ভুবনডাঙার চিঠি
পশ্চিম এশিয়ার (West Asia) রাজনৈতিক আকাশে ক্রমে যত মেঘ জমছে, দক্ষিণ ইরানের (Iran) চাবাহার বন্দর (Chabahar Port) ঘিরে দিল্লির (Delhi) চিন্তাও ততই বাড়ছে।
আদতে গত ৭ অক্টোবর ভোরে ইজরায়েলের এক সঙ্গীতোৎসবে হামাসের অতর্কিতে হামলার পরে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। একদিকে যখন তেল আভিভ (Tel Aviv) তাঁর অপহৃত ইজরায়েলিদের উদ্ধারের জন্য গাজা ভূখণ্ডে হামাসের অবস্থানের উপর হামলা চালাচ্ছে, সেইসময় লেবাননের হিজবুল্লাহ আর ইয়েমেনের হাউথি জঙ্গি গোষ্ঠী ইজরায়েল (Israel) আর আমেরিকার(America) উপর হামলা শুরু করেছে। ওয়াশিংটন এই তিন জঙ্গিগোষ্ঠীর মূল মদতদাতা হিসাবে তেহরানকেই চিহ্নিত করেছে। তারপর ইজরায়েলে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র করেছে তেহরান। আর এখন এই তেহরানের সঙ্গেই ১০ বছরের চাবাহার চুক্তি করে ওয়াশিংটনের বিরাগভাজন দিল্লি।
বস্তুত ভারতীয় বিদেশনীতি নিয়ে ওয়াশিংটন সহ পশ্চিমী দেশগুলো সাম্প্রতিককালে যে আদৌ খুশি নয় তা বার বার সামনে আসছে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রুশ তেল কেনা নিয়ে মার্কিন গুস্সা থেকে শুরু করে কানাডায় জঙ্গি খালিস্তানি নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে নয়াদিল্লিকে কাঠগড়ায় তোলা এরই ফলশ্রুতি। আর তেহরানকে ভাতে মারার জন্য ওয়াশিংটন যখন উঠে পড়ে লেগেছে, ঠিক তখনই দিল্লির এই চুক্তি যে তারা ভালভাবে নেবে না তা বলাই বাহুল্য।
আর এটাও এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে ইরানের উপর বেজিংয়ের ছায়া ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। এতে যে শুধু দিল্লির চিন্তা বাড়ছে তাই নয়, পশ্চিম এশিয়ায় ওয়াশিংটনেরও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে মাত্র ৫০ কিমি দূরত্বে পাক সীমান্ত পেরিয়ে পাক-বালুচিস্তানের বন্দরনগরী গদর যখন ইতিমধ্যেই বেজিংয়ের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। হরমুজ প্রণালীর মুখে পাশাপাশি দুটো বন্দর চিনের আজ্ঞাবহ হলে পারস্য উপসাগরের নৌপরিবহন যে বেজিংয়ের অঙ্গুলিহেলনে চলবে, তা অজানা কিছু নয়।
তাই ঠিকভাবে দেখলে দক্ষিণ ইরানের উপকূলের এই চাবাহার বন্দর পারস্য উপসাগরে শুধু চিনের দাদাগিরি ঠেকানোই নয়, পারস্য উপসাগরে মার্কিন স্বার্থরক্ষায় কার্যকরী হতে পারে। কিন্তু আর দেরি করলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। অর্থ্যাৎ শুধু দিল্লি নয়, ওয়াশিংটনের স্বার্থও জড়িয়ে আছে এই বন্দরের সঙ্গে।

চিন সম্প্রতি যে ২৫ বছরের ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে ইরানের সঙ্গে, তাতে সেদেশের বন্দর, টেলিযোগাযোগ, সড়ক, রেলপথ সহ পরিকাঠামো উন্নয়নের সব দিকই রয়েছে। অর্থ্যাৎ চিনের পাঁচ মহাদেশ জোড়া ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পে তেহরানও সামিল হল। বস্তুত পাক উপকূলে গদরের পর চাবাহারও চিনের কব্জায় গেলে সেটা ওয়াশিংটনের পক্ষেও অশনি সংকেত। পারস্য উপসাগর দিয়ে যে বিশ্বের ৪০ ভাগ তেল বেরোয় তা নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন নৌবহর। কিন্তু এই নয়া চুক্তির ফলে ইরানি তৈলক্ষেত্রে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও চায়না ন্যাশনাল অফশোর অয়েল কর্পোরেশন সরাসরি বিনিয়োগ করবে। শুধু তাই নয়, এই চুক্তির ফলে আগামী ২৫ বছর তেহরান তেল দেবে বেজিংকে। এতে লাভ উভয়েরই। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে তেল বিক্রিতে যে অসুবিধা হচ্ছিল তেহরানের, সেই ক্ষতি যেমন কিছুটা কাটিয়ে উঠবে সে, তেমনই পাইপলাইনে তেল পেলে চিনেরও অনেক সুবিধা হয়। বস্তুত রাশিয়া-তুরস্ক-ইরান-চিন তেল পাইপলাইন পরিকল্পনার একটি অংশ এটি। অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিম এশিয়ার তেল সরবরাহের উল্লেখযোগ্য অংশই মার্কিন খবরদারির বাইরে চলে যেতে পারে। তাই চাবাহার ওয়াশিংটনের কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
চাবাহারের সঙ্গে চিনা স্বার্থও জড়িয়ে আছে। দক্ষিণ পশ্চিম পাকিস্তানে বালুচিস্তানে ইসলামাবাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তেহরানের অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। অথচ এই বালুচ রাজ্য দিয়ে চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর গিয়েছে উপকূলের গদর বন্দর পর্যন্ত। তাই নিজের স্বার্থ বাঁচাতে চিন এগিয়ে এসেছে তেহরানের ত্রাতা হয়ে।
সত্যি বলতে চাবাহারের সঙ্গে চিনা স্বার্থও জড়িয়ে আছে। দক্ষিণ পশ্চিম পাকিস্তানে বালুচিস্তানে ইসলামাবাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে তেহরানের অঘোষিত যুদ্ধ চলছে। অথচ এই বালুচ রাজ্য দিয়ে চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর গিয়েছে উপকূলের গদর বন্দর পর্যন্ত। তাই নিজের স্বার্থ বাঁচাতে চিন এগিয়ে এসেছে তেহরানের ত্রাতা হয়ে। ট্রাম্প প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পুরো ফায়দা তুলেছে শি জিনপিং জমানা। তাই চাবাহার বন্দর হাতে রাখা বেজিংয়েরও জরুরি।
যে বন্দর নিয়ে ত্রিশক্তির এত মাথাব্যথা তার বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক।
ভৌগোলিক দিক থেকে ইরানের এই প্রাচীন বন্দরনগরী দেশের সিস্তান আর বালুচিস্তান রাজ্যের মাকরানা উপকূলে। ইরানের দীর্ঘ সমুদ্রতট থাকলেও ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে কাছে এই চাবাহার। এমনিতেই সারা বিশ্বের তেল রফতানির ৪০ শতাংশের বেশি বের হয় পশ্চিম এশিয়ার পারস্য উপসাগরের এই জলপথ দিয়ে। ভারত, জাপান, চিন, দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি করা তেলের ৮৫ ভাগই যায় এখান দিয়ে। ফলে এই জলপথের উপর কর্তৃত্ব রাখতে পারলে পশ্চিম এশিয়ার তেল বানিজ্যের সিংহভাগই যে নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আদতে পারস্য ভাষায় এর নাম চাহ বাহার। চাহ শব্দের অর্থ চার আর বাহার শব্দের মানে ঋতু। অর্থ্যাৎ চাবাহার শব্দের অর্থ চার ঋতু থাকে যেখানে। অনুকূল আবহাওয়ার জন্য চাবাহারের আরেক নাম বন্দর বেহস্ত।

