ছবির নাম: মায়েস্ত্রো (Maestro)
প্রকাশকাল: ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
পরিচালনা: ব্র্যাডলি কুপার
মুখ্য ভূমিকায়: ক্যারি মুলিগান, ব্র্যাডলি কুপার
সিনেমাটোগ্রাফি: ম্যাথিউ লিবাটিক
সংগীত : লিওনার্ড বার্নস্টেন

ছবির শেষদিকের একটি অন্যতম, সম্ভবত ছবির সবচেয়ে আলোচিত দৃশ্যে সিনেমাটোগ্রাফার ম্যাথিউ লিবাটিকের ক্যামেরা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানের ডাকোটা অ্যাপার্টমেন্টের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ভেতর। মেসি’স থ্যাংকসগিভিং ডে প্যারেড চলছে, বিশালাকার স্নুপি বেলুন জানলার বাইরে। ভেতরে লিওনার্ড-ফেলিসিয়া ওরফে ছবির ব্র্যাডলি কুপার-ক্যারি মুলিগানের তীব্রতম তর্কাতর্কির মুহূর্ত, যা খুব শান্তভাবে শেষ হচ্ছে স্বামীর দিকে ছুড়ে দেওয়া ফেলিসিয়ার শান্ত অভিশাপে – ‘If you are not careful, you’re going to die a lonely, old queen’। আক্ষরিকভাবেই সিগনেচার। এই সিগনেচার প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আরও পড়ুন: ‘পাস্ট লাইভস’ – স্থাপত্য, সম্পর্ক এবং অনিশ্চয়তার মনোলগ
‘Maestro’। ২০২৩-এর ডিসেম্বরে নেটফ্লিক্সে আসা এই ছবি ‘A Star is Born’-এর পর অভিনেতা-পরিচালক ব্র্যাডলি কুপারের পরবর্তী ভেঞ্চার— মার্কিন দিকপাল কম্পোজার-কন্ডাক্টর লিওনার্ড বার্নস্টেনের বায়োপিক। অবশ্য ততটা বায়োপিক নয়, যতটায় জিনিয়াস সুরকারের মিউজিকাল জার্নিটা ডিটেইলে ধরা যায়। বলা ভালো, ব্র্যাডলি অনেক বেশি ধরতে চেয়েছেন মানুষটার ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর স্ত্রী চিলি-কোস্টারিকা জাত অভিনেত্রী ফেলিসিয়া মন্টিলিগারের সঙ্গে লিওনার্ডের তিন দশকের দাম্পত্য, লিওনার্ডের একাধিক ঘোষিত-অঘোষিত সমকামী সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব পেরিয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা…
কীভাবে গল্প এগিয়েছেন ব্র্যাডলি? তার আগে একটু প্রাক-কথন হয়ে যাক।

লিওনার্ড বার্নস্টেনের বায়োপিকে প্রযোজকের তরফে মার্টিন স্করসেসের পরিচালনা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেও পরে ‘আইরিশম্যান’ ছবির ব্যস্ততার জন্য তা চলে আসে স্পিলবার্গের কাছে। পরে তাও বাতিল হলে অভিনেতা হিসেবে আগেই কাস্টিং হয়ে যাওয়া ব্র্যাডলি অফার করেন নির্দেশকের দায়িত্ব নেওয়ার। ‘আ স্টার ইজ বর্ন’-এর পর এ ব্যাপারে আরও বেশি করে উৎসাহ জোটে পরে ছবির সহ-প্রযোজকের তালিকায় নিজেদের রেখে দেওয়া স্করসেস বা স্পিলবার্গের কাছ থেকে। চিত্রনাট্যে জোস সিঙ্গারের সঙ্গে ব্র্যাডলি নিজে কলম ধরেছেন। কখনও এডিট টেবিলে রাতদিন এক করেছেন তরুণী সম্পাদক মিশেল টোশোরোর সঙ্গে। পরিচালক ড্যারেন আরনভস্কি-র সঙ্গী হয়ে একাধিক ছবিতে কাজ করা সিনেমাটোগ্রাফার ম্যাথিউ লিবাটিকের সঙ্গে ব্র্যাডলির জুটি বাঁধার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আগের ছবিতেই। সেই সাবলীলতা, স্বাধীনতার সঙ্গে এ ছবির অন্যতম প্রাপ্তি মেক-আপ শিল্পী কাজু হিরো বা কে. জর্জিউ। প্রসঙ্গত, এখানেই ‘ইহুদি সুলভ’ প্রস্থেটিকে দীর্ঘ নাক ব্যবহার করার জন্য কাজু হিরো সমালোচিত হলেও বিভিন্ন বয়সের লিওনার্ড বার্নস্টেনকে যেভাবে ধরিয়েছেন টিম মায়েস্ত্রোর মেক-আপ শিল্পীরা, কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।
এ পর্যন্ত তো হল, কিন্তু ছবি? গল্প?

