প্রতি বছর ১৯ অগস্ট পালন করা হয় বিশ্ব পর্বতারোহণ দিবস (Global Climbing Day)। সারা পৃথিবীর পর্বতারোহী এবং অভিযাত্রীদের জন্য এটি একটি বিশেষ দিন। ভারতের বিশিষ্ট পর্বতারোহী, এভারেস্টজয়ী দেবাশিস বিশ্বাস আজকের দিনে বাংলালাইভের জন্য সদ্য সমাপ্ত লেনিন পিক অভিযানের (climbing Lenin Peak in Kyrgyzstan) গল্প বললেন।
পিছনে অনেকটা নীচ থেকে একটা সিটির আওয়াজ কানে আসতেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। চারপাশ ঘন কালো অন্ধকার– যেন আদি দিগন্ত কালো কালি লেপে দিয়েছে কেউ। অনেকটা নীচে দুটো আলোর ফুটকি। ও দুটি মলয় আর সঙ্গের গাইড ইসু রাই এর হেড টর্চের আলো।
বুঝলাম কোন প্রয়োজন পড়েছে, তাই আমাদের দাঁড়াতে বলছে। আমার ঠিক সামনেই আর এক গাইড– সিঙ্গি তামাং। এরা দুজনেই নেপালি গাইড। সিটির আওয়াজ ওর কানেও গেছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি সামনে গিয়ে বললাম, উন লোগো কো আনে দিজিয়ে।
কিছুটা সময় লাগল ওদের আমাদের কাছে উঠে আসতে। কাছে আসার পর মলয় বলল, পায়ে একটা চোট লেগেছে, আমার চলতে অসুবিধা হচ্ছে।
মাত্র সামান্য রাস্তাই এসেছি, অনেকটা পথ চলা বাকি। রাত আড়াইটেয় রওনা দিয়েছি ক্যাম্প থ্রি থেকে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, তার উপর একটানা বয়ে চলেছে ঝড়ো হাওয়া; উড়ছে তুষার কুচি। বুঝলাম বাকি পথ এভাবে ওঠা মলয়ের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাই ওকে আর বাকি রাস্তা চলার জন্য উৎসাহিত করার চেষ্টা করলাম না। ইসুকে বললাম তোমরা সাবধানে ফিরে যাও, আমরা শৃঙ্গের দিকে ওঠার চেষ্টা করছি।
এসেছি কিরগিজস্তানের পামির মালভূমির পিক লেলিন (Lenin Peak) আরোহণ করতে।

প্রতিবছরই পর্বতারোহণের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ি, কিন্তু এবারের অভিযান ছিল কিছুটা অন্য ধাঁচের। প্রতিবার কোনও নির্দিষ্ট শৃঙ্গ বা নির্দিষ্ট এলাকা টার্গেট করে বের হই, কিন্তু এবার ভেবেছিলাম একটু অন্যভাবে ঘুরে বেড়াব কিরগিজস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে, মন ভরে দেখব পামির মালভূমির (Pamir Plateau) বিস্তীর্ণ এলাকা। কিরগিজস্তানের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন এর অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভরে নেব; স্বাদ নেব সে দেশের খাবারের ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর সেইসঙ্গে চেষ্টা করব পামিরের বিভিন্ন শৃঙ্গ আরোহণের।
এই উদ্দেশ্যেই রওনা দিয়েছিলাম কলকাতা থেকে। প্রাথমিকভাবে আমাদের অভিযান ছিল ইন্দো-বাংলাদেশ জয়েন্ট এক্সপিডিশন। দল গঠন হয়েছিল পাঁচজন ভারতীয় আর দুজন বাংলাদেশি আরোহী নিয়ে। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে দুই বাংলাদেশী বন্ধুর ভিসা বাতিল করে দেয় কিরগিজ সরকার। পাঁচ জনের দল হয়– মলয় মুখার্জি, সৌরভ সিঞ্চন মণ্ডল, অভিজিৎ রায় (রাজা), কিরণ পাত্র ও আমি।
২৪ শে জুন আমরা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে প্রথমে পৌঁছই দিল্লি। তারপর দিল্লি থেকে এয়ার আস্তানা এর ফ্লাইটে প্রথমে যাই কাজাকিস্তানের আলমাটি; সেদিনই আলমাটি থেকে এয়ার আস্তানা এর আরেকটি ফ্লাইটে পৌঁছে যাই কিরগিজস্তানের রাজধানী বিসকেক।
