পুরনো কলকাতার পোষ্য সংস্কৃতি নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম এই ওয়েব ম্যাগাজিনেই বছরকয়েক আগে। যার শিরোনাম ছিল সম্ভবত— ‘বাবু কোলকেতার পোষ্য বৃত্তান্ত’। সেখানে মূলত সেই সময়ের কোলকাতার বাবুসমাজ তথা রহিসি মহলের পশুপাখি পোষার হরেক বিচিত্র কিস্সা শুনিয়েছিলাম সামান্য সবিস্তারে। লক্ষ্ণৌ থেকে নির্বাসিত হয়ে কলকাতায় চলে আসা নবাব ওয়াজেদ আলি শা থেকে শুরু করে এ শহরের একাধিক ধনী পরিবারই ছিলেন সেইসব কিস্সার মূল কুশীলব। তবে সেসময় শহরে উচ্চবিত্ত মানুষদের বিপরীতে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এই পশুপাখি পোষার রেওয়াজটা কিন্তু সেভাবে ছিল না। ওই রাস্তার কুকুরকে খেতে দেওয়া, দুয়েকটা হুলো মিনিকে ঘরে রাখা আর খাঁচায় এক-আধটা টিয়া, তোতা বা মুনিয়া পোষা ছাড়া। মূলত ৫০ দশকের মধ্যভাগ থেকে এই দৃশ্যপটটা পাল্টাতে শুরু করল একটু একটু করে। ধনী মানুষদের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের পোষ্য সংস্কৃতিতেও একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করল ধীরে ধীরে। সাবেকি কলকাতার বাবুদের গায়ে এই পোষ্য রহিসির ছোঁয়াটা লেগেছিল মূলত নবাব ওয়াজেদ আলি শা এবং ব্রিটিশ রাজপুরুষদের হাত ধরে। দেখাদেখি মল্লিক প্যালেস, পাথুরেঘাটা, শোভাবাজার, ঠনঠনে, কলেজস্ট্রিটের দত্ত, ধর, রায়, মিত্তির, সরকার, লাহাবাবুরাও পুষতে শুরু করলেন বিচিত্র সব পোষ্য। তাদের প্রাসাদোপম বাড়ির অলিন্দে ঘুরে বেড়াতে শুরু কর হরেক প্রজাতির ছোটবড় বিদেশি কুকুর। যার মধ্যে গ্রেট ডেন, সেন্ট বার্নার্ডের মতো ব্যাঘ্রাকৃতি কুকুর থেকে শুরু করে মধ্যমাকৃতি জার্মান শেফার্ড (অ্যালসেশিয়ান) হয়ে ক্ষুদ্রাকৃতি বুলডগ, টিবেটিয়ান লাসা অ্যাপসো, সিডনি সিল্কি, পকেট ডগ চি হুয়া হুয়ার নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। পাখির তালিকায় প্রথম পছন্দ ছিল অবশ্যই কাকাতুয়া। সেসময়কার বাবুসমাজে আদতে অস্ট্রেলিয়া নিবাসী এই পাখিটির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। বনেদি বাড়ির চকমেলানো উঠোনে লোহার দাঁড়ে বসা গম্ভীরমুখো কাকাতুয়া— এ দৃশ্য ৬০-এর দশকেও চোখে পড়ত হরবখত। এছাড়াও ম্যাকাও, আফ্রিকান গ্রে প্যারট, ককাটিল, লাভবার্ড, চন্দনা আর আসামি ময়নার মতো পাখিও থাকত তাঁদের খাঁচার শোভা বর্ধন করে।

বাবুদের পায়রা ওড়ানো, বুলবুলির লড়াই, দেশিবিদেশি বহুমূল্য ঘোড়া নিয়ে মাতামাতির কথা তো আজ প্রবাদ বা কিংবদন্তিতে পরিণত। এ মাতামাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আলি শার মেটেবুরুজের আলিশান হাভেলির চিড়িয়াখানার মতোই মার্বেল প্যালেসের মল্লিকবাবুরাও তাঁদের প্রাসাদের বিশাল বাগানে বানিয়ে ফেলেছিলেন আস্ত একটা চিড়িয়াখানা। বাঘ, সিংহ, শিম্পাঞ্জি, জেব্রা থেকে পেলিক্যান— কী ছিল না সেখানে! রাজা ধরণীধর রায়ের শখ ছিল কুকুরের। সায়েবসুবোদের থেকেই এই শখটা পেয়েছিলেন তিনি, এটা নিশ্চিত। সারমেয়র এক বিশাল সংগ্রহ ছিল তাঁর। এহেন রাজা ধরণীধরের শখ হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে ছোট কুকুর নিজের সংগ্রহে রাখার। সেই ইচ্ছে পূরণ করতে রাজবাড়িতে এসেছিল বড়সড় বাছুরের আকারের গ্রেট ডেন আর রাজার আচকানের জেবে ঢুকে যেতে পারে, এতটাই খুদে মেক্সিকান চি হুয়া হুয়া।
বাবুদের পায়রা ওড়ানো, বুলবুলির লড়াই, দেশিবিদেশি বহুমূল্য ঘোড়া নিয়ে মাতামাতির কথা তো আজ প্রবাদ বা কিংবদন্তিতে পরিণত। এ মাতামাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আলি শার মেটেবুরুজের আলিশান হাভেলির চিড়িয়াখানার মতোই মার্বেল প্যালেসের মল্লিকবাবুরাও তাঁদের প্রাসাদের বিশাল বাগানে বানিয়ে ফেলেছিলেন আস্ত একটা চিড়িয়াখানা। বাঘ, সিংহ, শিম্পাঞ্জি, জেব্রা থেকে পেলিক্যান— কী ছিল না সেখানে!
