খেলার মাঠ থেকে ছবির নায়িকা খুঁজে পাওয়া? এও সম্ভব? কিন্তু এমনটাই ঘটেছিল একবার। সেটা ১৯৪৬ সাল। ময়দানে মোহনবাগানের খেলা চলছে। ফুটবলপাগল দর্শকে মাঠ পরিপূর্ণ। তার মধ্যে রয়েছেন শিশির মল্লিক, খগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতো চিত্রজগতের দুজন। শিশিরবাবু নাট্যজগতেও যুক্ত ছিলেন। খগেন্দ্রলাল ছিলেন ‘রীতেন এন্ড কোম্পানি’, ‘এম্. পি. প্রোডাকশন’, ‘ডিল্যুক্স পিকচার্স’-এর মতো নামকরা ছবি তৈরির কোম্পানির অন্যতম কর্ণধার। আরও একজন সঙ্গী ছিলেন সেদিন― প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়। এঁরা তখন ‘ডিল্যুক্স পিকচার্স’-এর ব্যানারে তাঁদের আগামী ছবি ‘সমর্পণ’-এর জন্যে নতুন নায়িকা খুঁজছেন। ফলে, পথেঘাটে সর্বত্র এঁদের চোখ ঘুরত নায়িকার সন্ধানে। আবার সবাই মোহনবাগান-পাগল। তাই ক্লাবের খেলা থাকলে, মাঠে আসা চাই। খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ শিশিরবাবুর চোখ গেল কিছুটা দূরে বসা হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিতা এক চঞ্চলা নারীর দিকে। মেয়েটি খেলার উত্তেজনার তালে তালে উঠছেন, বসছেন, হাত নাড়ছেন। সব মিলিয়ে বেশ নজর কাড়লো সে। মনে হল ‘সমর্পণ’-এর নায়িকা হিসেবে মানাবে। তিনজনেই তাঁর কাছে গিয়ে কথা বললেন এবং জানা গেল তাঁর নাম মৃদুলা গুপ্তা। ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিতে মৃদুলা বললেন, তিনি ছবিতে কাজ করেছেন তো। তিনজনেই অবাক! কোন ছবিতে? মেয়েটি বললেন, অভিনেত্রী হিসেবে নয়, গান গেয়েছেন। অর্থাৎ, প্লেব্যাক সিঙ্গার। যাই হোক, শুরুতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, অবশেষে মৃদুলা রাজি হয়ে গেলেন পর্দায় অভিনয়ের ব্যাপারে। বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে জন্মানো মৃদুলা গুপ্তা, ছবিতে এসেই অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর জাত চেনালেন। চিত্রদুনিয়ায় নাম হল অনুভা গুপ্তা।

কলকাতার বাসিন্দা হলেও, মৃদুলার জন্ম তখনকার অবিভক্ত দিনাজপুরে, তাঁর মামারবাড়িতে ১৯৩০ সালে। প্যারীচরণ গার্লস স্কুল, বাণীপীঠ বিদ্যালয় ছাড়া শান্তিনিকেতনেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন তিনি। মূল উৎসাহ ছিল নাচগান শেখা, ব্যায়াম চর্চা ইত্যাদিতে। ভবানীচরণ দাসের মতো প্রখ্যাত গায়ক ও সংগীতশিক্ষকের কাছে গান শিখেছেন। নৃত্যশিক্ষা বঙ্গীয় কলালয়ে। আবার গুরুদাস মল্লিকের দলে ড্রামও বাজিয়েছেন ছোট বয়সে। ১৫/১৬ বছর বয়সে পাড়ার আ্যামেচার ক্লাবের থিয়েটারে অভিনয়ও করেছেন বেশ কিছু, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সিরাজদ্দৌলা’-য় ‘আলেয়া’ বা ‘বিসর্জন’-এ ‘অপর্ণা’ ইত্যাদি। অন্যদিকে খেলাধুলোতেও দারুণ আগ্রহ ছিল। মোহনবাগানের খেলা থাকলে, অনুভাকে দর্শকাসনে পাওয়া যেতই। যেমন, সেদিন শিশিরবাবুরা