ক্রিস্টিনা ল্যাম্বের নাম প্রথম শুনি কয়েক বছর আগে‒ ‘আই অ্যাম মালালা’ বলে একটা বই লিখেছিলেন তিনি, নোবেল বিজেতা মালালা ইউসুফজ়াইয়ের সঙ্গে। তাঁর নতুন বই প্রকাশিত হল ২০২০-তে। ‘আওয়ার বডিজ় দেয়ার ব্যাটলফিল্ড’।
মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে যুদ্ধ চলছে দেশে দেশে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে। মানুষ কোনওদিনই যুদ্ধ ছাড়া থাকেনি। আমাদের যত মহাকাব্য, সবই কিন্তু বীরগাথা। কোনও রোম্যান্টিক গল্প মহাকাব্য হয়ে ওঠেনি কখনও। রোম্যান্স আশেপাশে থাকলেও প্রাধান্য পেয়েছে বীরত্ব। যুদ্ধের মধ্যে বেশ একটা মাচো ব্যাপার আছে। শত্রুপক্ষের কতকগুলো প্রাণ নিয়ে হয় বেরিয়ে এলাম, নয় মারা পড়লাম‒ অর্থাৎ শহিদ হলাম। আর নাহলে আহত হয়ে সেনা হাসপাতালে চিকিৎসারত রইলাম। এই মাচো ব্যাপারটা আছে বলেই প্রথাগতভাবে যুদ্ধ প্রধানতঃ পুরুষদের কাজ বলেই ধরা হয়।
[the_ad id=”266918″]
কিন্তু এই যুদ্ধ বা কনফ্লিক্ট নারীদের কীভাবে প্রভাবিত করে, তা অনুল্লিখিতই থেকে যায়। অনুল্লেখিত, কারণ এ বড় গ্লানির ইতিহাস, মর্যাদাহীনতার ইতিহাস। বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধের কাব্যগাথায় মাঝে মাঝে ‘স্ত্রীধন’ কথাটা পেয়েছি বটে, কিন্তু তার ব্যঞ্জনা বুঝতে পারিনি, চাইওনি কোনওদিন। ‘স্ত্রীধন’ লুণ্ঠন করে একটা গোটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যায়। সংসার বা দেশ তো বটেই। ‘স্ত্রী’ হল ‘ধন’‒ অর্থাৎ সম্পত্তি। লুণ্ঠিত মহিলা যদি আমার সম্পত্তি হয় তাহলে তার অধিকারও সম্পূর্ণ আমার‒ অন্যকে দেব, বিক্রি করব, নাকি কুলুঙ্গিতে বন্ধ করে রেখে দেব, তার অধিকার আর কারও নয়। শুধু আমার। এই বই এটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মনে আছে, শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর আগে দস্যুরা সমস্ত নারীদের লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল‒ কেন? কেন নারীরা লুণ্ঠিত হয়েছে বারবার?
[the_ad id=”266919″]
ক্রিস্টিনা নিজে একেবারে সামনে থেকে যুদ্ধসংবাদ রিপোর্ট করেছেন‒ যথেষ্ট সম্মানিত সাংবাদিক তিনি। নিজে নারী হয়ে নারীদের নিয়ে এই বই লেখা, মনুষ্যত্বের চরম অবমাননাকে একেবারে সরাসরি ফুটিয়ে তোলা‒ আমাদের চোখের সামনে এনে দেওয়া যুদ্ধের এই অনুচ্চারিত অন্ধকার দিকটাকে, অসম্ভব কঠিন কাজ। এর আগে কেউ সেই বিজিত, অপহৃত, লাঞ্ছিত নারীদের ইন্টারভিউ নেননি‒ ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব নিয়েছেন। কঙ্গোর যুদ্ধ, রোয়ান্ডা, বসনিয়া, রোহিঙ্গা, ইয়েজ়িদি মেয়েরা, এমনকী স্তালিনের রাশিয়ান সৈন্যরা বার্লিন দখল নেওয়ার পর যে ভয়ঙ্কর অত্যাচারের মুখোমুখি হয়েছেন সেখানকার মেয়েরা‒ তার কথা আগে কেউ বলেননি। ক্রিস্টিনা বলেছেন।

ক্রিস্টিনা লিখেছেন সেইসব মেয়েদের কথা‒ ইয়েজ়িদি মেয়েদের কথা, যাঁদের ক্রীতদাসী করে রেখেছিল আইসিসের জেহাদিরা। লিখেছেন সেইসব শিশু-কিশোরীদের কথা, যাদের বোকো হারামের সন্ত্রাসবাদীরা অপহরণ করেছিল আর পৃথিবী তাদের মনে রাখতে চায়নি। লিখেছেন কঙ্গোর সেই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কথা, যিনি ধর্ষিতা শিশু, কিশোরী, তরুণী, বৃদ্ধাদের চিকিৎসা করেছেন সারাজীবন, নোবেল প্রাইজ দেওয়ায় হয়েছে তাঁকে, তাঁর কাজের জন্য। ক্রিস্টিনার এই বই পড়তেই হবে রাগ হলেও, নিজেদের অসহায়তার কথা মনে হলেও, কারণ তিনি যা করেছেন, এ যাবৎ কেউ করেনি। এই নামহীন, অবয়বহীন, অচেনা, পরিত্যক্ত মেয়েদের নিজেদের গল্প বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন “As long as we keep silent, we are complicit in saying this is acceptable.”
