গরমের দাবদাহের পরেই আসে বর্ষাকাল (Rainy season)। এতদিনের অপেক্ষা শেষ হয়, সিজনের প্রথম দিনের বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়লে এক স্বর্গীয় অনুভূতি হয়, মনে হয় যেন তাপিত প্রাণ শীতল হয়।
কিন্তু এর সাথে আসে নানান রোগ-ভোগ। বর্ষা শুরু হলেই বায়ুর হিউমিডিটি বেড়ে যায়, যা ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস ও ফাঙ্গাসের বাড়-বাড়ন্তের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। মশা, মাছি একা আসে না, আসে নানা রোগের জীবাণু (disease) বহন করে।
আরও পড়ুন: বর্ষার রোগ-জ্বালা (১)
ঠান্ডা লাগা, সর্দি যদিও খুব বেশি হয়, তবুও আরও অনেক রোগ আছে, যা মারাত্মক ও প্রাণঘাতী হতে পারে। আজ আলোচনা করবো ডেঙ্গু আর ম্যালেরিয়া নিয়ে।
১। ডেঙ্গু (Dengue)
ডেঙ্গু যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। প্রতি বছর বর্ষা শুরুর কিছুদিন পরে থেকে শুরু হয় ডেঙ্গু। এর কারণ বর্ষাকালে নানা স্থানে জল জমে। সেই পরিষ্কার জমা জলে ডেঙ্গু মশা বংশবৃদ্ধি করে। আর ডেঙ্গু ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে এই ডেঙ্গু মশা, যার নাম এডিস মশা- আরেক নাম টাইগার মস্কুইটো (Tiger Mosquito)। দেখতে অনেকটা বাঘের মত সাদাকালো ডোরাকাটা। একমাত্র এই মশার শরীরেই ডেঙ্গু ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে পারে।

কথা উঠতে পারে, প্রথম এডিস মশাটি কোত্থেকে আসে? আগের বছরে এডিস মশা যে ডিম পেড়ে রেখেছিল, তা যদি প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট না হয়, তবে সেই ডিম যখন জলের সংস্পর্শে আসে, তখন তার থেকে নতুন মশা জন্ম নেয় এবং তারা আবার বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এই ভাবে জমা জলে ডেঙ্গু মশার বংশবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ডেঙ্গুও বাড়তে থাকে।
এই মশা সূর্যোদয়ের দুই ঘন্টার মধ্যে এবং সূর্যাস্তের দুই ঘন্টা আগেই বেশি কামড়ায়- যদিও যে কোনো সময়ে কামড়াতে পারে। ফলে, ভাইরাস শরীরে ঢোকে এবং ৭-১০ দিন পরে ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায়।
ডেঙ্গুর উপসর্গ
১। জ্বর, বেশি বা কম হতে পারে। সাধারণত জ্বরের মাত্রা বেশি হয়।
২। মাথায় যন্ত্রণা
৩। গলা ব্যথা
৪। চোখ লাল হয়ে যাওয়া
৫। বমি বা বমি ভাব
৬। গা-হাত পা ব্যথা বা জয়েন্টে ব্যথা কখনও কখনও পেশিতে বা গিঁটে এমন ব্যথা হতে হয়, মানুষ ঠিকমত চলতে পারে না। মনে হয়, হাত-পা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এই জন্যে এর আর এক নাম ‘হাড় ভাঙ্গা জ্বর” বা ডান্ডি জ্বর। ইংরাজীতে Break bone fever or Dandy fever
৭। র্যাশ হতে পারে
৮। অবস্থা খারাপ হলে মলের সাথে বা বমির সাথে রক্ত বেরোতে পারে, একে বলে ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার
৯। অন্যক্ষেত্রে খারাপ অবস্থায় শ্বাসকষ্ট হতে পারে, রক্তচাপ কমে যায় এবং রোগী শকে চলে যেতে পারে