শুরু থেকেই গল্পের গতি চোখে পড়বে। পুরোটাই রেমিনিসেন্স। ‘আ কোয়াইট প্লেস’ অপেরা’র টোনের সঙ্গে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্ত্রী প্রসঙ্গে সত্তরোর্ধ লিওনার্ড বলছেন— “আমি ওকে দেখতে পাই। আমার সন্তানেরা আমাকে হিংসে করে, কারণ ওরা ওকে দেখতে পায় না।” সেই দেখার গল্পে অ্যাসপেক্ট রেশিও বদলে সাদাকালোয় গল্প বলা– ১৯৪৩ সালে নিউ ইয়র্ক ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রায় ব্রুনো ওয়াল্টারের অসুস্থতার সুযোগে সহকারী কন্ডাক্টর বছর পঁচিশের লিওনার্ড বার্নস্টেনের এক অভাবনীয় সুযোগ, খ্যাতি, ক্ল্যারিওনিস্ট সমকামী বন্ধু ডেভিড ওপেনহেইমের প্রসঙ্গ এবং এক সিগনেচার দৃশ্যে অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে ক্রমশ একটি পার্টির ভেতর ঢুকে আসা ফেলিসিয়া ওরফে পর্দার এপারের এনিগম্যাটিক ক্যারি মুলিগানের প্রবেশ। তারপর অবধারিত প্রেম।
‘আ কোয়াইট প্লেস’ অপেরা’র টোনের সঙ্গে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্ত্রী প্রসঙ্গে সত্তরোর্ধ লিওনার্ড বলছেন— “আমি ওকে দেখতে পাই। আমার সন্তানেরা আমাকে হিংসে করে, কারণ ওরা ওকে দেখতে পায় না।” সেই দেখার গল্পে অ্যাসপেক্ট রেশিও বদলে সাদাকালোয় গল্প বলা
লিওনার্ড বার্নস্টেনের একাধিক মিউজিকাল রেন্ডারিং-এ সেই গল্প এগিয়েছে। এসেছে নেগেটিভিটি। বিবাহোত্তর লিওনার্ডের সঙ্গে মিউজিক্যাল স্কলার টম কথর্যানের সমকামী সম্পর্ক, ফেলিসিয়ার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ এবং একটি সিগনেচার দৃশ্যে লিওনার্ড বার্নস্টেনের বিশাল দৈত্যাকার ছায়ার পাশে ছোট, খুব ছোট ফেলিসিয়ার শান্ত, আড়ালে থাকা সাদা-পোশাকের শরীর। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর একটি উল্লেখযোগ্য আলোচনায় ফিল্ম-ক্রিটিক অ্যান হর্নাডে বলছেন – ‘Maestro isn’t a Great Man tale – if anything – it’s an ode to a Great woman.’ জিনিয়াসের পাশে ঠিক মিউজ না, বরং নিজস্ব এক প্রভায় বরাবর উজ্জ্বল ছিলেন ফেলিসিয়া। ‘লোনলি, ওল্ড কুইন’- ছুড়ে দেওয়া সাবধানবাণী দেরি করে হলেও বুঝতে পেরে একসময় ফিরে এসেছিলেন স্বামী। স্তন থেকে ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়া ফেলিসিয়ার মারণ ক্যানসারের শেষ দুবছরের লড়াইয়ে প্রতি সেকেন্ডে এক হয়ে গেছিলেন লিওনার্ড-ফেলিসিয়া, প্রাক-ইতিহাস ভুলে। স্ক্রিন-টাইমে খুব স্বল্পসময়ের জন্য হলেও ‘মায়েস্ত্রো’ সেই সময়টা ধরিয়েছে অদ্ভুত মায়াবি টোনে। গতি কমিয়ে কাছে এনেছে দুজন মানুষকে।

