(Jersey)
ছেলেটা ফিরছিল একা। খালি গা। ছেঁড়া জিন্স। ছলছলে চোখ। চুলগুলো ঘাঁটা। আর একটা লাল-হলুদ জার্সি, যথাসম্ভব ভাঁজ করে প্যান্টের ভেতর গোঁজা। আজ ইস্টবেঙ্গল হেরে গেছে। মরশুমের প্রথম ডার্বি! নিজের পাড়ায়, পাঁড় মোহনবাগান একটা পাড়ায়, আজ বুক চিতিয়ে ঢুকতে পারবে না ছেলেটা। কুঁকড়ে যাবে ভীষণ। কুঁকড়ে যেতে যেতে যদি মিলিয়েও যায় ছায়ায়, তবু সে জানে, ছায়াশরীরে লেগে থাকবে অমোঘ দুটো রং। লাল আর হলুদ। ছেলেটার আইডেন্টিন্টির সঙ্গে, এক্সিস্টেন্সের সঙ্গে, রেসিস্ট্যান্সের সঙ্গে কোন ফাল্গুনে যে জুড়ে গিয়েছিল! ছিনে জোঁকের মতো। একশো-হাজার ডলা দিলেও ওঠে না আর। ছেলেটা বুঝতে পারে, এই রং, এই জার্সি তাকে বহন করে যেতে হবে। ধাক্কা খাবে। হাঁটু ছুলে ঘা হবে। কত কত রাত ঘুম আসবে না। সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়… (Jersey)
আরও পড়ুন: প্রতিবেশী: গ্যালারির পড়শিরা
(Jersey) ফেলিক্স আর মারিয়া। ঘানা ছেড়ে পালাচ্ছে। সুদিন দেখবে বলে, খালি পায়ে হেঁটে পেরোচ্ছিল সাহারা মরুভূমি। মারিয়া সাত মাসের সন্তানসম্ভবা। উত্তর-আফ্রিকার স্প্যানিশ টেরিটরি থেকে দুজনকে গ্রেফতার করল পুলিশ। এরপর মারিয়া মিথ্যে বলবে। বলবে যুদ্ধবিদ্ধস্ত লিবিয়া থেকে পালিয়ে এসেছে। তারপর পৌঁছবে স্পেনের বিলবাও শহরে। যে ক্যাথলিক যাজকের আর্থিক এবং সামাজিক সহায়তায় প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছিল মারিয়া, সেই যাজক, সদ্যজাতের পাশে রেখেছিল একটা জার্সি। আপৃথিবীতে, উল্লাস আর বিষাদের মতো অভিবাসনেরও কত আশ্চর্য রং! যেমন ফেলিক্স এবং মারিয়ার অভিবাসনের রং—লাল আর সাদা। অ্যাটলেটিকো বিলবাও ক্লাবের জার্সি। জানেন, এ রং আসলে অভিবাসিত হয়ে এসেছিল বিলবাও শহরে। ক্লাবের জন্মলগ্নে, জার্সির রং নির্বাচিত হয়েছিল—নীল-সাদা। কিন্তু উনিশ শতকে, বিলবাও শহরের যে ছাত্রদল ব্রিটেন গিয়েছিল পড়াশোনা-সূত্রে, পর্যাপ্ত নীল-সাদা জার্সি খুঁজে পায়নি। বরং ব্রিটিশ ক্লাব সাউদ্যাম্পটন এফসি-র লাল-সাদা জার্সি নিয়ে ফিরেছিল তারা। মারিয়ার দ্বিতীয় সন্তান যখন জন্ম নেবে, যেন সে উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে সেই রং। আমরা দেখছি, স্প্যানিশ লা-লিগা কাঁপিয়ে দিচ্ছেন ইনাকি এবং নিকো উইলিয়ামস। আমরা দেখছি, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে উইলিয়ামস ব্রাদার্সের চিরন্তন সংগ্রামে আরও আরও প্রাণ ভরে দিচ্ছে লাল আর সাদা। (Jersey)
আরও পড়ুন: পরিকাঠামো: ক্রীড়া ধ্যান ক্রীড়া জ্ঞান ক্রীড়া চিন্তামণি
(Jersey) রঙের অভিঘাত এমনই! একটি মজাদার পরিসংখ্যানের উল্লেখ করি। কোন রঙের জার্সির জয়ের হার সর্বোচ্চ? লাল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৪৫%। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের কথাই ধরা যাক। লিভারপুল, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এবং আর্সেনাল—তিন জায়ান্ট ক্লাবের প্রিমিয়ার লিগ টাইটেলের সংখ্যা অন্য সমস্ত ইংলিশ ক্লাবের তুলনায় বেশি। আর অদ্ভুতভাবে, তিনটি ক্লাবের জার্সিতেই লাল। প্রসঙ্গত, ইতালিয়ান ক্লাব এসি মিলানের প্রতিষ্ঠাতা হারবার্ট কিল্পিনের একটি উক্তির কথা বলি। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ক্লাবের জার্সির রং লাল আর কালো কেন? হারবার্ট বলেছিলেন, ‘এসি মিলান শয়তানের ক্লাব। তাই বিপক্ষের মনে ও মগজে লাল রং আগুনের মতো জ্বলবে। কালো রং সৃষ্টি করবে ত্রাস।’ (Jersey)
