আমি একটা উত্তরবঙ্গ পেয়েছিলাম মেক্সিকোর তরুণ কবিদের আড্ডায়।
২০১৬। আমি সেবার চার মাসের জন্য আমেরিকায়। অনেকগুলো শহরে আমার কাজ। সাংঘাতিক কাজের চাপ। একেবারে ত্রিমুখী চাপ। প্রথম চাপ: একাধিক শহরে কবিতা পড়া। দ্বিতীয় চাপ: পড়ানোর। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন ছাত্রছাত্রীদের পোস্ট কলোনিয়াল সাহিত্য পড়ানোর চাপ। শুধু পড়ানো হলে ঠিক ছিল, কে কত নম্বর পাচ্ছে আমার হাতে, তাই নিয়ে ক্লাসে রীতিমতো চোরা কম্পিটিশন। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। ই-মেইল যুদ্ধ। কেন একটি ব্ল্যাক ছাত্রী বেশি পেল, তাই নিয়ে কী ক্ষোভ! তৃতীয় চাপ: সেবার আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম একজন ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে। বাংলা সাহিত্যজগৎ থেকে এর আগে যেহেতু মার্কিন সরকার কোনও ফুলব্রাইট পাননি, সেজন্য আমি ছিলাম ওদের চোখের মণি। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রায় প্রতি দিন একটা করে মেইল আসত। সেটা ভালোবাসা না সারভেইলেন্স বুঝতে পারতাম না। ফুলব্রাইটার হওয়া যে আমেরিকার বুকে এত সম্মানের– সেটা জানা ছিল না। অনেক আউটরিচ প্রোগ্রামে অংশ নিতে আমাকে নিয়মিত প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিতেন ওরা।
কিন্তু আমি একটা উত্তরবঙ্গ পেয়েছিলাম মেক্সিকোর কবিদের আড্ডায়।
কী হয়েছিল বলি।
একটা ফোন এল। আমেরিকার কেউ ফোন করত না। আমেরিকা ইমেল-এর ওপর চলে। তখনও তাই চলত। ফোন পেতাম কলকাতার।
‘হাই, দিস ইজ অলিভিয়া, আ ইয়াং পোয়েট ফ্রম মেক্সিকো, নাউ ইন দি ইউ.এস।’
আমি বললাম, ‘ইয়েস প্লিজ, বলুন।’
অলিভিয়া জানাল, তারা চিলি এবং মেক্সিকোর একঝাঁক তরুণ কবি একটা পাহাড়ের নীচে জঙ্গলে ঘেরা নদীর ধারে, মাঝরাত্তিরে একটা পোয়েটস মিট করতে চায়।
– খুব ভাল। দারুণ। কিন্তু আমাকে কী করতে হবে? আমি তো স্প্যানিশ জানি না।
অলিভিয়া বলল, ‘নো ইস্যু। তুমি তোমার কবিতা পাঠ করে উদ্বোধন করবে। প্রথমে বাংলায় পড়বে । তারপর ইংরেজিতে পড়বে। তারপর আমরা স্প্যানিশ অনুবাদে পড়ব।’
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, ‘আমার কাছে আমার কবিতার কোনো স্প্যানিশ অনুবাদ নেই।’
‘আমরা করে নেব। ইন ফ্যাক্ট, করেওছি কয়েকটা।’
মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে বেশ লাগল। খোঁজ রাখে। মেক্সিকো একটা হাফ গরিব দেশ। আমি বললাম, ‘আমি যাব। কিন্তু একটা শর্ত আছে।’
মেয়েটি বলল, ‘আমরা অনারারিয়াম দেব।’
আমি বললাম, ‘আমার শর্ত হল এই, আমি আমার কবিতা পড়ার আগে অক্তাভিও পাজের ভারত বিষয়ে একটি কবিতা পড়ে শোনাব।’
মেয়েটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘গ্রেট, গ্রেট– পাজ় ইজ মাই গড।’
নির্ধারিত দিনে, মানে রাত্রে দু’জন এল আমাকে নিতে। একজন মেক্সিকো ইউনিভার্সিটিতে ফরাসি পড়ে। একজন একটি বিপ্লবী দলে কাজ করে। দু’জনেই গাড়িতে চুপচাপ বসে থাকল। কেউ চুপ করে থাকলে আমার অসুবিধা হয়। আমি বিপ্লবী ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মেক্সিকোর বর্ডারে পাঁচিল তুলে সিল করে দেবে বলছে ট্রাম্প, তোমার কী মত?’