বিসকেকের এয়ারপোর্ট বেশ ছোট, এয়ারপোর্টের নাম মানস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহর প্রায় ৩০ কিলোমিটার। আগে থেকেই দু একটি এজেন্সির সঙ্গে কথাবার্তা, ই-মেইল চালাচালি হয়েছে। তাদেরই একজন একটা বড় সেভেন সিটার গাড়ি এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দিল। থাকার জন্য বিসকেকে প্রচুর হস্টেল রয়েছে। সেখানে মাথাপিছু সামান্য খরচে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হস্টেলগুলোতে থাকার মজা এই যে, এখানে রান্না করে খাওয়া, জামা কাপড় কাচা ইত্যাদির সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধাগুলো থাকে। নিজের বাড়ির মতো করেই থাকা যায়।

প্রথম দু’দিন রাজধানী ঘুরে দেখলাম। ক্যাব বুক করার লোকাল অ্যাপ মোবাইলে লোড করে নিলাম। যখন যেখানে যেতে হচ্ছে অ্যাপ দিয়ে বুকিং করে নিচ্ছি, চটজলদি চলে আসছে গাড়ি। লোকজন মূলত রাশিয়ান আর কিরগিজ ভাষায় কথা বলে, ইংরেজি বলা কিংবা বোঝার লোক প্রায় নেই বললেই চলে। কলকাতা ছাড়ার আগেই মোবাইলে ইংলিশ থেকে রাশিয়ান কনভার্ট করার অ্যাপ লোড করে নিয়েছিলাম। প্রয়োজনমতো সেই অ্যাপে আমাদের বক্তব্য রাশিয়ান ভাষায় পরিবর্তন করে লোকজনকে তা দেখিয়ে কাজ চালাচ্ছি। দেখলাম সাধারণ লোক বেশ হাসিখুশি, মিশুকে। কোনও কিছু জানতে চাইলে ভাষা না বোঝার জন্য কোনওরকম বিরক্তি কারও চোখে মুখে দেখলাম না, সবাইকে বেশ অতিথিবৎসল বলেই মনে হল– সে সাধারণ পথচারী, দোকানদার কিংবা পুলিশ; এমনকি ট্যাক্সির ড্রাইভার, যেই হোক।
সবার আগে বলতে হয় আমাদের হোস্টেলের মালকিনের কথা– ২৬-২৭ বছরের বেশ সুন্দর ছিপছিপে এক মেয়ে। নামটিও ভারী মিষ্টি– ‘নারী’। আমাদের সব সমস্যার যেন মুশকিল আসান সে। তার থেকেই এক এক করে বেশ কিছু লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হল। খোঁজ পেলাম কিছু ট্যুর অপারেটর এজেন্সির। কিন্তু তাদের সবাই কালচারাল ট্যুর করায়, ট্রেকিং বা পর্বতাভিযান এখানে একদমই জনপ্রিয় না। অনেক খোঁজ করে যে দুই একটা অ্যাডভেঞ্চার সংক্রান্ত এজেন্সির খোঁজ পেলাম, তারা সবাই এদেশে পর্বতাভিযান বলতে শুধুমাত্র পিক লেনিন বোঝে, শুধুমাত্র সেখানেই অভিযান হয়। অথচ সমস্ত কিরগিজস্তান জুড়ে বিভিন্ন পর্বতমালা রয়েছে সেসব পর্বতমালায় রয়েছে অনেক শৃঙ্গ। ভেবে এসেছিলাম দেশ ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে সেসব শৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা করব। সে ব্যাপারে ওদের কেউ কোনও আলোকপাত করতে পারল না। ভেবেছিলাম ভারতবর্ষ কিংবা নেপালের মতো এখানে এসব অভিযান সংঘটিত করার মতন কিছু এজেন্সি পাব যেখান থেকে জোগাড় হবে প্রয়োজনীয় গাইড এবং আরোহণের অন্যান্য সাজ সরঞ্জাম। কিন্তু হতাশ হলাম। অবশেষে আক-সাই ট্রাভেল নামের এক এজেন্সির খবর পেয়ে তাদের অফিসে ছুটলাম।