তাই বলে কি সাত রঙের অন্য ছ-টা ফেলনা? একেবারেই তা নয়। একটা ক্লাব-জার্সির এই রঙিন হয়ে ওঠার গল্পে কখনও থাকে প্রতিরোধের ইতিহাস। কখনও মানুষের অপাপবিদ্ধ আবেগ। কখনও মানুষের শ্রমের পরিচিতি। কখনও স্বাধীনতা। হতে পারে সেই রং সাদা। নীল। কিংবা সবুজ-মেরুন। এই ক্ষেত্রে, জাতীয় দলের জার্সির রং তুলনায় সহজ। দেশের জাতীয় পতাকাই সুস্পষ্ট প্রতিফলিত হয়েছে সেখানে।
লিভারপুল, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এবং আর্সেনাল—তিন জায়ান্ট ক্লাবের প্রিমিয়ার লিগ টাইটেলের সংখ্যা অন্য সমস্ত ইংলিশ ক্লাবের তুলনায় বেশি।
(Jersey) বেনীআসহকলায়, আপাতত হলুদ এবং কালোর গল্প বলি। ১৯০৯। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢের দেরি। জার্মানির ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহর ডর্টমুন্ডে তৈরি হল নতুন এক ফুটবল ক্লাব। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। বুন্দেশলিগার দ্বিতীয় জায়ান্ট। ক্লাব-আইডেন্টিটিতে শ্রমিক শ্রেণি ওতপ্রোত জড়িয়ে। মূলত ইস্পাত এবং কয়লা শ্রমিকের রক্তঘামের নির্মাণ এই ক্লাব। তাই ক্লাব-জার্সিতে পুরনো নীল এবং সাদার পরিবর্তে লাগল দুটো রং। ইস্পাত শ্রমিকের হলুদ। কয়লা শ্রমিকের কালো। আশ্চর্য! মাত্র দুটো রং শ্রমিকের প্রতিনিধি হয়ে উঠল ফুটবলে ভর করে এবং তা পুঁজিসর্বস্ব পৃথিবীতে কী ভীষণরকম প্রকট! এভাবেই হয়তো রঙে রঙে জুড়ে যায় কাতারে কাতারে মানুষ! দেশ-সময়কাল-কাঁটাতার পেরিয়ে। তারপর সম্মিলিতভাবে তৈরি করে একটা স্বতন্ত্র পরিচয়। কেবলমাত্র জার্সির রঙের অপরিসীম তেজে আর উদগ্র টানে, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান আর মহামেডান একসঙ্গে পথে নেমেছিল। রাষ্ট্র তো সবসময় বাইনারি তৈরি করতে চায়। ভেঙে দিতে যায় আমাদের যাবতীয় যৌথতা। অথচ ভারতবর্ষের মারকাটারি তিন ক্লাবের তিন জার্সির ছ-টা রং রাষ্ট্রকে বলে বলে গোল দিয়ে হারিয়েছিল। মুহূর্তের জন্যে থামিয়ে দিতে পেরেছিল সরকারের নির্লজ্জ হারাকিরি। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে, সে এক ঐতিহাসিক দিন। (Jersey)
যেমন ইতিহাসের পাতায়, স্পেন-কাতালোনিয়া দ্বন্দ্ব সুপ্রাচীন। এই দ্বন্দ্বে, কাতালান ভাষা এবং সংস্কৃতির পক্ষে, নিপীড়িতের পক্ষে দৃঢ় দাঁড়িয়েছিল যে ফুটবল দল, তার নাম বার্সেলোনা। আমরা দেখেছি, সে ক্লাবের গাঢ় লাল এবং হলুদ সমৃদ্ধ অ্যাওয়ে জার্সি—যা সরাসরি কাতালান পতাকার প্রচ্ছায়ায় তৈরি। দ্বিধাহীনভাবেই। তবে বার্সেলোনার আইকনিক জার্সির রং লাল-নীল কেন? এ-বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। (Jersey)
, কাতালান ভাষা এবং সংস্কৃতির পক্ষে, নিপীড়িতের পক্ষে দৃঢ় দাঁড়িয়েছিল যে ফুটবল দল, তার নাম বার্সেলোনা। আমরা দেখেছি, সে ক্লাবের গাঢ় লাল এবং হলুদ সমৃদ্ধ অ্যাওয়ে জার্সি—যা সরাসরি কাতালান পতাকার প্রচ্ছায়ায় তৈরি।