খুব ভুল হবে না হয়তো, যদি বলি, পরিচালক ব্র্যাডলি কিছুটা হলেও হেরে গেছেন অভিনেতা ব্র্যাডলির কাছে। বিভিন্ন বয়সের আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি, কখনও স্মার্ট ঝকঝকে প্রেমিক, বা স্বার্থপর ক্রিয়েটিভ অ্যালকোহলিক মিউজিশিয়ান অথবা স্ত্রী-সেবায় আত্মনিমগ্ন এক মধ্যবয়সী — চরিত্রায়ণ, ভয়েস মডিউলেশন — ব্র্যাডলি কুপার নিখুঁততম। এবং অবশ্যই ক্যারি মুলিগান, সম্ভবত এ প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। বলা হচ্ছে ‘মায়েস্ত্রো’ তাঁর কেরিয়ার-বেস্ট। ২০১৮-র পল ড্যানো-র ‘ওয়াইল্ডলাইফ’ বা ২০২১-এর সাইমন স্টোনের ‘দ্য ডিগ’কে সেইসময় ক্যারির কেরিয়ার-বেস্ট বলেছিলেন একাধিক ক্রিটিক। এবছর ‘মায়েস্ত্রো’-কে বলা হচ্ছে। এখানেই হয়তো জিনিয়াসের বিবর্তন। ক্যারি ক্রমশ ছাপিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে। এই লেখার শুরুতেই বলা দীর্ঘ কথা-কাটাকাটির ওই দৃশ্যে, বা ছবির শেষে মারণ রোগাক্রান্ত শীর্ণকায় এক নারীর বারবার নাকের রক্ত মোছার এক অসম্ভব দৃশ্যে কিংবা সামগ্রিকভাবে জিনিয়াস স্বামীর আড়ালে থেকেও আলাদা করে ফেলিসিয়া মন্টিলিগারর চারিত্রিক দৃঢ়তা ফুটিয়ে তোলা – ক্যারি মুলিগানের জন্য কোনও ভাষাই যথেষ্ট নয়।
এবং অবশ্যই ক্যারি মুলিগান, সম্ভবত এ প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। বলা হচ্ছে ‘মায়েস্ত্রো’ তাঁর কেরিয়ার-বেস্ট। ২০১৮-র পল ড্যানো-র ‘ওয়াইল্ডলাইফ’ বা ২০২১-এর সাইমন স্টোনের ‘দ্য ডিগ’কে সেইসময় ক্যারির কেরিয়ার-বেস্ট বলেছিলেন একাধিক ক্রিটিক। এবছর ‘মায়েস্ত্রো’-কে বলা হচ্ছে। এখানেই হয়তো জিনিয়াসের বিবর্তন। ক্যারি ক্রমশ ছাপিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে।
ম্যাথিউ লিবাটিকের নৈর্ব্যক্তিক এবং কখনও নিজেই এক চরিত্র হয়ে যাওয়া ক্যামেরাও হয়তো এ ছবির একটি চরিত্র, এবং পাশাপাশি অন্যতম চরিত্র লিওনার্ড বার্নস্টেনের একাধিক কম্পোজিশন – বিশেষ করে ১৯৭৩-এর এলি ক্যাথিড্রালে গুস্তাভ মাহ্লারের ‘রেজারেকশন সিম্ফনি’-র কিংবদন্তি মিউজিকাল কন্ডাকশনের একটি দীর্ঘ দৃশ্যসহ ছবির একাধিক সাংগীতিক মুহূর্ত গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। গতি কমিয়ে-বাড়িয়ে স্টিয়ারিং ধরেছেন প্রয়াত সুরকার নিজেই। ছবির ক্রেডিট রোলের ঠিক আগে ধরা পড়েছে বৃদ্ধ জিনিয়াসের পুরনো ফুটেজ, পূর্ণতা পেয়েছে মায়েস্ত্রো। এই সবকিছুর সামগ্রিক পরিণতি— বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, অভিনেতা, অভিনেত্রীর বিভাগ সহ মোট সাতটি অস্কার মনোনয়ন।

তাই, কোথাও কোথাও যখন পড়ছি, লিওনার্ড বার্নস্টেনের মিউজিকাল জীবন বা তার ডিটেইলকে সেভাবে ধরতে পারল না ব্র্যাডলি কুপারের ‘মায়েস্ত্রো’, তখন মনে হয় ‘মায়েস্ত্রো’-কে বুঝতে কোথাও ভুল থেকে যাচ্ছে। এ ছবি তো সাংগীতিক রঁদেভু-র গল্প নয়, বরং নেগেটিভিটি পেরিয়েও কোথাও আলো খুঁজতে চাওয়া হতবাক আত্মার গল্প— আয়নার কাছাকাছি দাঁড়ানোর গল্প। আত্ম-সমীক্ষা আর আত্মা-সমীক্ষার গল্প। ছবির মাঝে একটি সাক্ষাৎকারেই এর নির্যাসটুকু দেওয়া। তরুণ, খ্যাতির শিখরে থাকা লিওনার্ড বার্নস্টেন বলছেন – ‘I think man is just this trapped animal, he’s a victim of his own greeds and follies. Either one believes in the divine element in this or one doesn’t. As long as I believe it – which I assume is why I love people so much then I have to believe that, in some remote corner of my soul there is a way out.’
‘মায়েস্ত্রো’ সেই ওয়ে-আউট, সেই রাস্তা খোঁজার সেলিব্রেশন …
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Netflix, Facebook
অনির্বাণ ভট্টাচার্য পেশায় প্রসারভারতীর অধীনে দিল্লি দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রোগ্রাম একজিকিউটিভ। লিখেছেন গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ। বিশেষ আগ্রহ - চলচ্চিত্র, প্রাচীন স্থাপত্য, মন্দির-শিল্প এবং ক্রীড়াজগত।