আমার ভাবনায় ছিল প্রথমে বিসকেকের কাছাকাছি রয়েছে যে আলা আর্চা ন্যাশনাল পার্ক, সেখানে গিয়ে সেখানকার পর্বতমালার একটি কিংবা দুটি শৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা করব। এরপর যাব কারাকুল শহরে। তার কাছে রয়েছে আর এক পর্বতমালা। সেখানে আরোহণ করার চেষ্টা করে শেষে যাবো এদেশের প্রাচীনতম শহর ওস। সেখান থেকে আরও দক্ষিণে গিয়ে পিক লেনিন এবং তার সঙ্গে আশেপাশে থাকা শৃঙ্গগুলোর ভিতর যে কটা সম্ভব হয় আরোহণের চেষ্টা করব। আক-সাই ট্রাভেলকে আমাদের পরিকল্পনা জানানোতে তারা জানালো, তারা শুধুমাত্র পিক লেনিনে আমাদের সহযোগিতা করতে পারে, অন্যান্য শৃঙ্গ গুলোর ক্ষেত্রে তারা কোনরকম সাহায্য করতে পারবে না। বুঝতে পারলাম আমাদের একলা চলো রে নীতি নিতে হবে। ঠিক করলাম আমাদের পরিকল্পনা মাফিক আমরা নিজেরাই চলে যাব এক এক জায়গায়। সেখানে গিয়ে নিজেরাই খোঁজার চেষ্টা করব সেখানকার লোকাল গাইড, পর্বতারোহনের সাজসরঞ্জাম। তারপর এগিয়ে যাব এক একটা শৃঙ্গের দিকে।
বিসকেক থেকে একটা সেভেন সিটার গাড়ি ভাড়া করে চলে গেলাম আলা আর্চা ন্যাশনাল পার্ক। পার্কের রেইটজেক-এর ট্রেকার্স হাটে আশ্রয় নিলাম। এখানে রয়েছে আলা টু পর্বতমালা। কলকাতা থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম এই এলাকার দুটি শৃঙ্গ– মাউন্ট করোনা আর মাউন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আরোহণের চেষ্টা করব। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম ওই দুটি শৃঙ্গ অত্যন্ত দুর্গম এলাকায়, সেখানে যেতে প্রয়োজন ভাল গাইড আর পর্বতারোহনের প্রচুর সরঞ্জাম। সেসব ছাড়া ওখানে যাওয়া অসম্ভব। আর ওই দুটি শৃঙ্গ এতটাই দুর্গম এলাকায় যে অন্তত ৭ থেকে ১০ দিন প্রয়োজন এক একটি শৃঙ্গ আরোহণে। অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু গাইড আর পর্বতারোহণের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম– কিছুই পাওয়া গেল না। আমাদের পাঁচজন ছাড়া সাকুল্যে আর তিন চার জন অভিযাত্রীকেই চোখে পড়ল; অতিরিক্ত গাইড এখানে মিলবে কোথা থেকে!! দেখলাম এখানে যারা আসে তাদের বেশিরভাগ আরেকটু এগিয়ে যে আক-সাই গ্লেসিয়ার (Ak-Sai glacier) আছে সেটা অবধি যায়।

খোঁজ নিয়ে রেইটজেকের কাছাকাছি অন্য তিনটে শৃঙ্গের সন্ধান পেলাম – মাউন্ট রেইটজেক (Mt Reitzek), উচিটেল (Mt Uchitel) আর বকস্। তিনটে শৃঙ্গই আরোহণ হয় এই জায়গাটিকে বেস ক্যাম্প বানিয়ে। অর্থাৎ এখান থেকে এক একদিনে এক একটা শৃঙ্গ আরোহণ করে নেমে আসে এখানে। আরও জানতে পারলাম, হোটেলের দেখভাল করার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত, সেই রাশিয়ান ছেলে ভ্লাদিমির গাইড এর কাজ করে। এবার ওকে ধরে পড়লাম। অনেক সাধ্য সাধনার পর ও আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হল, তবে শুধুমাত্র উচিটেল শৃঙ্গের জন্য।
ঠিক হলো এখান থেকে পরদিন আমরা ভোর চারটের সময় শীর্ষের উদ্দেশ্যে রওনা দেব। সেই মতন রওনা দিয়ে প্রায় সাত ঘন্টা একটানা খাড়া উঠে ২৯শে জুন, ২০২৩ বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটা নাগাদ প্রথম ভারতীয় দল হিসেবে আরোহণ করি তিয়েন সান পর্বতমালার (Tian Shan mountain range) ৪,৫৪০ মিটার উচ্চতার মাউন্ট উচিটেল। উচিটেল এক রাশিয়ান শব্দ, যার অর্থ ‘শিক্ষক’; তাই এটি মাউন্ট টিচার নামেও পরিচিত। আমরা পাঁচজনই আরোহণ করি উচিটেল।
পরদিন ভ্লাদিমিরকে ফের রাজি করাতে লেগে গেলাম মাউন্ট রেইটজেক আর বকস্ শৃঙ্গে যাবার জন্য। কিন্তু কোনওভাবেই, এমনকি অতিরিক্ত ডলারের লোভ দেখিয়েও ওকে রাজি করা গেল না। ওখানে থেকে কোনও লাভ হবে না বুঝতে পেরে বিসকেক ফিরে এলাম।
