আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১]
দশ বছরের সেই মেয়েটিকে আমরা এখন চিনি। মহারাষ্ট্রের নাইগাঁও গ্রামের মেয়ে, বিয়ে হয়ে পুণেতে এসেছে। বিয়ে হয়েছে জ্যোতিবার সঙ্গে। জ্যোতিবা ফুলে, মহারাষ্ট্রের ফুলে সম্প্রদায়ের তেরো বছরের ছেলেটি শুরু থেকেই কতটা অন্যরকম তাও আমাদের অজানা নয়। দলিত হয়েও বেশ কিছুটা পড়াশুনো শেখার সুযোগ পেয়েছিল সে।
কিন্তু সেখানেই থেমে থাকে না জ্যোতিবা। সাবিত্রীকেও শিক্ষিত করে তোলে। তার জাতির, বা তার থেকেও জাতিগতভাবে নীচে অবস্থিত মাহার আর মাং জাতিদেরও পড়াবার উদ্যোগ নেয়। ফলত, বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। এক মুসলিম বন্ধু, ওসমান শেখের বাড়িতে আশ্রয় নেয় জ্যোতিবা, কিছুদিন পরে চলে আসে সাবিত্রীও। সেখানে চলতে থাকে সাবিত্রীর পড়াশুনো, আর জ্যোতিবার স্কুল, দুইই। সালটা ১৮৪৮।
[the_ad id=”266918″]
সাবিত্রী এখন আর ছোটটি নেই। আট বছর প্রায় পেরিয়ে গিয়েছে বিয়ের পর। বিয়ের আগেও সে অল্পস্বল্প লেখাপড়া জানত, সেই দেখেই তো খুশি হয়ে তাকে পড়াতে শুরু করে জ্যোতিবা। জ্যোতিবা নিজে প্রায় আটক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল– ইংরেজি, ল্যাটিন, ভূগোল, সবকিছুই জানত কিছুটা করে। সাবিত্রীকেও শিখিয়েছিল সবটাই। পরে জ্যোতিবার বন্ধু কেশব শিবরাম বাভালকরের কাছেও রীতিমত পড়াশুনো চলে সাবিত্রীর। তার পরামর্শেই আহমেদনগরে মিস মিচেলের নর্মাল স্কুল আর মিস ফারারের টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ভর্তি হতে যাবে সাবিত্রী।

পুণে থেকে আহমেদনগরের দূরত্ব ৭৫ মাইল। এত দূরের কোনও জায়গায় সাবিত্রী কখনও যায়নি। শুধু যাওয়া তো নয়, সেখানে থাকতে হবে, পড়াশুনো শিখতে হবে। বিশেষভাবে শিখতে হবে ইংরেজি ভাষা। এক বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।
কী দরকার এত দূরে যাওয়ার? এখানেই তো কত পড়াশুনো শিখেছে, শিখছে সাবিত্রী। মেয়েদের পড়াশুনো শেখাবার ইচ্ছে জ্যোতিবার, সাবিত্রীরও। তার কত বান্ধবী আছে, যাদের অক্ষর পরিচয়টুকু পর্যন্ত নেই, চিঠি লেখা তো দূরের কথা, কোনও দরকারি চিঠিপত্র এলে পড়তে, বুঝতে পর্যন্ত পারে না। কেউ পড়ে দেবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
[the_ad id=”266919″]
তা সে তারা বুঝলে তো! কত বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছে সাবিত্রী, যাতে মেয়েরা পড়তে আসে। লাভ হয়নি। ওসমান শেখের বোন ফতিমা কিন্তু পড়াশোনা জানে, সেও চায় মেয়েদের পড়াতে। কিন্তু মেয়েদের পড়তে পাঠাচ্ছে কে?
