পৃথিবী: পর্ব ১
সুজয়: আমি বাজে কথা বলছি? মাসিমা, আপনি সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম সব খুলে দেখুন – সবাই এখন এই নিয়েই আলোচনা করছে। (ফোন খুলে দেখায়) এই তো, আমার এক বন্ধু আমেরিকায় থাকে, সে লিখেছে সেখানকার এক স্বামীজি অতুলানন্দ মহারাজ বলেছেন উনি অনেক আগেই এই ধ্বংসের কথা জানতেন। কিন্তু মানুষের মনে যাতে ভয় না ঢোকে তাই তিনি কাউকে বলেননি। খুব নামডাক এই স্বামীজির – এমআইটি থেকে পি এইচ ডী। অনেক শিষ্য সাবুদ। উনি বলেছেন, দিন ক্ষণ হয়ত একটু এদিক ওদিক হতে পারে, কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছেই। কেউ আটকাতে পারবে না।
মানসী: কোনও প্রতিকার নেই? শান্তি স্বস্ত্যয়ন যাগ যজ্ঞ করে কিছু হবে না?
সুজয়: যাগ যজ্ঞ হচ্ছে তো! মন্দিরে মন্দিরে যাগ যজ্ঞ হচ্ছে। চার্চে মসজিদে প্রার্থনা হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন ওসব করে কোনও লাভ নেই। যা হবার তা হবেই। আপনি টিভি খুলে দেখুন – সি-এন-এন, বিবিসি সবাই রিপোর্ট করছে –
শ্যামলী: টিভি খারাপ। সারাতে দেওয়া হয়েছে। থাকলেও কোনও লাভ হত না। কেবল কেটে দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুঞ্জয়: তাহলে তুমি নিশ্চিত যে এই সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই যা ঘটার ঘটে যাবে?
সুজয়: হান্ড্রেড পারসেন্ট।
মৃত্যুঞ্জয়: বলছ আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব? কেউ থাকব না?
সুজয়: কেউ না। কাক পক্ষীটিও বেঁচে থাকবে না।
মৃত্যুঞ্জয়: শিওর?
শ্যামলী: কি হচ্ছে কি বাবা? তুমিও কি পাগল হয়ে গেলে?
মৃত্যুঞ্জয়: আঃ, আমাকে কথা বলতে দে। সুজয়, এমন হবে না তো, যে আমি মরলাম কিন্তু তোমার মাসিমা বেঁচে গেলেন?
সুজয়: ভেতরের চাপে পৃথিবীটা একটা বেলুনের মতো ফেটে চৌচির হয়ে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাবে মেসোমশাই। আপনার মনে হয় ওই অবস্থায় কেউ বেঁচে থাকতে পারবে?
মৃত্যুঞ্জয়: যাক, বাঁচালে!
মানসী: কী আবোল তাবোল বলছ তুমি?
মৃত্যুঞ্জয়: দেখ সুজয়, চার বছর হল কলেজ থেকে রিটায়ার করেছি। আজ পর্যন্ত পেনশনের একটা পয়সা পাইনি। আমার ন্যায্য পাওনা, সেটাও ওরা দিতে নারাজ। অন্য যেটুকু সঞ্চয় ছিল, বাড়িটা শেষ করতে গিয়ে সেটাও নিঃশেষ। ফলে ভাঁড়ে মা ভবানী। আজ কী বাজার করেছি জানো? দুটো চারা পোনা আর দুইশ গ্রাম আলু। বাজারে প্রচুর ধার। কী করে শোধ দেব জানিনা। কিন্তু তোমার ভবিষ্যৎবাণী যদি ফলে যায়, তাহলে এসব নিয়ে আর কোনও দুশিন্তা করতে হবে না। পাওনাদার, আমি, আমরা সবাই শেষ। না রহেগা বাঁশ, না বাজেগা বাঁশুরি। মেয়েটার বিয়েটাও দিতে হবে না। সেই খরচাটাও বেঁচে যাবে।
শ্যামলী: আমার বিয়ের জন্য তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না।
মৃত্যুঞ্জয়: আরে মাথা থাকলে তবে না মাথা ঘামাব। কিন্তু সুজয়, তোমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে যে দুর্ঘটনাটা ঘটবেই।
সুজয়: মেসোমশাই, আপনি ঠাট্টা করছেন? ভবিষৎবাণীটা কিন্তু আমি করছি না। করছেন বিশ্বের তাবর তাবর বিজ্ঞানী। আপনি ওঁদের কথা অবিশ্বাস করবেন?
