বসন্তের হাওয়ায় জানলার পর্দা উড়ে যাচ্ছে। বারান্দা আর উঠোন পেরোলেই ফুলের রঙে ভরে উঠছে আকাশের কোল। সেই আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে আস্ত একখানা কবিতার খাতা ভরে ওঠে। যারা খুব ভালো ছবি আঁকে তারাও কি চাইলে ওকে রঙে আর রেখায় বেঁধে ফেলতে পারে? পারে না বোধহয়। ধ্বনি আর রঙের সাধ্য কী! তবুও তো রেখায় আর লেখায় মানুষ বারবার কবিতার শরীরকে ছুঁয়ে যেতে যায়। নরম আলো ফোটা ভোরে যে মেয়েটি চৌকাঠ পেরিয়ে মারুলি দেয়, সে কি কবিতার ছবি হয়ে ধরা দেয় না!
রান্দা আর উঠোন পেরোলেই ফুলের রঙে ভরে উঠছে আকাশের কোল। সেই আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে আস্ত একখানা কবিতার খাতা ভরে ওঠে। যারা খুব ভালো ছবি আঁকে তারাও কি চাইলে ওকে রঙে আর রেখায় বেঁধে ফেলতে পারে? পারে না বোধহয়।
এইসব ভেবে ভেবে আমি বসন্তের চাঁদকে পিছনে ফেলে কোজাগরীর জোছনাকে খুঁজি। গোবর নিকোনো উঠোন পেরিয়ে চালের পিটুলির আলপনা। নরম ধানের শীষ থেকে আরশি আর কলমিলতা। আলপনায় গেরস্ত জীবনের সাধ বুঝি ছবি হয়ে ধরা দিয়েছে। ঠিক তার পাশটিতে পেতলের রেকাবিতে চালের নৈবেদ্য। কী নিপুণ ওর নিবেদন! চাঁদের ছায়ায় মায়াঘোর জড়ানো পট যেন। এই ছবি হয়ে ওঠা থালাখানিকে আমার কেবলই কবিতা বলে বোধ হয়। কেউ তো কখনও ওকে কবিতার বলে ডেকে ওঠেনি! কিন্তু মানুষের ভিতরের কত কত মায়ার আলপনা ধরা পড়ে নৈবেদ্য’র রেকাবি হয়ে নরম আতপের ভাতে।

এসব প্লেটিং নিয়ে জীবনের অত ভাবলে চলে না। অথচ কী সাবলীল এই সজ্জা। এও কি কবিতার ভাষা নয়? বটেই তো। এমন করেই কত না রান্নাঘরে কবিতার অলিন্দ খুলে যায় সময়ে সময়ে, বসন্তে বর্ষায়। তার খোঁজ যে পায় সে পায়। খাদ্য-খাবারের থালায় তখন সেই রাঁধুনি আশ্চর্য অরণ্যের ছায়া এঁকে দেয় বেমালুম। কে বলে রান্নার ভাষা নেই! ভাষা বুনে দেওয়ার অপূর্ব ক্ষমতা ওর। ডমিনিক ক্রেন (Dominique Crenn) কেমন করে যে সে ভাষা আয়ত্ত করলেন! ওর রান্না, ওর বিন্যাসকে কেবলই কবিতা বলে ভ্রম হয় তাই। ভ্রমই বা বলি কেন! ডমিনিক নিজেও তো জানেন সে কথা। ওর রেস্তোরাঁ, ওর মিশেলিন স্টার পাওয়া জীবন— এসব পেরিয়ে, রান্না ওর কাছে কথা কওয়ার সামিল। মানুষের সঙ্গে কথা বলার ভাষাকেই ও চিনেছে রান্না বলে। বাবার মতো ছবি আঁকতে শেখেনি ও কখনও। শেখেনি গান। নাচের তালিম নেয়নি। কেবল ঠাকুমার কাছে যে রান্নার হাতেখড়ি পেয়েছে ও, সেই হল ওর আত্মপ্রকাশের ভাষা। রান্নাঘরে যে ফুল ফল আর মাটির সান্নিধ্যে ও উত্তাপ বুনে দেয় সে ওর ভারী ব্যক্তিগত চয়ন। সুচারু সংগ্রহে ভরে ওঠে ওর রান্নাঘর তাই। আসলে এই নিবিড় সংযোগখানা গড়ে তুলতে পারে বলেই না খাবারের থালায় অমন করে ও কবিতা লেখে!

