নারী দিবসের প্রাক্কালে ফের শুরু হয়ে গেছে কী পাইনি তার হিসেব মেলানোর পালা! আমরা, একুশ শতকের মেয়েরাও এই ‘পাইনি’-র হিসেবে আরও আরও সংখ্যা যোগ করতে করতে চলেছি। আরও কত পথ চলা বাকি, সেই দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।
এখনও বাকি অনেক লড়াই, অনেক সংগ্রাম, ‘স্বাধীন’ নারীর অধিকার অর্জনের পথে, এ কথা নিঃসন্দেহে ঠিক। সে লড়াইয়ের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, লাল কার্পেটে মোড়া নয়। প্রতি মুহূর্তে কাঁটা বেঁধার যন্ত্রণা, এ কথাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু যাঁরা এই লড়াইয়ের পথ কাটার পথিকৃৎ, তাঁদের দিকে পিছু ফিরে তাকালে কিছুটা নিঃশ্বাস কি বুক ভরে নেওয়া যায় না? ক্লান্ত পায়ে নারীর অধিকার রক্ষার যুদ্ধটা করতে করতে একবার যদি ফিরে দেখা যায় তাঁদের, যাঁরা পথের তোয়াক্কা করেননি! এগতে গেলে পথ চাই, এই ধারণাকেই সমূলে নস্যাৎ করে যাঁরা পা বাড়িয়েছিলেন সামনের দিকে!
সেখানে আপত্তির খাদ ছিল, প্রতিরোধের খরস্রোতা জলধারা ছিল। ছিল বাধার সমুদ্র, সংস্কারের পাহাড়। তাঁদের সম্বল ছিল জেদ, আত্মপ্রত্যয় আর সাহস। এই নিয়েই পথের কথা না-ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন খাদ, জলস্রোত, নদী, সমুদ্র পার হতে। তাঁদের পদক্ষেপে একটু একটু করে পাকদণ্ডী তৈরি হয়েছে, পাহাড় ভেঙেছে, সমুদ্রে হয়েছে সেতুবন্ধ। তার ওপরেই পা ফেলে ফেলে এগিয়েছে পরবর্তী প্রজন্ম।
একুশ শতকের নারী দিবসে তেমনই এক নারীর কথা ফিরে পড়া যাক, যিনি ছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘অ্যাহেড অফ টাইম’। তাঁর সামনে ছিল না কোনও শুঁড়িপথ বা কোনও বাতিস্তম্ভ। নিজেই প্রদীপশিখা হয়ে, পথের কাঁটা পায়ে দলে তৈরি করেছেন ইতিহাসের পাতা ভেদ করে এগিয়ে চলা অনন্য অস্তিত্ব। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের বাধাবিপত্তি হেলায় দূরে সরিয়ে সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রের আপত্তি আর প্রতিরোধের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন এই মেয়ে। তাঁরই কথা বাংলালাইভের পাতায়, আজ।

আইন মেয়েদের খেলার জিনিস নয়
হ্যাঁ, অনেকটা এরকমই বলেছিলেন সার চার্লস সার্জেন্ট। বম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। উল্টোদিকে ছিলেন কর্নেলিয়া সোরাবজি, প্রথম ভারতীয় মহিলা ব্যারিস্টার। বিলেত থেকে আইন পাশ করে বম্বে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে আসা কর্নেলিয়াকে স্যার চার্লস স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘দেখুন, আপনি তো পুরুষ নন। মহিলা। আর কোনও মহিলার হাতেই আইন নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার তুলে দেওয়া যায় না।’
সর্বসমক্ষে এভাবে অপমানিত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি কর্নেলিয়া। তাঁর জীবনে ‘প্রথম’ কথাটা নতুন কিছু ছিল না। তিনি যে শুধু প্রথম ভারতীয় মহিলা আইনজীবী ছিলেন তা-ই নয়, ছিলেন বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা ম্যাট্রিকুলেট, এবং প্রথম মহিলা যিনি অক্সফোর্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন আইনের পাঠ নিতে।