কঙ্গো ছিল বেলজিয়ামের উপনিবেশ‒ অর্থাৎ রাজা লিওপোল্ডের প্রায় পৈতৃক সম্পত্তি। অবাধ লুণ্ঠন, অত্যাচার, ধর্ষণ এবং ধর্ষকামের এক ঊর্বর জমি হয়ে উঠেছিল এই দেশ। আফ্রিকার অন্যতম ধনী দেশ হতে পারত কঙ্গো। খনিজ সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার এখানে। মোবাইল ফোন, অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যে ব্যবহৃত সমস্ত খনিজের সবচেয়ে বড়ো ভাণ্ডার গোটা পৃথিবীতে, এই কঙ্গোতে। গৃহযুদ্ধ চলছে এখানে গত তিরিশ বছর ধরে। পৃথিবীর কোনও দেশ, কোনও রাষ্ট্রসঙ্ঘের মাথাব্যথা নেই এ নিয়ে। লক্ষ লক্ষ মেয়ে ধর্ষিতা হচ্ছেন রোজ‒ তাতে কার কী এসে যায়?
[the_ad id=”270084″]
শুধু একজন, একটি মানুষ, ডাক্তার‒ কোনও রাজনৈতিক নেতা নন, সাধারণ গাইনিকোলজিস্ট‒ ডেনিস মুকোয়েগে, স্থানীয় লোকেরা তাঁকে ডাক্তার মিরাকল বলে, চেয়েছিলেন একটা পরিবর্তন আনতে। নিরন্তর অত্যাচারের ফলে যে পরিমাণ ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তাঁর পরিণাম হতে পারে সুদূরপ্রসারী। মুকোয়েগে একা চিকিৎসা করেছেন প্রায় পঞ্চান্ন হাজার মহিলার। আরও দু’জন মহিলার সাহায্য নিয়ে তৈরি করেছেন আনন্দ নগরী‒ সিটি অফ জয়। ক্ষতবিক্ষত নারীদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার জায়গা এবং আশ্রয়স্থল।
সত্যি কথা বলতে কি, হিটলারের নৃশংসতা নিয়ে যে পরিমাণ সাহিত্য এবং সিনেমা হয়েছে, তার এক শতাংশও হয়নি স্তালিনের লাল ফৌজের জার্মানি দখল নিয়ে। ক্রিস্টিনা লিখেছেন, গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে লাল ফৌজ কোনও মহিলাকে ছেড়ে দেয়নি। হিটলারের পাপের ফল সুদে আসলে শোধ করেছিল জার্মানির গ্রামের নিরীহ মেয়েরা। মনে পড়ে যায় সলঝেনেৎসিনের কবিতা ‘প্রাশিয়ান নাইটস’-এর কথা‒
“ছোট মেয়েটি খাটে মরে পড়ে রয়েছে
কতজন ছিল সেখানে?
একটা প্লাটুন? হয়তো বা একটা গোটা কোম্পানি।”
প্রসঙ্গত মনে রাখতে হয় সলঝেনেৎসিন নিজে কিন্তু রাশিয়ান লেখক ছিলেন এবং সেই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
[the_ad id=”270085″]
রোয়ান্ডার দুই বোন‒ ভিক্টোরিয়া আর সেরাফিনা। তাঁদের মুখ থেকে শোনা যায় সেই বীভৎস হত্যালীলার কথা। ১৯৯৪ সালের ঘটনা। ১০০ দিনে খুন করা হয়েছিল আট লক্ষ লোককে। মনে আছে তাঁদের‒ রেডিওতে জর্জ মাইকেলের রোম্যান্টিক গান ‘কেয়ারলেস হুইস্পার’ বাজছিল তখন। ক্রিস্টিনা লিখেছেন এই বীভৎসতার কথা। তিনি লিখছেন রোয়ান্ডার সেই মেয়েদের কথা, যাঁরা রাতে বাথরুম যান না বাইরে, ডায়াপার পরে শুতে যান, যাতে রাতে না বেরুতে হয়। লিখেছেন রোয়ান্ডার সেই মহিলার কথা, যিনি পিঠে বাচ্চা বেঁধে পালাচ্ছিলেন, গুলিতে বাচ্চার মাথা চৌচির হয়ে গেলে তাকে ছুড়ে ফেলে দৌড়তে থাকেন।
কোনও মহিলাই নিরাপদ নন যুদ্ধের সময়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে, জার্মান মহিলারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, নাইজেরিয়ায় স্কুলের মেয়েরা, রোয়ান্ডায়, কঙ্গোতে, মধ্যপ্রাচ্যে, চিনে‒ জাপান যুদ্ধের সময়, ফিলিপাইন্সে, আর্জেন্টিনায় জুনটা সরকারের সময়‒ এ বইয়ের পাতায় পাতায় শিউরে ওঠার মতো ঘটনা। ক্রিস্টিনা দেখিয়েছেন, যে আইন থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কোনও শাস্তি হয়নি যুদ্ধকালীন ধর্ষণের জন্যে। রোয়ান্ডার ভিক্টোরিয়া লেখককে বলেছেন‒ “রাষ্ট্রসঙ্ঘ শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছে।” ফিলিপাইন্সে জাপানি সৈন্যদের বর্বরতার স্মারকস্বরূপ একটি মূর্তি বানানো হয়। পরবর্তীকালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অস্বস্তি প্রকাশ করলে অবিলম্বে তা নামিয়ে দেওয়া হয়‒ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বড়ো দায়। বিশেষ করে গরিব দেশে।
[the_ad id=”270086″]
ক্রিস্টিনা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই অপরাধের কিন্তু কোনও শাস্তি ছিল না। প্রথম শাস্তি দেওয়া হয় মাত্র পঁচিশ বছর আগে‒ ১৯৯৭ সালে।
এর মধ্যেই পড়ি সেই বিখ্যাত শ্রিমের কথা‒ যাকে পৃথিবীর লোকে চেনে ‘বি কিপার অফ আলেপ্পো’ বলে। আলেপ্পো শহরে মৌমাছি সংরক্ষণের কাজ করতেন তিনি। আইসিস এসে যখন মহিলা, বিশেষত ইয়েজ়িদি মহিলাদের নিয়ে গেল, তখন এই একেবারে সাধারণ মানুষটি এক চরম দুঃসাহসিক অসাধারণ কাজ করে ফেললেন। যে লোকটিকে রাস্তায় দেখলে দু’বার কেউ তাকাবে না, সেই মানুষটাই মেয়েগুলিকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করলেন। মানে সোজা কথায় সিংহের গুহা থেকে হরিণশিশু তুলে আনা আর কি। কীভাবে করলেন এই অসাধ্যসাধন?

কুর্দ স্মাগলাররা সাহায্য করল। তারা যেত সিগারেট স্মাগল করতে। সেখান থেকে অপহৃত মেয়েগুলোকে আবার অপহরণ করে চার-পাঁচবার ট্রাক বদল করে নিয়ে আসত। অবশ্যই বিপুল অর্থের বিনিময়ে। সব মিলিয়ে ৩৬৭জন মেয়েকে উদ্ধার করেন তিনি। মাঝে মাঝেই মনে হয় হিরো হবার জন্য সিক্স প্যাক্স লাগে না, রে-ব্যানের চশমা লাগে না, লাগে শুধু সাহস, ইচ্ছেশক্তি আর দরাজ মন।
সাংবাদিকতাকে যে সাহিত্য করে দেখানো যায় তা আমরা আগেই দেখেছি স্ভেৎলানা আলেক্সিভিচের বইয়ে‒ চেরনোবিল নিয়ে তাঁর বই মৌখিক ইতিহাস বা ওরাল হিস্ট্রির এক অবিস্মরনীয় দলিল। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান তিনি এই জার্নালিস্টিক সাহিত্যের জন্যে। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয় যে ক্রিস্টিনার অন্যতম প্রিয় লেখকও স্ভেৎলানা আলেক্সিভিচ‒ এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি নিজেই আমাকে বলেছেন। তারও আগে দেখেছি সাহিত্যের এই ধারাকে মূল স্রোতে মিলিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ়। নিজে সাংবাদিক হবার দরুণ তাঁর অন্তত চারটে বই এই ধারায় লেখা। এবং প্রতিটাই জমজমাট‒ শেষ না-করে রাখা অসম্ভব।
[the_ad id=”270088″]
বই আমরা পড়ি আনন্দের জন্য। কিন্তু এই বইটা পড়তে হবে মনখারাপের জন্যে। মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে মানুষ হবার কথা ভাবার জন্য। এই বই সম্বন্ধে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় অক্সফোর্ডের বিশ্বইতিহাসের অধ্যাপক পিটার ফ্র্যাঙ্কোপান লিখছেন “Rape, writes Christina Lamb at the start of this deeply traumatic and important book, is “the cheapest weapon known to man”. Her compassion for those she talks to and deep understanding of how to tell their stories makes this a book that should be required reading for all – even though (and perhaps because) it is not an enjoyable experience.”
আলোচিত বই:
Our Bodies Their Battlefield
Christina Lamb
প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ২০২০
প্রকাশক: Scribner
মূল্য: ১৯৪২ টাকা (হার্ডকাভার)
৪৪৬ টাকা (পেপারব্যাক)
২৬৮ টাকা (কিন্ডল সংস্করণ)
*ছবি সৌজন্য: লেখক ও facebook
ডাঃ শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম আসানসোলে। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা। অতঃপর প্রবাসী। কর্মসূত্রে সুদূর স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত অ্যাবার্ডিন রয়্যাল ইনফার্মারি হাসপাতালে মহিলা ও শিশুবিভাগে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর। বইপড়া, বই সংগ্রহ বাতিক! লেখার অভ্যেস ছোট থেকেই। দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ, সৃষ্টির একুশ শতক, কবিতীর্থ-তে লেখালিখি করেন। বই নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।