ডমিনিক (Dominique Crenn) যখন বেশ ছোট, তখন থেকেই বাবা-মায়ের কৃষিজীবনকে ও কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেয়েছে। মা, ঠাকুমার রান্নার মধ্য দিয়ে ওর এই বেড়ে ওঠা। ফরাসি রেস্তোরাঁগুলোর রান্নাঘরে ও দেখেছে পৌরুষের আগ্রাসন। সেসব থেকে অনেক দূরে থাকতে চেয়েছে ও। নিজের মতো। ইন্দোনেশিয়ায় ওই তো প্রথম মহিলা হেড শ্যেফ! কিন্তু তাতেই শেষ নয়। ওই যে বললাম, ও রান্নার ভাষা দিয়ে কবিতা লিখতে চায়! অনেক পথ পেরিয়ে সেই কোজাগরীর ছায়া খুঁজে খুঁজে অবশেষে ওর এই নিজের পথ চলা। আমেরিকায় যারা ওকে চেনেন, তারা জানেন রান্না ছাড়াও আরও কিছু দিয়ে থালা সাজায় ও। ওর ভাষায় ওর রান্নারা সব –‘poetic culinaria’.
কাব্য শরীরের স্বাদে এমন করে থালা সাজানোর কথাই বা ভাবতে পারে কজন! মারণব্যধি যাকে ছোঁয় তাকে পেরোতে হয় যন্ত্রণার পাহাড়। ডমিনিক সেই অন্ধকার মৃত্যুর স্বাদকে স্পর্শ করে আবার ফিরে এসেছে জীবনের তরঙ্গে। আবার হেঁটেছে গাছের ছায়ায় পৃথিবীর পথে। এ জীবন তাই ওর কাছে এত কাম্য বুঝি-বা। ওর কাছে রান্না মানে সুস্থতার চাবিকাঠি। সেই চাবিকাঠি দিয়ে কোন সে স্বপনপারের গল্প বোনে ও! তাই তো এমন বসন্তদিনে ওর কথা ভেবে ভেবে আকাশ দেখি কেবল। আলো দেখি।

ওর রেস্তোরাঁয় মানুষেরা যান বটে কিন্তু সে কেবল পেট ভরাতে নয়। ওর সঙ্গে সে যেন এক যাত্রা। প্রত্যেক ঋতুতে ঋতুতে ডমিনিক একেকখানা কবিতা লেখে। মানুষের পাতে যে খাবার ও তুলে দেয়, সেসব যেন কবিতার পঙ্ক্তিমালা। ওর মনের আকাশখানি এমন করে মেলে ধরতে জানে ও রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে।
আসলে ওর রান্না ওর ভিতরের মনটিকে আর ভিতরের ভাষাটিকে ব্যক্ত করে। ভাষার যে সীমাবদ্ধতা আছে, সুরের তো তা নেই! ফুল ফল আনাজের সংযোগে কোন ভাষা গড়ে তোলে ডমিনিক? মানুষের রান্নাঘরের ইতিহাসে আসলেই তো কত না কবিতা লেখা হয় দেশে দেশে কালে কালে। সেসব কথা কি মনে রাখে মানুষ! জীবনের স্বাদকোরকে পৃথিবীর গন্ধকে অনুভব করায় যে তেল নুন মরিচের আঘ্রাণ, সে তো অপার্থিব নয়! এই আলো ছায়া আর মায়ায় ঘেরা পৃথিবীই। ডমিনিক বুঝি সেকথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন।

মানুষের ভুলে ভরা পৃথিবীতে মানবিক স্পর্শটুকু বেঁচে থাক— এই নিয়েই না কত লড়াই। অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিন মানবিক হতে চায় ডমিনিক। খুব কঠিন তো নয় এসব, তবুও কী কঠিন। রাগ দ্বেষ হল্লাহাটির জীবন পেরিয়ে মানুষের পাশে গিয়ে বসবে বলেই না ডমিনিক টেবিলে টেবিলে ঘুরে মানুষের মুখের হাসি বা ক্ষোভটুকু দেখতে চায় রোজ রোজ। কে না জানে জীবনকে ছুঁয়েই কবিতার বারান্দাখানি সেজে ওঠে প্রতিদিন। ওর ‘Atelier Crenn’ কবিতার ভাষায় সেজে উঠুক দিনে রাতে। মানুষেরা জানুক – Atelier Crenn ‘serves a cuisine so visually, texturally and conceptually inventive…’ (The Wall Street Journal). আমরা যদি ডমিনিকের কবিতা পড়ার সুযোগ না পাই না পাবো। না হয় নাই খেলাম ওর রান্না। তবু, ওকে মনে করে জোছনার ছায়া পেরিয়ে নিপুণ হাতে সাজানো ভাতের থালাটির পাশটিতে গিয়ে তো বসতে পারি! কে বলতে পারে ভাতের থালায় এক টুকরো জোছনা এসে পড়বে না!
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Wikipedia
*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে এপ্রিল, ২০২৪
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।