আমাদের ছোটবেলায় শীতের ছুটি বলতে ছিল অগুন্তি কমলালেবু, বাবার হাত ধরে নিউমার্কেট, চত্বর জুড়ে আলো ঝলমলে ক্রিসমাস ট্রি, আরও একটু এগুতেই নাহুমসের কেকের মিঠে গন্ধ, দল বেঁধে চিড়িয়াখানা বা রাতের পার্কস্ট্রিটে আলো দেখা, দুপুরে ওয়াল্ড্রফে চাইনিজ খাওয়া। শীতের বেলা ছিল এরকমই পাঁচমিশেলি উৎসবে ভরপুর, নলেনের গন্ধে আমোদিত, কেক-পিঠে, পোলাও-মাংসের রেজালা, শেপার্ডস পাই, প্যানথেরাস প্রভৃতি দিয়ে অতি স্বাদু ছোটবেলার সেই ক্রিসমাস। পুজো শেষ হতে না হতে মায়ের তাড়নায় বইপত্র নিয়ে পড়তে বসতে হত কারণ আর কিছু নয়, স্কুল খুলেই ক্লাসে ওঠার বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার শেষে লম্বা ক্রিসমাসের ছুটি থাকত সে সময়ে।
শীতে কলকাতার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার খুব একটা চল আমাদের পরিবারে ছিল না। মাঝে মাঝে শুধু সবাই দল বেঁধে বাবার গাড়ি করে সারাদিনের মতো কাছাকাছি কোথাও যাওয়া হত যেমন ডায়মন্ড হারবার বা আর কোথাও। বাবার দু’ একজন বন্ধুও যেতেন সপরিবার আমাদের সঙ্গে। ওঁদের ছেলেমেয়েরা ছিল আমাদের সমবয়সী। মা আমাদের জন্য লুডো, ব্যাগাডুলি গুছিয়ে নিতেন। গঙ্গানদীর পাড়ে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হত। বড়-ছোট সবাই সে খেলায় যোগ দিতেন। টিফিনক্যারিয়ার ভর্তি করে খাবার নেওয়া হত। ঘাসের ওপরে শতরঞ্চি পেতে বসে কাগজের প্লেটে স্যান্ডউইচ, ডিম সেদ্ধ, মায়ের হাতে তৈরি ফ্রুট কেক দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতাম আমরা। দুপুরে লুচি, শুকনো শুকনো পাঁঠার মাংস, ফুলকপির রোস্ট, টমেটোর চাটনি, আর নলেন গুড়ের সন্দেশ। অন্য কাকিমারাও সারাদিন মুখ চালাবার জন্য কত কিছু করে আনতেন।
একটা সময় আবার আমার আর আমার তিন বছরের বড়ো দিদির শীতের ছুটি কাটত চিত্তরঞ্জন শহরে, হাওড়া স্টেশন থেকে রেলপথে যার দূরত্ব ২৭৩ কিলোমিটার। পাঁচের দশকের মাঝামাঝি আমার সেজকাকা, যাঁকে আমরা কাকামণি বলে ডাকতাম, রেলের চাকরি নিয়ে চিত্তরঞ্জন চলে যান। এই অঞ্চলের খ্যাতি রেল ইঞ্জিন কারখানার জন্য। আসানসোলের পরেই চিত্তরঞ্জন। প্রথমে স্টেশনটির নাম ছিল মিহিজাম। পরে যখন চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন শহরের নামের সঙ্গে স্টেশনের নামও পালটে রাখা হয় চিত্তরঞ্জন।
ছবির মতো সুন্দর রেলওয়ে কলোনি। রেলবাবুদের জন্য গাছগাছালির ছায়াঘেরা সুদৃশ্য একতলা কোয়ার্টার। এলাকা চিহ্নিত হত রেলকর্মীদের চাকরির পদমর্যাদা অনুযায়ী। কর্মজীবনে কাকামণির পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে যে শুধু বাড়ি পাল্টাতে হয়েছে তাই নয়, যেতে হয়েছে অন্য অঞ্চলে যেখানে তিনি প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছেন কর্মস্থলে শুধুমাত্র পদমর্যাদায় তাঁরই সমকক্ষ সহকর্মীদের। কাকামণির সেই সবক’টি বাড়িতেই নানা উপলক্ষে গেছি। প্রতিটি বাড়িই আগের বাড়ি থেকে সুন্দর মনে হয়েছে সবাইয়ের কাছে, কিন্তু আমার মনের মণিকোঠায় কাকার প্রথম কোয়ার্টার আমলাদহি স্ট্রিট নং-২২-এর সাদাসিধে বাড়িটির স্মৃতি আজও উজ্জ্বল।