পেয়েছিলেন। এর অবশ্য আরেকটা বিশেষ কারণ ছিল। সেইসময় মোহনবাগানে খেলা অসামান্য রাইট হাফ অনিল দে-র সঙ্গে মৃদুলা তথা অনুভার গভীর প্রণয় চলছিল তখন, যা কিছুদিন পরেই পরিণয়ে পরিণত হয়। অনিল দে মাঠে নেমেই গ্যালারির বিশেষ অংশের দিকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়তেন। তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তর দিতেন তাঁর প্রণয়িনী।
আরও পড়ুন: সুরসন্ধানী জটিলেশ্বর
আগেই বলা হয়েছে, মৃদুলা গুপ্তার প্রথম প্রকাশ সংগীতশিল্পী হিসেবে। তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের কাহিনি ও পরিচালনায় ‘অশোক'(১৯৪২) ছবিতে। সংগীত পরিচালক ছিলেন শচীন দেব বর্মন। অজয়বাবু মৃদুলার সন্ধান পেয়েছিলেন ভবানীচরণ দাসের কাছ থেকে। এরপর, ১৯৪৪ সালে অনিল বাগচীর সুরে ‘সন্ধি’ ছবিতে মৃদুলার গাওয়া গানগুলি সুপারহিট হল। ফলে, ইতিমধ্যেই গায়িকা হিসেবে পরিচিত মৃদুলাই যখন ছবিতে অনুভা নামে অবতীর্ণ হলেন এবং শুরু থেকেই দেখালেন তাঁর অভিনয়ের দক্ষতা, তা আলোড়িত করেছিল সেইসময়ের দর্শক শ্রোতাদের। ‘সন্ধি’-র পর আরও একটি দুটি ছবিতে গান গেয়েছিলেন তিনি। শুধু বাংলা গানই নয়, তখন বাংলার শিল্পীদের মধ্যে যে হিন্দি ভার্সন গান গাইবার চল ছিল, তাও তিনি গেয়েছেন রেকর্ডে। যেমন, ১৯৪৩ সালে “তুম হো কিসিকে ঘর কে উজালে…”(১৯৩৬ সালে ‘স্নেহলতা’ ছবিতে রাজকুমারীর গাওয়া), ১৯৪৪-এ “ম্যয় কলি বনউ মাতওয়ালি…”(১৯৪১-এ ‘সার্কাস কি সুন্দরী’ ছবিতে মোতিবাঈ-এর গান), ১৯৪৬ সালে “আঈ বসন্ত ঋতু আঈ…”(১৯৪৪ সালে ‘কাদম্বরী’ ছবিতে শান্তা আপ্তের গান) ইত্যাদি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, গায়িকা হিসেবে শুরুতে কতটা পথ হেঁটেছিলেন মৃদুলা গুপ্তা! কিন্তু অন্তরের মূল আহ্বান যে ছিল অভিনয়ের, তা দেখা গেল যখন তিনি অনুভা গুপ্তা হয়ে পর্দায় এলেন। এই জগতে আসার পর, গান আর করলেন না। ফলে, ছবিতে তাঁর নৃত্যদক্ষতা কিছু ক্ষেত্রে চোখে পড়লেও, গান-কণ্ঠ আর শোনা যায়নি।
সেদিন মাঠে শিশির মল্লিকরা অনুভাকে ‘সমর্পণ’ ছবির জন্যে নির্বাচিত করলেও, মুক্তির দিন হিসেবে অনুভা গুপ্তার প্রথম ছবি হল গুণময় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বিশ বছর আগে'(১৯৪৮)। ‘সমর্পণ’ মুক্তি পায় ১৯৪৯ সালে। এরকম কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করার পর, অনুভার অভিনয়-প্রতিভার আসল বিচ্ছুরণ ঘটল দেবকী বসু পরিচালিত ‘কবি’ (১৯৪৯) ছবিতে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অবিস্মরণীয় উপন্যাসটি দেবকীবাবু ভালো করে পড়তে বলেছিলেন অনুভাকে। তারপর একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠাকুরঝি’ না ‘বসন’ কোন চরিত্রটি তাঁর পছন্দ? দুটিই নায়িকার চরিত্র। অনুভা বলেছিলেন, বসন। কারণ, তিনি নাচ জানেন। তাই এটাই তাঁর উপযুক্ত হবে। কিন্তু