Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ছোটদের গল্প: ঢেউ

সৌরভ হাওলাদার

ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩

childrens story on environment
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

সাবু ডাবু বড়মামার সঙ্গে কাছিমপুলের জঙ্গলে এসেছে। এবারে মুন্নি হাতির জন্য এক কাঁদি কলা বখশিস এনেছে। ডাবু আর বড়মামা দুজনে মুন্নি হাতির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে, সাবু একটু তফাতে একটা বড় পাথরের গায়ে হেলান দিয়েছিল। হঠাৎ পাথরটা নড়ে ওঠে। বলে, “এক্সকিউজ মি। এবার তো উঠতে হয়।”

ডাবু চমকে ছিটকে ওঠে। পাথর কথা বলে! তারপর তাকিয়ে দেখে চশমা পরে নিথুর ওর দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে, “কী ব্যাপার! ঘাবড়ে গেলে নাকি?”

সাবু এবারে বোঝে, ঘাস মাটির মধ্যে যাকে পাথর ভেবেছিল, সে একটি প্রমাণ মাপের কচ্ছপ।

কাছিমপুলের সদ্য যুবক কাছিম, নাম তার নিথুর। এই বৈশাখে আটানব্বইয়ে পা দিল। ইদানিং তার চশমা হয়েছে। বেশ ভারিক্কি চাল। অন্য পশু পাখিরা আড়চোখে দেখে, নিথুর সেটা বুঝতে পারে। একটু গর্ব হয়। চশমার সঙ্গে একটা বিজ্ঞভাব আসে। এমনিতে কাছিমপুলে সবাই নিথুরকে জ্ঞানী বলে মানে। শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা শেষ করে, পশুপাখিরা নিথুরের কাছে উচ্চশিক্ষার জন্য আসে। 

সাবুর হাসি পেল, কচ্ছপটিকে চশমা পরা দেখে। নিথুর একটু যেন বিরক্ত হয়ে বলে, “হাসির কী আছে? চশমা যেন কখনও দেখোনি!”

সাবু বোঝে, হেসে ফেলা মোটেও উচিত হয়নি, “সরি স্যর, ভুল হয়ে গেছে।”

নিথুরের ‘স্যর’ ডাকটা ভালো লাগল। জঙ্গলে বেশিরভাগ পশুপাখি ওকে দাদু বলছে। এত অল্প বয়সে ‘দাদু’ ডাক শুনতে কেইবা চাইবে? নিথুরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ‘অদ্বৈত’ আলিপুর চিড়িয়াখানায় আড়াইশো বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তিনি ছিলেন লর্ড ক্লাইভের বন্ধু। আর ডারউইন সাহেবের বন্ধু হ্যারিয়েট একশো ছিয়াত্তর বছর বেঁচে ছিলেন। এছাড়া সেশেলস দ্বীপের জোনাথন তো একশো অষ্টআশি পার করে এখনও দিব্যি আছেন, সিনেমা টিনেমাও করছেন। সেখানে নিথুর মাত্র আটানব্বই হয়ে কী এমন বুড়ো হয়েছে?


আরও পড়ুন: ছোটদের ছড়া- হরেক ভূতের কিসসা


নিথুর একটু গলা নামিয়ে বলে, “তোমার সাথে একটা পরামর্শ আছে।”

সাবু এতটা গুরুত্ব পেয়ে ফুলে উঠে, “বড়মামা কে ডাকি?”

“না না, ওসব বড়মানুষদের কাজ নয়, এটা আমাদের মতো ছোটদের ব্যাপার।”

পাশ দিয়ে একটা দোয়েল ঘুরছিল। কচ্ছপের চলার পথে মাটির তলা থেকে পোকামাকড় বেরিয়ে আসছে। ও সেগুলো খাচ্ছে আর মনের সুখে লেজ নাড়াচ্ছে। নিথুরের কথা শুনে ফ্যাক করে হেসে ফেলে। হাসির শব্দটা দুজনেরই কানে যায়। নিথুর বলে, “হাসলি কেন?”

দোয়েল লেজ নামিয়ে বলে, “একশো বছরের দাদু যদি নিজেকে ছোট্ট বলে, হাসি পাওয়ারই কথা।”

সাবু চোখ কপালে তুলে বলে “কার একশো বছর?”