শুধু অনুকূল আবহাওয়াই নয়, ভৌগোলিক অবস্থানও চাবাহারকে দিয়েছে বেশ সুবিধা। ইরানের উপকূলের মধ্যে ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে কাছে হল চাবাহার। উপরন্তু হরমুজ প্রণালী থেকে দূরত্ব থাকায় পারস্য উপসাগরের রাজনৈতিক বা সামরিক অস্থিরতা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না চাবাহারের উপর। ফলে নিরুপদ্রবে সমুদ্র বাণিজ্য করার যথেষ্ট সুবিধা রয়েছে এখানে। বস্তুত এই সুবিধা থাকাটাই মাকরান উপকূলে বন্দর গড়ার পথে সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই কারণকেই পুঁজি করে উপকূলে কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই পোতাশ্রয় গড়ে ওঠে। আজ থেকে ৪৫০০ বছর আগেও, খ্রীষ্টের জন্মের আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে তিস নামে এক প্রাচীন বন্দরের খোঁজ মিলেছে। আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়ী সেনাবাহিনী বাণিজ্যে সরগরম এই বন্দর নগরীকে দখলও করে। দশম শতকের সংস্কৃতজ্ঞ তথা মধ্যযুগীয় ইসলাম সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ভারত বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক আল বেরুনি তাঁর ‘তারিখ অল হিন্দ’ (ভারতের ইতিহাস) বইতে ভারতের পশ্চিম উপকূলের সঙ্গে তিস বন্দরের সঙ্গে রমরমিয়ে চলা সমুদ্রপথে বাণিজ্যের বিশদ বিবরণও দিয়েছেন। শোনা যায় পরে মঙ্গোল আক্রমণে এই প্রাচীন বন্দর ধ্বংস হয়।
১৯৭০ সালে পুনর্জন্ম হয় তিস-এর যখন পারস্য তদানীন্তন শাসক শাহ রেজা পহলবী চাবাহার নাম দিয়ে তাকে আধুনিক নৌবন্দর করার পরিকল্পনা নেন। তৈরি হয় বিমান ঘাঁটিও। বেশ কয়েকটা মার্কিন সংস্থা নেমেও পড়ে সেই কাজে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে রুহোল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামিক বিপ্লব শাহকে তাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করলে আগেকার সব হিসেব নিকেশের পঞ্চত্ত্বপ্রাপ্তি হয়।
১৯৭০ সালে পুনর্জন্ম হয় তিস-এর যখন পারস্য তদানীন্তন শাসক শাহ রেজা পহলবী চাবাহার নাম দিয়ে তাকে আধুনিক নৌবন্দর করার পরিকল্পনা নেন। তৈরি হয় বিমান ঘাঁটিও। বেশ কয়েকটা মার্কিন সংস্থা নেমেও পড়ে সেই কাজে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে রুহোল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামিক বিপ্লব শাহকে তাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করলে আগেকার সব হিসেব নিকেশের পঞ্চত্ত্বপ্রাপ্তি হয়। সাময়িকভাবে আধুনিক বন্দর গড়ার কাজ শিকেয় ওঠে। কিন্তু কিছুদিন বাদেই তেহরানের নতুন শাসকরা চাবাহারের ভৌগোলিক অবস্থানের উপযোগিতা হাড়ে হাড়ে বুঝে যান। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ঝটিকা আক্রমণ চালায় পশ্চিম ইরানের খুজেস্তান রাজ্যে। শুরু হয় পশ্চিম এশিয়ার দুই পড়শির দীর্ঘ ৮ বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আর এই লড়াই চলার সময়ই দেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলে বন্দর থাকা কতটা জরুরী তা তেহরানের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। যুদ্ধের আঁচ এসে লেগেছিল হরমুজ প্রণালিতে থাকা বন্দর আব্বাসেও। তাই তড়িঘড়ি আধাখেঁচড়া তৈরি চাবাহার বন্দরেই নিয়ে আসতে হয়েছিল রণতরী আর বাণিজ্যপোত গুলোকে।