আরবি, রাজস্থানি, ব্রুহ্যাম, ওয়েলার, হাঙ্গেরিয়ান স্ট্যালিয়নের মতো সব বহুমূল্য ঘোড়ার কালেকশনে সায়েবসুবো রাজপুরুষদেরও লজ্জায় ফেলে দিতে পারতেন বিডন স্ট্রিটের ছাতুবাবু লাটুবাবুরা। বেলেঘাটার নস্করবাড়ির বিশাল অ্যাভিয়ারিতে বন্দি অবস্থায় ডিম ফুটে বাচ্চা হয়েছিল ম্যাকাওয়ের। আর এসবের পাশাপাশি ওই একটু আগেই যা বললাম, ৫০-এর দশক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পোষ্য সংস্কৃতিও পাল্টাতে লাগল একটু একটু করে। দুটো এঁটোকাঁটা বা ছাঁট মেখে দেওয়া কালুভুলুর পাশাপাশি বাড়িতে আসতে শুরু করল পমেরেনিয়ান, স্পিৎজ, লাসা, ডাকশুন্ড, এমনকি অ্যালশেসিয়ানের মত বৃহদাকৃতি কুকুরও। ম্যাকাও, কাকাতুয়া, গ্রে প্যারট না হোক– বদ্রিকা, ফিঞ্চ, লাভবার্ড, ককাট্যিলের মত বিদেশি পাখিও ঢুকে পড়ল পোষ্য তালিকায়। অ্যাকোয়ারিয়মের রঙিন মাছ তো মধ্যবিত্ত ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকে পড়ল হতদরিদ্রের আঙিনায়। এল খরগোশ, গিনিপিগ, সাদা বিলিতি ইঁদুর। একইভাবে পায়রাও। তবে শহরের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত সমাজে পায়রা তথা কবুতরবাজির ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ১৮০০ শতক থেকেই, মূলত বাবু সংস্কৃতি আর নবাবি ঘরানার হাত ধরে। বনেদি বাড়ির ছাদ থেকে টালিখোলার চালের মাথায় পায়রার ব্যোম, কলকাতার পুরনো পাড়া আর সংখ্যালঘু মহল্লার সিম্বল ছিল বহুকাল ধরেই। আর এই চাহিদা পূরণ করতেই গজিয়ে উঠেছিল হাতিবাগান হাট। প্রাথমিক স্তরে মূলত পায়রার হাট হিসেবে পরিচিত হলেও আজ কুকুর, পাখি, মাছ আর সেইসব পোষ্যদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রি— এককথায় কী না পাওয়া যায় এই পোষ্য পশরার হাটে। এরকমই আরও বেশ কয়েকটি পশুপাখির হাট আছে এ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে আকারে বা বিকিকিনির প্রশ্নে তারা কেউই হাতিবাগান হাটের সমকক্ষ নয়।

কালগ্রাসে শহরের বাবুদের অবস্থা যত পড়তির দিকে ঝুঁকতে লাগল, ততই পোষ্যদের রাশটা ক্রমাগত চলে গেল নব্য মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণির হাতে। এরা সবাই হয় উচ্চপদস্থ চাকুরিজীবী, নয়তো ব্যবসায়ী। হাতে অঢেল অর্থ, ফলে সাবেকি ‘বাবু পেট কালচার’কে বেহেড লজ্জা দিয়ে পুষতে শুরু করলেন ডোবারম্যান, রটওয়েলার, পাগ আর বক্সারের মতো কুকুর যা সাবেকি বাবুদের সংগ্রহে দেখা যায়নি খুব একটা। ৭৫০ থেকে বড়জোর ১৫০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে অবলীলায় নিয়ে আসতে শুরু করলেন ল্যাব্রাডর, গোল্ডেন রিট্রিভার, সাইবেরিয়ান হাস্কি, এমনকি গ্রেট ডেন, সেন্ট বার্নার্ড, ইংলিশ ম্যাস্টিফের মত দানবাকৃতি সারমেয়দের। একবার ভেবেও দেখলেন না এতটুকু জায়গা ওদের জন্য যথেষ্ট কি না, অথবা এই আবহাওয়া এদের পক্ষে আদৌ উপযুক্ত কি না! টাকা আর জাঁক দেখানোই হয়ে উঠল এদের মূল উদ্দেশ্য। আর এই চাহিদা বা বৈভব প্রদর্শনের সুযোগ নিয়েই গজিয়ে উঠল ডগ ব্রিডার বা সেলার নামক লাখ লাখ দালাল। এদের নানাবিধ কার্যকলাপ কশাইকেও লজ্জা দেবে। শুধু সেটুকু নিয়ে বলতে গেলেই হাজারখানেক পাতার একটা বই হয়ে যাবে। ফলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে আরেক পোষ্যর বিষয়ে যাই।