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাকামণি প্রথম যিনি কলকাতার বাইরে চাকরি করতে গেলেন। প্রথম চাকরি, এবং আমার কাকা তখন সবে মধ্য কুড়িতে পা দিয়েছেন। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম তিনি অজানা জায়গায় যাচ্ছেন। আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমার স্বভাবতই তাঁকে নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না। প্রথম কয়েকমাস কাকা মেসবাড়িতে ছিলেন, তার পরে রেলের কোয়ার্টারে। চিঠিতে জানালেন বাগান ঘেরা একতলা ভারী সুন্দর কোয়ার্টার পেয়েছেন তিনি। আমার বাবারা চার ভাই, তিন বোন। বাবা সকলের বড়। এঁদের মধ্যে কাকামণি ছিলেন যাকে বলে বাবা-মায়ের ‘ছোটছেলে’ না হয়েও একেবারে কোলঘেঁষা ছেলে। আমার ঐ বাচ্চাবেলায় দেখেছি দিনের শেষে কাকামণিকে আমার দাদু-ঠাকুমার পাশে বসে তাঁর সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিতে। সেই কাকামণির কোয়ার্টার পাওয়ার খবর আসতেই ঠাকুর্দা স্থির করলেন তিনি ও ঠাকুমা কিছুদিন অন্তত চিত্তরঞ্জনে কাকার কাছে গিয়ে থাকবেন। যৌথ পরিবারে ঠাকুর্দার কথাই শেষ কথা। আমার বড়কাকা ওঁদের জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা করে ট্রেনে করে পৌঁছে দিলেন আমাদের না-দেখা চিত্তরঞ্জনের রেল কলোনিতে। আমার আর দিদির কান্নাকাটিতে মন গলল না কারুর।
ঠাকুর্দা পোস্টকার্ডে নিয়মিত চিঠি লিখতেন আর কাকামণি ইনল্যান্ড খামে। প্রতি চিঠিতে কাকার প্রতিশ্রুতি- শীতের ছুটি পড়লেই তিনি নিজে এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। অবশেষে গরম গড়িয়ে শীত এল আর আমরা কাকামণির অপেক্ষায় স্যুটকেস গুছিয়ে এক্কেবারে রেডি। কাকামণি কথা রাখলেন আর বাবা-মাকে ছেড়ে সেই প্রথম তুফান এক্সপ্রেসে চেপে আমরা রওনা দিলাম চিত্তরঞ্জনের উদ্দেশে।
কাকামণির সঙ্গে রেলকম ঝমাঝম করে বেড়াতে যাওয়া যে কী মজার, সেই প্রথম টের পেলাম। স্টেশনে ট্রেন থামতেই কত রকমের ফিরিওয়ালা কত রকমের সামগ্রি নিয়ে উঠল। গরম সিঙাড়া, মুড়ি বাদামভাজা, হজমি লজেন্স, আরও কত কী। মায়ের হাজারও বারণের কথা রেলগাড়ির জানালা দিয়ে এক ফুৎকারে বেরিয়ে গেল। কাকামণিকে আবদার করে না-জ্বালানোর নিষেধও ছিল তার মধ্যে। অবশ্য আমাদের তেমন কিছু করতেই হল না। আমাদের মতো কাকামণিরও দেখি লজেন্স, ঝালমুড়ি, বাদামভাজা খাওয়ার ঝোঁক যথেষ্ট। তিনজনের সমান ভাগ। মাটির ভাঁড়ে গরম চা-ও সেই প্রথম খাওয়া। আমি একটু ছোট বলে আমার চা-টা কাকামণি ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে করে খাইয়ে দিলেন। মায়ের দেওয়া লুচি-আলুর দম, গুড়ের মিষ্টি খাওয়ার জন্য পেটে আর একফোঁটাও জায়গা রইল না।
