একেকদিন খুব ভোরবেলায় কুয়াশায় ঢেকে থাকে চারিপাশ। চেনা রাস্তা, চেনা মাঠের পাশে দাঁড়ালেও মনে হয় যেন পথ হারিয়ে ফেলব। হেমন্ত অরণ্যের চেয়ে মাঘের এই মাঠ, ঘাট, বন-জঙ্গল অনেক অনেক বেশি মায়াবী বলে মনে হয় তখন। খুব চেনা পৃথিবীকে অন্যরকম লাগে। কেবলই মনে হয়, এ যেন কোনও কুহকের দেশ। মনে হয়, এই কুয়াশার চাদর যদি না সরে! চেনা গাছ, ঘাস আর ফড়িঙের রং যদি ফুরিয়ে ফেলি! ভয়ের তো কোনও ব্যাখ্যা থাকে না সব সময়! মানুষী ভয় সব। অকারণ, অবান্তর। এসব ভাবতে ভাবতেই নরম রোদ্দুর ওঠে ধীরে। কুয়াশার পর্দারা সরে সরে যায়। আস্ত একখানা ইজেল হয়ে ধরা দেয় আমার চিরচেনা মাঠ-ঘাট, জলা, জঙ্গল। বীরভূমের জল মাটি আর আকাশের আশ্বাসে পৃথিবীর চেনা গন্ধেরা তখন যেন জেগে ওঠে চারিদিকে।
মাঠের পাশে বসে বসে এই ছবি দেখি সারা দিন ভরে। পৃথিবী কি আসলেই আস্ত একখানা ছবি? এই প্রান্তর, এই গাছ এ কী বিনোদ বিহারীর হাতে আঁকা? ছবির ছায়ায় যেন প্রাণ পেতে চাইছে এই চরাচর। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মনে হয়, মানুষ কি কেবল তার দৃষ্টি দিয়ে ছবি আঁকে? ক্ষীণদৃষ্টির ওপারে কোন সে মানসলোকের সন্ধান পেয়েছিলেন বিনোদ বিহারী? সে কথা আমি এই পার্থিব মন নিয়ে বুঝে উঠতে পারি না সহসা, বুঝে উঠতে চাই আসলে। এই চাওয়ার মধ্যে দিয়ে আসলে আমি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকে ছুঁতে চাই ইন্দ্রিয়াতীত বোধের স্পর্শে। শেষ পর্যন্ত টের পাই, সেই মায়ালোকের সন্ধান আসলে সকলে পান না। কেউ কেউ পান। নইলে কেমন করে বিনোদ বিহারী অমন ছবি আঁকতে পেরেছিলেন? কই, কুয়াশার পর্দা সরে গেলেও আমি তো পারি না! অথচ এমন কুয়াশায় ঘেরা ছিল তাঁর দৃষ্টি। সেই কুয়াশার ওপারে দাঁড়িয়ে কেমন করে রং আর রেখাকে ছুঁতে পারলেন তিনি!

কেবল কি বিনোদ বিহারী? আমি আশ্চর্য হতেও ভুলে যাই ক্রিস্টিন হা’ (Christine Hà) কে দেখে। যাঁর চোখে ভারী কুয়াশার পর্দা টানা, যাঁর কেবলই মনে হয় দৃশ্যমান সমস্ত কিছুই কাচের উপর জমে থাকা বাষ্পের মতো অস্পষ্ট, তিনি কেমন করে এমন আশ্চর্য সব রান্না করেন? তাবড় বিশ্বের মানুষদের অবাক করে দিয়ে পরিবেশনের পাত্র সাজান অপরূপ দক্ষতায়! নিপুণ হাতে ছুরি দিয়ে কুচিয়ে নিতে পারেন প্রয়োজনীয় শাক-পাতা আনাজ। আমায় এসব অবাক করে। অবাক হতে হতে আমি টের পাই ঈশ্বরকণার মতো ওর ভিতরের এই আলোটিকে। সেই আলো জ্বেলেই বুঝি ও পথ চলে আঁধার রাতে।
এই তো সেদিন! আমাদের ছোট্ট ক্রিস্টিন (Christine Hà), মায়ের আদরে বড় হচ্ছিল প্রতিদিন একটু একটু করে। ভারী যত্নে। সায়গন থেকে ওঁর বাবা-মা আমেরিকায় এসেছিলেন ওর জন্মের আগেই। জন্মসূত্রে ভিয়েতনামের হলেও ক্রিস্টিন বড় হচ্ছিল মার্কিন মুলুকেই। ছেলেবেলাটা ভারী সুন্দর ছিল ওর। বাড়িতে আদর স্নেহ পেয়েছিল ঢের ঢের। ওর মা কখনও ওকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয়নি! দেবেই বা কেন! ও তো নেহাতই বাচ্চা তখন। কিন্তু জীবন তো কৈশোর যৌবনের ধার ধারে না! সে তাই কিশোরী ক্রিস্টিনকে মাতৃহারা করে দেয় আচমকা। কী করে ক্রিস্টিন! ভাতের থালায় মাছের ঝোলে যে মেয়ে তার মা’কে খোঁজে, সে কি চাইলেই আস্ত একখানা মানচিত্র খুঁজে পেয়ে যায়? পায় না। বরং চোখের আলো তার নিভে আসে ক্রমে। সমস্ত পৃথিবীটাই তখন ভারী কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই কুয়াশার ওপারে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টিন কেবল ওর মা’কে খোঁজে। মায়ের হাতের স্বাদকে খোঁজে। ইন্দ্রিয় দিয়ে ইন্দ্রিয়াতীত বোধকে খুঁজে নেবার কী আকুলতা! আসলে ও তো কেবল রান্নার নিপুণতাকে নয়, খুঁজতে চেয়েছে ওর মা’কে। কুয়াশার ওপারে সেইটিই বোধহয় ওর একমাত্র আলোকবর্তিকা, ওর ঈশ্বরকণা।