চাবাহার চালু হলে তেহরানের লাভ কিছু কম নয়। চাবাহার হতে চলেছে ইরানের প্রথম গভীর নাব্যতার বন্দর যেখানে বড় পণ্যবাহী জাহাজ আসতে পারবে। এতদিন এই কাজ পারস্য উপসাগরের অপর উপকূলে পড়শি দেশ সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর বন্দর ব্যবহার করে চালাচ্ছে তেহরান। চাবাহার চালু হলে পুরো ছবিটাই পাল্টে যাবে। আর এতে আফগানিস্তান আর মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করার আরেকটা নতুন রাস্তা খুলে যাবে। এমনকি সরাসরি সমুদ্রপথের সঙ্গে সংযোগ না থাকা পড়শি দেশগুলো চাবাহারকে তাদের দেশের ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবেও ভাবতে পারবে। অর্থ্যাৎ চাবাহার হয়ে উঠবে ইরানের উত্তরের পড়শি দেশগুলোর কাছে বর্হিবিশ্ব থেকে পণ্য আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করার প্রধান যোগসূত্র। অর্থনীতিবিদদের মতে, সব দিক বিচার করলে সড়ক বা রেলপথের চেয়ে জলপথে পণ্য আনা তুলনামূলক ভাবে সস্তাই পড়ে।

চাবাহার দৃশ্যপটে দিল্লির প্রবেশ ২০০৩ সালে। এখানে ইরানের পড়শি দেশ আফগানিস্তানের কথা একটু বলা দরকার কারণ এই বন্দরের পরতে পরতে যেমন জড়িয়ে আছে আফগান ইতিহাসের ছায়া তেমনি দিল্লির এই বন্দরে উৎসাহের পিছনেও রয়েছে এই দেশ।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আফগানিস্তানে রক্তক্ষয়ী তালিবান রাজ চলে। হয়তো আরও কিছুকাল চলত। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে জঙ্গি হামলা সব হিসাব ওলট পালট করে দেয়। ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর হিসাবে আফগানিস্তানকে চিহ্নিত করে হামলা চালায় তালিবানের ওপর। তাসের ঘরের মতো তালিবান শাসন ভেঙে পড়ে। মোল্লা ওমর সহ ছোটবড় সব তালিবান নেতা পালায় কাবুল ছেড়ে। মার্কিনিরা হামিদ কারজাইকে নয়া অন্তর্বতী আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট করে ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর। ২০০৩ সালে আফগান উপজাতিগুলোর ৫০২ জন প্রতিনিধি লোয়া জিগরা বা সংসদে মিলিত হয়ে নয়া আফগান সংবিধানে সিলমোহর দেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকায় কারজাই আফগান অর্থনীতির হাল ফেরানোর উপর জোর দেওয়া শুরু করেন। ঠিক হয় কাবুলের উত্তরে হাজিজাক অঞ্চলের যে আনুমাণিক ৩ লক্ষ কোটি টনের লৌহ আকরিক সহ অন্য খনিজ আছে তা খনন করতে আফগান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কনসোর্টিয়াম গড়া হবে। তিন ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া, রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেড আর ন্যাশনাল মিনারেল ডেভলেপমেন্ট কর্পোরেশনের উদ্যোগে এই নয়া আফগান সংস্থা গড়েও ওঠে। আরও ঠিক হয় এখানে লৌহ আকরিক দিয়ে ৬১লক্ষ টন বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতার ইস্পাত কারখানা গড়া হবে। থাকবে প্রতিটি ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম দুটি ইউনিটের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই বিপুল পরিমান ইস্পাত ও খনিজ, রেল সহযোগে ইরান সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে বলে ঠিক করা হয়। তারপর সেটি দক্ষিণ ইরানের সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতে নিয়ে আসা হবে। ঠিক হয় ভারতীয় রেল পরিবহন পরিকাঠামো সংস্থা রাইটস মোট ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেললাইন নির্মাণ করবে। এই রেলপথের শেষে এই ইরানি বন্দরটিই হল চাবাহার।