ফের নারীর হোস্টেল। শুরু হল পরবর্তী পরিকল্পনার ভাবনাচিন্তা। প্রতিদিন পরিচিতির সংখ্যা বাড়ছে, তাদের কাছ থেকে একটু একটু করে জেনে নিচ্ছি দেশটার খুঁটিনাটি। আর আমার বিভিন্ন রকম কৌতুহল মেটানোর জন্য হাতের কাছে নারী তো রয়েছেই।

বেশ ছোট দেশ এই কিরগিজস্তান (Kyrgyzstan)। আয়তন দু’লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের থেকেও কম, আর জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ– তার মধ্যে একটা বড় অংশ থাকে বিদেশে। জনসংখ্যার ৭৭.৫ শতাংশ মানুষ কিরগিজ, প্রায় ১৪ শতাংশ উজিবেক আর ৪ শতাংশ রাশিয়ান। দেশের নব্বই শতাংশ মানুষ মুসলিম ধর্মাবলম্বী, সাত শতাংশ খ্রিস্টান। দেশে দুটো সরকারি ভাষা– কিরগিজ আর রাশিয়ান।
কিরগিজস্তানের মুদ্রার নাম সোম, মূল্য আমাদের টাকার থেকে কিছুটা কম। বর্তমানে ১ ডলার এর মূল্য যেখানে আমাদের ৮৩ টাকা, সেখানে এক ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যায় ৮৮ – ৯০ সোম।
কিরগিজস্তান (Kyrgyzstan), কাজাকস্তান (Kazakhstan), উজবেকিস্তান (Uzbekistan) প্রভৃতি দেশগুলো একসময় সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্গত ছিল। ১৯৯০ এর দশকে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ-এর আনা পেরেস্ত্রোইকা এবং গ্লাসনস্ত নীতির প্রভাবে এই দেশগুলো এক এক করে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বেরিয়ে যায়। এই দেশ রাশিয়ার থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯৯১ সালের ৩১ শে আগস্ট।

বিসকেকের এয়ারপোর্টের নাম– মানস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। মানস কিরগিজস্তানের এক কিংবদন্তি নায়ক। প্রাচীন তথ্য অনুসারে দশম শতাব্দীর একজন কিংবদন্তি বীর মানস। মানস এক মেষপালকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। এবং অতি অল্পবয়সেই এক মহান যোদ্ধা হয়ে ওঠেন। নিষ্ঠুর, দুর্ধর্ষ, যুদ্ধবাজ মোঙ্গলদের প্রতিহত করে মানস কিরগিজদের অবিসংবেদিত নেতা হয়ে ওঠেন। বর্তমানে মানস দা গ্রেট কিরগিজস্তানের জাতীয়তা ও সংস্কৃতির প্রতীক।
এবার ঠিক করলাম যাব কারাকোল (Karakol)। একটা সেভেন সিটার গাড়ি বুক করে পাড়ি দিলাম বিসকেক (Bishkek) থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরের সেই শহরের দিকে। পথে পরে প্রায় দুশো কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রের মতন বিশাল এক হ্রদ ইসিক কুল (Issyk Kul)। কারাকোলে যোগাযোগ হয় গাইড অকল এর সঙ্গে। সেখানে একদিন কাটিয়ে পরদিন চলে যাই কারাকোল বেস ক্যাম্প। ৩রা জুলাই বেলা সাড়ে তিনটেয় আমরা পাঁচজনই আরোহণ করি কারাকোল ন্যাশনাল পার্কের এক শৃঙ্গ – 30 Let Vlksm (৪,০৮৩ মি)। Vlksm মানে সঙ্ঘবদ্ধ করা। উচ্চারণের অসুবিধার জন্য এই রাশিয়ান শব্দের মানে আমাদের মতন করে শৃঙ্গটার নাম দিয়েছিলাম সংহতি বা Mt. Unity। শৃঙ্গটি আরোহণ করার জন্য পার হতে হয় ভয়ংকর খরস্রোতা পাহাড়ি কারাকোল নদী।

পরদিন আমাদের পরিকল্পনা ছিল আরেকটি শৃঙ্গ আরোহণের যার নাম – Prejevalsk (৪,২৭২ মি)। এই শৃঙ্গের নামকরণ করা হয় এক বিখ্যাত পরিব্রাজকের নামে; এই সমস্ত এলাকা আবিষ্কার করার কৃতিত্ব তাঁর। উচ্চারণের সুবিধার জন্য একইভাবে আমরা শৃঙ্গটার নাম নিজেদের মধ্যে পাল্টে দিয়েছিলাম আমাদের পরিব্রাজক স্বামীজীর নামে– বিবেকানন্দ, সংক্ষেপে বিবেক। কিন্তু ফের ওই ভয়ংকর কারকোল নদীকে পার হতে হবে ভেবে আমরা সেই পরিকল্পনা বাতিল করে বিসকেক ফিরে আসি।