পরিচালক তাঁকে নিলেন ঠাকুরঝি-র ভূমিকায়। এর ফলে, কী হল, তার প্রমাণ তো ছবিটাই। স্বয়ং কাহিনিকারের যা দেখে মনে হয়েছিল, তাঁর তৈরি চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে পর্দায়। পরিচালকের জহুরির চোখকে লাখোকোটি সেলাম জানাতে হয় এজন্য। তিনি অনুভার বহিরঙ্গটি না দেখে, অবলোকন করেছিলেন তাঁর অন্তর-রূপ! অধরা প্রেমে সমর্পিত এরকম অভিনয় কি ভোলা যায়? দুধের পাত্র মাথায় নিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছেন ঠাকুরঝি। আর নিতাই কবিয়াল-রূপী রবীন মজুমদার গাইছেন, “ও আমার মনের মানুষ গো/ তোমার লাগি পথের ধারে বাঁধিলাম ঘর…”। অন্তরকে উদ্বেল করে দেয় গোটা ছবিতে এই সব মুহূর্ত।
অন্তর্মুখী আবেদন যেসব চরিত্রে আছে, সেইসব চরিত্রে অনুভার অভিনয় এক অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে বলা যায়। ‘কবি’-র পরেই দেবকী বসুর ‘রত্নদীপ'(১৯৫১) ছবিতে ‘বউরানি’-র অভিনয়ে আবারও বিস্ফোরণ ঘটল। কিন্তু অভিনয়ের ধরনে আনলেন তফাৎ। এক সরলমনা গৃহবধূর কাঙ্ক্ষিত জীবনের অন্বেষণ যেভাবে ফোটালেন অভিনয়ে, তা অতুলনীয়।
উত্তমকুমারের সঙ্গে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন অনুভা। যার মধ্যে দুটি ছবিতে তিনি ছিলেন অন্যতম নায়িকা― কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সাহেব বিবি গোলাম’ (১৯৫৬) এবং ১৯৫৭ সালে অসিত সেনের পরিচালনায় ‘জীবন তৃষ্ণা’। প্রথম ছবিটিতে ‘জবা’ চরিত্রে এক ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিনয়। আর দ্বিতীয়টিতে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পাশে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা। এছাড়াও বলা যায় ‘চাঁপাডাঙার বউ’ (১৯৫৪) ও ‘অনুপমা'(১৯৫৫) ছবিদুটিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের কথা। যদিও দুটি ছবিতেই নায়িকা বলতে যা বোঝায়, তা ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু অনুভা ছিলেন আপন দীপ্তিতে ভাস্বর! উত্তমকুমার একটি লেখায় বলেছিলেন, “অনুভা গুপ্তা-র সঙ্গে কাজ করে বুঝেছি, দারুণ ওর অভিনয়ক্ষমতা, সহশিল্পীকে সাহায্য করার অদম্য ইচ্ছা ওঁর। চাঁপাডাঙার বউ, অনুপমা ভোলবার নয়। কবি, রত্নদীপের অনুভা গুপ্তা প্রতিভাময়ী নিঃসন্দেহে― ওঁর সঙ্গে কাজ করে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি।” বৈচিত্র্যময় স্বকীয়তায় ভরপুর ছিল অনুভার অভিনয়। তাই যেকোনও চরিত্রে তিনি নিজেকে আলাদা করে চেনাতে পারতেন।