জ্যোতিবা, সাবিত্রী হাল ছাড়েনি মোটেই। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কুল তৈরি করতে চায় তারা। তাদের পড়াবার জন্য শিক্ষিকা চাই। পুরুষ শিক্ষকের কাছে তো মেয়েরা কোনমতেই পড়তে আসবে না। তাই সাবিত্রীকে তৈরি হতে হবে তাদের পড়ানোর জন্য। কীভাবে পড়াতে হয়, কী পড়াতে হয় সেইসব শেখানোর নাকি স্কুল আছে বিলেতে, তাদের নর্মাল স্কুল বলে।

এদেশেও উইলিয়াম কেরী বলে এক পাদ্রি বাংলার শ্রীরামপুরে এরকম নর্মাল স্কুল খুলেছেন ১৭৯৩ সালে, তবে ছেলেদের জন্য। বম্বে আর মাদ্রাজেও আছে নর্মাল স্কুল, এমনকী মাদ্রাজে তো মেয়েদের জন্যেও নর্মাল স্কুল খোলা হয়েছে। এরপর কলকাতায়, বেথুন স্কুলের পাশে ১৮৬২ সালে মেয়েদের জন্য নর্মাল স্কুল করা হবে। তবে মেয়েদের জন্য তৈরি এই স্কুলগুলো তেমন সফল হয় না। বেথুন স্কুলের পার্শ্ববর্তী এই স্কুল ১০ বছরে মাত্র ১৭ জন ছাত্রী পাওয়ায় ১৮৭২ সালে বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য ১৮৪৯ সালে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের প্রতিষ্ঠা করা ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল, পরে যার নাম হবে বেথুন স্কুল, এগিয়ে চলবে ছাত্রীদের নিয়ে। সেই স্কুল অবশ্য এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে– সাবিত্রী জানে না সেই কথা, ইতিহাসও জানে না তখনও।
আহমেদনগরেও ছিল একটি নর্মাল স্কুল, মিস মিচেলের নর্মাল স্কুল। ইংলন্ডের যে টিচার্স ট্রেনিং-এর ধরন, সেই পদ্ধতিতেই পড়ানো হত মিস মিচেলের স্কুলে। ইংলন্ডেও সেই সময় মহিলা শিক্ষিকা পাওয়া ছিল বেশ দুষ্কর। তাই উদ্ভাবন করা হয় ‘পিউপিল-টিচার’ পদ্ধতি। এর অভিনবত্ব ছিল, ছাত্রীদের মধ্যে থেকেই শিক্ষিকা নিয়োগ করা হত। যেসব ছাত্রীরা কিছুটা উঁচুক্লাস অবধি পড়াশোনা করতে পারতেন, তাদের মধ্যে থেকেই কয়েকজনকে নির্বাচিত করা হত, যাতে তারা নিচুক্লাসে পড়াতে পারে। অপেক্ষাকৃত বয়সে বড় যারা, তাদের জন্য রইলেন অভিজ্ঞ শিক্ষিকারা। তবে সেই সময় ছাত্রীসংখ্যাই অকুলান, তাই শ্রেণিবিভাগও তেমন নির্দিষ্ট ছিল না। তবে ১৮৩০-র দশক থেকে ছাত্রী সংখ্যা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়, শিক্ষিকার প্রয়োজনও বাড়ে।
[the_ad id=”270084″]
সাবিত্রীর অবশ্য এত কিছু জানার কথা নয়। শুধু, জ্যোতিবার মতো তারও ইচ্ছে, মেয়েরা পড়াশোনা শিখুক। সত্যিই কি কোনওদিন পুণেতে মেয়েদের ইস্কুল হবে? সেখানে পড়াবে সাবিত্রী? পুণেতে যে ইস্কুল নেই, তা তো নয়। পেশোয়াদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল আছে– কিন্তু সেখানে তো পড়তে পারে না দলিত বাড়ির ছেলেরা। আর মিশনারিদের স্কুলে পড়াতে চায় না কেউ। মেয়েদের পড়ার কথা তো ভাবেও না কেউ। যেমন ছেলেদের জন্য স্কুল খুলেছে জ্যোতিবা, তেমনটাই মেয়েদের জন্যও হয়তো কোনও একদিন স্কুল খুলবে সাবিত্রী।
স্বপ্নটাকে আঁকড়ে ধরে আহমেদনগর পাড়ি দেয় সাবিত্রী। টিচার্স ট্রেনিং থাকলে সাহেবদের কাছ থেকে টাকাপয়সা পেতে সুবিধে হবে, মেয়েদের স্কুল তৈরিতেও কম অসুবিধে হবে। এখন তো আর আগের মত ছোট নেই সাবিত্রী। দেখতে পায়, জ্যোতিবা কত ছুটোছুটি করে, চিঠিপত্র লেখে সাহেবদের– যাতে স্কুলের জন্য টাকাপয়সা পাওয়া যায়। সাবিত্রীকে স্বামীর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাই ভয় পেলে চলবে না। অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হবে। মিস মিচেলের স্কুলের পাশাপাশি মিস ফারারের টিচার্স ট্রেনিং স্কুলেও ভর্তি হয় সাবিত্রী।