সাত বোনের পঞ্চম
১৮৬৬ সালে নভেম্বরে মহারাষ্ট্রের নাসিকে এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম হয় কর্নেলিয়ার। সাত বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। তাঁর বাবা রেভারেন্ড সোরাবজি কারশেদজি পার্সি থেকে খ্রিস্টান হওয়ায় পার্সিরা তাঁকে একঘরে করেছিল। কিন্তু প্রগতিশীল উদারমনস্ক কারশেদজি মেয়েদের পর্দানশীন করে রাখেননি, পড়াশোনার আবহেই বড় করে তুলেছিলেন। কর্নেলিয়ার মা ফ্র্যাংকিনা সোরাবজি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই তাঁর পূর্বসুরী। প্রথাগত শিক্ষা খুব বেশি না-থাকলেও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে মহারাষ্ট্রের গোঁড়া সমাজে তাঁর প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। আইনের ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও তিনি সম্পত্তি ও উত্তরাধিকার বিষয়ে মেয়েদের সাহায্য করতেন। পরবর্তীকালে কর্নেলিয়ার জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে তাঁর মায়ের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়।

ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়াশোনার পর কর্নেলিয়া বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যান, সেখান থেকে পরীক্ষায় বসবেন বলে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই দরজা বন্ধ করে তাঁকে প্রত্যাখান করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কারণ একটাই, তিনি নারী।
কর্নেলিয়াকে বলা হয়, আইন নয়, তাঁকে পড়তে হবে ইংরিজি সাহিত্য। কারণ, ও বিষয়টা তবু খানিকটা মেয়েলি। অনেক ধরাকরার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুণের ডেকান কলেজে ভর্তি হবার অনুমতি দেন। ক্লাস করতে কলেজে পৌঁছে কর্নেলিয়া দেখেন অধ্যাপকেরা ক্লাসঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন, যাতে ছাত্রী ঢুকতে না-পারেন।
তিনশো ছাত্র বনাম এক ছাত্রী। লড়াইটা ছিল অসম। কিন্তু প্রতিভার কাছে হার মেনেছিল সমাজ। পাঁচ বছরের ল্যাটিন কোর্স এক বছরের মধ্যে শেষ করে বৃত্তি নিয়ে পাশ করেন কর্নেলিয়া। ১৮৮৭ সালে ডেকান কলেজের যে পাঁচজন ছাত্রছাত্রী প্রথম শ্রেণীতে অনার্স নিয়ে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পান, তাঁদের মধ্যে কর্নেলিয়া সোরাবজি ছিলেন অন্যতম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা তখন সরকারি বৃত্তি পেতেন বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য। কর্নেলিয়ার খুব ইচ্ছে অক্সফোর্ডে গিয়ে আইন পড়েন। আবেদন করলেন বৃত্তির। শুধু নারী বলেই নাকচ হয়ে গেল। কর্নেলিয়া ছাড়বার পাত্রী নন। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে চোস্ত ইংরিজিতে চিঠি লিখে পাঠালেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। তাঁরা নড়েচড়ে বসলেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বিলিতি মেয়েদের নিয়ে কর্নেলিয়ার জন্য টাকা জোগাড়ের কাজ শুরু করলেন। সেই ব্যক্তিগত বৃত্তির জোরেই ১৮৮৯ সালে বিলেতে পৌঁছলেন কর্নেলিয়া।