এক ধরনের আধুনিক আভিজাত্যের মোড়কে কীভাবে অন্তর্মুখী আবেদনের প্রকাশ ঘটতে পারে, তা দেখা যায়, সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা'(১৯৬২) ছবিতে অনুভার অভিনয়ে। পাশাপাশি, একই বছর মুক্তি পাওয়া তপন সিংহের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ছবিতে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন চরিত্রে অন্যরকম অভিনয়-বৈচিত্র্য। যাত্রিক পরিচালিত ‘পলাতক'(১৯৬৩)-এ একবুক যন্ত্রণা নিয়ে লাস্যময়ী ঝুমুরওয়ালির চরিত্রে আরেক রকম প্রকাশ তাঁর। যে দৃশ্যে ‘বসন্ত’-রূপী অনুপকুমার, ওই ঝুমুরওয়ালির মধ্যে তাঁর মাকে খুঁজে পাচ্ছে, তা শুনে, মুহূর্তে যে অভিব্যক্তির বদল ঘটে অনুভার, তা হৃদয়কে অস্থির করে দেয়। অন্য দিকে মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১'(১৯৭২)-এ আমরা পাই একেবারে আলাদা অনুভা গুপ্তাকে। শুধু ইনট্রোভার্ট ধরনের চরিত্রেই নয়, নানারকম চরিত্রে তিনি অনবদ্য হয়ে উঠেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পাওয়া উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘ছদ্মবেশী’ বা অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে অনুভা দেখালেন কমেডির ছোঁয়া-লাগা মনকাড়া অভিনয়। আর কালীপ্রসাদ ঘোষ নির্দেশিত ‘শ্রীশ্রীমা'(১৯৫৮) ছবিতে মুখ্য চরিত্র মা সারদা-র ভূমিকায় অনুভা আত্মনিবেদিত ভক্তিময়ী স্নেহশীলা মাতৃরূপের যে প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, তা সবকিছু থেকে তাঁকে এক অন্য মাত্রায় তুলে ধরে। অথচ, এমনিতে তাঁর ধর্মকর্মে সেভাবে মতি ছিল না। কিন্তু যে কাহিনি থেকে ছবিটি তৈরি সেই তমোনাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মা সারদার জীবনীটি পড়ে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সেই অনুভূতিই ফুটে উঠেছিল তাঁর চরিত্র রূপদানে।
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, অনুভা গুপ্তার অভিনয়ের প্রধান সম্পদ ছিল তাঁর চোখদুটি। অভিনয়ের ক্ষেত্রে চোখের ভূমিকা যে কত বড়, তা আমরা জানি। অনুভার ক্ষেত্রে তার অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত বোধহয় দেখা যায়। শুধুমাত্র তাকানোর ধরনে তফাৎ ঘটিয়েই তিনি অভিনীত চরিত্রটিকে দর্শকমনে গেঁথে দিতে পারতেন। নায়িকা হিসেবে বাংলা সিনেমায় যে কজন শিল্পী নিজেদের শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অনুভা গুপ্তা অবশ্যই তার প্রথম সারির একজন। প্রসঙ্গত, দুটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি― ১৯৫২ সালে ‘রত্নদীপ'(বাংলার পরে এটি হিন্দিতেও হয়) এবং ‘স্বামী বিবেকানন্দ'(১৯৫৫)।

অনিল দে-র সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর, অনুভা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন যশস্বী অভিনেতা রবি ঘোষকে। কিন্তু তাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে, মাত্র ৪২ বছর বয়সে প্রয়াত হন অনুভা গুপ্তা। অভিনয় জগতে এ যে কত বড় ক্ষতি, তা বলাই বাহুল্য। শুধু গান, নাচ বা অভিনয়েই নয়, সামগ্রিকভাবে অনুভা যে কতখানি ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার ছিলেন, তা বোঝা যায়, ‘সাহিত্য ও চিত্রজগৎ’ নামে তাঁর একটি ছোট লেখা পড়লে। এখানে তিনি বলছেন, ছবির জগতের শিল্পীদের নিয়ে পত্রপত্রিকার যে বাড়াবাড়ি, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতির অন্য যে বিরাট ক্ষেত্র রয়েছে বাংলায়, তার কথা যেন গৌণ হয়ে পড়ছে, চিত্রদুনিয়ার পেছনে দৌড়নোর হিড়িকে। এক জায়গায় তিনি লিখছেন, “পত্রিকার প্রশ্ন কে আপনার বেশি প্রিয়, কারোর প্রশ্ন― কী খেতে ভালোবাসেন। শ্রদ্ধেয় সম্পাদক আপনাদের দোহাই আপনারা এবার প্রশ্ন করুন― মায়ের পেটে Artist-রা চোঁয়া চোঁয়া করে কেঁদেছিলেন, না টোঁয়া টোঁয়া করে কেঁদেছিলেন।… দেশটাকে আপনারা কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছেন ভাবতে পারেন। বাংলা সাহিত্য, কাব্য ম্লান মুখে তাকিয়ে আছে বর্তমানের দিকে। আপনারা যেমন করে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের কাছে লেখার জন্যে চেষ্টা করেন তার সিকি কণা কি চেষ্টা করেন সাহিত্যের জন্যে, কাব্যের জন্যে? যে লেখনী যুগ রচনা করে, যে লেখনী ভবিষ্যৎ বলিষ্ঠ সমাজের ইঙ্গিত দিয়ে দেয়, যে চিন্তা স্বতঃস্ফূর্ত জাহ্নবীর মতো ভাঙাগড়ার অধীশ্বর সেই পবিত্র সাহিত্যের আজ স্থান কোথায়?” লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘চলন্তিকা’ পত্রিকার কার্তিক ১৩৫৮ সংখ্যায়। অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৫১ সালে। মনে রাখতে হবে, সেটা অনুভার অভিনেত্রী হিসেবে উত্থানের সময়। ঐ অবস্থায় দাঁড়িয়ে যিনি এরকম মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে পারেন কোনও লেখায়, তিনি কতখানি ব্যতিক্রমী ভাবনার অধিকারী ছিলেন, তা কি নতুন করে বলার? যে দুনিয়ায় তিনি পেশাগতভাবে রয়েছেন এবং যেখানে টিঁকে থাকার অন্যতম চাবিকাঠি হল প্রচার ও প্রচারমাধ্যম, তার অতিব্যবহার নিয়েই এরকম প্রতিবাদী লেখা, বড় কম কথা নয়! এতে তাঁর যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারত। কিন্তু তা তিনি গ্রাহ্য করেননি। তাই, শুধু শিল্পী হিসেবে নন, সব অর্থেই তিনি অনন্যা।

তথ্যঋণ :
১) ‘সোনার দাগ’― গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (যোগমায়া প্রকাশনী, ১৯৮২)
২) ‘সাতরঙ'(দ্বিতীয় খণ্ড)― রবি বসু(দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ১৯৯৮)
৩) ‘নায়কের কলমে’― উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদনা: অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন, জুলাই ২০১৫)
৪) ‘সাতাত্তর বছরের বাংলা ছবি’ ―সংগ্রাহক-গ্রন্থনা-সম্পাদনা: তপন রায় (বাপী প্রকাশনী, আগস্ট ১৯৯৬)
৫) ‘অভিনেত্রী কথা’― সংকলন ও সম্পাদনা : দেবীপ্রসাদ ঘোষ (উর্বি প্রকাশন, ২০০৯)
কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত
জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।