(Sholay)
পঞ্চাশ বচ্ছর ধরে ‘হিট’। জনপ্রিয় তো শুধু সিনেমা নয়, জনপ্রিয়তার শিখরে এ ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গান, আবহ-সংগীত, অভিনয় তো বটেই, এমনকি এই ছবির প্রোডাকশন ডিজাইন, অ্যাকশন দৃশ্যের পরিকল্পনা থেকে দৃশ্যগ্রহণ, সম্পাদনা— যা এক অর্থে একটি ছবির টেকনিক্যাল দিক— সেখানেও এই ছবি এক্কেবারে দুর্দান্ত জনপ্রিয়। (Sholay)
সত্যি বলতে, আম দর্শক-শ্রোতা যেমন এই পঞ্চাশ বচ্ছর ধরে বহুবার দেখেছে, তেমনভাবেই ফিল্ম-শিক্ষার্থীদের কাছেও এই ছবি অবশ্য-‘পাঠ্য’। আবার সমাজ-বিজ্ঞানের ছাত্র গবেষকের কাছেও ‘শোলে‘ একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘বই’। ‘বই’ বলতে কেবল তাকে শুধু মুখ-বোলতি সিনেমা অর্থে নয়, টেক্সট অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে এই ‘বই’ শব্দটি। (Sholay)

গত পঞ্চাশ বছরে তাই ‘শোলে’-র জনপ্রিয়তার সঙ্গে যেমন ওতপ্রোত জুড়ে আছে এর শিল্পরূপ, তেমনই কোন গুণে এতদিন ধরে এই ছবি ভারতীয় জনগণমনে স্থায়ী জায়গা করে রাখল, সেটিও ভারী অনুসন্ধানের বিষয়। মধ্যভারতে ডাকাতির ইতিহাস, স্বাধীনতা- পরবর্তী ভারতের বাস্তবতায় এক অত্যাশ্চর্য পর্ব। ঠাকুর সম্প্রদায় তথা উচ্চবর্গীয় মানুষের প্রবল ও নিষ্ঠুর প্রতাপের বিরোধিতা থেকে, এখানকার ডাকাতদের উত্থান বলা যেতে পারে। তথাকথিত সভ্য আর ভদ্দরলোক ভারতের চোখে, তারা ছিল ডাকাত। শোলে এই ভদ্দরলোক ভারতীয়দের চোখে তৈরি গব্বর সিংকে ভিলেন বানানোর প্রকল্প। এদিক থেকে গল্পটা সাজালে এখন অন্যভাবে পড়তে চাইবে মন! সে না হয় অন্য পাঠ। (Sholay)
ছবির এই কাহিনির পাঠে এ আখ্যান বস্তুত দুর্ধর্ষ ডাকাতদের ধরার গল্প। এখানে ডাকাতরাই নিষ্ঠুর। তারাই অত্যাচার করে সাধারণ মানুষের ওপর। এই প্রচলিত আখ্যানকে অবলম্বন করে তৈরি, এই ছবির কাহিনি আর চিত্রনাট্য। একদিক থেকে দেখলে, ‘শোলে’, ভারতীয় একটি ছবি ঠিক কোন কোন গুণে জনপ্রিয়তার শিখর স্পর্শ করতে পারে, তার এক মেড ইজি। অ্যাকশন, চেজ সিকোয়েন্স, নানা ধরনের ইমোশন বা ভাবাবেগকে ঠিকঠাক মাপে মেশানো আর তাকে পুরো ছবি জুড়ে ছড়িয়ে রাখার দুরূহ কাজটি অত্যন্ত সহজ আর সাবলীলভাবে করা হয়েছে। প্রতিটি চরিত্র আর প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যে একাধিক বিপরীত ইমোশনের যাতায়াত। কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ অফিসারের মধ্যে একদিকে সাহসিকতা আরেকদিকে সকল কাছের মানুষকে চোখের সামনে হারানোর শোক। (Sholay)