শ্যামলী: এরকম গুজব এর আগেও অনেকবার রটেছে সুজয়দা। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, রসাতলে যাবে, উল্কাপাত হবে, জলোচ্ছ্বাস হবে – এইসব কত কী বলে ভয় দেখানো হয়েছে। কোনওদিন সেরকম হয়েছে কি?
সুজয়: সেইগুলো এরকম বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা বলেছিল কি? এবার রীতিমত সাইন্টিফিক এনালিসিস করে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে – কী হবে কেন হবে। আমার তো ভীষণ ভয় করছে। আপনাদের ভয় করছে না?
মৃত্যুঞ্জয়: ভয় কেন করবে? দেখ সুজয়, মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় কারণ প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে। কিন্তু সবাই মিলে যদি একসঙ্গে চলে যাই তাহলে ভয় কিসের? আর তুমি যেভাবে ব্যাপারটা হবে বলছ, দুম করে এক লহমায় মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যাব, তাতে তো মনে হচ্ছে যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হবে। কিছু বুঝতেই পারব না।
সুজয়: আপনার পক্ষে এসব কথা বলা সহজ। আপনি জীবনটা এঞ্জয় করে নিয়েছেন। কিন্তু আমরা –
মৃত্যুঞ্জয়: এঞ্জয়? হ্যাঁ তা করেছি বলতে পার। (মানসী কে) কি গো? আমরা আমাদের জীবনটা এঞ্জয় করেছি তো? কী মনে হয় তোমার?
মানসী: আমি জানিনা তুমি হাসি মুখে কী করে এই সব কথা বলছ? এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে, আর তুমি ঠাট্টা ইয়ার্কি করছ? কী করে বাঁচা যায় সেই চিন্তা কর। আচ্ছা সুজয়, আমরা যদি পালিয়ে যাই? কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিই?
মৃত্যুঞ্জয় (হেসে ওঠে): কোথায় পালাবে? শুনলে না গোটা পৃথিবীটা চুরচুর হয়ে মহাকাশে বিলীন হয়ে যাবে। আমরা সবাই অসীম মহাশূন্যে ধুলো হয়ে ভেসে বেড়াব।
শ্যামলী: একমাত্র উপায় মঙ্গল গ্রহে যদি পালিয়ে চলে যাওয়া যায়। কী বল সুজয়দা? মঙ্গলায়ন কতদূর এগুলো একটু খোঁজ নেবে নাকি?
সুজয়: ইয়ার্কি মের না। আমেরিকায় সেই চেষ্টাই চলছে। নাসা বেশ কয়েকটা রকেট রেডি করছে। ইলন মাস্কের স্পেস এক্স কোম্পানিও কয়েকটা স্পেসশিপ রেডি করেছে। রাশিয়া, চায়না, ফ্রান্স এরাও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মঙ্গলে যাবার প্ল্যান করছে। বাছা বাছা কিছু মানুষকে নিয়ে যাওয়া হবে। এই যে এতদিন মঙ্গলে যাবার জন্য সব ভলান্টিয়ার খুঁজছিল, সেটা কি এমনি এমনি। ওরা ঠিক জানত এইরকম একটা ঘটনা ঘটবে। তার জন্যই এত ছক। এবার বুঝতে পারছ?
মৃত্যুঞ্জয়: কিন্তু মঙ্গলে মনুষ্য বসবাসের মত ব্যবস্থা তো এখনও কিছু হয়নি –
সুজয়: তলে তলে ওরা সব করে নিয়েছে মেসোমশাই। ওদের এত বোকা মনে করেছেন?
মানসী: না না, এটা হতে পারে না। আমি এখুনি মরতে রাজি নই। এখনও অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে।
মৃত্যুঞ্জয়: অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে? তার মানে বলতে চাও আমার সঙ্গে তোমার জীবন তুমি তেমন উপভোগ করনি? এঞ্জয় করনি?
মানসী: করিনি বলছি না তো? কিন্তু তাই বলে আর কোনও ইচ্ছে থাকতে পারে না? আর কোনও চাহিদা থাকতে পারে না? তুমি তো তোমার ছাত্র আর কবিতা নিয়েই খুশি। আমার তো তা নয়। আমি সংসার নিয়ে থাকতে ভালবাসি, সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালবাসি।
মৃত্যুঞ্জয়: সংসার নিয়ে কি আমি থাকতে ভাল বাসিনা? কিন্তু সুজয় যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে সংসারের কেউই তো থাকবে না। তখন কি তোমার একা বেঁচে থাকতে ভাল লাগবে?
মানসী: আমি তো একা বেঁচে থাকতে চাই না। আমি সবাইকে চাই। (কেঁদে ফেলে)
শ্যামলী: আঃ মা কাঁদছ কেন? আর আমি ভেবে পাচ্ছিনা, তোমরা এই ব্যাপারটাকে এত সিরিয়াসলি নিচ্ছই বা কেন? এটা একটা হোক্স ছাড়া কিছু নয়। সুজয়দা, তুমি এখন বাড়ি যাও তো।
সুজয়ছ: দ্যাখ শ্যামলী, আমি জানি তুই মেসোমশাই আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না। ভাবছিস, আমি, মাসিমা আমরা খুবই নাইভ, সরল – বোকা। যে যা বোঝাবে তাই বুঝে যাব। কিন্তু তুই ভুল ভাবছিস।
শ্যামলী: কিচ্ছু ভুল ভাবিনি। যে পুরুষমানুষ হাতের পাঁচটা আঙুলে পাঁচটা গ্রহ রত্ন ধারণ করে থাকে, রোজ খবরের কাগজে হরস্কোপ পড়ে, মাসে দুদিন করে জ্যোতিষী আর কাপালিক দর্শন করতে যায়, তার আত্মবিশ্বাস কতটা আমার জানা আছে।
সুজয়: জ্যোতিষ একটা বিজ্ঞান! যারা মানে না, তারাই বরং বোকা। সারা পৃথিবীতে বড় বড় লোকেরা সব জ্যোতিষে বিশ্বাস করে। হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মুনি ঋষিরা এর চর্চা করছেন, বিদেশেও চর্চা হয়েছে। সে সব মিথ্যে? আপনিই বলুন মাসিমা, গ্রহ নক্ষত্রদের প্রভাব কি আমাদের জীবনে পড়ে না? গ্রহ তারা থেকে নানান রশ্মি ঠিকরে এসে পৃথিবীতে প্রবেশ করে। গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভও তো প্রমাণ হয়ে গেছে। সেই কোথায় কত আলোকবর্ষ দূরে দুই ব্ল্যাক হোল কলাপ্স করল, আর স্পেস-টাইমে সেই কম্পন আমাদের পৃথিবীতে ধরা পড়ল। এসব তথ্য তো এখন আবিষ্কৃত হচ্ছে। তা সেই কম্পন, সেই রশ্মি তো আমাদের দেহ, আমাদের মগজের মধ্যে দিয়েও প্রবাহিত হচ্ছে, নাকি? তার একটা এফেক্ট থাকতে পারে না? কি বলুন মাসিমা? আর এই আংটির পাথর সেই রশ্মি ফিল্টার করে আমাদের রক্ষা করে।
(মৃত্যুঞ্জয় হো হো করে হেসে ওঠে)
মানসী: তুমি হাসছ কেন? সুজয় তো ঠিকই বলেছে। তা হ্যাঁ সুজয়, এই দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য কোনও পাথরটাথর নেই?
মৃত্যুঞ্জয়: সেরকম পাথর যদি থাকেও, কাকে পরাবে? ফাটবে তো পৃথিবী।
ছবি সৌজন্য: Flickr
সুদীপ্ত ভৌমিক একজন প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। ওঁর নাটক অভিবাসী জীবনের নানা দ্বন্দ ও সংগ্রামের কথা বলে। সুদীপ্তর নাট্যদল একতা (ECTA) উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিমবঙ্গের নাট্যপ্রেমীদের কাছে এক পরিচিত নাম। ভাষানগর পুরস্কার, নিউ জার্সি পেরি এওয়ার্ড নমিনেশন, সিএবি ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস এওয়ার্ড ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত সুদীপ্ত ড্রামাটিস্ট গিল্ড অফ আমেরিকার পূর্ণ সদস্য। ওঁর পডকাস্ট স্টোরিজ অফ মহাভারত অ্যাপল আইটিউনস-এ শ্রেষ্ঠ পডকাস্টের স্বীকৃতি পেয়েছে।