ছত্রপতি সাহু। নামটা প্রায় না-চেনা, ছুঁয়ে গেছে আগের পর্ব। কিন্তু সে স্পর্শক মাত্র।
একটি মানুষ, যাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠে বিখ্যাত ‘ভেদাকোটা বিতর্ক’, যিনি ভারতবর্ষে প্রথম দলিত সংরক্ষণ করেন এবং তাও পঞ্চাশ শতাংশ, বাবা সাহেব আম্বেদকরের আইনপাঠে উৎসাহ দেন, আর্থিক সাহায্য করেন যিনি, আম্বেদকরের প্রকাশ করা সংবাদপত্রেও দান করেন তা দলিত মুখপত্র বলে, আম্বেদকরের পত্রিকা বলে। এমনকী দলিতরা যাতে প্রশাসনিক কাজে শিক্ষিত হয়ে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য ভারতবর্ষের প্রথম প্রশাসনিক শিক্ষাকেন্দ্রও গড়ে তোলেন তিনি। আর যে প্রসঙ্গে আগের পর্বের লেখায় এসেছেন তিনি, তাও কম বড় কর্মকাণ্ড নয়। সাবিত্রী-জ্যোতিবার পতাকা বহন করা, তাঁদের সত্যসোধক সমাজকে নতুন করে প্রাণোদীপ্ত করা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বও তাঁর।
মানষটি ছত্রপতি সাহু। তাঁকে আমরা চিনি না, সমকালও চেনে না তেমন। জ্যোতিবা-সাবিত্রীর জীবনের বৃত্তে তিনি সরাসরি আসেন না। কিন্তু খুব বেশি প্রাসঙ্গিক জ্যোতিবা-সাবিত্রীর আদর্শের বৃত্তে। সত্যসোধক সমাজ আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না সাহুর কথা ছাড়া। ব্রাহ্মসমাজের ক্ষেত্রে মহর্ষি, কেশবচন্দ্র সেনের যুগের পরে যে অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল অধ্যায় আসে এবং ব্রাহ্মসমাজের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অটুট থাকলেও তার ধর্মসংস্কার ও সামাজিক গুরুত্ব ক্ষীণ হয়ে আসে। একই চলন দেখা যায় আর্য সমাজের ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রেও ।

সত্যসোধক সমাজের ক্ষেত্রে যে তা হয় না, তার কারণ ছত্রপতি সাহু। দলিতশিক্ষা, দলিত সংস্কারের যে আদর্শ সত্যসোধক সমাজের ছিল, তা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেন সাহু। তামাশার মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের গ্রামে গ্রামে প্রচার করতে থাকেন দলিতদের স্বার্থরক্ষার কথা, তাদের নিষ্পেষণ শেষ হওয়ার কথা। আর সেখানে থেকেই জন্ম নেয় কৃষক আন্দোলন, যার কথা আগে বলেছি।
কিন্তু কে এই ছত্রপতি সাহু? কীভাবে তিনি দলিতদের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন? কী তাঁর জীবনরেখ?
জন্মসূত্রে মৎসজীবী ছেলেটি ছোটবেলা থেকে সব বিষয়েই চৌকস। খেলাধুলো, লেখাপড়া কোন কিছুতেই কাগাল গ্রামে তার জুড়ি মেলা ভার। কাগাল গ্রামেই তার জন্ম, যা কোলাপুর রাজ্যের অন্তর্গত। সময়টা ১৮৮৪। কোলাপুরের রাজা চতুর্থ শিবাজির মৃত্যুর পর রানি আনন্দীবাঈ সিংহাসনে বসেন। ছত্রপতির আশ্চর্য প্রতিভা, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি, উন্নত ললাট দেখে আনন্দীবাঈ-এর বুঝতে বিলম্ব হয় না, যে এ কোনও সাধারণ বালক নয়। বেশি দেরি করেন না রানি আনন্দীবাঈ। কিছুদিনের মধ্যেই ছত্রপতিকে দত্তক নেন তিনি। সাহু হয়ে যায় ছত্রপতি সাহু। রানির মৃত্যুর পর ১৮৯৪ সালে সিংহাসনে বসেন ছত্রপতি।