দু’জন জেল-ফেরত চোর, যাদের সঙ্গে সমাজের যোগাযোগ দাঁড়িয়েই আছে শুধু অবিশ্বাস আর তঞ্চকতার ভিতের ওপর, সেই তাদের নিজেদের মধ্যে রয়েছে অসামান্য এক বন্ধুত্বের বাঁধন। তাদের ভেতর একজন লঘু চপল স্বভাবের তো অন্যজন বেশ গম্ভীর এবং সিরিয়াস। একজনের প্রেম, ছলবলে-খলবলে টাঙ্গাওয়ালির সঙ্গে, তো আরেকজনের ভালবাসা ধীরস্থির শিক্ষিত উচ্চবর্গীয় এক বিধবা নারীর প্রতি। প্রথম সম্পর্কটিতে আছে উচ্ছ্বাস আর হইচই আর দ্বিতীয় সম্পর্কের মধ্যে আছে নিরুচ্চার ভালবাসা আর শোভা-সম্ভ্রম দূরত্বের গাম্ভীর্য। (Sholay)
একদিকে দৃষ্টিহীন দরিদ্র মুসলিম, এক সহজ সরল বৃদ্ধ যাঁর চরিত্রের কেন্দ্রে আছে সকলের প্রতি অপত্য স্নেহ, সেই মানুষটিকেই হারাতে হল নিজের সন্তানকে। অন্যদিকে আছে সুরমা-ভোপালির মতো চরিত্র বা সেই ওভারস্মার্ট হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চাওয়া পুলিশ অফিসার।
একদিকে দৃষ্টিহীন দরিদ্র মুসলিম, এক সহজ সরল বৃদ্ধ যাঁর চরিত্রের কেন্দ্রে আছে সকলের প্রতি অপত্য স্নেহ, সেই মানুষটিকেই হারাতে হল নিজের সন্তানকে। অন্যদিকে আছে সুরমা-ভোপালির মতো চরিত্র বা সেই ওভারস্মার্ট হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চাওয়া পুলিশ অফিসার। এই যে তাঁর নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে চাওয়ার ইচ্ছে এবং প্রতি পদে তাঁর নিজেকে হাস্যাস্পদ করে তোলার ধরন, তা অতিনাটকীয় হতে পারে, তবে সেটাও মনোরঞ্জনের চমৎকার উপাদান। অনেক কিছুই অতিনাটকীয় মনে হতে পারে সম্পূর্ণ ছবিতে, কিন্তু তা মনে হওয়ার আগেই সংলাপের গুণে আর অভিনয়ের কৌশলে, আমাদের মনোরঞ্জন করে ফেলেছে। (Sholay)
এই হরেক ভাল লাগার আরেকটা অব্যর্থ জায়গা এই ছবির গান। সব কটাই, যাকে বলে, হিট! আর সেই সব গান-ও জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রত্যেকে কাটিয়ে দিয়েছে অর্ধ শতক! ছবিটিতে ছিল মোট পাঁচটি গান। সেই সব গানের কথায় একটু বিস্তারে আলাপ করা যাক। (Sholay)

‘শোলে’-র গানগুলো লক্ষ করে দেখবেন, একেবারে দর্শক-শ্রোতা যে-গান শুনতে ভালবাসে বা ভালবাসবে, এ যেন তার একটা প্রপার প্ল্যাটার! একটা বন্ধুত্বের গান— হুল্লোড়ে মোড়া (ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে)। একটি হোলির গান (হোলি কে দিন)— তারও মূল ধরন হইচই! তিন নম্বরে আছে একেবারে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে এক প্রেম নিবেদনের গান: ‘কোই হাসিনা জব রুঠ জাতি হ্যায়)! তা নিয়ে আমরা কেউ কেউ আপত্তি করতে পারি, বিতর্ক তৈরি করতে পারি, কেন এমনটাই হবে প্রেমনিবেদনের ধরন? কিন্তু জনপরিসরের মূল প্রবাহ, সে বিতর্ক করে না, তাকে মেনে নেয়। সেখানেই তার জনপ্রিয়তার জড়! এখানেই সফল ওই প্রেম নিবেদনের গানখানা! আছে একটা এক্কেবারে ছক-মানা আইটেম সং ‘মেহেবুবা মেহেবুবা’! (Sholay)