৭৫০ থেকে বড়জোর ১৫০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে অবলীলায় নিয়ে আসতে শুরু করলেন ল্যাব্রাডর, গোল্ডেন রিট্রিভার, সাইবেরিয়ান হাস্কি, এমনকি গ্রেট ডেন, সেন্ট বার্নার্ড, ইংলিশ ম্যাস্টিফের মত দানবাকৃতি সারমেয়দের। একবার ভেবেও দেখলেন না এতটুকু জায়গা ওদের জন্য যথেষ্ট কি না, অথবা এই আবহাওয়া এদের পক্ষে আদৌ উপযুক্ত কি না! টাকা আর জাঁক দেখানোই হয়ে উঠল এদের মূল উদ্দেশ্য।
পাখি— সাবেকি বাবুদের ম্যাকাও, কাকাতুয়া আর গ্রে প্যারটের সীমা ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের এই শখের তালিকায় অধুনা যুক্ত হয়েছে টোউকান (ধনেশ পাখির দক্ষিণ আমেরিকান জ্ঞাতিভাই), চ্যাটারিং লোরি, লরিকিট, আমাজন প্যারট— এরকম হাজারো প্রজাতির বিদেশি পাখি। পাশাপাশি বদ্রিকা, ফিঞ্চ, লাভবার্ড, জাভা স্প্যারো, বারবারি ডাভ আর ককাট্যিলরা মধ্যবিত্ত পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে নিম্নবিত্তের ঘরেও। একই সঙ্গে চলছে জিন কালচার আর জিন মিউটেশনের মাধ্যমে একই প্রজাতির পাখির হাজাররকম রং পরিবর্তন। অধিক প্রজনন। আর অধিক প্রজনন মানেই অধিক মুনাফা। শুধু এবং শুধুই মুনাফা— এই তারিকায় কোনওরকম নীতি বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ধার না ধেরে, সহজাত প্রাকৃতিক ধারাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার এবং অবজ্ঞা করে চলছে বেপরোয়া জিন মিউটেশন আর সেম ব্লাডলাইন ব্রিডিং। যার নিট ফল— স্বল্পায়ু, ক্ষীণজীবী, একাধিক রোগভোগের শিকার হচ্ছে পোষ্যরা। শুধু পাখি নয়, মাছ, কুকুর— প্রতিটি পোষ্যের ক্ষেত্রেই এটা সমপরিমাণে সত্যি।

এবার আসা যাক রোডেন্ট প্রজাতির পোষ্য মানে খরগোশ, গিনিপিগ, সাদা ইঁদুর ইত্যাদির প্রসঙ্গে। সেই খরগোশেরও হাজাররকম প্রজাতির নিত্যনতুন আমদানি হয়েছে পোষ্য বাজারে। সাধারণ গিনিপিগের পাশাপাশি এসেছে লোমে ঢাকা পেরুভিয়ান গিনিপিগ। সাদা ইঁদুর ছাড়াও তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে হ্যামস্টার, জারবিলের মত খুদে পোষ্যরা। পোষা হুলো, মিনির জায়গা নিতে শুরু করেছে বহুমূল্য পার্শিয়ান, সায়ামিজ প্রজাতির বিদেশি বেড়ালরাও— বছর দশ-বারো আগেও যা অকল্পনীয় ছিল। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরণের বিদেশি মুর্গিও খুব দ্রুত ঢুকে পড়ছে বাঙালির পোষ্য তালিকায়। লখনওভি আর হায়দরাবাদি ‘আসিল’ লড়াকু মোরগের চাহিদা তো যাকে বলে একেবারে তুঙ্গে ট্যাংরার চিনেপাড়া আর শহরের সংখ্যালঘু মহল্লাগুলোয়। একদা নবাবি আর বনেদি পরিবারগুলোর জাঁকজমক এবং ঐতিহ্যের প্রতীক পায়রা বা কবুতরবাজির শখ দীর্ঘকাল ধরেই ছড়িয়ে পড়েছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সীমানা ছাড়িয়ে নিম্নবর্গের আঙিনায়। সেখানেও আজকাল হররোজ আমদানি ঘটছে নিত্যনতুন প্রজাতির, যার স্বল্প কিছু অরিজিলাল স্পিসিস আর বেশিরভাগটাই জিন কালচার আর মিউটেশনের ফসল। যার কু-প্রভাবটা পরিলক্ষিত হচ্ছে এখানেও।