মিস সিন্থিয়া ফারার কিন্তু ইংরেজ নন, এসেছেন আমেরিকা থেকে। তিনিই প্রথম মহিলা মিশনারি যিনি আমেরিকা থেকে একা ভারতবর্ষে আসেন ১৮২৭ নাগাদ। মিস ফারারের টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের শিক্ষণ-পদ্ধতি কিন্তু নর্মাল স্কুলের শিক্ষণ পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘পিউপিল-টিচার’ ধরনের আধা-প্রথাগত পদ্ধতির সু্যোগ এখানে ছিল না। আমেরিকায় প্রচলিত টিচার্স ট্রেনিং পদ্ধতি ছিল পৃথক, যা বেল ল্যাঙ্কাস্টার মেথড অনুসরণ করত। মিস ফারারের স্কুলে সেই পদ্ধতিতেও নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সাবিত্রী এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণও হয়।
[the_ad id=”270085″]
দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় শিক্ষকতার পাঠ নিয়ে, ইংরেজি ভাষা আদবকায়দায় রপ্ত হয়ে প্রায় দেড়বছর বাদে আহমেদনগর থেকে পুণে ফিরে আসে সাবিত্রী। বছরটা ১৮৫০। বেথুনসাহেবের স্কুল তখন প্রতিষ্ঠা হয়েছে সবে। সাবিত্রীবাঈ-এর দেশে জন্ম নেবেন যে আনন্দীবাঈ – যিনি মহারাষ্ট্র থেকে পাড়ি দেবেন সোজা বিলেত, তাঁর জন্ম হতে তখনও ১৫ বছর বাকি। আর আমাদের কাদম্বিনী গাঙ্গুলির জন্ম ১২ বছর দূরে।
মানবী ইতিহাসে নতুন ভোরের লেখনী নিয়ে পুণে ফিরলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে। সেই ভোরে সাবিত্রীর পাশে সবসময় থাকবেন জ্যোতিবা, যেভাবে আনন্দীবাঈ-এর পাশে গোপালরাও যোশি, কাদম্বিনীর পাশে দ্বারকানাথ। সময়রা শুধু পঞ্চাশ বছর আগে-পরে।
পায়ে পায়ে এগোবে মানবী তথা দলিত ইতিহাস। সাবিত্রী, জ্যোতিবার হাত ধরে।
*ছবি সৌজন্য: লেখক
আগের পর্বের লিংক – [পর্ব ১]
তথ্যসূত্র:
‘দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস্ অফ ধ্যানজ্যোতি ক্রান্তিজ্যোতি সাবিত্রীবাঈ ফুলে’; আলোক, নূপুর প্রীতি; ২০১৬
‘কাস্ট, কনফ্লিক্ট অ্যান্ড আইডিওলোজিঃ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে অ্যাড লো কাস্ট প্রোটেস্ট ইন্ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া’; ও’হানলন, রোজালিন্ড; ২০০২
‘এ টেল অফ টু রিভোল্টস্’; গান্ধী, রাজমোহন; ২০০৯
‘কালেক্টেড ওয়ার্কস্ অফ্ মাহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে’ ভলিউম ১-২, গভর্নমেন্ট অফ মহারাষ্ট্র, ১৯৯১
‘দ্য ওয়েস্টমিন্সস্টার হ্যান্ডবুক টু উইমেন ইন অ্যামেরিকান রিলিজিয়াস হিস্ট্রি’; লিন্ডলে, সুজান হিল; স্টেবনার, এলিনর জে; জন নোক্স প্রেস, ২০০৫
‘দ্য ইন্ডিয়ান ফিমেল পিউপিল টিচার – সোশ্যাল টেকনোলজিস অফ এডুকেশন অ্যান্ড জেন্ডার ইন দ্য সেকেন্ড হাফ অফ নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি’; কারুসো মার্সেলো’ মোইরিতজ, মারিয়া; সাউথ এসিয়ান ক্রোনিকল; বের্লিন ইউনিভার্সিটি
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
One Response
খুব ভালো লাগলো। সংক্ষেপে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত।