(Menu Card)
এক ঝলকে একদম যেন আধার কার্ড, আর তাতে সংযুক্ত করা কিউআর কোড! কলকাতার নবদম্পতির বিবাহের এমন চমকপ্রদ মেনু কার্ড নজরে এসেছিল অনেকেরই। সেই কার্ডেই আধার নাম্বারের মতন বিয়ের তারিখ যেমন লেখা তেমনই লেখা পদতালিকায় কী কী আছে। আর অবশ্যই পাত্র ও পাত্রীর নাম তো থাকবেই! এভাবেই ভাইরাল হয়েছিল অভিনব এই মেনু কার্ড, তবে বিয়ের মেনুর লেগ্যাসি কিন্তু বেশ পুরনোই। বিয়ের মেনু-র প্রসঙ্গ যখন এল, তখন বিয়ের আমন্ত্রণের কথাই বা আসবে না কেন? তাহলে বরং একটু পিছন ফিরে তাকানো যাক। (Menu Card)
আরও পড়ুন: বিবাহ রন্ধন: বিয়ের ছবির ভাগচাষ
বিবাহ বা বিয়ে বিষয়টার ভিতর যেমন ঐতিহ্য ও পরম্পরার ধারণাটি মিশে আছে, তেমনই এক ঐতিহ্য বিবাহের নিমন্ত্রণ বা আমন্ত্রণের ভিতরেও ছিল! অবশ্যি এই জেনারেশন ই-কার্ডের জমানায় সেসব আমন্ত্রণকে বিশেষ মনে রাখেনি। মধ্যভারতে একসময় হলুদ চাল বা ‘পিলে চাওয়াল’ পাঠানোর প্রথা প্রচলিত ছিল বিবাহের আমন্ত্রণ হিসেবে। মনে করা হত হলুদ চাল একটি শুভ অনুষ্ঠান শুরু করার প্রতীক। (Menu Card)
মধ্যভারতে একসময় হলুদ চাল বা ‘পিলে চাওয়াল’ পাঠানোর প্রথা প্রচলিত ছিল বিবাহের আমন্ত্রণ হিসেবে।
বহু আগে কোনও কোনও পরিবার তাঁর পরিচিতদের নিমন্ত্রণ জানাতেন ‘শামুক ডাক’ সহযোগে! ভেবেও অবাক হতে হয়। আত্মীয়দের প্রথমে মনোহর পত্রিকার মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হত, তারপর পাঠানো হত শামুক ডাক। একসময় বিবাহের কার্ড লেখা হত হাতে কিন্তু সময় ও প্রযুক্তির নিয়মে সেইসব এখন অতীত। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আসে ছাপা কার্ড, বদলায় ছাপার প্রযুক্তি ও ধরনও। কখনও লিথোগ্রাফ, কখনও বা থার্মোগ্রাফ বা লেটারপ্রেস প্রিন্টিং তো কখনও আবার ব্লাইন্ড এমবসিং বা অফসেট প্রিন্টিং; নানান ধরন ও ধারণে বদলেছে সনাতনী কার্ডের ঐতিহ্য! কেবল ধরন নয়, বদলেছে ভাষাও। একসময়ের কঠিন, মার্জিত, গদ্যরীতির ব্যবহার ধীরে ধীরে হয়েছে সাবলীল, সহজ থেকে সহজতর। ছোটো কবিতা বা গানের লাইন কখনও কখনও জুড়ে দেওয়া হয়েছে কার্ডের ভাষায়। সময়ের দাবি মেনে এভাবেই বদলে বদলে গেছে ‘যদিদং হৃদয়ং তব’-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ! (Menu Card)
আরও পড়ুন: বিবাহ রন্ধন: চিঠি কি এসব বোঝে! বেনারসি আসে যায় ওদের বিয়ের কথা হোক…
(Menu Card) এখন তো প্রায় সবার হাতেই মোবাইল আর তাতে হোয়াটসঅ্যাপ। বোলপুরের এক নবদম্পতি তাতেই ভাইরাল হয়ে গেলেন! কারণটা বেশ মজার, পুরো মেনুকার্ডটাই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের আদলে তৈরি! আইফোনের আদলে তৈরি করা হয় তাদের মেনু কার্ড আর তাতেই হরেক পদের খবর উঠে আসে চ্যাটিংয়ের ভঙ্গিতে। যেমন ধরুন চ্যাটিংয়ে দুই ব্যক্তির কথোপকথন চলছে, “কী মেনু করলেন?” তার উত্তরে কিছু পদের নাম, আবার প্রশ্ন, “এরপর কি আর কিছু, কোন ক্যাটারিংকে দায়িত্ব দিলেন?” তার উত্তরে আরও পদ ও ক্যাটারিং সার্ভিসের পরিচয়! (Menu Card)
পুরো মেনুকার্ডটাই হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের আদলে তৈরি! আইফোনের আদলে তৈরি করা হয় তাদের মেনু কার্ড আর তাতেই হরেক পদের খবর উঠে আসে চ্যাটিংয়ের ভঙ্গিতে।
(Menu Card) মেনু কার্ডের এমন অভিনব প্রয়োগ তো নজর কাড়বেই তবে মেনুকার্ড সংগ্রহের বাতিক আছে বলে একজনের বদনাম ছিল, আর তিনিই কী না হয়ে গেলেন ‘অভিনব সংগ্রাহক’! ব্যক্তির নাম ভাস্কর চক্রবর্তী, আসানসোলের বাসিন্দা তিনি। তাঁর সংগ্রহে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি মেনু কার্ড! মেনু কার্ড বিষয়টি যখন প্রায় জানতই না আমজনতা, সেই সময়ে অভিজাত পরিবারের মেনু কার্ডের আভিজাত্যও ছিল তাক লাগানো! ১৯০৬-এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির মেনু কার্ডে ছিল ৩৬ রকমের পদ! ভাস্করাবুর সংগ্রহ এমনই সব চমকপ্রদ ইতিহাসের হদিশ দিয়েছে। তেমনই আরেক সংগ্রাহক গৌতমকুমার দে। গড়িয়ার বাসিন্দা গৌতমবাবুর সংগ্রহশালা আরও এগিয়ে, তাঁর সংগ্রহে প্রায় ৬০০০ মেনু কার্ড! সবচেয়ে পুরনো মেনু কার্ডটির বয়স ৯৩ অথবা ৯৪। (Menu Card)
আরও পড়ুন: বিবাহ রন্ধন: বিয়ের গপপো: হারানো রীতির কয়-কাহন
এই বয়স ধরে আপনাকে ফিরে যেতে হবে ১৯১৭-তে অলোকেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়ির বিয়েতে। সেখানে পেয়ে যাবেন ‘মোগলাই শাকভাজা’ থেকে ‘মোগলাই আলুভাজা’; আবার ১৩৪০ বঙ্গাব্দে সলিসিটর রবীন্দ্রচন্দ্র দেবের মেয়ের পাকা দেখার মেনু কার্ডে চলে আসবে মোচার কাটলেট! মডার্ন আর্টপ্রেস থেকে ছাপানো সেই মেনুকার্ডে কেবল ১১২টি রকমারি পদই নেই, গোটা মেনুটিই একটি অপূর্ব সিল্কের রুমালে ছাপা! প্রবীণ ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথের ছেলের বিয়ের মেনু কার্ডটি ১৮ পাতার একটি ‘মিনিবুক’, তাও আবার রঙিন ফোর কালার পেপারে ছাপা! তারই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ছিল এই ছড়া—
“নেই সিগারেট, নেইকো বিড়ি
নেইকো মদ্যপান
পানমশলা ও দোক্তা খৈনি
নেইকো গাঁজা ও ভাঙ
দুঃখিত ভাই দুঃখিত!”