ঠিক হয় কাবুলের উত্তরে হাজিজাক অঞ্চলের যে আনুমাণিক ৩ লক্ষ কোটি টনের লৌহ আকরিক সহ অন্য খনিজ আছে তা খনন করতে আফগান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কনসোর্টিয়াম গড়া হবে। তিন ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া, রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেড আর ন্যাশনাল মিনারেল ডেভলেপমেন্ট কর্পোরেশনের উদ্যোগে এই নয়া আফগান সংস্থা গড়েও ওঠে।
অর্থ্যাৎ হাজিজাক থেকে খনিজ আর ইস্পাত নিয়ে আসা ছিল ভারতের পক্ষে আধুনিক চাবাহার বন্দর গড়ার কাজে হাত লাগানোর অন্যতম প্রধান যুক্তি। এছাড়া এই বন্দর হলে মধ্যএশিয়া থেকে পাকিস্তানকে এড়িয়ে দিল্লির সরাসরি তেল আমদানি যে করা যাবে শুধু তাই নয়, এই বন্দরকে ভিত্তি করে দিল্লির মধ্য এশিয়ায় বাজার ধরার প্রয়াসও করা যাবে। এ ছাড়া পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরে ক্রমবর্ধমান চিনা আধিপত্য ঠেকানোর ব্যাপারেও চাবাহার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। এ বাদে পরিকল্পনা করা হল বন্দর সংলগ্ন এলাকায় এক বিশাল কর-মুক্ত শিল্পাঞ্চল করার। অর্থ্যাৎ এক বন্দরকে কেন্দ্র করে গোটা মধ্য এশিয়ার শিল্প মানচিত্রে বড় মাপের পরিবর্তন আসতে পারে।

এখানে বলে নেওয়া ভাল ২০২০ এর ১৫ অগস্ট তালিবানরা ফের কাবুল দখল করায় হাজিজাক প্রকল্প এখন বিশবাঁও জলে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে চলতি বছরের জানুয়ারিতে উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডর নিয়ে দু’দেশ কথা বলা শুরু করেছে। পরিকল্পনা অনুসারে মুম্বই থেকে ইরান, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া হয়ে ইউরোপে জলপথ, রেলপথ আর স্থলপথ দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে এই ৭২০০ কিমির প্রস্তাবিত করিডরে। হিসাব কষে দেখা গিয়েছে বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থার চেয়ে এই নয়া করিডরে মুম্বই থেকে ইউরোপ পণ্য পরিবহন শুধু যে ৩০ শতাংশ কম খরচে করা যাবে তাই নয়, ৪০ ভাগ সময়ও কম লাগবে।
আরও পড়ুন : আফগানিস্তান কি ফের গৃহযুদ্ধের মুখে?
কিন্তু এসব ভবিষ্যতের কথা। আপাতত অধুনা চিন-ইরান সমঝোতা সব হিসেব পাল্টিয়ে দিয়েছে। আসলে ট্রাম্প প্রশাসন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার জেরেই বেহাল আর্থিক ব্যবস্থার হাল ফেরাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকা তেহরান বেজিংয়ের দ্বারস্থ। মার্কিন ড্রোন দিয়ে প্রকাশ্যে ইরানের রিভোলিউশনারি গার্ডের জেরুজালেম বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাশিম সোলেইমানি হত্যা পরিস্থিতি আগেই ঘোরালো করে তুলেছিল। এখন গাজা যুদ্ধ তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।
তাই চাবাহার এখন পারস্য উপসাগরের ক্ষমতার ভারসাম্যের বড় ঘুঁটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভারতেরও পশ্চিম এশিয়ায় পা রাখার জায়গা।
*মতামত, সত্যতা ও বক্তব্যের দায় লেখকের।
মূলত শিল্প বাণিজ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ব্যপ্ত বিগত তিন দশক। তবে সুযোগ পেলে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া বা অন্য ধরনের লেখাতে প্রাণের আরাম খোঁজার চেষ্টাও চলে