ডেঙ্গু রোগের কিছু কিছু খারাপ উপসর্গ আছে বা এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে ধরা হয়। একে বলে ওয়ার্নিং সাইন। যেমন-
- পেটে অনেক ব্যথা এবং বমি হতে থাকা
- নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত বের হওয়া
- বমির সাথে, প্রস্রাবের সাথে অথবা মলের সাথে রক্ত বের হওয়া
- কখনও কখনও কালো পায়খানা হয়
- ত্বকের নীচে রক্ত জমে যাওয়া
- পেট ফুলে যাওয়া বা পেটে জল জমা
- শ্বাসকষ্ট হওয়া
- ক্লান্তি, অবসন্নতা, অস্থিরতা
এই উপসর্গ দেখলে ডেঙ্গু রোগী খারাপ অবস্থায় আছে বলে ধরে নিতে হবে এবং হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।
কথা উঠতে পারে, প্রথম এডিস মশাটি কোত্থেকে আসে? আগের বছরে এডিস মশা যে ডিম পেড়ে রেখেছিল, তা যদি প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট না হয়, তবে সেই ডিম যখন জলের সংস্পর্শে আসে, তখন তার থেকে নতুন মশা জন্ম নেয় এবং তারা আবার বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এই ভাবে জমা জলে ডেঙ্গু মশার বংশবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ডেঙ্গুও বাড়তে থাকে।
রোগ নির্ণয়:
ডেঙ্গু রোগ সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। প্রথমে এন.এস.১ এন্টিজেন টেস্ট ও পরে আই.জি.- জি বা এম পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
চিকিৎসা:
ডেঙ্গু ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে উপসর্গ অনুসারে চিকিৎসা করতে হবে। অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। আর বেশি করে জল খেতে হবে, পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। জ্বর হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। আতঙ্কের বা ভয়ের কিছু নেই।
প্রতিকার:
দেখতে হবে, ডেঙ্গু রোগ যাতে না হয়। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। জল জমতে দেওয়া যাবে না। মশা মারার জন্যে নিয়মিত স্প্রে করতে হবে। মশারি টাঙিয়ে শুতে হবে। এটি মশার কামড় ছাড়া এক জনের থেকে অন্য জনের শরীরে যায় না। একটু সতর্ক থাকলেই ডেঙ্গু থেকে বাঁচা যায়।

ম্যালেরিয়া (Malaria)
এটিও মশাবাহিত রোগ। তবে এনোফিলিস জাতীয় মশা ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাসমোডিয়ামকে বহন করে এবং মশার কামড়ের মাধ্যমে এই জীবাণু আমাদের রক্তে ঢোকে।
শরীরে ঢুকে এরা আমাদের লোহিত রক্ত কণিকাকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। ফলে রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। চার রকমের প্লাসমোডিয়াম ম্যালেরিয়া রোগ তৈরি করে। তার মধ্যে ভাইভ্যাক্স সবচেয়ে বেশি, কিন্তু অতটা মারাত্মক নয়। আর ফ্যালসিপেরাম খুব মারাত্মক, পাহাড়ি বা জঙ্গল এলাকায় বেশি হয়।
উপসর্গ:
- প্রথম উপসর্গ জ্বর। বেশিরভাগ সময়েই জ্বর আসে কাপুঁনি দিয়ে। এই জ্বর ম্যালেরিয়ার জীবাণুর ওপর নির্ভর করে কখনও দুই/তিন দিন পরে আবার প্রতিদিনই আসতে পারে।
- জ্বরের সঙ্গে থাকে দুর্বলতা, মাথা ধরা, দ্রুত শ্বাস নেওয়া, ক্লান্তি ও অবসন্নতা।
- কখনও কখনও পেটে ব্যথা, বমি, গা হাত পায়ে ব্যথা হতে পারে।
- যদি খারাপ ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া আক্রমণ করে, তবে মস্তিষ্ক বা কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মূত্রের সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে। অনেক রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তাই ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসার দরকার।

রোগ নির্ণয়:
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই রোগ নির্ণয় করা যায়। এন্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে আধঘন্টার মধ্যেই ম্যালেরিয়া রোগ ধরা পড়ে। তারপর চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়।
তাই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে সাথে সাথেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
দ্য ডক্টরস ডায়লগ ওয়েব পোর্টাল থেকে পুনর্মুদ্রিত।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, প্যাথলজিস্ট