এবার প্লেনে পাড়ি দিই প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণের কিরগিজস্তানের প্রাচীনতম শহর ওশ (Osh) এর উদ্দেশে। ৭ই জুলাই ওশ থেকে গাড়ি করে পৌঁছই পিক লেলিন এর বেস ক্যাম্প (৩,৬০০ মিটার), সঙ্গে দুই নেপালি গাইড। পিক লেলিন ট্রান্স আলায় (Trans Alay Range) পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। পরদিন উঠে যাই ৪,৪০০ মিটারের ক্যাম্প ওয়ান। ৯ তারিখ ক্যাম্প ওয়ানের পাশে ৫,১৩০ মিটার উঁচু শৃঙ্গ উহিন (Uhin) পাঁচজনই আরোহণ করি।

১০ তারিখ উঠে যাই ৫,৩০০ মিটার উচ্চতার ক্যাম্প টু। পথে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সৌরভ নেমে যায়। ১১ তারিখ ক্যাম্প টু এর পাশে একটি অনামি শৃঙ্গ (৫,৮০০ মিটার) আমি, রাজা আর মলয় আরোহণ করি। ১২ তারিখ ৬,১০০ মিটার উচ্চতার ক্যাম্প থ্রি পৌঁছই। পরের দিন আমরা চারজনই আরোহণ করি পাশের এক শৃঙ্গ Razdelnaya, ৬,১৪৮ মিটার।
সেদিনই রাত আড়াইটায় রওনা দিয়েছিলাম পিক লেলিনের শীর্ষে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। রাজা আর কিরণ পাত্র থেকে যায় ক্যাম্প থ্রিতে। পায়ে চোট পাওয়ায় মাঝপথ থেকে ফিরে যায় মলয়, সঙ্গে এক গাইড। সারারাত প্রবল ঝড়ো হাওয়া আর তুষারের ঝাপটার মাঝ দিয়ে একটানা চরম কষ্টকর পথ পার হয়ে পরদিন, ১৪ই এপ্রিল ২০২৩ শুক্রবার, সকাল সাড়ে এগারোটায় পৌঁছই পিক লেলিনের (৭,১৩৪ মিটার) মাথায়। রচনা হয় এক নতুন ইতিহাসের। মিনিট ১৫ কাটে শৃঙ্গের চূড়ায়। এরপর ক্যাম্প ৩ পৌছই বেলা সাড়ে তিনটেয়। পরদিন সকালবেলা নামতে শুরু করে সোজা ক্যাম্প ওয়ান নেমে আসি বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যেই।
১৬ ই জুলাই, ২০২৩ পিক লেনিন বেস ক্যাম্পে নেমে আসি। এরপর ওশ হয়ে গাড়িতে ফিরি বিসকেক। দেশে ফিরি ২০ শে জুলাই।
এই অভিযানে সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছটি শৃঙ্গ আরোহণের পাশাপাশি প্রাণ ভরে দেখেছি কিরগিজস্তানের শহর গ্রাম নদীনালা, পামির মালভূমির বিভিন্ন রূপ; দেখেছি টলটলে নীল জলের সমুদ্রের মতন বিশাল হ্রদ। মিশেছি অসংখ্য মানুষজনের সঙ্গে। পেয়েছি তাদের প্রাণভরা আতিথেয়তা। জানতে চেয়েছি তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি। যোগদান করেছি বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে আর স্বাদ নিয়েছি সেদেশের বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং পানীয়ের।
ছবি সৌজন্য: দেবাশিস বিশ্বাস
দেবাশিস বিশ্বাস আয়কর বিভাগের ডেপুটি কমিশনার পদে কর্মরত। তিনি ২৯টি পর্বতারোহণ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছেন এবং মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাকালু, অন্নপূর্ণা সহ অনেকগুলি শৃঙ্গ জয় করেছেন। ২০১৬ সালে তিনি তেনজিং নোরগে ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড পান। তিনি প্রথম বাঙালি অসামরিক এভারেস্ট আরোহী যুগলের একজন এবং প্রথম ভারতীয় অসামরিক কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহী যুগলের একজন।
One Response
আমরা লেলিন শৃঙ্গ দেখেছিলাম সারি তাস থেকে। ২০১৮ সালে।