মেনু কার্ড থেকে বিয়ের কার্ড, পরিবর্তন তো সময়সাপেক্ষ! তাই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না বিশেষ। কাগজ ও কার্ডের নানান বাহার নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে সারি বেঁধে থাকেন দোকানিরা।
এই মেনুকার্ডের ইতিহাস থেকেই একটি বিচিত্র কাজের বিষয়ে জানা যায়। যারা করতেন এই কাজ, তাদের বলা হত ‘হাঁকিয়ে’, পোশাকি নাম ‘ফুঁকে-দা’! এদের কাজ ছিল বিয়েবাড়িতে খানেওয়ালাদের নজরে রাখা আর নতুন পদ এন্ট্রি নিলেই হেঁকে জানান দেওয়া। (Menu Card)
মেনু কার্ড থেকে বিয়ের কার্ড, পরিবর্তন তো সময়সাপেক্ষ! তাই মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না বিশেষ। কাগজ ও কার্ডের নানান বাহার নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে সারি বেঁধে থাকেন দোকানিরা। কত রঙের এবং ঢঙের কার্ড ছিল আমাদের ছোটোবেলায়। লাল, নীল, হলুদ তো ছিলই তার উপর কখনও লাল, সোনালি বা রূপালি রঙের লেখা! কোনও কার্ডে আবার কাঠের ছোটো ব্লক ডিজাইন করে বসানো থাকত। এমন বেশকিছু কার্ড মনে পড়ে, পাত্র-পাত্রীর ছবি আঁকা। কোনও কোনও কার্ড হত মখমলের মতো নরম, তেমনই তুলোট কাগজ বা ভূর্জপত্রের ধাঁচে বানানো কার্ডগুলিও ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। বর-কনের পরিচিতির বাইরেও এইসব কার্ডে থাকত দিকনির্দেশ। (Menu Card)
আরও পড়ুন: হারিয়ে-যাওয়া গির্জা, ভাঙা স্কুলবাড়ি তথা আগরপাড়ার মিশন-কাহিনি
(Menu Card) কোন রাস্তায় কীভাবে গেলে পৌঁছানো যাবে বিয়েবাড়িতে, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ ছিল বেশ চিত্তাকর্ষক! বিয়ের কার্ডের ছাপার কালির বিশেষ এক গন্ধ পাওয়া যেত। অনেক পরে জানতে পারি সেই গন্ধ সিল্ক স্ক্রিনের কালির গন্ধ। বদলে গেছে বিয়ের ধরন-ধারণ। বদলেছে সম্পর্কের সমীকরণ, আর সব বদলের ফাঁকে ফাঁকে হারিয়ে যেতে বসেছে বিয়ের কার্ড থেকে মেনু কার্ডের রকমারি বাহারও! ই-দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগত জানাতে চলে এসেছে ডিজিটাল নিমন্ত্রণ কার্ড। মোবাইলে অনায়াসেই সেই কার্ড শেয়ার করে দেওয়া যায়। বাড়ি গিয়ে কার্ড দিয়ে আসার খরচ এবং পরিশ্রম দুইই বাঁচে। অন্যদিকে মডিউলার বাড়িতে ঘর নোংরাও হয় কম! তেমনই মেনু এখন কার্ডের বদলে সার্ভ হয় সোজা প্লেটে। বিভিন্ন পদ যেখান থেকে তুলে নিচ্ছেন, তার তলায় ছোটো করে লেখা থাকে পদের নাম! পরিবর্তনের ডিজিটাল দুনিয়ায় বিবর্তনের নিয়মেই না হয় একদিন হারিয়ে যাবে কাগজে ছাপা কার্ডের আভিজাত্য ও বংশকৌলিন্য; মেনে নেওয় ছাড়া আর কীই-বা করি বলুন তো? (Menu Card)
তথ্যঋণ:
লেখাটির ক্ষেত্রে আনন্দবাজার ডিজিটাল, প্রতিদিন ডিজিটাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস অনলাইনসহ কিছু অনলাইন ওয়েবজিন ও পোর্টালের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রহর ডট ইন-এর একাদশ অশ্বারোহী নামক ডিজিটাল ক্রোড়পত্রটিও বিশেষ সহযোগিতা করেছে।
বিতান দে, বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, অনুরাগী ও পাঠক। খাদ্য সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভালোবাসেন সিনেমা দেখতে ও খেলাধূলার চর্চা করতে। প্রকাশনা এবং কপি এডিটের নেশাকে পেশায় রূপদানের চেষ্টায় আছেন।