অতঃপর মৎস্য প্রসঙ্গ। রঙিন মাছ বলতে পোষ্য পালকরা আগে জানতেন ২ থেকে ৪ ফুটের একটা অ্যাকোয়ারিয়াম, সেই অ্যাকোরিয়ামের তলায় বালি বা কাঁকর, হাট থেকে কেনা বা কোনও জলাশয় থেকে তুলে আনা অক্সিজেন প্ল্যান্ট জাতীয় গাছ, খাদ্য হিসেবে অতি নিম্নমানের ড্রাই ফুড বা জীবন্ত কেঁচো, অক্সিজেন সরবরাহের জন্য সস্তা একটা পাম্প আর এঞ্জেল, সোর্ডটেইল, মলি, গাপ্পি, গোরামি, গোল্ডফিশ, প্লাটি, লোচ, জেব্রা, টাইগার বার্ব, ডিসকাস, ফাইটারের মতো বড়জোর গোটা বিশ পঁচিশেক প্রজাতির মাছ।
৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকেই খুব দ্রুত বদলে যেতে শুরু করল এই ছবিটা। কত হাজার প্রজাতির রঙিন মাছ যে আসতে শুরু করল ভারতের বাজারে তার ইয়ত্তা নেই, যার মধ্যে আগে অনেকের নামই শুনিনি আমাদের ছেলেবেলায়। যেরকম ব্ল্যাক ঘোস্ট, এলিফ্যাল্ট নোজ, ক্রোকোডাইল সাকার ফিশ, পিরানহা, পাকু, এ্যরোয়ানা, ফ্লাওয়ার হর্ন, এ্যালিগেটার গার, অস্কার ইত্যাদি। আবার পুরনো এঞ্জেল বা গোল্ডফিশের ঘন ঘন মিউটেশন ঘটিয়ে মানুষ নামক ইশ্বরপ্রতিম নিয়ন্ত্রকের হাতে তৈরি হতে লাগল হাজারটা নতুন প্রজাতি। সঙ্গে এল বিদেশি দামি শুকনো খাবার বা ড্রাই ফুডের প্যাকেট, বিভিন্ন ধরণের দামি পাওয়ার ফিলটার, সূর্যের আলোর বিকল্প এল ই ডি লাইট, কাচাধারের পিছনে লাগানোর দৃশ্যপট সম্বলিত পোস্টার, হরেকরকম নতুন নতুন প্রজাতির জলজ গাছ। সব মিলিয়ে উন্নত বিশ্বের পোষ্য জগতে একটা আধুনিকতম অ্যাকোয়ারিয়ামের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই মিলতে শুরু করল এ দেশে আর এ শহরে। অতঃপর শুধু মিষ্টি জলের মাছ পুষেই ক্ষান্ত হল না এ শহরের পোষ্য-পালকেরা। পুষতে হবে সামুদ্রিক মাছ। তার জন্য চাই মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম। চাই সাদা বালি, প্রবাল, বিশেষ ফিল্টার, বিশেষ খাবার…আরও বহুকিছু।

ক্রমেই বেড়ে চলেছে মানুষের পোষ্য শখের দৌড়। চাইলেই পাওয়া যাবে চাহিদা ও মর্জি মতো পোষ্য। শুধু পকেটে ঠিকঠাক রেস্তটি থাকা চাই। বেপরোয়া এই পোষ্য শখ কোন কোন দিক থেকে কী কী ক্ষতি করছে এক এক করে তার একটা খতিয়ান দিই এখানে। প্রথমেই যেটা জানানো প্রয়োজন, ভারতীয় বন্যপ্রাণ আইন ও দণ্ডবিধি অনুসাারে হাঁস, মুরগি, পায়রা, গোরু, ছাগল, কুকুর, বেড়াল ছাড়া ভারতীয় আর যে কোনও পশুপাখি ধরা, শিকার করা বা পোষা গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। তবু হাতিবাগান সহ আরও একাধিক পোষ্য হাটে প্রতি হাটবারে লুকিয়ে-চুরিয়ে বিক্রি হয় টিয়া, চন্দনা, ময়না, তোতা, মদনা, ফুলটুসি, দিশি মুনিয়া এমনকি বাজ (ফ্যালকন) বা শিকরে বাজের (স্প্যারো হক) মতো বিপন্ন প্রজাতির পাখি। বর্তমানে বন্যপ্রাণ দফতরের কড়াকড়িতে সেসব অনেকটা রোধ করা গেলেও অন্য আরেক পথ খুলে গেছে। এদেশে বাজ, শিকরে বাজ, টিয়ার মতো পাখি ধরা বা পোষা নিষিদ্ধ। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে নয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শ্যাম অঞ্চলের থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো পৃথিবীতে যে কোনও পোষ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। বিশেষত থাইল্যান্ড। ঠিকঠাক গ্যাঁটের কড়ি খসাতে পারলে আইনসম্মত কাগজপত্র সহ এখানে কিনে ফেলা যায় কাকাতুয়া, ম্যাকাও, বাজ, সুগার গ্লাইডার (উড়ন্ত কাঠবিড়ালি), হেজহগ (কাঁটাচুয়া, শজারুর ক্ষুদ্রাকৃতি জ্ঞাতি ভাই) বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি সাপ আর কচ্ছপ।