যতদূর মনে পড়ে বর্ধমান স্টেশনে ট্রেন অনেকটা সময় থেমেছিল। কাকামণি অন্য সহযাত্রীদের জিম্মায় আমাদের দুই বোনকে রেখে, ঝটপট করে নেমে গেলেন। ফিরে এলেন শালপাতার ঠোঙায় করে বর্ধমানের বিখ্যাত সীতাভোগ মিহিদানা নিয়ে। আহা কী তার সোয়াদ! সবচেয়ে মজা হল যখন কাকামণি তাঁর ঝোলা থেকে লুডোর বোর্ড আর গুটি বের করলেন। এমনিভাবেই মজা, গল্প, খেলায় কেটে গেল ৫/৬ ঘণ্টা সময়। ট্রেন ছাড়তে প্রথমবার মা-বাবাকে ছেড়ে আসবার জন্য আমাদের একটু যে মনখারাপ হচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু কাকামণি এমন সব মজার গল্প বলা শুরু করলেন যে আমরা হেসে খুন।

চিত্তরঞ্জনে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। গায়ে গরমজামা তো ছিলই, হুড-অলা সাইকেল রিক্সায় ওঠার আগে কাকামণি আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও দু’জনকে কানঢাকা টুপি পরিয়ে দিলেন। একটা হালকা ওজনের কিটব্যাগ দিদির কোলে আর কাকামণির কোলে আমি। পায়ের কাছে মাঝারি মাপের স্যুটকেস। আমলাদহি পৌঁছুতে পৌঁছুতে সারা শহরে আলো জ্বলে উঠল। মনে হল যেন দীপাবলীর রাত! হাড় কাঁপানো শনশনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্য দিয়ে সাইকেল রিক্সা চলেছে শোঁ শোঁ করে। হাত আর নাকের ডগা ঠান্ডার দাপটে একটু যেন ব্যথা ব্যথা করছিল। নতুন শহর আর একটু বাদেই দাদু-ঠাকুমার সঙ্গে দেখা হবার উত্তেজনায় শীতের কষ্ট তেমন কাবু করতে পারল না আমাদের। শহরের বেশ কয়েকটি ফটক পেরিয়ে আমাদের গন্তব্য আমলাদহি পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। প্রতি ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকবার জন্য রিক্সা থামিয়ে কাকামণিকে নিজের পরিচয়পত্র দেখাতে হল। কারখানাকেন্দ্রিক শহরকে সুরক্ষিত রাখার জন্যই নাকি পুরো শহর উঁচু প্রাচীর আর তিনটি ফটক দিয়ে ঘেরা আর তার কড়া পাহারায় মোতায়েন রেলপুলিশ। কাকার বাড়ির গেটের কাছে রিক্সা থামতেই নেমে এক ছুট দিলাম মোরাম বিছানো পথ ধরে। বারান্দায় বেতের চেয়ারে টুপি মাথায় দাদু বসে আছেন, পাশে ঠাকুমা। ওঁরা দুজনে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন।

