শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনও। তাঁর সঙ্গে যেটুকু পরিচয় সেটা ওঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে। আর প্রথম পরিচয়েই আমাকে চমকে দিয়েছিলেন তিনি।
“ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হল?
চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?
মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে
বসে থাকি?”
যখন প্রথম পড়ছি এই পঙক্তিগুলো, এক অনাবিল পৃথিবী পেরিয়ে টালমাটাল দাঁড়িয়েছি অচেনা এক দুনিয়ার চৌকাঠে। তার আবিলতার আভাসটুকু পাওয়া যাচ্ছে, পুরোটা বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু আন্দাজ করা যাচ্ছে, দুনিয়াদারি চটপট আয়ত্ত করে না ফেলতে পারলে একটু মুশকিলে পড়তে হবে। কিন্তু সেই ভুলভুলাইয়াতে ঢোকার চাড়টা আসছে না মোটেই।
ঠিক এই সময়ে, তাঁর শান্ত, সমাহিত স্বরে শঙ্খবাবু যেন আমায় বললেন,
“মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পড়ে নিই
মানব শরীর একবার?
দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার
ভেসে ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো?
যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো! চতুরতা, যাও!
কীবা আসে যায়
লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়”
একটা খুব পেলব আলো শঙ্খ ঘোষ জ্বালিয়ে দিলেন আমার সামনে, আর আমি জেনে গেলাম এভাবেও তবে হতে পারে যাপন।
***
“কবি তো নিজেকেই লিখে চলেন কবিতায়” – এই কথাটা আমাদের বলেছিল রাজেশ, ওদের পুরনো ভবানীপুরের বাড়ির তেতলার ছাদের ঘরের আড্ডায়। আমাদের জনাকয়েকের তুমুল সেই আড্ডা চারিয়ে যেত চিলেকোঠার ঘর পেরিয়ে রাস্তায় রাস্তায়, চায়ের দোকানে, স্টেশনের ওভারব্রিজে। যেমনটা হয় আর কী। আর সেই আড্ডায় আমাদের প্রেম-অপ্রেমের গপ্পো, ক্রিকেট, সমসাময়িক রাজনীতি, সুমন চাটুজ্যের নতুন গানের ফাঁক দিয়ে তাঁর আশ্চর্য অক্ষরমালা নিয়ে ঢুকে পড়তেন শঙ্খবাবু।
আমাদের এক বন্ধু তখন যাদবপুরে ছাত্র, শঙ্খ ঘোষ তার মাস্টারমশাই। আমরা শুনতে পেতাম কীভাবে বাংলা বিভাগের এই বিখ্যাত কবি-অধ্যাপক তাঁর ক্লাসে সাহিত্যপাঠকে অনায়াসে করে তোলেন জীবনের দিকচিহ্ন, কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের ভাবনার পরিসরকে দিগন্তমুখী করে দেন, আর কীভাবে ক্লাসে অর্বাচীন প্রশ্নের উত্তরেও এই শিক্ষকের ঠোঁটে লেগে থাকে প্রশ্রয়ের নিঃশব্দ হাসি।
এই নীরবকথনই শঙ্খ ঘোষের অভিজ্ঞান। নিভৃত উচ্চারণের আবরণে মোড়া থাকে তাঁর আলোছায়াময় কবিতাগুচ্ছ, যে পঙক্তিগুলোর কাছে বারবার ফিরে গেছি।
“জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে ? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে ?”
এই নিবিড় সজলতা মাখানো কলমটি শঙ্খবাবুর সঙ্গে রয়ে গেছে বরাবর, যে কলম তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় অবিস্মরণীয় কিশোর-উপন্যাস ট্রিলজি, প্রায় চল্লিশ বছর জুড়ে যে বই তিনটির রচনাকাল, যাদের মধ্যে শঙ্খবাবু আলগোছে বুনে দেন আমাদের দ্বিজাতিতত্ত্বের ইতিহাস, আমাদের দেশভাগের যন্ত্রণা। সেই কলমের মুখ থেকেই কবির প্রান্তবয়েসে উৎসারিত হয় মায়াময় সেই লাইন: “তোমার দুঃখের পাশে বসে আছি”।

তবে আরও একটা কলম আছে তাঁর। সেটার মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে এসেছে শাণিত ব্যঙ্গ, তীব্র শ্লেষ আর হ্যাঁ, মাঝে মাঝে, চিৎকারও।
“খুব যদি বাড় বেড়ে ওঠে
দাও ছেঁটে দাও সব মাথা
কিছুতে কোরো না সীমাছাড়া
থেকে যাবে ঠিক ঠাণ্ডা, চুপ
ঘরেরও দিব্যি শোভা হবে
লোকেও বলবে রাধাচূড়া।
সবই বলেছিল ঠিক, শুধু
মালী যা বলে নি সেটা হলো
সেই বাড় নীচে চারিয়ে যায়
শিকড়ে শিকড়ে মাথা খোঁড়ে আর
এখানে–ওখানে মাটি ফুঁড়ে
হয়ে ওঠে এক অন্য গাছ।”
এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে বোধহয় যে এই কবিতা লেখা হয়েছিল জরুরি অবস্থার সময়, ১৯৭৫ সালে। দেশ পত্রিকা ছাপার সাহস পায়নি, তখন এই শব্দগুলির জন্যেই জেলে যেতে হতে পারত লেখক আর সম্পাদক, দু’জনকেই। সেই ক্রান্তিকালের সময়েই তীক্ষ্ণ উপহাস ঝলসে উঠেছে তাঁর এই কলমটিতে: “পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি
কাজেই এখন স্বাধীনভাবে ঘুরি
………………………এখন সবই শান্ত, সবই ভালো।
তরল আগুন ভরে পাকস্থলী
যে কথাটাই বলাতে চাও বলি
………………………সত্য এবার হয়েছে জমকালো।
এইসব লেখাপত্র নিয়ে বন্ধুরা যখন মেতে আছি তরজায়, ঠিক তখনই, বোধহয় নব্বই দশকের মাঝামাঝি হাতে এল ‘লাইনেই ছিলাম বাবা।’ অতি কৃশকায়, দু’ফর্মার বইটার পাতায় পাতায়, ছত্রে ছত্রে কী পরিমাণ বিস্ফোরক বারুদ যে ঠুসে দিয়েছিলেন শঙ্খবাবু! বেশ মনে আছে, হাজরা মোড়ের কাছে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে আমরা জনাতিনেক বুঁদ হয়ে কাটিয়ে দিলাম ঘণ্টাদুয়েক, বইটাকে নিয়ে। আর তার একদম শেষ পাতার শেষ লাইন দুটো পড়ে চুপ করে বসে রইলাম আরও খানিকক্ষণ।
“আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন দল
রাতে ঘুমোবার আগে ভালবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন দল তুমি কোন দল”
***
এক দশকে সঙ্ঘ ভেঙে যায় – লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তার আগেই যে আমাদের বন্ধুদের ভাসমান যৌথপাঠচক্র ভেঙে যাবে, সে তো সহজ কথাই। রাস্তার বিভিন্ন বাঁকে ঢুকে পড়তে লাগল আমাদের জীবন, হাতের ওপর হাত রাখা তত সহজ রইল না আর। এর পরের দুই দশকে শঙ্খবাবু ক্রমে হয়ে দাঁড়াবেন জাতির জাগ্রত বিবেক। নন্দীগ্রাম গণহত্যা থেকে নাগরিক আইন বিল হয়ে উন্নয়নের খড়গের বিরুদ্ধে জারি থাকবে তাঁর অমোঘ লেখনী। বরাবরের মতো, প্রচারের ঢক্কানিনাদের পৃথিবীর সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে দাঁড়াবেন তিনি, অপূর্ব একা। আর শব্দ আর সত্যের মধ্যে দিয়ে তাঁর এই অনির্বাণ পথচলা দেখতে দেখতেই, অতি নিভৃতে, আমি ঘুরে দেখব শঙ্খ ঘোষের ছন্দের বারান্দা, অথবা দীক্ষা নেব নতুন করে, একটু অন্যভাবে রবীন্দ্রপাঠের।
এসবের মাঝখানে, একদম হঠাৎ করেই এসে গেল একুশে এপ্রিল, কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই। খবরটা পাবার আধঘণ্টা পর, একটি অচেনা নম্বর থেকে চেনা গলার উদ্বেল ফোন। তার কিছুক্ষণের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তকে ঈথার তরঙ্গে জুড়ে আরম্ভ হল যৌথপাঠচক্র, প্রায় সেই সময়ের মতো, যখন রোদবৃষ্টির রং হত আলাদা। অনেক ভুলে যাওয়া লাইন উচ্চারিত হল আবার, তর্পণের মতন। আমরা জেনে গেলাম, জীবন চলে গিয়েছে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার। কবিও চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর আখরগুলি রয়ে গেছে এক অলৌকিক সেতু হয়ে।
ফোটোগ্রাফার। লেখক। ইন্দোনেশিয়ার সালফার শ্রমিকদের ওপর ছবি তুলতে নেমেছেন আগ্নেয়গিরির মধ্যে, কাশ্মীরের মানুষের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখবেন বলে বারবার ফিরে গেছেন অশান্ত উপত্যকায়, চীন-ভিয়েতনামের অচেনা জায়গায় ঘুরে বেড়ান নতুন গল্পের খোঁজে। সেইসব লেখা-ছবি নিয়মিত বেরোয় দেশবিদেশের পত্রিকা-জার্নালে। তার মধ্যে আছে আল জাজিরা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ম্যাগাজিন। প্রকাশিত কফিটেবল বই ‘অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ডঃ আ ভিসুয়াল মেমোয়ার অফ লাদাখ’। নির্ভেজাল আরাম পান আড্ডা দিয়ে, আর বাংলায় লেখালেখি করে। আদ্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, তবে উত্তরের পুরনো বাড়ি, অলিগলি আর তার প্রাচীন কাফেগুলোর ওপর প্রবল টান।