৃজনশীল কাজের মধ্যে ওঁকে ঢোকাতে না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না। ডাঃ সেনের ভালমন্দের দায়িত্ব দেওয়া হল সংস্থার কর্মী অঙ্কিতাকে, যিনি সপ্তাহে দু’দিন নিয়মিতভাবে এসে সময় কাটাবেন ওঁর সঙ্গে। অঙ্কিতা বাচ্চাদের আঁকা শেখাতে সিদ্ধহস্ত। জীবনে যে মানুষটি রং তুলি ছুঁয়ে দেখেননি, তাঁকে দিয়ে ছবি আঁকানো মোটেই সহজ হয়নি অঙ্কিতার পক্ষে। কাজে লাগিয়েছিলেন বাচ্চাদের আঁকা শেখানোর সরল পদ্ধতিকেই। কথা বলে, নানা গল্প করে সেই মানুষটিকে দিয়ে আঁকানো শুরু করলেন অঙ্কিতা। সে ছিল এক মজার রঙের খেলা। সাদা কাগজের পাতায় গাছ পাতা আকাশ পাখি ফুটে উঠল। না, হয়তো নিপুণ হয়ে উঠতে পারেনি সে আঁকা, কিন্তু সেই আঁকিবুকি কেটে ভারি খুশি ডাঃ সেন। খুশি অঙ্কিতা, সূর্য।

সংস্থার আর এক কর্মী শান্তনু আবার পেশাদার মঞ্চের অভিনেতা, সংযোজক, পরিচালক। সময় পেলে তিনি যোগ দেন এই প্রবীণ পরিষেবায়। ওঁরই উদ্যোগে শুরু হয় আর এক সদস্য শীলা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির মস্ত হলঘরে শ্রুতি নাটকের মহড়া। উৎসাহী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মুক্তি গুহ তো আছেনই। আর আছেন ওঁদের দেবাশিসকাকু, সন্ধ্যামাসি, প্রশান্তকাকু, শীলা মাসিমণিরা। পাপিয়া, নূপুর, জয়িতা অঙ্কিতারাও নাটকে অংশ নেন, না হলে পুরো ব্যাপারটা সামলানো মুস্কিল। শান্তনুর পাঠশালায় কুশীলবদের ভুলত্রুটি সব মাফ। শুধু মাঝে মাঝে নিজে পড়ে দেখিয়ে দেওয়া আর বাহ্ বাহ্ বলে উৎসাহ দেওয়া। মহড়ার স্বাদু সঙ্গতে চা, সিঙাড়া কোনওদিন, তো কোনওদিন কেক, নিমকি। অনুষ্ঠানের দিন সেজেগুজে সবাই হাজির। হুইলচেয়ারে বসে ডাঃ সেনও উপস্থিত আসরে। কুশীলব এবং দর্শক সবই ঘরের লোক, অর্থাৎ সংস্থার সদস্য ও বন্ধুজনেরা। মুগ্ধ সবাই।
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ! নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, বর্ষামঙ্গল, দুর্গাপুজো, ক্রিসমাস- ‘কেয়ার আনলিমিটেড’-এর উৎসবের তালিকায় সব আছে। জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর তার সঙ্গে দারুণ ভোজ। যেমন, উৎসাহ, ইচ্ছে থাকলেও দুর্গাপুজোর ভিড় ঠেলে ঠাকুর-দেখা যে আর কোনওদিন সম্ভব হবে, সে কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারেননি প্রবীণ সদস্যরা। সূর্য ও তাঁর সঙ্গীরা তাও ঘটিয়ে ছাড়লেন।
মস্ত বাস ভর্তি করে পুজোর একদিন আগে সকাল সকাল পূজা পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়া হল। পরনে সকলের নতুন পোশাক। যেসব প্যান্ডেলে প্রতিমার মুখ খোলা হয়ে গেছে এবং বাস থেকে নেমে হেঁটে যাওয়ার দূরত্ব বেশি নয়, তেমনই দু’চারটে পুজোয় নিয়ে যাওয়া হল। এটুকু হাঁটতে কারও আপত্তি নেই। আর হাত ধরার জন্য পাপিয়া, দেয়ারা সব আছে তো! কৃষ্ণা মাসিমা,দেবাশিসকাকুদের মতো যাঁদের হাঁটাচলার অত সমস্যা নেই, তাদের ফুর্তি দেখে কে! ঐটুকু হাঁটা রাস্তার মধ্যে ঠেলা গাড়িতে চা বিক্রি হচ্ছে দেখে, সবাইয়ের চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেল।

সূর্য নিজে চা কফি কিছু খান না, কিন্তু তিনি তাঁর সম্মানীয় সদস্যদের ইচ্ছে বুঝতে ওস্তাদ। আর তাঁদের ইচ্ছেপূরণে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা হুইলচেয়ারে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে দারুণ খুশি সবাই। যে প্যান্ডেলগুলিতে হেঁটে পৌঁছনোর দূরত্ব বেশি, সেখানে বাসে বসে বসেই বাইরে থেকে শিল্পকর্মের সৌন্দর্য দেখে নিতে হবে আর তাতেই কত খুশি সবাই! পরিক্রমা শেষে সোজা সংস্থার দফতরে। সেখানে চেয়ার টেবিল পেতে দারুণ ভোজের ব্যবস্থা! বাড়িতে তৈরি স্বাদু পঞ্চব্যাঞ্জন। বেশির ভাগ পদই সূর্যর ইঞ্জিনিয়ার স্ত্রী মৌসুমী যত্ন করে রেঁধে পাঠিয়েছেন। পাপিয়া, অঙ্কিতারাও আরও কিছু পদ করে এনেছেন। সবমিলিয়ে জমজমাট খাওয়াদাওয়া। ভোজনপর্ব শেষে পুজোর উপহার হিসেবে সবাইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হল একটি করে শারদীয়া পত্রিকা।
২০২০-র মার্চ মাস। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে। বঙ্গভূমিও বাদ গেল না। কলকাতাতেও অন্য শহরগুলির মতো শুরু হল লকডাউন। মুখে মাস্ক, নিরাপদ দূরত্ব ও ঘরবন্দি থাকার বিধিনিষেধ ঘেরা জীবন। মহা সমস্যায় পড়ে গেল ‘কেয়ার আনলিমিটেড।’ বয়স্ক মানুষদের প্রত্যেকেরই প্রায় নানা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা আছে। চিকিৎসকদের মত অনুসারে করোনা জীবানুর সহজ লক্ষ্যস্থল হল বৃদ্ধবৃদ্ধারা। একবার আক্রান্ত হলে সুস্থ করে তোলা প্রায় অসাধ্য। তাই তাঁদের নিরাপদ রাখতে বহিরাগতদের থেকে শত হস্ত দূরে। সংস্থার পক্ষ থেকে সাপ্তাহিক পরিদর্শন বন্ধ। বন্ধ সূর্যর ব্যবস্থাপনায় ময়দানের লেডিস গলফ ক্লাবে পিকনিক, লেকের ধারে গাছের তলায় বসে দলবেঁধে মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়া, স্টিমার পার্টি ও নানা আনন্দ উৎসব। জরুরি প্রয়োজনে যাতে চটজলদি সদস্যদের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, ব্যবস্থা করা হল সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুমতি পত্রের। শুরু হল সদস্যদের পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলা, আশ্বস্ত করা এই বলে যে, পাশে আছে কেয়ার আনলিমিটেড।। প্রয়োজনে পৌঁছে যেতে একটুও সময় লাগবে না।

সদস্যদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু এই আশ্বাসবাণীতে স্বস্তি পেলেন না। ওঁদের সেই এক কথা– কী করে থাকব আমরা তোমাদের ছাড়া? কে থাকবে আমাদের পাশে বিপদে, প্রয়োজনে? সূর্য বুঝলেন এই পরিস্থিতিতে পিছিয়ে গেলে চলবে না। শুরু হল নিয়মিত ফোনে কথা ওয়ান টু ওয়ান। নানা গল্প, নানা কথা, ফোনেই গান শোনানো, বই পড়া। এর মধ্যে সদস্যদের শেখানো শুরু হল কীভাবে গ্রুপ ভিডিও কলে অংশগ্রহণ করতে হয়। সে বছরটা এভাবে পালিত হল বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র জয়ন্তী। প্রথম দিকে খুব অল্প সংখ্যক সদস্য যোগ দিলেও পরের দিকে অনেকেই অংশ নিতে শুরু করলেন। গানে গলা মেলালেন প্রশান্তকাকু, সন্ধ্যামাসিরা। গাইলেন, “আমি ভয় করব না ভয় করব না / দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না”। জুম সেশনে বলে দেওয়া হল সেজেগুজে আসতে হবে। দেখ গেল সবাই সেজেগুজে হাজির। মাস্কবিহীন মুখ, মাসিদের ঠোঁটে লিপস্টিকের আভাস। সঞ্জয়বাবু আবৃত্তি করতে ভালবাসেন। এখনও সঞ্চয়িতার অনেক কবিতা তাঁর কণ্ঠস্থ। এব্যাপারে তাঁর উৎসাহ দেখবার মতো।
ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হলেন মুক্তি গুহ। সূর্য ও তার সঙ্গীরা ওই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন। করোনার ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে ওঁরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো সজাগ থেকেছেন রাতদিন। মুক্তির আত্মজদের অনুপস্থিতি বুঝতেই দিলেন না। সুস্থ করে স্বগৃহে ফিরিয়ে এনে তবে স্বস্তি। মুক্তিমাসিমণির ঘরে ফিরে আসা উদ্যাপন করতে সূর্য ও তাঁর সহযোগীরা এক আশ্চর্য উপহারের ব্যবস্থা করলেন। একসময়ে নাচগানের পাশাপাশি লেখালিখি শুরু করেছিলেন মুক্তি। মুক্তির ইচ্ছে ছিল লেখার সংকলন নিয়ে বই প্রকাশ করার। উদ্যোগী হয়ে ‘কেয়ার আনলিমিটেড’ প্রকাশ করল মুক্তি গুহর লেখার একটি চমৎকার সংকলন ‘মুক্তির আকাশ’। লেখক, তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন, কেয়ার আনলিমিটেডের সব সদস্য, বন্ধুদের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে জুম সেশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হল গ্রন্থের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। মুক্তির মুখে হাসি ফুটল, চোখে আনন্দাশ্রু।

ঘরে বসে আমোদের ব্যবস্থা করতে এবছরের নতুন আর এক উদ্যোগ ‘দ্য সিক অ্যান্ড কানেক্ট সিরিজ’। বিবিধ রকমারি বিষয় নিয়ে গল্প, গান, ছবি, ভ্রমণ। আর সবটাই সংঘটিত জুম সেশনের মাধ্যমে। করোনার প্রকোপে নামী প্রকাশকদের বই প্রকাশ নাকি ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও পিছিয়ে রইল না ‘কেয়ার আনলিমিটেড’। এই দুর্দিনেও সংস্থার বার্ষিক পত্রিকা প্রবীণ সদস্যদের রচনাসমৃদ্ধ ‘ভালো থেকো’ প্রকাশিত হল সঙ্গীতার সম্পাদনায়, বাংলা নববর্ষের দিনে। করোনার টিকা নিয়ে যখন সারা শহর জুড়ে হাহাকার, তারই মধ্যে সব সদস্যের টিকাকরণ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করল কেয়ার।
কেয়ার আনলিমিটেড তার প্রবীণ সদস্যদের জন্য অফুরান যত্নের এক নিশ্চিন্ত আশ্রয়। বার্ধক্যের দিনগুলিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শেখানো থেকে সন্তানতুল্য মমতা ও ভালবাসাকে মূলধন করে সত্যিই ‘বিশেষ যত্ন’ প্রদান করে চলেছে এই তরুণ ব্রিগেড। প্রবীণদের আশীর্বাদের হাত মাথায় রেখে এভাবেই এগিয়ে চলেছেন ওঁরা লক্ষ্য সাধনের দিকে।
*ছবি সৌজন্য: কেয়ার আনলিমিটেডের ফেসবুক পেজ
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
7 Responses
তোমাদের প্রশ্রয় আর আফুরান ভালবাসা আমাদের পাথেয়। তোমাদের দেখানো পথে যেন চলতে পারি।
আমাদের পথ চলার এতো চমৎকার গ্রন্থনা! Hats off ছোডদি (ছোড়দি)….
আমাদের পথ চলার এতো চমৎকার গ্রন্থনা! Hats off ছোডদি(ছোড়দি)…..
Lekhata pore ami abhibhuto,amader kaaj niye eto sundor likhechho,tomay pronam 🙏🙏
ছোড়দি,তুমি খুবই সুন্দর লিখেছো। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মন টা ভালো হয়ে গেল।
প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
Noble and Novel উদ্যোগ। Care Unlimited কে অনেক অনেক অভিনন্দন ।এই উদ্যোগ সফলতার আরও সিঁড়ি চড়ুক, ও এই ছাতার তলায় আরও অনেক মানুষকে এনে এইরকম পরিষেবা দিতে সমর্থ হোক এই কামনা করছি।