আর একটি গান হল প্রেমিকের প্রাণ-প্রার্থনা করে প্রেমিকার আত্মনিবেদনের গান: যব তক হ্যায় জান জানে জাঁহা ম্যায় নাচুঙ্গি’। পুরুষতান্ত্রিক সমাজমন, এই নাচই মধ্যযুগে বেহুলার পায়েও দেখেছিল। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়’! এই যে বিপন্ন নারী তাঁর প্রেমিক পুরুষের প্রতি প্রেমের জন্যেই প্রায় আত্মসম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে অন্য এক পুরুষের কাছে তাঁর লাস্যময় বিভঙ্গে নৃত্য প্রদর্শন করছেন— জনপ্রিয় মাধ্যমে এ এক অদ্ভুত চিত্র-শব্দময়ী উপস্থাপনা পুরুষতান্ত্রিক দর্শকের দৃষ্টিকোণে। এখানে প্রেমিকার ভালোবাসার পরাকাষ্ঠাও প্রকাশিত আর দর্শকের ভয়াবহ ভয়ারিজম— সেও সম্পূর্ণত পরিতৃপ্ত! মোট কথা, একেবারে জনগণমনের চাহিদা মেনেই এই ছবির সংগীত পরিকল্পনা। সেই উদ্দেশ্যগুলি একেবারে সফল। কেবল সফলই নয়, হাজার বিতর্কের মুখে ছাই দিয়ে সেই গানের জনপ্রিয়তার বয়সও ‘শোলে’ ছবির সঙ্গেই অর্ধ শতাব্দী পার করে দিল! (Sholay)
ছবির গানের লেখক হিসেবে নিজের নাম বদলে নেন একটু! দেশভাগের সময় পশ্চিম পঞ্জাব থেকে এপারে আসেন আর জীবনের একপর্বে তিনি ভারতীয় নৌসেনায় যোগ দিয়ে, পরে আসেন গানের জগতে। ‘শোলে’-র জন্য যখন গান লিখছেন তিনি, ততদিনে তিনি স্বনামধন্য।
গানের কথা লিখেছিলেন আনন্দ বক্সী (১৯৩০-২০০২)! তাঁর আসল নাম ছিল বক্সী আনন্দপ্রকাশ বৈদ্য। ছবির গানের লেখক হিসেবে নিজের নাম বদলে নেন একটু! দেশভাগের সময় পশ্চিম পঞ্জাব থেকে এপারে আসেন আর জীবনের একপর্বে তিনি ভারতীয় নৌসেনায় যোগ দিয়ে, পরে আসেন গানের জগতে। ‘শোলে’-র জন্য যখন গান লিখছেন তিনি, ততদিনে তিনি স্বনামধন্য। ততদিনে ‘ববি’, ‘অমর প্রেম’, ‘আরাধনা’, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ছবির গান লিখে প্রভূত জনপ্রিয়। (Sholay)
এই গীতিকার ‘শোলে’ ছবির গান লিখতে বসে, এক অদ্ভুত কাজ করেন, তা হল, ছবির গল্পের সঙ্গে অনায়াসে জুড়ে দেন গানের কথা। গান শোনার সময় মনেই থাকে না, সেটা গানের কথা? নাকি ছবির সংলাপ? ধরা যাক, ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ গানটির কথাই। এমনিতে বন্ধুত্বের কথা বলে, খাওয়া-দাওয়া আমাদের একসঙ্গে, বাঁচা-মরা আমাদের একসঙ্গে কথা তো আসেই, তার সঙ্গেই আসে কাহিনির ইঙ্গিত। তাই, ছবির শেষে যে-দৃশ্য আসবে, মানে জয়-এর মৃত্যু আর তার সামনে বীরুর ভেঙে পড়া, তারই এক মুখড়া যেন এই প্রথম গানের কথা। (Sholay)

তা না হলে, এই গানের কথায় কেন গীতিকার লিখবেন, ‘তোড়েঙ্গে দম মগর, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে’। ছবির শুরুতে যে কথাগুলি আসে হুল্লোড়ের সুরে, ছবির শেষে তা-ই ফিরে আসে অন্য অর্থে। আর শুধু এই কথাটিই বা কেন, তারা তাদের বন্ধুত্বের খাতিরে একসঙ্গে গায়: ‘জান পে ভি খেলেঙ্গে/ তেরে লিয়ে লে লেঙ্গে/ সবসে দুশমনি’। আসন্ন গল্পের সূচনা করে দেয় এই গান! কাহিনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে লেখা গানের কথা। শুরুর গানের কথায় ছিল, দুই বন্ধুর একসঙ্গে চলার অঙ্গীকার, কিন্তু ছবির শেষে জয়ের মৃত্যুর পরে ওই গানেই আরেকটি স্তবক যোগ করা হল। বলা হল, বন্ধু, তুমি তো বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। তুমি আমাকে ফেলে একা এগিয়ে চলে গেলে। শুরুর গানে ছিল, একসঙ্গে চলার অঙ্গীকার। বলা হয়েছিল, ‘খানাপিনা সাথ হ্যায়/ মরনা-জিনা সাথ হ্যায়’, ‘চল দিয়া ইস তারা রাহো মে তু মুঝে পিছে ছোড়কে/ আগে তু নিকল গয়া/ সাথী তু বদল গয়া’। (Sholay)
এই গল্পের সূত্র বলার মতো করে গানের ভেতর দিয়ে সংলাপ বলার ধরনটি বারেবারে ফিরে আসবে গোটা ছবির গানে। সে টাঙ্গাওয়ালি বাসন্তীকে বীরুর প্রেমনিবেদনের গানেই হোক বা তাদের হোলি-র গানে। লক্ষ করলে চোখে পড়বে, কানে ধরবে, ‘কোই হাসিনা যব রুঠ যাতি হ্যায় তো/ ঔর ভি হাসিন হো যাতে হ্যায়’ গানটি। গাইয়ে বীরু প্রেম নিবেদন করছে টাঙ্গাওয়ালির প্রতি, তাই গানের কথা তৈরি হল, ‘হাঁথো মেঁ চাবুক, হোঠোঁ পে গালিয়া/ বঢ়ি নখরেওয়ালি হোতি হ্যায় টাঙ্গেওয়ালিঁয়া’। তারপরে ‘কোই টাঙ্গেওয়ালি যব রুঠ যাতি হ্যায় তো/ ঔর নমকিন হো যাতি হ্যায়’। এই লাইনটিতে আসার জন্য গীতিকার শ্রোতাকে তৈরি করেছেন গানের একেবারে দ্বিতীয় চরণ থেকে। প্রথম লাইনে ‘হাসিন হো যাতি হ্যায়’-র পরের চরণে ছিল স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে গেলে ‘এক-দো-তিন হো যাতি হ্যায়’। এমনিতে মনে হত, এই স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার কথা কোথা থেকে এল? এটা কি শুধু মিল দেওয়ার জন্যেই লেখা! আসলে, তার মানে হল, স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন সুন্দর কিন্তু শব্দ করে ট্রেন যখন ছুটতে থাকে, তখনই তার আসল সৌন্দর্য ধরা পড়ে। এই উপমাতে বলা হল নায়িকার সৌন্দর্যের কথা! সে এমনিতে ‘হাসিন’, কিন্তু রেগে গেলে সে আরও সুন্দর! এই চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে চলন্ত টাঙ্গাওয়ালির যোগ তৈরি করে তৃতীয় স্তবকে বলা হল, সে এমনিতে সুন্দর হলেও অমন তর্জন-গর্জনেই আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এ সত্যিই একেবারে এই ছবির জন্য তৈরি গান। এমন নয়, একটি গান তৈরি ছিল, তাকে বসানো হল ছবিতে। (Sholay)
রামপুর গ্রামের হোলির দিন যে গানটি গাওয়া হয়, বাইরে থেকে হোলির গান। বাইরে থেকে একজন নায়ক আর নায়িকার তরজার মতো, কথার পিঠে কথার লড়াই চলতে থাকে গোটা গানে। তবে এহো বাহ্য। আসলে হোলির আবহের হই-হুল্লোড়ের পাশে থাকে জয়ের ভালবাসার পাত্রীর বৈধব্যের ছবি।
রামপুর গ্রামের হোলির দিন যে গানটি গাওয়া হয়, বাইরে থেকে হোলির গান। বাইরে থেকে একজন নায়ক আর নায়িকার তরজার মতো, কথার পিঠে কথার লড়াই চলতে থাকে গোটা গানে। তবে এহো বাহ্য। আসলে হোলির আবহের হই-হুল্লোড়ের পাশে থাকে জয়ের ভালবাসার পাত্রীর বৈধব্যের ছবি। একদিকে রঙিন উৎসব, আরেকদিকে তার পোশাকের সাদা রঙ। শুধু তাই কেন, একেবারে আইটেম সং নামাঙ্কিত ‘মেহেবুবা মেহেবুবা’ গানটিতে যেভাবে মরুপ্রদেশের যন্ত্রায়োজনে গানটি গাওয়া হয়, জিপসিদের সুরের হিল্লোলে ছলাৎ করে ওঠে মন, সেটা তো অভিনব বটেই। তার সঙ্গে কথাতেও আছে অন্যরকম এক আঁচ। এমনিতে তাঁর নৃত্যের বিভঙ্গ যেমনই হোক, গানের কথাগুলি লক্ষ করলে দেখবেন সেখানে একটা সম্পূর্ণ প্রেমের গানই গাওয়া হয়েছে। যে গানের মোট কথাটা হল, ‘হে প্রিয়তমা, তুমি আর আমি মিলিত হলে, সমস্ত সৌন্দর্য সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।’ (Sholay)
কিন্তু ডাকাত গব্বর সিংয়ের আস্তনায় এই হুল্লোড়ের গানের দরকার ছিল অন্য দিক থেকে। কারণ, ওই হোলির দিন সকলে যখন মেতে ছিল, তখন গব্বরের দল অকস্মাৎ আক্রমণ করে রামপুর গ্রামের শান্তি নষ্ট করেছিল, তাই তার ডেরাতেও বীরু আর জয় হানা দিয়ে আক্রমণ করে তাদের মোচ্ছবের মহা-মুহূর্তেই! মনে আছে নিশ্চয়ই, দুটি দৃশ্যেই ঠিক একই ভাবে এই দুই গানের শেষে ঘটে দুটি বিস্ফোরণ, জ্বলে যায় তাঁবুর কাপড়। ছবির মানচিত্রে যেন প্রতিশোধের গল্প লেখা হয়। (Sholay)