বিলেতের পথেও পাথর ছড়ানো
কিন্তু বিলেতেও গল্পটা কিছু আলাদা হল না। সেই একইভাবে আইনের দরজা জোর করে বন্ধ করে রেখে কর্নেলিয়াকে ফের বাধ্য করা হল ইংরিজি সাহিত্য পড়তে। কলেজে তাঁর বন্ধুত্ব হল ম্যাক্স মুলার এবং বেনজামিন জোয়েট-এর সঙ্গে। তাঁদের পীড়াপীড়িতেই ১৮৯০ সালে অক্সফোর্ড কর্নেলিয়ার জন্য এক বিশেষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পাঠ্যক্রম তৈরি করে। আইসিএস পরীক্ষার জন্য আইনের যে পেপারগুলি পড়তে হয়, সেগুলিই এই পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই পরীক্ষাতে অনায়াসে অসাধারণ ফল করেন কর্নেলিয়া। ফলে ব্যাচেলর অফ সিভিল ল পড়তে তাঁর আর কোনও বাধা রইল না।

কিন্তু বাধা তো আইনে নয়, মনে। দু’ বছর পড়ার পর পরীক্ষার সময় বহিরাগত পরীক্ষক বেঁকে বসলেন। তিনি কোনও মহিলার খাতা দেখবেন না। ফের আসরে নামলেন জোয়েট। তাঁর কথাতেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ নিজেরা খাতা দেখার ব্যবস্থা করল। এবং ১৮৯২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ব্যাচেলর অফ সিভিল ল পরীক্ষা পাশ করলেন কর্নেলিয়া। কিন্তু ডিগ্রি পেলেন না। কারণ অক্সফোর্ডে মহিলাদের ডিগ্রি দেওয়ার নিয়মই ছিল না। এবার আর জোয়েটেরও কিছু করার ছিল না। ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফিরতে হয় কর্নেলিয়াকে। ১৯২২ সালে, অর্থাৎ স্নাতক হবার ত্রিশ বছর পর অক্সফোর্ড শেষপর্যন্ত তাঁকে ডিগ্রি প্রদান করেছিল।
আইন বোঝাবেন নারী?
দেশে ফিরে লড়াইটা আরও কঠিন হল কারণ গোটা দেশই মহিলা আইনজীবীকে মেনে নিতে নারাজ। ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয়, লর্ড কার্জন, সাফ জানিয়ে দিলেন, কোনও মহিলা ব্যারিস্টারকে আইনের পদাধীকার দেওয়াতে তাঁর সায় নেই। এমতাবস্থায় ১৮৯৫ সালে কর্নেলিয়া স্থির করলেন আবার বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পরীক্ষায় বসবেন। কারণ, নিয়ম ছিল, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা সরাসরি ভারতীয় ‘বার’-এর সদস্যপদ পাবেন। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। ১৮৯৬-তে ফের পরীক্ষায় পাশ করলেন কর্নেলিয়া। কিন্তু ‘বার’-এর দরজা বন্ধই রইল। কারণ, তিনি নারী।

এরপর এলাহাবাদ হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে চেয়ে আবেদন করলেন কর্নেলিয়া। সেখানে তখন রমরম করে প্র্যাকটিস করছেন মতিলাল নেহরু, তেজ বাহাদুর সপ্রুর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু কর্নেলিয়ার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। প্রত্যাখ্যানই জুটল। মহিলা ব্যারিস্টার কাজ করতে চান শুনে ব্রিটিশ চিফ জাস্টিস বিদ্রুপ করে বললেন, ‘আপনি সামনে দাঁড়ালে আমি তো ধমকও দিতে পারব না!’