এখানে মনে রাখা দরকার আমাদের এখানে দেশজ সাপ, কচ্ছপ, বাজ, কাঠবিড়ালি, টিয়া ধরা বা পোষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাইরের অনেক দেশেই এই পোষ্যগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে বেশ ভালোরকম। আর আইনি কাগজপত্র সহ এদের পোষাটাও দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। আর ম্যাকাও, কাকাতুয়া, গ্রে প্যারট, লোরি, আমাজন প্যারট, লরিকিটের মত পাখি সহ বিদেশি সাপ, কচ্ছপ, কাঠবিড়ালি, ট্যারান্টুলা মাকড়শা, ইগুয়ানা (লাতিন আমেরিকান বৃহদাকার গিরগিটি) পোষাটা কোনও দণ্ডনীয় অপরাধই নয় এদেশে। শর্ত একটাই। প্রাণীটি বিদেশি হওয়া চাই। এই সূত্র ধরেই ভারতের বুকে গড়ে উঠেছে একাধিক ‘এক্সক্লুসিভ পেট শপ’। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে সরাসরি এইসব ‘এক্সক্লুসিভ’ পোষ্যরা এসে পৌঁছে যাচ্ছে এ দেশের পেট শপগুলোয়। মোটামুটি এক হাজার থেকে আট দশ লাখ খরচ করতে পারলেই যে কেউ পেয়ে যেতে পারেন ট্যারান্টুলা স্পাইডার, স্কারলেট ম্যাকাও, সুগার গ্লাইডার, এ্যালডেবরান টরটয়েজ, রেড ইয়ার স্লাইডার টার্টেল, গ্রিন ইগুয়ানা, আমাজন প্যারট, বল পাইথন বা পিগমি মারমোজেট ফিঙ্গার মাংকির মতো সব বিশেষ ধরনের পোষ্যদের।

এই অবধি পড়ে অনেকেরই মনে হতে পারে এ তো সম্পূর্ণ আইনি ব্যবসা। ধোঁয়াটে কিছু তো দেখছি না এর মধ্যে। না, যতটা ভাবছেন আসলে ব্যাপারটা মোটেই অতটা সিধেসাদা নয়। থাইল্যান্ড হোক বা ভারত, এই সমস্ত পেট শপ ওনার বা পশুপাখির ব্যবসাদারদের প্রায় প্রত্যেকেরই আছে ব্রিডিং লাইসেন্স, সোজা বাংলায় পোষ্য প্রজনন অনুমতিপত্র। আর এই ‘গ্রে জোন’ দিয়েই শুরু হয় আসল খেলাটা। ব্রাজিলের আমাজন রেইন ফরেস্ট থেকে পাচার হয়ে চলে আসা চারটে বহুমূল্য হাইসিন্হিয়ান ম্যাকাওয়ের ছানা বা ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কোনও একটা ছোট দেশের জঙ্গল থেকে তুলে আনা রেড ইগুয়ানার বাচ্চা চোরাপথে থাইল্যান্ড, মায়নামার, বাংলাদেশ হয়ে সোজা চলে এল ভারতে। তারপর ছড়িয়ে পড়ল দিল্লি, মুম্বাই, কোলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, পুনে, হায়দরাবাদের এক্সক্লুসিভ পেট ডিলারদের কাছে। এদের সবার কাছেই এইসব বিশেষ পোষ্যদের কিছু পুরনো স্টাড বা ব্রিডিং পেয়ার আগে থেকেই সংগ্রহে থাকে। ফলে পাচার হয়ে আসা প্রাণীগুলোকে ‘ঘরের বাচ্চা’ হিসাবে দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না।
ব্রাজিলের আমাজন রেইন ফরেস্ট থেকে পাচার হয়ে চলে আসা চারটে বহুমূল্য হাইসিন্হিয়ান ম্যাকাওয়ের ছানা বা ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কোনও একটা ছোট দেশের জঙ্গল থেকে তুলে আনা রেড ইগুয়ানার বাচ্চা চোরাপথে থাইল্যান্ড, মায়নামার, বাংলাদেশ হয়ে সোজা চলে এল ভারতে। তারপর ছড়িয়ে পড়ল দিল্লি, মুম্বাই, কোলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, পুনে, হায়দরাবাদের এক্সক্লুসিভ পেট ডিলারদের কাছে।