এইভাবেই ‘জব তক হ্যায় জান/ জানে জাঁহা/ ম্যায় নাচুঙ্গি’ গানটিও, পুরোপুরি সংলাপ। সেখানে গানের মাঝখানে সুরের ভেতরেই আছে দৃশ্যের প্রসঙ্গ। মনে পড়বে, গানের ভেতরেই কখনও আছে বাসন্তীর ক্লান্তির স্বর, কখনও আছে তাঁর পায়ের সামনে কাচ ভেঙে তার ওপর দিয়ে নাচতে বলার হুমকি, কখনও আছে বন্দুকের ট্রিগার টানার শব্দ, বাসন্তীর হাতে বীরুর গেঞ্জির কাপড় ছেঁড়ার শব্দ আবার মাঝে মাঝেই বাসন্তী ক্লান্ত হলে, সব শব্দকে ছাপিয়ে আছে সুরেতেই মোড়া কয়েকটি নিঃশব্দ-মুহূর্ত। এর সবটাই গল্পের সঙ্গে গান আর সুরকে ওতপ্রোত করে রাখে। গানের কথায় যেমন সংলাপ আছে, তেমনই সুরের ফাঁক আর তালের মধ্যেও বোনা আছে গল্প। গান হিসেবে, এ এক অভিনব সৃজন। চিত্রনাট্য, সংলাপ, গানের কথা আর সুর এবং তারই সঙ্গে সাউন্ড ডিজাইন, কোরিয়োগ্রাফি— সব একাকার হয়ে রয়েছে এই গানে। এই সমস্ত যথাযথভাবে মেশে সম্পাদনার নিখুঁত কাটা-জোড়াতে। এই সব কটি ঠিক-ঠিক পরিমাপে মিলে আছে বলেই বোধহয় এই গানটির অভিঘাত এখনও ভারতীয় ছবিতে এক কথায় বিস্ময়কর! (Sholay)
এখানে বলা দরকার, এই ছবির জন্য তৈরি হলেও একটি গান কোনওদিন ব্যবহৃত হয়নি আর। একটি গান এই ছবির জন্য তৈরি হয়েছিল, পুরোপুরি কাওয়ালির ধরনে।
পুনশ্চ:
এখানে বলা দরকার, এই ছবির জন্য তৈরি হলেও একটি গান কোনওদিন ব্যবহৃত হয়নি আর। একটি গান এই ছবির জন্য তৈরি হয়েছিল, পুরোপুরি কাওয়ালির ধরনে। সেই গান গেয়েছিলেন নাকি স্বয়ং গীতিকার আনন্দ বক্সী। সঙ্গে সহশিল্পী ছিলেন কিশোরকুমার, মান্না দে, ভূপিন্দর। গানটি অবশ্য ছবির জন্য শুট করাও হয়নি, ফলে ব্যবহৃতও হয়নি। কেবল এই গানটি থেকে গেছে ‘শোলে’-র ভিনাইল রেকর্ড-এ। সেইভাবেই এসেছিল বাজারে। বেশ বড় গান, প্রায় এগারো মিনিটের গান। কিন্তু আহা, কী তার কথা! ‘শুরু হোতা হ্যায় ফির বাতোঁ কা মৌসম/ সুহানি চাঁদনি রাতোঁ কা মৌসম।’ এত চমৎকার একটা গান তৈরি করেও তা ব্যবহৃত হল না যে, তার মধ্যে আছে পরিচালক রমেশ সিপ্পির পরিমিতিবোধের পরিচয়। তেমনই এই হারিয়ে যাওয়া গানটি শুনে এখনও বোঝা যায়, গান নিয়ে কী উচ্চ স্তরের আর কী ধরনের নিরীক্ষা হত আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। শোলে-র পঞ্চাশে তাই তার যা পেয়েছি, তা যেমন গর্বের ততটাই গর্বের তার থেকে যা পাইনি তা-ও! (Sholay)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
ছবি সৌজন্য – আন্তর্জাল
শুভেন্দু দাশমুন্সী
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, স্যর গুরুদাস মহাবিদ্যালয়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, গবেষক, সত্যজিৎ রায় বিশেষজ্ঞ। চিত্রনাট্যকার। গুপ্তধন সিরিজের সোনাদা চরিত্রের স্রষ্টা। গীতিকার। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত সার্ধশতবার্ষিক রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পাদক।