১৮৯৯। ডিসেম্বর। ফুটবল ক্লাব হিসেবে, সদ্য আত্মপ্রকাশ করেছে বার্সেলোনা। আর্থার এবং আর্নেস্ট—দুই ভাই—প্রস্তাব দিয়েছিল, জার্সির রং হোক লাল আর নীল। ব্রিটেনের যে স্কুলে পড়াশোনা করছিল দু’জনে, মার্চেন্ট টেলার্স, সেই স্কুলের রাগবি দলের জার্সির রং—লাল-নীলের সংমিশ্রণ। এ-প্রস্তাবে, বার্সেলোনার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের মুখ্য, জোয়ান গ্যাম্পার অনেকখানি খুশি। কেন? গ্যাম্পার যে সুইস-ক্লাবে ফুটবল খেলতেন, এফসি বাসেল, সেই ক্লাবের জার্সির রং লাল-নীল। আবার কেউ বলেছেন, সেই সময় লাল আর নীল—দু-মুখো কলমের বহুল ব্যবহারে জার্সির রঙেও তা প্রতিফলিত হয়। কখনও শোনা যায়, ফরাসি বিপ্লবের আঁচ পেয়েই বার্সেলোনার জার্সি রেঙেছিল লাল-নীলে। (Jersey)
(Jersey) লেখার শেষলগ্নে, জার্সির রং-সংক্রান্ত একটি ফুটবল ম্যাচের কথা বলি। হে পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোধগম্য যে, রঙের গভীরে আছে আরও আরও রং। অভিবাসীর। শ্রমিকের। পরাধীনের। তা একেবারে নিজস্ব সংগ্রামের। আর্জেন্টিনার সবচাইতে বিখ্যাত, লাতিন আমেরিকান ক্লাব—বোকা জুনিয়ার্স। যে ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েগো মারাদোনা। লা বোকা। আর্জেন্টিনার শ্রমিক মহল্লা। পাশাপাশি ইতালীয় অভিবাসীদের নিশ্চিত আশ্রয়। উনিশ শতকে, ইতালীয় ছাত্রদের আবেগে-উল্লাসে তৈরি হয়েছিল বোকা জুনিয়ার্স। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, ক্লাব-জার্সির রং প্রথমে সাদা-কালো। কেউ কেউ বলেছেন, গোলাপি রঙের ছোঁয়াচও ছিল। ইতিমধ্যে গোল বাঁধিয়েছে অন্য এক আর্জেন্টিনিয়ান ফুটবল ক্লাব, সান লরেঞ্জো দে আলমাগ্রো। কেন? দুই ক্লাবেরই জার্সির রং এক। সাদা কালো। অগত্যা দুই ক্লাব মুখোমুখি। একটি ফুটবল ম্যাচ। বোকা জুনিয়ার্স হেরে বন্দরে ফিরছে যখন, যখন নিজেদের জার্সির রঙের দখল নিয়েছে সান লরেঞ্জো দে আলমাগ্রো, সেদিন প্রথম যে সুইডিশ জাহাজ বন্দরে পৌঁছয়, তার মাথায় উড়ছিল নীল-সোনালি পতাকা। তৎক্ষণাৎ সকলের সিদ্ধান্তে স্থির হয়, বোকা জুনিয়ার্সের জার্সির রং হবে ওই উড়ান-দেওয়া নীল-সোনালি। (Jersey)
যে ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েগো মারাদোনা। লা বোকা। আর্জেন্টিনার শ্রমিক মহল্লা। পাশাপাশি ইতালীয় অভিবাসীদের নিশ্চিত আশ্রয়। উনিশ শতকে, ইতালীয় ছাত্রদের আবেগে-উল্লাসে তৈরি হয়েছিল বোকা জুনিয়ার্স।
এ-বহুমাত্রিক কথকতা, ক্যাপিটালিস্টিক ফুটবল যত মলিন করে তোলে, জার্সির রং তত বারুদ হয়ে জ্বলে। স্কটল্যান্ডের ‘ওয়ার্কিং-ক্লাস’ ফুটবল ক্লাব সেল্টিকের গ্যালারিতে তাই ওড়ে ফিলিস্তিনি-পতাকা। সদ্য যে টিফো এ-ব্রহ্মাণ্ড আলোড়িত করেছিল, স্পষ্ট ভাষায় লেখা: শো ‘ইজরায়েল’ দ্য রেড কার্ড। এই যে এক জার্সির রঙের প্রতি অন্য জার্সির রঙের সংহতি—তার কথা যদি বসন্তে না লিখি, তবে অস্বীকার করা হয় এই মানুষ। এই প্রকৃতি। রাষ্ট্র যখন প্রতিনিয়ত চাইছে এক রঙের দেশ গড়তে, ঠিক তখনই, কোনও মহাজাগতিক বলে, পলাশ ফোটে। শিমূল ফোটে। বাগানবিলাস আর নীলমণিলতা যেন নক্ষত্রের মতন ঝরে ঝরে পড়ে আমার দেশের বুকে। আমি বুঝি রেসিস্ট্যান্স। আপনি? (Jersey)

রোদ্দুর মিত্র
রোদ্দুর এমন একটা বই যার ফ্রণ্ট কাভারে সিনেমা আর ব্যাক কাভারে ঘুম। মধ্যে অনেকগুলো পাতা। লেখা ও না-লেখা। সসম্মানে অঙ্কে তৃতীয় বর্ষের পড়াশোনা শেষ করে স্নাতকোত্তরে প্রবেশ করলেও, হিসেবনিকেশ গুলিয়ে দেওয়াই রোদ্দুরের প্রধান কাজ।