অগত্যা তিনি নেটিভ স্টেটের মহারাজাদের হয়ে আইনি লড়াই লড়বেন বলে স্থির করলেন। অদ্ভুত সমস্ত কেস জুটতে লাগল তাঁর কপালে। এক মহারাজা তাঁর পোষা হাতির উকিল নিযুক্ত করলেন কর্নেলিয়াকে। হাতির হয়ে মামলা লড়তে হবে, যিনি হাতির প্রিয় কলাবাগান কেটে ফেলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে।
পর্দানশীনদের জন্য পর্দা পার্টি
পাঁচ বছর এইভাবে কাজ করার পর কর্নেলিয়া ঠিক করলেন আর নয়। নিজের পথ তিনি এবার নিজেই কাটবেন। ১৮৯৯ সালে পর্দানশীন নারীদের আইনি পরামর্শ দেবার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন কর্নেলিয়া। রাজা-মহারাজা-জমিদারদের বিধবা স্ত্রীরা সাধারণত বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে বিপদে পড়তেন এবং শেষমেশ পরিবারেরই কেউ তাঁদের ঠকিয়ে সব সম্পত্তি থেকে বেদখল করে দিত। লেখাপড়া না-জানা, অসহায় এইসব মেয়েদের ন্যায়বিচারের ভার নিলেন কর্নেলিয়া।
এ কাজে আশ্চর্য সাফল্য পেলেন তিনি। পর্দার অন্তরালে থাকা এই নারীদের উত্তরাধিকার, দত্তক সন্তান, জমি-বাড়ির বিবাদ সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ তো দিতেনই, তাঁদের জন্যে আয়োজন করতেন ‘পর্দা পার্টি’… যেখানে তাঁরা নিজেরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করতেন, মেলামেশা করতেন। পর্দানশীন মেয়েদের সামাজিকতার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিলেন কর্নেলিয়া।

দীর্ঘ সময় এ কাজ সাফল্যের সঙ্গে করার পর সরকারের টনক নড়ল। ১৯০৪ সালে সরকার তাঁকে কোর্ট অফ ওয়ার্ডস-এর নারী সহকারীর পদে বহাল করল, যিনি মৃত অভিভাববকদের নাবালক সন্তানদের সম্পত্তির অধিকার পেতে সাহায্য করবেন। ১৯২২ সাল পর্যন্ত এই পদে কাজ করেন কর্নেলিয়া। কলকাতা শহরেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ছিল তাঁর দফতর। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে দুটি বইও রচনা করেন কর্নেলিয়া – ‘লাভ অ্যান্ড লাইফ বিহাইন্ড দ্য পর্দা’ এবং ‘দ্য পর্দানশীন’।
সফল হয়েও সাফল্য অধরা
১৯২২ সালে লন্ডনের ‘লিংকন ইন বার’ থেকে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয় প্র্যাকটিস করার জন্য। এই লিংকন ইনের বার লাইব্রেরিতে বসেই স্নাতকের পড়াশোনা করতেন কর্নেলিয়া। সেখান থেকে ডাক পেয়ে লন্ডন যান তিনি। এবং ত্রিশ বছর বাদে হাতে পান নিজের আইনের ডিগ্রিটি। পরবর্তীকালে লিংকন ইন বার-এ মহাসমারোহে কর্নেলিয়ার আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয়।
১৯২৪ সালে ভারতেও মহিলাদের জন্য খুলে যায় আইনের দরজা। কলকাতায় ফিরে এখানেই প্র্যাকটিস শুরু করেন কর্নেলিয়া। কিন্তু লড়াইয়ের শেষ হয়নি তখনও। কোনও মহিলার কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন কোনও পুরুষ, এ কথা কল্পনাই করতে পারতেন না অধিকাংশ ভারতীয়। আর কোনওক্রমে যদি সেই মহিলার কাছে আদালতে হার স্বীকার করতে হয় পুরুষ আইনজীবীকে? এ লজ্জা তিনি রাখবেন কোথায়?