সিংহাসনে বসার কয়েক বছরের মধ্যে ঘটে সেই বিখ্যাত ‘ভেদাকোটা বিতর্ক।’ রাজা ছত্রপতি সাহুর চোখে পড়ে যায় নির্দয় অথচ রোজই ঘটতে থাকা এক ঘটনা। ছত্রপতি দেখেন যে, রাজপরিবারের এক ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাছে বিদ্যাশিক্ষার জন্য প্রার্থনা করছে একটি বালক। এবং তাকে নির্দয়ভাবে প্রত্যাখ্যান ও পদাঘাত করে সরিয়ে দিচ্ছেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। বালকটি দলিত, এ-ই তার একমাত্র অপরাধ।
বিচলিত ছত্রপতিকে বিক্ষুব্ধতর করে তোলে আরও একটি ঘটনা। এক দলিত বিয়ের অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ করতে গিয়ে দেখেন, অনুষ্ঠানে পুরোহিতের দেখা নেই। ছত্রপতি জানতে পারেন, ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আনতে অনেক সাধ্যসাধনা করতে হয়, অপমান সহ্য করতে হয় দলিতদের। এই সমস্যার কথা ছত্রপতি যে আগে শোনেননি তা নয়। কিন্তু সমস্যার স্বরূপ ও কারণ দেখে সত্যই বিস্মিত হন। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এর কারণ হিসেবে যা বলেন তা হল, বিয়ে বা শ্রাদ্ধের মন্ত্র দেবভাষায় লিখিত। দেবভাষার মন্ত্র শুধু পুরোহিত উচ্চারণ করবে তা তো নয়, তার সঙ্গে দলিত পাত্রপাত্রী বা শ্রাদ্ধের ক্ষেত্রে দলিত পুত্রও উচ্চারণ করবে। ব্রাহ্মণদের চোখে এ রীতিমত অনাচার। তার জন্য যদি বিয়ে, শ্রাদ্ধ সমাধা না হয়, না হবে। দলিতদের বিয়ে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্রাহ্মণসমাজ কোনও সহানুভূতি দেখাতে অপারগ।
দেরি করেন না বিস্মিত, বিক্ষুব্ধ ছত্রপতি। রাজকার্যের, পৌরোহিত্যের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ব্রাহ্মণদের অপসারিত করেন তিনি। তাহলে এইসব গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করবেন কারা? ছত্রপতি এই সমস্যার সমাধান করেন সম্পূর্ণ অপ্রচলিত পদ্ধতিতে। ব্রাহ্মণ হিন্দুদের মধ্যে একাংশ, যাঁরা হয়তো দলিত নন, কোনওভাবে কিছুটা সংস্কৃত শিক্ষা পেয়েছেন, তাঁদেরকে ডেকে পাঠান ছত্রপতি। তাঁদের মধ্যে থেকেই রাজদায়িত্ব পালনের উপযুক্ত মানুষদের খুঁজে উচ্চপদে অভিষিক্ত করেন। যেহেতু তাঁরা ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য বর্ণের হিন্দু যেমন ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, তাই তাঁদের উপাধি দেন ‘ক্ষাত্রগুরু।’
ক্ষাত্রগুরু নিয়োগ, ব্রাহ্মণদের অপসারণ এক বিশাল সামাজিক ও ধর্মীয় ঢেউ তোলে যা ‘ভেদাকোটা বিতর্ক’ নামে পরিচিত। ব্রাহ্মণ সমাজ স্বাভাবিকভাবেই এই অপসারণ মুখ বুজে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। রাজার বিরুদ্ধে তারা একরকম বিদ্রোহ গড়ে তোলে। কিন্তু ছত্রপতি সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। শুধু তাই নয়, কীভাবে দলিতদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, তাদের ধর্মীয় অধিকার, সামাজিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া যায়, তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। এবং এই সূত্রেই তিনি প্রবেশ করেন জ্যোতিবা-সাবিত্রী প্রতিষ্ঠিত সত্যসোধক সমাজে। এই সমাজের মূল আদর্শ, সমাজের পরিচালন প্রক্রিয়ায় যেভাবে অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত হন, তা মনে রাখার মতো। ১৯০২ সালের কথা, সাবিত্রী-জ্যোতিবার যুগ শেষ হয়ে প্রায় এক দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। নিভন্ত প্রদীপ আবার প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে সাহুর নেতৃত্বে।
এখানে বলে রাখা ভাল, সাবিত্রী-জ্যোতিবার পরেও তাঁদের পতাকা বহন করার জন্য ছিলেন তাঁদের মানসপুত্রী তারাবাঈ শিন্ডে এবং দত্তকপুত্র যশবন্ত রাও। তারাবাঈ শিন্ডে ও যশবন্ত রাওয়ের কথা আমরা পরের পর্বে জানব অবশ্যই। প্রাসঙ্গিক কথা এই যে তারাবাঈ, যশবন্ত রাওয়ের পরে জ্যোতিবা সাবিত্রীর ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলন ক্রমে নিশ্চিহ্নই হয়ে যেত, যদি ছত্রপতি সময়ে না আসতেন। এখানেই তাঁর প্রাসঙ্গিকতা।

জ্যোতিবা-সাবিত্রীর কথা যখন আমরা বলি, তখনই মনে হয় দুটো মানুষ এক জীবনে এত কিছু করতে পেরেছিলেন? ফতিমা শেখের কথা, তারাবাঈয়ের কথা মনে করতে করতে একই চিন্তা হয়– এত যে শিখার প্রজ্জ্বলন, তাকে ধারন করছে কে? দলিতশিক্ষা, নারীশিক্ষার যে গৌরবময় আন্দোলনের অতীত আর আমাদের চারপাশের চেনা দলিত আন্দোলন, নারীবাদের বর্তমানের মধ্যে সেতু হয়েছিলেন কে বা কাঁরা? ছত্রপতি সাহু সেই বিরল মানুষদের মধ্যে একজন, যিনি জ্যোতিবা-সাবিত্রীর দলিতশিক্ষার ঐতিহ্যকে বাবাসাহেবের হাতে সার্থকভাবে সমর্পণ করেছিলেন, উত্তরাধিকার রূপে। সেই উত্তরাধিকারের গল্প, বাবাসাহেবের গল্প আবার পরের পর্বে।
আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩], [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬], [পর্ব ৭], [পর্ব ৮]
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Royal Collection Trust
* তথ্যঋণ:
‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্ অফ্ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।