সকালে ঘুম থেকে উঠতেই কাচের জানলা দিয়ে চোখে পড়ল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক মস্ত পাহাড়। মনে হচ্ছিল দু’পা হাঁটলেই ছুঁতে পারব সেই পাহাড়কে। দাদুকে সে কথা বলতেই দাদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “যেতে চাও তোমরা? কিন্তু হেঁটে যেতে পারবে তো?” দুই বোন সানন্দে ঘাড় নেড়ে রাজি! একদিন সকাল সকাল দাদু আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আমাদের পিঠে ঝোলানো রুকস্যাকে ঠাকুমা দিয়ে দিলেন পছন্দের টুকিটাকি খাবার আর জলের বোতল। হাঁটতে শুরু করে বোঝা গেল পাহাড় আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কয়েক যোজন দূরে। আমি তো একটু হেঁটেই রাস্তার ধারের বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। অগত্যা সাইকেল রিক্সাই ভরসা। পাহাড়ের গায়ে গোল করে কাটা রাস্তা ধরে রিক্সা আমাদের পৌঁছে দিল পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে রয়েছে ঢাকা দেওয়া চমৎকার এক বসার ব্যবস্থা। সেই চূড়া থেকে ছবির মতো শহরটিকে দেখতে পেলাম, যেখানে বাড়িঘর, রাস্তা সবই চোখে ঠেকছিল খেলনা বাড়িঘরের মতো। পাহাড়কে দূর থেকে কাছের বলে মনে হওয়াটা যে চোখের ভ্রমমাত্র সেকথা বোঝাতেই ছিল আমাদের নিয়ে ঠাকুর্দার সেদিনকার পাহাড় অভিযান।
অনেকবছর পরে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ ভ্রমণ উপন্যাস ‘পালামৌ’ পড়েছিলাম। সেই গ্রন্থে লেখক তাঁর পর্বত দর্শনের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। “আমি স্পষ্ট দেখিতেছিলাম, পাহাড় অতি নিকট, তথা যাইতে আমার পাঁচ মিনিটও লাগিবে না…, পাঁচ মিনিটের স্থলে ১৫ মিনিটকাল দ্রুতপদবিক্ষেপে গেলাম, তথাপি পর্বত পূর্বমতো সেই পাঁচ মিনিটের পথ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তখন আমার ভ্রম বুঝিতে পারিয়া গাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম।” এই লেখা পড়ে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম এই ভেবে যে পর্বতের দূরত্ব সম্বন্ধে আমার বালিকা বয়সে যে ভ্রম হয়েছিল, পরিণত বয়সে সঞ্জীবচন্দ্রের মতো নামী লেখকেরও সেই একই ভ্রম হয়েছিল।
সত্যিই বড়ো সুন্দর লেগেছিল চিত্তরঞ্জন রেলওয়ে শহরকে। পাহাড়ের গায়ে রেলওয়ে কলোনি। ছোট ছোট টিলা পাহাড়, চড়াই উৎরাই পথ, বাগানঘেরা রেলের কোয়ার্টার। আমার ঠাকুর্দার গাছের শখ ছিল। কাকামণির কোয়ার্টার সংলগ্ন জমিতেও দারুণ বাগান করেছিলেন। টগর, জবা, করবী, অতসী, বেল, জুঁই যেমন ফুটত, তেমনি ফুটত নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, জিনিয়ার মতো মরসুমি ফুল। অনেক সবজিও ফলিয়েছিলেন দাদু। মাটিতে ফুলকপি, ওলকপি, বাঁধাকপি ফলে আছে সেই আমার প্রথম চোখে দেখা। কাঁচালঙ্কা, টমেটো, বেগুনের ভারে ছোট গাছগুলো যেন নুয়ে পড়ত। এক একদিন সকালে একটি ছোট ডালি হাতে দিয়ে ঠাকুমা যখন আমাদের কোনওদিন বেগুন, কোনওদিন লঙ্কা, কোনওদিন শুধু টমেটো তুলে আনতে বলতেন, সেদিন আমাদের আনন্দ দেখে কে! তবে কেন জানি না ফুলকপি, ওলকপি তোলার অনুমতি ছিল না। দাদু নিজে তুলতেন সে সব। বিকেলে এক একদিন দাদুর সঙ্গে লম্বা পাইপে করে গাছে জল দিতাম।

আমাদের পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন মৈত্রকাকু আর মায়াকাকিমা, আমার কাকামণির দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। মৈত্রকাকু রেলের কারখানায় কাজ করতেন আর আমার কাকামণি কাজ করতেন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। কাকামণি যখন আমলাদহির বাড়িতে থাকতে শুরু করেন, তখন থেকেই ওঁদের সঙ্গে পরিচয়। শুনেছি, প্রথমদিকে মৈত্রকাকুরা নাকি আমার কাকাকে রাঁধতে পর্যন্ত দিতেন না। সদা হাস্যময়ী তরুণী কাকিমাটি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের দুই বোনের খেলার সাথী। গজদাঁতের জন্য হাসলে বড় মিষ্টি দেখাত ওঁকে। সাদাসিধে করে মায়েদের মতো শাড়ি পরতেন। আমাদের সঙ্গে হুটোপাটি করে খেলার সময় শাড়ির আঁচল কোমড়ে বেঁধে দৌড়তেন। লুকোচুরি, ব্যাডমিন্টন এমনকী এক্কাদোক্কা খেলাতেও তিনি ছিলেন দারুণ চৌকস। সন্ধ্যের সময় তাঁর বাড়িতে লুডোর আসরে কর্মস্থল থেকে ফিরে কাকারাও যোগ দিতেন। খেলার সঙ্গে চলত চা আর টা। ছুটির শেষে কলকাতায় ফিরে আসার দিন আমাদের সঙ্গে কাকিমাও কেঁদে ভাসাতেন।
ছুটির দিনে কাকামণি এক একদিন নিয়ে যেতেন অজয় নদী দেখাতে। শীতের সময়ে জল খুব কম থাকত নদীতে। কাকামণির হাত ধরে বালির চর পেরিয়ে আমরা নদীর হিমশীতল জলের মধ্যে নেমে যেতাম। জল ছোড়াছুড়ি করে খেলাও হত। নদীর কাছে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে কাকামণি কাজ করতেন। সেখানে বিরাট ফুলের বাগান ছিল। নানা রঙের ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ ফুটে সে বাগান আলো করে রাখত। প্রথম যেবার চিত্তরঞ্জন গিয়েছিলাম সালটা ছিল ১৯৫৪। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই এক শুভেচ্ছা সফরে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। সারা দেশজুড়ে রব উঠেছিল “হিন্দি চিনি ভাই ভাই”। চিত্তরঞ্জনের রেল কারখানা তখন ভারতবর্ষের অন্যতম দ্রষ্টব্য বস্তু। গণ্যমান্য বিদেশি অতিথিদের সফরসূচিতে তাই চিত্তরঞ্জন থাকতই। চৌ-এন-লাইয়ের ভারত সফরের সময়ও তার ব্যতিক্রম হল না।

এই উপলক্ষে সেদিন ছোট্ট শহরটির প্রধান সড়কগুলিতে ফুল দিয়ে তোরণ সাজানো হয়েছিল। বিদেশি অতিথিদের দেখতে রাস্তার দুধারে সারি দিয়ে দাঁড়ানো জনতার মধ্যে কাকামণির সঙ্গে আমরা দুই বোনও ছিলাম। হাতও নেড়েছিলাম বিদেশি অতিথিকে। এখনও মনে আছে চৌ-এন-লাই খোলা গাড়িতে দু’হাত বুকের কাছে জড়ো করে নমস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখে ছিল স্মিত হাসি। কে ভেবেছিল সেদিন যে কয়েক বছরের মধ্যেই দুই দেশের এত বন্ধুতা চির শত্রুতায় পরিণত হবে!