ফলে কেউ যদি বা তাঁর পরামর্শ নিতে আসত, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পুরুষ আইনজীবী লড়তেই চাইতেন না। ফলে বিচারকরা নিদান নিলেন, মামলার কাগজপত্র তৈরি করা পর্যন্তই কাজ করবেন কর্নেলিয়া, নিজের কেস বিচারকের সামনে পেশ করার অধিকার তাঁর থাকবে না। সমাজের এই বাধা কিছুটা বাধ্য হয়ে, কাজের তাগিদেই মেনে নিতে হয়েছিল কর্নেলিয়াকে।
সমাজের চাই সাফাই অভিযান
আইনি পরিচয়ের চেয়ে সমাজসেবিকা ও অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেই নাম ছড়িয়ে পড়ে কর্নেলিয়ার। ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ উইমেন-এর সদস্য হিসেবে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কর্মক্ষেত্র। কলকাতায় বেঙ্গল লিগ অফ সোশ্যাল সার্ভিস ফর উফমেন নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন কর্নেলিয়া এবং ১৯২৬ সালে ভ্রুণহত্যার বিরুদ্ধে জাতীয়স্তরে প্রচার ও সচেতনতার কাজ শুরু করেন।
কিন্তু রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ এখানেও তাঁর পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছিল ক্রমশ। কর্নেলিয়ার ভাগ্নে তথা জীবনীকার রিচার্ড সোরাবজির লেখা থেকে জানা যায়, গান্ধীর মতাদর্শের বিরোধী ছিলেন কর্নেলিয়া। নরমপন্থী কংগ্রেসি রাজনৈতিক গোপালকৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বও ছিল। গান্ধীর অসহযোগকে কোনওদিনই তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে অনেক রাস্তাই তাঁর জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯২৯ সালে কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর লন্ডনে ফিরে যান কর্নেলিয়া। শীতকালে মাঝে মাঝে ভারতে আসতেন। ত্রিশের দশকে দু’টি আত্মজৈবনিক বইও লেখেন তিনি। ‘ইন্ডিয়া কলিং’ এবং ‘ইন্ডিয়া রিকল্ড’। ১৯৫৪ সালের ৬ জুলাই লন্ডনেই তিনি প্রয়াত হন। অতি সম্প্রতি (২০১৬) কর্নেলিয়া সোরাবজির জন্ম সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে অক্সফোর্ডের সামারভিল কলেজ (যেখানে তিনি আইনের পাঠ নিয়েছিলেন) তাঁর স্মৃতিতে একটি বৃত্তি চালু করে। আইনপাঠে আগ্রহী ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের জন্যই এই বৃত্তি।

এমন একজন অগ্নিস্ফূলিঙ্গকে ভারতের ক’জন সচেতন নাগরিক আজ মনে রেখেছেন, এ প্রশ্ন করা বোধহয় অনুচিত হবে না, একুশ শতকের নারীদিবসের প্রাক্কালে। আজ, এখনও কর্মক্ষেত্রে অসাম্য, অন্যায়, উপার্জনের বৈষম্য নিয়ে আমরা যখন কথা বলি, এই অসমসাহসী, হার-না-মানা, লড়াকু নারীর মুখ বা নাম আমাদের স্মরণে আসে কি? ‘গ্লাস সিলিং’ বলে যে কথাটি আজ কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি হয়ে চলা বৈষম্য বোঝাতে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হয়, সেই কাচের ছাদকে নিজের প্রতি পদক্ষেপে চুরমার করতে করতে এগিয়ে চলা এই নারীর কথা বোধহয় আমাদের নতমস্তকে স্মরণ করা উচিত।
আদালতকক্ষে প্রতিবার যখন উঠে দাঁড়াবেন কোনও করুণা নন্দী বা সীমা সম্রুদ্ধি, কোনও নির্ভয়ার হয়ে সওয়াল করতে, টেলিভিশনের পর্দায় সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা যেন নীরবে মনে করি কর্নেলিয়া সোরাবজির একলা চলার আঁধারপথটির কথা।
তথ্যসূত্র: www.livehistoryindia.com, postoast.com, www.ourmigrationstory.org.uk
*ছবি সৌজন্য: postoast, livehistory, thebetterindia, facebook
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!
4 Responses
এনাদের কথা আমরা কেউ মনে রাখিনি। লজ্জা হলো,বড় লজ্জা হলো। আলোকবর্তিকা হাতে এক অনন্য অগ্রগামিনীর দেখা পেলাম।
অনবদ্য। বাংলা লাইভের পাতায় প্রকাশিত হতে থাকুক আরও অনেক অনালোচিত চরিত্র।
খুব সুন্দর। ভালো লাগলো।
বা:। সত্যি এঁদের কথা পড়লে মনে হয় আমরা কী করেছি জীবনে? কতটকু দাম দিয়েছি যা পেয়েছি, তার জন্য?