এই একই ঘটনা ঘটে মাছের ক্ষেত্রেও। ঘরে ব্রিডিং পেয়ারের বাচ্চা, এই অজুহাতে সমুদ্র জুড়ে প্রায় ডাকাতি করে তুলে নেয়া হচ্ছে অসংখ্য মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ, মিনিয়েচার অক্টোপাস, স্কুইড, স্টিং রে, নিরীহ প্রজাতির হাঙর, লুট হচ্ছে কোরাল রিফ বা প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ। মিষ্টি জলের অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছের ক্ষেত্রে বিপদ আসছে অন্যভাবে। পাকুর (পিরানহা মাছের নিরীহ নিরামিষাশী প্রজাতি) ঝাঁকের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে চলে আসা হচ্ছে ভয়ঙ্কর হিংস্র এবং পোষ্য হিসেবে নিষিদ্ধ রেড বেলিড আর ব্ল্যাক পিরানহা। দাঁতের পার্থক্য ছাড়া চেহারা হুবহু একরকম। খালি চোখে দেখে ফারাক বোঝা অসম্ভব। আসছে অ্যালিগেটার গার আর অ্যারোয়ানার মতো মাছ, যারা আকারে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় পাঁচ-ছ ফুট অবধি পৌঁছতে পারে। ক্রেতারা কিছুমাত্র না জেনে-বুঝে কিনে ফেলছেন এসব মাছ। বিক্রেতারাও মুনাফার লোভে বেচেই খালাস। ক্রেতাকে কোনওরকম তথ্য দিচ্ছেন না তাঁরা। পরে বাড়তে শুরু করলে বিপদ বুঝে নিয়ে গিয়ে চুপচাপ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় পুকুর বা নদীতে। হিংস্র স্বভাবের এইসব মাছের হাতে ব্যাপকহারে মারা পড়ছে স্থানীয় মিষ্টি জলের মাছেরা। একই বিপদ ঘটছে ম্যাটাম্যাটা টার্টেল, স্ন্যাপার টার্টেল, রেড ইয়ার টার্টেল প্রজাতির কচ্ছপদের এভাবে স্থানীয় জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়ার ফলে। বিপর্যস্ত, ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য আর জীব বাস্তুতন্ত্র।

মাছ, পাখি আর বিশেষ ধরণের সব পোষ্য পর্ব শেষ করে এবার আসি বিদেশি কুকুর প্রসঙ্গে। এই পোষ্যের বিপদগুলো কিঞ্চিৎ অন্যধরণের। মানুষের সবচেয়ে পুরনো বন্ধু এই প্রাণীটি আজও সারা দুনিয়া জুড়েই পোষ্য তালিকায় এক নম্বরে। এই পোষ্যের সমস্যাটা আবার দুদিক থেকে। একদিকে অতিরিক্ত স্নেহ, আদরযত্ন আর ভালবাসা— অন্যদিকে অপরিসীম লোভ আর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। প্রথমটির প্রসঙ্গেই আসি আগে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে বাড়িতে কুকুর নিয়ে আসা। যার প্রকৃষ্টতম উদহারণ ল্যাব্রাডর রিট্রিভার নামক কুকুরটি, যা ‘ল্যাব’ নামে অধিক পরিচিত এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় এ শহর তথা সারা দেশের সারমেয়প্রেমী সমাজে। জার্মান শেপার্ড, ডোবারম্যানের মতোই ল্যাবও মধ্যম বৃহদাকৃতির কুকুর। আদতে গানডগ বা রিট্রিভার বিভাগের এই সারমেয়টির প্রয়োজন নিয়মিতভাবে প্রচুর দৌড়ঝাঁপ বা সাঁতার জাতীয় ব্যায়াম। সেই পরিমাণ জায়গা তাদের বাসায় দেওয়া সম্ভব কি না, যতটা ব্যায়াম নিয়মিতভাবে তাকে করানো দরকার সেটা সাধ্যে কুলোবে কি না, এসব না ভেবেই পোষ্যপ্রেমীরা তাঁদের ৬০০-৭৫০ স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাটে নিয়ে চলে আসেন এরকম একটা কুকুরকে। নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব আর যথেচ্ছ পরিমাণ খেতে দেওয়া, যার ফল স্থূলতা এবং অনেকসময় হৃদরোগে মৃত্যু। ফলে অতিরিক্ত স্নেহও কখনও কখনও প্রিয় পোষ্যর ক্ষতি বা অত্যাচারের নামান্তর হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় বিপদটা আক্ষরিক অর্থেই ভয়ংকর। যার মূল