নিথুর তাড়াতাড়ি করে বলে, “সবে আটানব্বইয়ে পড়লাম। এখনও একশো ছুঁতে ঢের দেরি।”

দোয়েলটা একটা শিস দিয়ে উড়ে যায়, যেন ব্যঙ্গ করল!

নিথুর বলে, “একটা কান্ড হয়েছে! এই জঙ্গলের অন্যদিকে নীলুয়া নদী আছে। সেখানে আমাদের বংশ পরম্পরায় বাস। এখন শুনছি, ওখানে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি হবে?”

সাবু বলে, “জলবিদ্যুৎ কি জলহস্তীর মতো কিছু?”

মাথা নেড়ে নিথুর বলে, “না হে না। তুমি দেখছি ভূগোলে খুব কাঁচা।”

সাবু প্রতিবাদ করতে গিয়েও চুপ করে গেলো। নিথুর বলে চলে, “জলবিদ্যুৎ হলে তোমাদের শুরুতে সুবিধা হবে, আলো জ্বলবে পাখা চলবে, কিন্তু পরে আমাদের সঙ্গে সকলকেই মরতে হবে।”

“কেন? সবাই মরবে কেন?” সাবু এবার সত্যিই ভয় পেয়েছে।

“নীলুয়া নদীতে জলবিদ্যুৎ হলে, নদীতে বাঁধ দেওয়া হবে, জল কমে যাবে, স্রোত থাকবে না, নদী শুকিয়ে যাবে। প্রথমেই আমাদের মতো যারা জলে বাস করি, তারা মারা যাবে, তারপর জল না পেয়ে অন্য পাখি, জানোয়ার, গাছ মারা পড়বে। সাথে মানুষেরও মরণ ঘনিয়ে আসবে।”

“তাহলে তো ভারী বিপদ! বড়মামাকে ডাকি?”

“আহ, তোমায় তখন বললাম না? এসব বড় মানুষের কাজ নয়। যা করার আমাদেরই করতে হবে।”

কথা শুনে সাবু আগ্রহতে টগবগ করতে থাকে। ঘাসের ওপর বসেই পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয় বড়মামা আর ডাবু কোথায়? ওরা তখনও হাতিদের ঘরে গিয়ে মাহুতদের সঙ্গে গল্প করছে। 

নিথুর বলতে থাকে, “এই নদীবাঁধ প্রায় সম্পূর্ণ। এবার জলবিদ্যুৎ তৈরি করতে আরও বছরখানেক লাগবে। তার আগে আমার সমুদ্রের ঢেউ লাগবে।”

“সমুদ্রের ঢেউ?”

“হ্যাঁ বড় বড় পাহাড়ের মতো সমুদ্রের ঢেউ।”

সাবু কথাটা শুনে দূরে আকাশের গায়ে লেগে থাকা ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “অত বড় ঢেউ!”

নিথুর চশমার ভিতরে চোখ দিয়ে হাসে, “হ্যাঁ। আমিই গিয়ে দেখেশুনে বেছে নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু আমার ঘুরে আসতে আসতে প্রায় আড়াই তিন বছর হয়ে যাবে। তাও যদি প্রতিদিন আট ঘন্টা করে জোরে জোরে হাঁটি। জঙ্গলের চৌহদ্দি পেরলে, কে কখন ধরে খেয়ে নেয়, তার ঠিক নেই।”

“তাহলে, বড়মামাকে বলি, গাড়িতে করে নিয়ে যাবে?”

“ওফ! আবার বড়মামা? তাহলে আমি অন্য কোন বাচ্চাকে দেখি?”

সাবু তাড়াতাড়ি করে সামাল দেয়, “ঠিকাছে ঠিকাছে আমিই করব। তা কী করতে হবে?”