ছেলেটি শুধু একটি শব্দ বলল, ‘স্টুপিড।’
তখনও ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেনট হননি। হব হব করছেন। বিপ্লবী ছেলেটিকে আমি ‘ভিশনারি’ বলব। সে যে শব্দটি বলেছিল, সেই শব্দটাই সারা পৃথিবী বলেছে গত পাঁচবছর। একটা অসাধারণ জঙ্গলে এসে গাড়ি থামল। পাহাড় থেকে আছড়ে নামছে একটা দুরন্ত নদী, তার শব্দ শুনে মনে হল আমি সেবকের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। অনেকগুলো মোমবাতি জ্বলছে একটা গাছের নীচে। একটা টেবিল। একটা চেয়ার। একটা হ্যান্ড মাইক। কুড়ি পঁচিশ জনের একটা দল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে। একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। পরে জেনেছিলাম ওটা এক রকম মেক্সিকোর গাঁজা।আমাকে চেয়ারে বসতে দিল প্রথমেই। তারপর হাতে একটা বিয়ার ক্যান ধরিয়ে দিল। অসাধারণ আপ্যায়ন। ফুলের বদলে বিয়ার– এ আমি কোথাও পাইনি। আমি পাজ়ের কবিতা দিয়ে শুরু করে নিজের কবিতা দিয়ে শেষ করলাম। তারপর বললাম, আমি তোমাদের কবিতা শুনতে এসেছি।
ওরা একজন একজন করে এসে দুটো করে কবিতা শুনিয়ে গেল। রাত তখন দুটো। বিপ্লবী ছেলেটির নাম রবার্তো। সে একটি কবিতা পড়ল- মনে হল সে উত্তরবঙ্গ নিয়ে কবিতা পড়ছে–
নর্থ ইজ মাই লাভ
নর্থ ইজ মাই নেমেসিস
নর্থ ইজ মাই এনিগমা
নর্থ ইজ মাই ফ্যানটাসম্যাগোরিয়া।
নর্থ ইজ মাই মাদার
নর্থ ইজ মাই মাদার্স সিক্রেট লাভার
থ্রি চিয়ার্স
আই অ্যাম নট ইওর স্লেভ।
আই অ্যাম আ স্ট্যান্ডিং স্টোন
মেকিঙ লাভ টু অ্যানাদার স্ট্যান্ডিং স্টোন
ইন দ্য টোয়াইলাইট
অব রেজারেকশান।
এরপর আমি যতবার উত্তরবঙ্গে গিয়েছি, এই কবিতাটির কথা ভেবেছি। অনেকগুলো তরুণ মুখ ভেসে উঠছে আমার সামনে। অনেকগুলো ভালোলাগা মুখ। অনেকগুলো কবিতা অন্ত প্রাণ। অনেকগুলো রাগী মুখ। অনেকগুলো উদ্ভাসন। অনেকগুলো স্বপ্ন। আমি যেদিন প্রথম ধূপগুড়ির চাল উড়ে যাওয়া কলেজে পা রেখেছিলাম জীবনে প্রথম চাকরির চিঠি পকেটে নিয়ে, যেদিন আমার নিজের উপার্জিত টাকায় রুটি কিনেছিলাম চালসায়, সেদিন থেকে আমি উত্তরবঙ্গকে মা বলে ডাকি। মেক্সিকো মিশে যায় উত্তরবঙ্গে। একমাত্র কবিতাই পারে মিশিয়ে দিতে। অলিভিয়া, রবার্তো, রাউল, লিজা, মিগুয়েল এই নামগুলো যেন উত্তরবঙ্গে এসে আছড়ে পড়ছে আর অরণ্য থেকে অরণি কাঠ নিয়ে বাংলা কবিতার জন্য নেমে আসছে নিখিলেশ। নেমে আসছে সুভান। নেমে আসছে সুমন। নেমে আসছে জয়শীলা। একদিন নেমে আসতেন সমর চক্রবর্তী, পুণ্যশ্লোকেরা। নেমে এসেছেন অনিন্দিতা, সেবন্তীরা। নামতে নামতে এসে দাঁড়িয়ে আছেন সমর রায়চৌধুরী, বিজয় দে, কৃষ্ণপ্রিয়, উত্তম দত্তেরা।
সেদিন মেক্সিকোর কবিদের রাতভোর আড্ডাটা ছিল আসলে সেবকের রাস্তা জুড়ে এক মাঘনিশীথের হিস্টিরিয়া।
জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে‚ ১৯৫৮ | ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক | পড়িয়েছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। 'দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে' এনে দিয়েছে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার‚ ২০১৩ সালে| বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি। লিখেছেন পঁয়ত্রিশটি কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে একা নরকগামী (১৯৮৮), জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর (২০০১), মণিপুরের মা (২০০৫) ইত্যাদি। 'ভাষানগর' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সুবিদিত।