কারণ মূলত কেনেল ওনার, ডগ ব্রিডার, ট্রেনার নামক কিছু নরপশু। এদের এতরকম কীর্তির কথা জানি তা নিয়ে সবিস্তারে লিখতে গেলে একটা আস্ত মহাভারত হয়ে যাবে। তাই এই মহানদের দুয়েকটি কীর্তির কথা বলেই এই পোষ্য আখ্যানে দাঁড়ি টানবো। এ শহরেরই এক নামী ব্রিডার বহু অর্থ ব্যয় করে অত্যন্ত হাই পেডিগ্রি বা উচ্চ বংশতালিকাভুক্ত একটি কুকুর আনিয়েছিলেন বিদেশ থেকে, তার বাচ্চা বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করবেন এই আশা নিয়ে। পরবর্তীতে যখন জানতে পারেন কুকুরটি প্রজননে অক্ষম তখন সুস্থ প্রাণীটিকে ইঞ্জেকশনে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। তার খেকে রোজগারের কোনও সম্ভাবনা নেই, শুধুমাত্র এই কারণে।
দ্বিতীয় ঘটনাটিও কিছু কম মারাত্মক নয়। মধ্য কলকাতার বিখ্যাত ধনী এক বাঙালি স্বর্ণ ব্যবসায়ী পরিবার। তারাও এরকমই একটি হাই পেডিগ্রির ব্লাড লাইনের জার্মান শেফার্ডের (অ্যালসেশিয়ান) মেল পাপি বা পুরুষ বাচ্চা আনিয়েছিলেন খোদ জার্মানি থেকে। বড় হওয়ার পর তার প্রশিক্ষণের ভার তুলে দিয়েছিলেন এক নামী ডগ ট্রেনারের হাতে। রোজ সকালে কুকুরটিকে বাইরে হাঁটাতে নিয়ে যেত সেই প্রশিক্ষক। কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারের লোকজনরা লক্ষ্য করলেন কুকুরটা ক্রমাগত রোগা এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে। একাধিক পশু চিকিৎসক দেখিয়ে, গাদাগাদা স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার তথা হেলথ ফুড, টনিক খাইয়েও কোনও ফল পাওয়া গেল না। সমস্যা থেকেই গেল। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের কয়েকজনের সন্দেহ হওয়ায় বাড়ির একজন বিশ্বস্ত কাজের লোককে ওই প্রশিক্ষককে নিয়মিত অনুসরণ করতে বললেন তারা। দুদিনের মধ্যেই রহস্যের পর্দা ফাঁস! কুকুরটিকে ঘোরানোর নাম করে রোজ স্থানীয় একটা পার্কে নিয়ে যায় ওই প্রশিক্ষক। দু-তিনদিন বাদে বাদেই সেখানে এসে হাজির হন ওই একই প্রজাতির স্ত্রী কুকুরের মালিকরা। মোটা অর্থের বিনিময়ে ওই উচ্চ বংশীয় সারমেয়টির সঙ্গে শারীরিক মিলন, পোষ্য দুনিয়ায় ভাষায় ‘মেটিং’ করান তারা। ব্যাপারটা ঘটে সপ্তাহে চার থেকে পাঁচবার। যেখানে ভেটেরিনারি সিস্টেম বা প্রজননতন্ত্র অনুযায়ী একটা সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান কুকুরকে এই মেটিং করানো যায় মাসে বড়জোর তিন থেকে চারবার। শুধুমাত্র মোটা টাকা কামানোর লোভে কুকুরটাকে ক্রমাগত বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছিল নরপশু ওই প্রশিক্ষক।
রোজ সকালে কুকুরটিকে বাইরে হাঁটাতে নিয়ে যেত সেই প্রশিক্ষক। কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারের লোকজনরা লক্ষ্য করলেন কুকুরটা ক্রমাগত রোগা এবং দুর্বল হয়ে পড়ছে। একাধিক পশু চিকিৎসক দেখিয়ে, গাদাগাদা স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার তথা হেলথ ফুড, টনিক খাইয়েও কোনও ফল পাওয়া গেল না। সমস্যা থেকেই গেল। এ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের কয়েকজনের সন্দেহ হওয়ায় বাড়ির একজন বিশ্বস্ত কাজের লোককে ওই প্রশিক্ষককে নিয়মিত অনুসরণ করতে বললেন তারা। দুদিনের মধ্যেই রহস্যের পর্দা ফাঁস!