আমেরিকা কেন, পৃথিবীর কোনও প্রান্তেই কোনও মাস্টার-শ্যেফ প্রতিযোগিতায় কুয়াশার ওপারে দাঁড়িয়ে, এমন করে কেউ চাল, ডাল আর আনাজপাতির আলপনা আঁকেনি। রান্নার মুন্সিয়ানায় ও পেরেছে সবাইকে অবাক করে দিতে। ওর কাছে রান্না মানে comfort food. ওর কাছে রান্না মানে মায়ের উত্তাপ। তাই আস্ত একখানা রান্নার বই যখন ও লিখতে বসে, তখন জটিল রান্নার বুনন ওকে দিয়ে দু’কলম লিখিয়ে নিতে পারে না। একখানা রান্নার বই মানে ওর কাছে কেবল রান্নার প্রণালীর বর্ণনা নয়, বরং ওর নিজের জীবনের গল্পও সেখানে বোনা থাকে পশমের ওমে। সেই উত্তাপটুকু দিয়েই তো ও রান্না করে। সেই তো ওর বুকের ভিতরের চুলা। ঝরে পড়া হিজলের চুমার মতো গোল গোল গরম রুটির গন্ধে ও উষ্ণতা খুঁজে নিতে শিখেছে কেবল। ওর রেস্তোরাঁ ‘দ্য ব্লাইন্ড গ্যোট’ সম্পর্কেও ওর বক্তব্য ভারী স্পষ্ট। চেতনা আর ইন্দ্রিয় দিয়ে ও স্বাদ খুঁজে ফেরে। মানুষের পাতে এই রূপ রস গন্ধে ভরা পৃথিবীর উষ্ণতাটুকু ও সাজিয়ে দিতে চায়।
ক্রিস্টিনের রান্নাকে অনেক দূর থেকে দেখেও আমি বুঝতে পারি ও আসলে রান্নার স্পর্শে ওর মা’কে খোঁজে। এ যেন ঋত্বিকের ছবির মতো কোনও এক বুনে চলা অন্তর্বয়ন। বারবার কেবল সেই ফিরে আসা প্রতিধ্বনির পুরাণপ্রতিমা যেন। এমন করেও যে রান্নার ভূগোল নির্মাণ করা যায়, আমরা কি আসলেই ভেবেছিলাম কোনোদিন! স্মৃতি দিয়ে আমরাও রান্না করি বটে। তা হলেও কুয়াশার ওপারে দাঁড়িয়ে রঙের আর আখরের তুলি দিয়ে বুনে তুলবার ক্ষমতা! সে কি সহজ! অথচ দেখুন, ক্রিস্টিন কেবল সহজ সাধারণ কমফোর্ট ফুডের গল্প খুঁজে ফেরে। সেই তো ওর শৈশরের রান্নাঘর, সেই তো ওর ছেলেবেলা। আমাদের নস্টালজিয়া আর হারিয়ে যাওয়া স্বাদের অলিগলি আর রাজপথের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে ওর ‘দ্য ব্লাইন্ড গ্যোট’। সেখানে আমি তো যাইনি কখনও, যাওয়াও হবে না হয়তো। কিন্তু অনেক দূরে বসে বসেও আমি টের পাই— ক্রিস্টিনের কাছে, এই রান্নাটা আসলে একটা চলা। গন্তব্যটা সেখানে মুখ্য নয়। যাত্রাপথটাই সব। সে যেন ফুরোবার নয়। সে পথের ওপারে দাঁড়িয়ে আছেন ওর মা।

একেকদিন হয়তো বা কুয়াশার পর্দা সরে গিয়ে আশ্চর্য রংধনু ওঠে সেই আকাশে। হাঁড়ি, পাতিল, আনাজপাতির ছবি দিয়ে মোড়া সেই আশ্চর্য মায়ালোকের মধ্যে বসে বসে ক্রিস্টিন রান্না করে। কুয়াশারা তখন ভিড় করতে ভুলে যায়। মাঘের সকালেও তখন ওঁর রান্নাঘরখানা বিনোদ বিহারীর ইজেল হয়ে উঠতে থাকে ক্রমাগত।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।