১৯৫০ সাল। সংবিধানের খুঁটিনাটি কাজ নিয়ে ব্যস্ত ভীমরাও আম্বেদকর। আর্টিকল তেইশের খসড়া করার সময় হঠাৎ চল্লিশ বছর আগের একদিনের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর। ছোট এক নেটিভ রাজ্য কোলাপুর। ১৯১৫ সাল। সেই রাজ্যের রাজা এমন এক আইন করেছেন যে রীতিমত নড়েচড়ে বসেছে সমাজ।
অবশ্য এ ঘটনা এই রাজার জন্য নতুন বিষয় নয়। রাজা হওয়ার পর থেকেই কিছু না কিছু নতুন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন তিনি। ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত শিখবেন, ব্রাহ্মণরা পুরোহিত হবেন, এমনটাই তো জানে সকলে। কোলাপুরের এই নতুন রাজার কাছে তা হবার নয়। অন্যায় করছিলেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা, সংস্কৃত জ্ঞান ও পৌরোহিত্যের আড়ালে শোষণের নানা কদর্য রূপ প্রকাশিত হয়েছিল। এক কোপে সেই ব্রাহ্মণ্যের অহঙ্কার ধ্বংস করে দেন রাজা। অব্রাহ্মণদের জন্য খুলে দেন পৌরোহিত্যের দরজা এবং সংস্কৃত জ্ঞানের ভাণ্ডার। রাজকার্যেও অব্রাহ্মণের প্রবেশ সিদ্ধ করেন রাজা। সেই রাজা যে এতবড় কাণ্ড ঘটাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী?
ছত্রপতি রুখে দাঁড়ান। বস্তুত সবরকম দাসপ্রথা বা বেগার শ্রমেরই বিরোধী ছিলেন ছত্রপতি। নিজের রাজ্যকে এই অমর্যাদা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। তার জন্য আইন প্রণয়ণ, সেনাবাহিনীর সুরক্ষা সব দিয়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সব ক্ষেত্রে সফল হননি। কিন্তু দেবদাসীদের মুক্ত করতে সমর্থ হন ছত্রপতি। এমন সুকৌশলে এই আইন প্রযুক্ত করেন, যে শুধু ভবিষ্যতের দেবদাসীরা নয়, তৎকালীন দেবদাসীদেরও মুক্ত করতে সমর্থ হন। রীতিমতো লেঠেল বাহিনী তৈরি করে এ কাজে নামেন। পুরোহিত, পাতিলদের হাত থেকে দেবদাসীদের উদ্ধার করার জন্য একাধিকবার সম্মুখ সমরে নামতে হয়েছিল তাঁকে।

একদিকে মন্দিরের পুরোহিত, ধর্মের আড়ালে তাদের পোষা লেঠেনবাহিনী আর একদিকে ছত্রপতির শুভকাজে নিযুক্ত সেনানীরা। শুধু কোলাপুর তো নয়, সমগ্র দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে ছিল এই দেবদাসী নামের আড়ালে শোষণ। আইন, বলপ্রয়োগ ও আপ্রাণ প্রচেষ্টার পর কোলাপুরকে দেবদাসী চক্র থেকে মুক্ত করতে সমর্থ হন।
মুক্ত করা তো হল, এবার ছত্রপতির সামনে এসে দাঁড়ায় দেবদাসীদের পুনর্বাসনের প্রশ্ন। সমাজের চোখে পতিত তাঁদের অবস্থান। তাঁরা মূলস্রোতে ফিরবেন কী করে? পুনর্বাসনের চেষ্টা শুরু করেন ছত্রপতি। প্রথমেই উঠে আসে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, দেবদাসীরা থাকবেন কোথায়? এতদিন তাঁরা মন্দিরপ্রাঙ্গণে থাকছিলেন। কিন্তু এখন থাকবেন কোথায়? একই প্রশ্ন উঠেছিল যখন মেয়েদের আবাসিক পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন ছত্রপতি। তখনও মেয়েদের জন্য ছাত্রীনিবাস তৈরি করেছিলেন ছত্রপতি। এক্ষেত্রেও তাই করলেন। দেবদাসীদের থাকার ব্যবস্থার জন্য পৃথক গৃহ নির্মিত হল। তারপর শুরু হল তাদের শিক্ষাব্যবস্থা। তার মধ্যে প্রথাগত শিক্ষাও যেমন আছে, তেমনই বৃত্তিমূলক শিক্ষারও ব্যবস্থা করেন। অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে, সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার সব সুযোগ করে দেন ছত্রপতি।
কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। চেষ্টা শুরু করেন দেবদাসীদের পারিবারিক মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার। দেবদাসীরা যাতে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে পরিবারে প্রবেশ করতে পারেন, তার চেষ্টাও করেন ছত্রপতি। কিন্তু এক্ষেত্রে সফল হন না। তবু দেবদাসীদের সম্মান ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা চলতে থাকে অবিরাম। সেই চেষ্টারই সাক্ষী থাকেন বাবাসাহেব। তখন তিনি দলিত যুবনেতা। ছত্রপতির সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে তাঁর। সেই ইতিহাস পরের পর্বে।

এখন থেকে পিছনে ফিরে তাকালে, সময়ের ব্যবধান দেড়শো বছর হবে, এখনও প্রান্তিক নারীদের মূলস্রোতে ফেরাবার চেষ্টা কী অকুলান! কতজন রাজা তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে উদ্ধার করে আনেন রাক্ষসপুরীতে আটকে পড়া মেয়েদের? আর ফেরাতে চান তাঁদের ন্যূনতম সম্মান? ছত্রপতি সাহুকে তখনও প্রয়োজন ছিল সমাজের। আজও প্রয়োজন। যেমন প্রয়োজন জ্যোতিবা ফুলে আর সাবিত্রীবাঈকে।
প্রয়োজন, তাই তো আমরা তাঁদের কথা উচ্চারণ করছি বারবার। এই কথন, এক তর্পণ বৈ তো নয়।
*চিত্রঋণ: Wikipedia, Swarajyamag, Jagran.com, Indiatimes
*তথ্যঋণ: ‘রাজর্ষি সাহু ছত্রপতি অফ কোলাপুর – আ রিফর্মার আহেড অফ হিস্ টাইমস’ – অভিরাম গাধ্যাপটিল
‘নন ব্রাহ্মণ মুভমেন্ট ইন সাদার্ন ইন্ডিয়া’ – কাশীনাথ কাভালকার
‘ছত্রপতি সাহু – লাইফ এন্ড প্রোফাইল’ – কালচারাল ইন্ডিয়া
‘ছত্রপতি সাহু – পিলার অফ সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ – এম জি মালি, পি বি সালুনকে
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।