এই ধরণের নরপশু নামক ব্রিডার বা ট্রেনাররাই ন্যূনতম কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই অজস্রবার মেটিং করিয়ে যায় তাদের পোষ্যদের। ক্রমশ প্রজনন ক্ষমতা কমতে থাকলে সস্তা থেকে আরও সস্তাদরে ব্রিডার থেকে ব্রিডারে হাতবদল ঘটতে থাকে। অবশেষে একেবারেই প্রজনন-অক্ষম হয়ে পড়লে পরিত্যক্ত অবস্থায় রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয় পোষ্যটিকে। এই অ্যাবানডান করে দেওয়ার ঘটনা প্রতি বছর একধিকবার ঘটছে এবং ঘটেই চলেছে এই শহরে। এর জন্য দায়ী কিছু সাধারণ পোষ্য পালক বা কোট আনকোট পেট লাভার বা পেট কিপারও। কিছুই না জেনে-বুঝে কুকুর কিনে এনে পরে ঝক্কি সামলাতে না পেরে কোনও নির্জন হাইওয়ের ধারে বা বাজার এলাকায় অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া, এজাতীয় নিষ্ঠুরতম, চরম অমানবিক ঘটনার উদাহরণও নেহাত কম নয় আমাদের চারপাশে। শুধু কুকুর নয়, অন্যান্য পোষ্যদেরও এজাতীয় অমানবিকতা বা চরম নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয় আকছার। এই একই আচরণ দেখা যায় একাধিক পশু চিকিৎসকের মধ্যেও। পোষ্যের প্রতি তার পালকদের অপরিসীম ভালোবাসা, এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের প্রায় সর্বস্বান্ত করে ছাড়েন তারা। স্রেফ অবহেলাজনিত চিকিৎসার কারণে মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দেন পোষ্যটিকে। কখনও কখনও আইন আদালতের চৌকাঠ অবধিও পৌঁছে যায় বিষয়গুলো। যা আমরা প্রায়ই শুনতে বা দেখতে পাই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। তবে এর বিপরীতে এরকম প্রচুর ব্রিডার আছেন, যারা এই বিশেষ ধরনের ব্যবসাটি নিয়ম মেনেই করতে চান। তাদের কাছে পোষ্য শুধুমাত্র একটা ব্যবসার সামগ্রী নয়, প্রাণও বটে। আছেন এরকম বহু চিকিৎসক আর প্রশিক্ষকও, যারা পালকদের প্রতারিত না করে প্রকৃত চিকিৎসায় সুস্থ করে তুলতে চান, তুলতে চান সঠিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে তুলতে। আছেন সেইসব পালকেরা, যারা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় পোষ্যদের সন্তানতুল্য স্নেহ করেন। সমাজে আজও এরাই বিপুল পরিমাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আজকের পোষ্য পরিমণ্ডলে আশার কথা এটাই।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
2 Responses
অসাধারণ একটি লেখা।
লেখক আমাদের ঘরের আশেপাশে পশুপাখি দের ওপর নিত্যদিন যে অমানবিক অত্যাচার হয়ে চলেছে তার ছবিটি তুলে ধরেছেন।
অসংখ্য ধন্যবাদ। আরো প্রত্যাশা রইলো।
অসাধারণ। প্রায় সব রকমের পোষ্য নিয়েই লেখা। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাক্তিগত জীবনেও খুব পোষ্য প্রেম না থাকলে এমন লেখা বের হয়না। এমন নানা নতুন বিষয়ের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।