নীলুয়া নদীতে জলবিদ্যুৎ হলে, নদীতে বাঁধ দেওয়া হবে, জল কমে যাবে, স্রোত থাকবে না, নদী শুকিয়ে যাবে। প্রথমেই আমাদের মতো যারা জলে বাস করি, তারা মারা যাবে, তারপর জল না পেয়ে অন্য পাখি, জানোয়ার, গাছ মারা পড়বে। সাথে মানুষেরও মরণ ঘনিয়ে আসবে।

নিথুর বলে, “মন দিয়ে শোনো। কোন পূর্ণিমার রাতে যখন চাঁদের আলো সমুদ্রের ওপর পড়বে, সেই আলোমাখা তিনটে ঢেউ গুণে গুণে একটা বোতলে পুরে রাখবে। তারপর আবার যখন কাছিমপুলে আসবে, আমাকে দেবে।”

“সমুদ্রের ঢেউ দিয়ে কী হবে?”

নিথুর বলে, “ওই ঢেউ যেখানে মিশবে, সেখানেই অমন বিপুল ঢেউ তৈরি হবে। এদের বাঁধ ভেঙে যাবে।”

সাবু বলে, “তোমায় কী করে পাব?”

কথাটা শুনে নিথুর এবার ওর মোটা খোলের ভেতর ঢুকে পড়ে। খানিক পর একটা ছোট শামুকের মতো জিনিস বার করে এনে হাতে দেয়। “এটার ভেতর ফুঁ দিলে আওয়াজ হবে। আমি ঠিক শুনতে পাব। চলে আসব তোমার কাছে। আর এই সব কথা কাউকে বলা চলবে না। তাহলে গুণ কেটে যাবে। আর কাজ করবে না।”

শামুক পকেটে নিয়ে সাবু ফিরে আসে। ডাবু বলে, “চল, আইসক্রিম খাব। বড়মামা ডাকছে।”

আইসক্রিম খেতে খেতে বড়মামা জিজ্ঞেস করে “ওখানে ঘাসের ওপর বসে কী করছিলি?”

“কচ্ছ..” বলতে গিয়ে কথাটা গিলে নেয়, “কিছু না এমনিই।”

“চল চল, এবার বাড়ি ফিরবো। সবাই অপেক্ষা করছে।” 

ছুটিটা কেমন হুড়মুড় করে শেষ হয়ে গেল। এখানে আসার আগে কত দিনগোনা, কত অপেক্ষা, কত উত্তেজনা আর দুইভাইয়ে কত পরিকল্পনা!

কলকাতায় ফিরে এসে আবার স্কুল, হোমটাস্ক, টিউশন, আঁকার ক্লাস, ক্যারাটে, গিটার। সেদিন সকালে জানলার পাশে টেবিলে বসে সাবু পড়াশুনো করছে, শিস দিয়ে লেজ নাচিয়ে একটা দোয়েল এসে উপস্থিত। “কী! কলকাতায় এসে দেখছি, ভুলেই গেছো?”

কথা শোনা মাত্র সাবুর সেইদিনের কথা মন পড়ে যায়। নিথুর বলেছিল, “গুণে গুণে তিনটে ঢেউ আনতে।”

সাবু বলে, “আমি বাবাকে বলব, সমুদ্রের ধারে নিয়ে যেতে।”

কথা শেষ করার আগে দোয়েল ফুড়ুৎ করে, জানালার ওপর একটা শব্দ ফেলে রেখে, কোথায় উড়ে চলে গেল। জানলা দিয়ে ঘাড় কাত করেও সাবু ওকে দেখতে পেল না।

রাতে খাওয়ার টেবিলে বাবা বলে, “সামনের শুক্রবার গুরুপূর্ণিমার ছুটি আছে, চলো দুদিনের জন্য দীঘা ঘুরে আসি।”

শুনে সবাই হইহই করে ওঠে। 

ভোরবেলা গাড়িতে ওঠে সবাই। দুপুরের ভিতর দীঘা পৌঁছে যায়। সাবু-ডাবু-রা খাওয়া দাওয়া করে সমুদ্রের ধারে একটু ঘুরতে বের হয়। জলের ওপর অনেকগুলো সিগাল উড়ছিল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ সাবুর দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে বলে, “মনে আছে তো? আজ কিন্তু পূর্ণিমা।”

fullmoon night childrens story on nature

সাবু চমকে ওঠে, মনে মনে ভাবে, “বাব্বা! এরাও জানে?”

সন্ধের পর, সকলে মিলে আবার সাগরপারে যায়। সাবু নিজের ওয়াটার বটলটা সাথে নিয়ে আসে। একসময়, বাবা বলে, “এক ঢোঁক জল দে তো।”

সাবু বোতলটা এগিয়ে দিয়ে ভাবে, “ফেরার সময়, জল চাইলেই মুশকিল হবে।”

সে রাতে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছিল। সাধারণতঃ বর্ষাকালে মেঘ থাকে বলে, চাঁদ অনেক সময় দেখা যায় না। আজ যেন সে অকৃপণ! ঢেউ গুলো উঠছে পড়ছে। ঢেউয়ের মাথায় ফেনাগুলো অন্ধকারেও কেমন জ্বলজ্বল করছে। সাবু পায়ে পায়ে জলের কাছে এগিয়ে যায়। বড় ঢেউ দেখে বোতলটা পেতে ধরে। তিনবার। অনেকটা ভরে গেছে। কেউ বোঝার আগে আবার বাবা মা আর ডাবু-র কাছে ফিরে আসে।

বাড়ি ফিরে খুব খুশি। অন্ততঃ নিথুরের কথা অনুযায়ী পূর্ণিমারাতের ঢেউ ধরে এনেছে। তবে সত্যিই এই ঢেউ থেকে অমন বড় বড় ঢেউ জন্মাবে তো? সাবু একটু টেস্ট করে দেখতে চায়। বাথরুমে গিয়ে ওর ওয়াটার বটল থেকে এক ছিপি বার করে খুব ভয়ে ভয়ে চোখ বুঁজে বালতির জলে মেশায়। চোখ বুঁজেই থাকে। এক্ষুণি বালতির জল ফুলে ফেঁপে হুলুস্থুলুশ ঘটিয়ে ছাড়বে। খানিক চোখ বন্ধ রেখে যখন বোঝে, কোন সাড়াশব্দ নেই, তখন আলগা করে একটা চোখ খোলে। তাকিয়ে দেখে বালতির জল যেমন ছিল, তেমনি আছে। চোখ ফেটে জল এল সাবুর। ঘরে নিয়ে ওয়াটার বটল-টা লুকিয়ে রাখল। আর নিজে হাপুস নয়নে কেঁদেই চলে। সবাই এসে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে?” “পেট ব্যথা না কি?” “কী খেয়েছ?” “স্কুলে পড়া পারনি?” কিন্তু সাবু কাউকেই কিছু বলতে পারে না। জানলার কাছে আবার সেই দোয়েলটা এসে বলে, “সাগর ভরা তিন ঢেউ, সাবু কাঁদে ভেউ ভেউ।” শুনে থমকে যায় সাবু, “ভারী বেয়াদপ পাখী তো? আমি মরছি, আমার জ্বালায়, এ আসছে তাতে নুনের ছিটে দিতে।” দোয়েল বলে, “চিন্তা কোরও না জোয়ারে ঢেউ ওঠে, বালতিতে হবে না। তুমি নিথুরকে দিও, তাহলেই হবে।” 

প্রতিবার শীতের ছুটিতে ডাবু সাবুর মামাবাড়ি আসা চাই। আর মামাবড়ির পাশেই কাছিমপুলের জঙ্গল। গত পাঁচ ছয় মাস ধরে সাবু নিজের পড়ার বইএর ফাঁকে সেই জলের বোতলটা লুকিয়ে রেখেছিল। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখত, ঠিক আছে কিনা। 

কাছিমপুলের জঙ্গলে এসে সাবু পকেট থেকে শামুকটা বার করে ফুঁ দেয়। তখন কোথা থেকে একটা হাঁস হেলেদুলে এসে হাজির। “তুমি নিথুরকে ডেকেছো, কিন্তু ও এখন নীলুয়া নদীর পারে আছে। ওখান থেকে এটুকু আসতে একমাস লেগে যাবে।”

সাবু ভয় পেয়ে যায়, “অতদিন আমি তো থাকব না। আমার স্কুল খুলে যাবে।”

হাঁস বলে, “তবে তো চিন্তার কথা। তবে একটা উপায় আছে।”

“কী সেটা?”

“নীলুয়া নদীতে যদি জোয়ার আসে, অন্ততঃ কিছুটা রাস্তা স্রোত বাড়বে। নিথুর সেই স্রোতে ভেসে আসতে পারবে।” তারপর একটু থেমে বলে, “তুমি একটু গুগুল ঘেঁটে দেখো না, কখন জোয়ার আসবে?”

সাবু বলে, “এখানে তো আমার ল্যাপটপ নেই। বড়মামার মেয়ে তিন্নিদিদিকে বলতে হবে।”

হাঁস ডানা দুলিয়ে বলে, “সে হবে না। কাউকে বললেই গুণ চলে যাবে।”

সাবু ঘরে ফিরে, গেম খেলবার জন্য তিন্নিদিদির ল্যাপটপটা নিয়ে জোয়ার ভাটার সময় দেখে। ঠিক তখন জানালার ওপাশ থেকে প্যাঁক করে একটা গলা দেখা যায়। হাঁসটা এসে গেছে। সাবু জানালার কাছে গিয়ে বলে, “আজ রাত সাতটায় জোয়ার আসবে বলছে।” শুনে হাঁস বলে, “তাহলে নিথুর যদি এক জোয়ারে ভাসে, কাল জোয়ারে তোমার কাছে আসবে।” 

“কাল কখন জোয়ার আসবে?”

হাঁস গম্ভীর হয়ে বলে, “সাতটা বাহান্নতে আসবে।”

সাবু অবাক হয়ে বলে, “তুমি কী করে জানলে?”

“তুমি দেখছি ভূগোলে খুব কাঁচা!”

সত্যিই এই ঢেউ থেকে অমন বড় বড় ঢেউ জন্মাবে তো? সাবু একটু টেস্ট করে দেখতে চায়। বাথরুমে গিয়ে ওর ওয়াটার বটল থেকে এক ছিপি বার করে খুব ভয়ে ভয়ে চোখ বুঁজে বালতির জলে মেশায়। চোখ বুঁজেই থাকে। এক্ষুণি বালতির জল ফুলে ফেঁপে হুলুস্থুলুশ ঘটিয়ে ছাড়বে। খানিক চোখ বন্ধ রেখে যখন বোঝে, কোন সাড়াশব্দ নেই, তখন আলগা করে একটা চোখ খোলে। তাকিয়ে দেখে বালতির জল যেমন ছিল, তেমনি আছে।

সাবু এই কথাটা শুনলেই দুঃখ পায়। কিন্তু এখন প্রতিবাদ করার সময় নয়। হাঁস বলে, “প্রতিদিন বাহান্ন মিনিট বেশি সময় লাগে। পৃথিবীর তুলনায় চাঁদ তেরো ডিগ্রি এগিয়ে যায় কিনা? তিনশো ষাট ডিগ্রিকে সাতাশ দিয়ে ভাগ করে দেখো, তেরো হয়। চাঁদ পৃথিবীকে সাতাশ দিনে একবার আবর্তন করে। আর পৃথিবী নিজেকে চব্বিশ ঘন্টায় একবার আবর্তন করে। সেই হিসেবে তেরো ডিগ্রি ঘুরতে পৃথিবীর বাহান্ন মিনিট লাগবে।”

সাবু কিছুই বুঝল না। খানিক হাঁ করে থেকে হাঁস কে বলে, “তুমি এত ভূগোল জানলে কী করে?”

হাঁস হেসে বলে, “বাঃ রে! আমাদের না জানলে চলে? সেই কোন সাইবেরিয়া থেকে, প্রতি বছর তোমাদের দেশে আসি। ভূগোলের জ্ঞান না থাকলে, পথ চিনে আসতে পারতাম?”

সাবু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, সাইবেরিয়া কী? পাছে হাঁসটা আবার হেসে ওঠে, তাই কিছু বলে না।    

পরদিন সন্ধে থেকে সাবু অপেক্ষায় আছে, কখন নিথুর আসবে? সকাল থেকে নিজের বাক্সটা খুলে খুলে দেখছিল ওয়াটার বটল-টা ঠিক মতো আছে কিনা? বিকেলে খেলতে বাইরে গিয়েছিল, ফিরে এসে হঠাৎ খেয়াল করে বোতলটা নেই। ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গিয়ে থেমে যায়, বললে গুণ নষ্ট হয়ে যাবে। এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে। মা ওকে দেখে বলে, “কিছু খুঁজছিস?”

সাবু প্রায় কেঁদে ফেলে বলে, “জল”

মা অবাক হয়ে বলে, “জলের জন্য কাঁদার কী আছে? আয় খেয়ে যা।”

মায়ের সাথে রান্নাঘরে ঢুকে জল খেতে গিয়ে দেখে, ওর ওয়াটার বটলটা বাসন মাজার জন্য রাখা। ছুট্টে গিয়ে ওটা হাতে নেয়। মা অবাক হয়ে বলে, “ওটা কবে কার পুরোনো জল। ওখান থেকে খাবি না।”

“আমি এই জল খাবো না।”

“বোতলটা দে। কবে থেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওটা ধুতে হবে।”

সাবু মুখ নামিয়ে বলে, “একটু পরে দেব। এখন আমার কাছে থাক।”

মা কিছু বুঝল না। একটা কাচের গ্লাসে জল ভরে এগিয়ে দেয়। সাবু জল না খেয়েই চলে আসে। ঘড়িতে সাতটা সাতটা বাহান্ন বাজতে আর বেশি দেরি নেই। জানালার নীচ থেকে নিথুরের চশমা পরা মুখটা জেগে ওঠে। ওয়াটার বটল পেয়ে খুব খুশি হয়ে চলে যায়। 

সাবুর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। গত কয়েকমাস ধরে ওর একটাই চিন্তা ছিল। এখন মনে হচ্ছে এতদিন পরে সমুদ্রের ঢেউ কাজ করবে তো? সেদিন বাথরুমে তো কিছুই হয়নি।

পরদিন এদিক ওদিক থেকে কোনও খবর আসছে কিনা খোঁজ রাখছে। কিন্তু তেমন কিছু নেই।  

তার পরদিন রাতে আটটা বিয়াল্লিশ মিনিটে প্রবল হড়কা বান নামে। নীলুয়া নদীবাঁধ ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। চারিদিকে লম্ফঝম্ফ লেগে যায়। বড়মামা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। বাড়িতে সবাই টিভির সামনে খবর শুনছে। কোন পাহাড়ের ওপারে নাকি ভীষণ বৃষ্টি হয়ে হঠাৎ করে মেঘ ভেঙে গেছে। সাবু শুধু একা একা জানালার পাশে মিটমিট করে হাসে। এতদিন পরেও বোতলের ঢেউ তাহলে ঠিকই ছিল। ডাবু এসে জিজ্ঞেস করে “কীরে এখানে বসে কী করছিস?”

সাবু হাতে একটা বই নিয়ে, বিজ্ঞের মতো বলে, “পড়ছি”

ডাবু বলে, “কী পড়ছিস?”

সাবু হেসে উত্তর দেয়, “ভূগোল।”

ছবি সৌজন্য: Rawpixel

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

Picture of সৌরভ হাওলাদার

সৌরভ হাওলাদার

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।
Picture of সৌরভ হাওলাদার

সৌরভ হাওলাদার

এক সর্বগ্রাসী হাঁ-করা চোখ নিয়ে, কলকাতা ও সংলগ্ন শহরতলিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌরভের। যা দেখেন, তাই মনে হয় ছুঁয়ে দেখলে ভালো হয়। কিছুটা প্রকৌশল, কিছুটা ছবি আঁকা, ভাষা শিক্ষা, থিয়েটার এমন আরও অনেক কিছু। এভাবেই ভেসে চলা। শৈশবে স্কুল পত্রিকায় হাত পাকিয়ে রেল স্টেশনে দেওয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের পাতা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যিক পত্রিকায় পৌঁছনো। জীবিকার তাগিদে কম্পিউটারের সাথে সখ্য। পাশাপাশি কয়েক মাইল ‘কোড’লেখা চলে সমান্তরাল। কর্পোরেটের হাত ধরে পৃথিবীর কয়েক প্রান্ত দেখে ফেলার অভিজ্ঞতা। সবই উঠে আসে লেখায়। আপাততঃ কলকাতা ও ঢাকা মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com