ঠিক এক বছর বাদে সোভিয়েত রাশিয়ার দুই রাজনৈতিক নেতা ও কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও নিকোলাই বুলগানিন ভারতবর্ষে এসেছিলেন। দিল্লি হয়ে নভেম্বরের শেষে কলকাতায় পা রেখেছিলেন ওঁরা। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল ওঁদের। কলকাতার আপামর জনসাধারণ তখন এক অদ্ভুত ক্রুশ্চেভ-বুলগানিন জ্বরে আক্রান্ত। সে জ্বরের ছোঁয়া থেকে আমার পরিবারও ছাড় পায়নি সেবার। সেই বিশেষ দিনটিতে সারা কলকাতাবাসী ব্রিগেডমুখী। শুনেছি আনুমানিক অর্ধকোটি মানুষের সমাগম হয়েছিল সেদিন ব্রিগেডের মাঠে। স্বভাবতই বিদেশি অতিথিরা অভিভূত হয়েছিলেন। আমাদের বাড়ি থেকে আমার দুই কাকা, পিসি, মা আর আমার কিশোর দাদাও গিয়েছিলেন বিদেশি দুই নেতাকে দেখতে। বাদ পড়েছিলাম আমরা দুই বোন।
ক’দিন বাদে রাশিয়ার দুই নেতা যখন রেল কারখানা পরিদর্শন করতে চিত্তরঞ্জনে গেলেন, দিদি আর আমি আগের বারের মতোই শীতের ছুটি কাটাতে ঐ শহরে উপস্থিত। এবারেও কাকামণির উৎসাহে প্রায় ঢিলছোড়া দূরত্ব থেকে ক্রুশ্চেভ-বুলগানিনকে দেখা হল। কলকাতায় ব্রিগেড গ্রাউন্ডে ওঁদের না দেখার দুঃখ, হতাশা দূর হল।

চিত্তরঞ্জনে শীতের ছুটি কাটানোর আর একটি বড় আকর্ষণ ছিল, ঠাকুমার হাতের রান্না। বিকেলে কাকামণির অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। জমজমাট চায়ের আসরে টা হিসেবে আমাদের সব চেয়ে প্রিয় ছিল ঠাকুমার হাতের গরমাগরম মাংসের চপ বা ফুলকপির সিঙাড়া। মৈত্রকাকু, কাকিমাও সে আসরে যোগ দিতেন। আমি লুচি খেতে ভালোবাসি বলে রোববার সকালে এক একেক দিন ঠাকুমা ভেজে দিতেন লুচি-বেগুনভাজা। আবার কোনওদিন হত কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুর দম। ঠাকুমার হাতের মোগলাই পরোটা বা ফ্রেঞ্চ টোস্টের স্বাদ আজও ভুলতে পারিনি। জানুয়ারি মাসে আমাদের স্কুল খুলে যেত। পৌষসংক্রান্তির আগেই তাই আমাদের কলকাতা ফিরে আসার পালা। ঠাকুমার রান্নাঘরে তাই আমরা থাকতে থাকতেই পিঠেপার্বণের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যেত। সারাদুপুর বসে ঠাকুমা কত কী যে বানাতেন, গুণে বলা মুস্কিল। এর মধ্যে অবশ্য আমাদের হট ফেভারিট ছিল- চষিপুলির পায়েস, পাটিসাপ্টা, ঝোলা গুড় আর নারকেল দিয়ে চিতইপিঠে খাওয়া।
শীতের ছুটির একমাস ঘুরে বেড়িয়ে, নানান স্বাদের চমৎকার খাবার খেয়ে, মায়াকাকিমার সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করে, খেলে কোথা দিয়ে যে হূহূ করে দিন কেটে যেত টেরও পেতাম না। বাড়ি ফেরার দিন যত এগিয়ে আসত, তত মন খারাপ। ছুটির শেষের দিকে কাকামণির হাত ধরে চোখের জল মুছতে মুছতে কলকাতা ফিরে আসতাম। আবার এক বছরের অপেক্ষা শীতের ছুটির জন্য।
*ছবি সৌজন্য: Dhaka post, Chittaranjan.blogspot.com
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।
2 Responses
Amra jetam Madhupur e . Shekhan theke
Mihijam Jamtara. Karmatar Deoghar Giridih
Barganda aaro koto jaega. Nostalgia toiri korte Shiddhho hosto Alpona k ke na chen?
রীনাদি! 🙏🙏