মানসিক রোগের জন্য থাকে মানসিক হাসপাতাল, মনোবিদ কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরও অন্যান্য বিষয়। কিন্তু ১৯২২ সাল থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দেন ভিয়েনার মনোবিদ জ্যাকব লিভি মোরিনো। ভিয়েনার (জার্মানি) চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই ছাত্র দেখিয়ে দিয়েছেন থিয়েটার নিয়ে এইভাবেও ভাবা যায়। মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষদের থিয়েটারে নির্দেশনা দেন বলে আমরা তাকে মনোনির্দেশকও বলতে পারি। সেই থিয়েটারের আঙ্গিক তাঁর নিজস্ব আবিষ্কার। কেমন সেই থিয়েটার? মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষ অভিনয় করেন-ই বা কীভাবে?
আরও পড়ুন: শেক্সপিয়র নাটকে অভিনয়ের জন্য সংগীতশিল্পী দান করলেন নিজের মাথার খুলি
থিয়েটারের মাধ্যমে মানসিক রোগের চিকিৎসার ধারণাটি প্রথম আবিষ্কার করেন নাট্যকর্মী ও পরিচালক অগুস্ত বোওয়াল। ১৯৫০ সালে ব্রেজিলে তিনি এ নিয়ে কাজও শুরু করেন। মহড়া ছাড়া ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আবেগকেন্দ্রীক তাৎক্ষণিক অভিনয় শৈলীকে বলা হয় ‘থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি’, এর মধ্য দিয়ে অভিনয়শিল্পী সৃজনশীল ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে ‘আর্ট অব ইমপ্রোভাইজেশন’ এই ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আর এই ধরনের থিয়েটারের প্রবক্তা হলেন জ্যাকব লিভি মোরিনো। ১৯১২ সালে মোরিনো যখন ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা মেডিকেল স্কুলের শিক্ষার্থী; তখন সেখানে অধ্যাপনা করতেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। এ সময় ফ্রয়েড তাঁর সাইকো-অ্যানালাইসিস বা মনোবিশ্লেষণ তত্ত্বের বিকাশ ঘটাতে খুঁজে নিয়েছিলেন কিছু সার্থক বরপুত্র শিষ্যকে। যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোরিনো। কিন্তু মোরিনো পরবর্তীকালে ফ্রয়েডের অনুসারী না হয়ে; বিপ্লবীর মতো ফ্রয়েডকে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন এই বলে যে— “ড. ফ্রয়েড, আপনার যেখানে সমাপ্তি আমার সেখানে শুরু। আপনি মানুষের স্বপ্ন বিশ্লেষণ করেন; আর আমি তাদের আবার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করি; শেখাই কীভাবে নিজেই নিজের স্রষ্টা হতে হয়। আপনি মানুষের সঙ্গে মেশেন আপনার অফিসের এক কৃত্রিম পরিবেশে। আর আমি মেলামেশা করি তাদের বাড়িতে, রাস্তায় সর্বোপরি প্রকৃতির সংস্রবে।”

সৃজনশীলতাবর্জিত ও স্বতস্ফূর্ততাহীন অভিনয় ধারা মূলত ‘হিমায়িত পণ্য’ সমতুল্য। যদি এমন হত, পাণ্ডুলিপি নেই; চরিত্র নেই— কিন্তু নাট্যাভিনয় চলছে, তাহলে অভিনয়শিল্পী স্বতঃস্ফূর্ত এবং সৃষ্টিশীল অভিনিবেশ সহকারে তার নিজস্ব চিন্তা ও সমস্যার রূপায়ন ঘটাচ্ছে মনে হত। কিন্তু এক্ষেত্রে অভ্যাগত দর্শক কি ক্যাথারসিস মুক্ত থাকবে? দর্শনের ছাত্র হিসাবে অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিকস’-এর আলোকে ক্যাথারসিস অভিধাকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করতে গিয়ে মোরিনো আবিষ্কার করেছিলেন যে, নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দর্শক ‘চরিত্রের’ প্রতি একাত্ব হয় এবং নবতর ধারণা অর্জন করে। কিন্তু অভিনয়শিল্পী তাঁর অভিনীত চরিত্রের সামগ্রিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হন না। প্রকারান্তরে অভিনয়শিল্পীর ওপর বিভিন্ন সময়ে অভিনীত চরিত্রের অন্তরাত্মার প্রভাব কিছুটা হলেও তাঁদের অভ্যন্তরে রয়ে যায়। যার ফলে অভিনয়শিল্পীরা প্রায়ই ‘হিসট্রিওনিক নিউরোসিস’- এ ভোগেন, যা তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনকেও কখনও কখনও করে তোলে ভারসাম্যহীন।
যদি এমন হত, পাণ্ডুলিপি নেই; চরিত্র নেই— কিন্তু নাট্যাভিনয় চলছে, তাহলে অভিনয়শিল্পী স্বতঃস্ফূর্ত এবং সৃষ্টিশীল অভিনিবেশ সহকারে তার নিজস্ব চিন্তা ও সমস্যার রূপায়ন ঘটাচ্ছে মনে হত। কিন্তু এক্ষেত্রে অভ্যাগত দর্শক কি ক্যাথারসিস মুক্ত থাকবে?
জীবন-নাট্যমঞ্চে প্রত্যেক মানুষই ‘ইমপ্রোভাইজিং অ্যাক্টর’— এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী মোরিনো ১৯২১ সালে ভিয়েনায় অভিনয়শিল্পীদের এই করুণ পরিণতি থেকে মুক্তি দিতে খুঁজছিলেন এমন একটি নতুন ও ভিন্ন কাঠামো; যার মধ্যে দিয়ে বিকাশ ঘটবে এমন এক থিয়েটারের যেখানে গুরুত্ব পাবে সৃজনশীলতা ও স্বতস্ফূর্ততা। এতে মনের গভীরতম স্তরের সঙ্গে অভিনেতার নিবিড় যোগাযোগ তৈরি হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী স্বাভাবিকের চেয়ে আরও বেশি জীবন্ত, সমৃদ্ধ সেই অভিনয় অংশগ্রহণকারী ভোক্তা (অভিনয় শিল্পী) এবং উপভোক্তা (দর্শককুল)-এর জীবনকে সাবলীল করে তুলবে। বিকাশ ঘটাবে ‘থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি’ ঘরানার। বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে মোরিনো ১৯২২ সালে ভিয়েনায় গড়ে তোলেন তাঁর ‘থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি’।

এবার একটা ঘটনা বলি— সমসাময়িক বিখ্যাত অভিনেত্রী বারবারা একই চরিত্রে দীর্ঘদিন অভিনয় করার ফলে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ রোগে আক্রান্ত হন। বারবারা ইস্টারের ‘ফ্যাশন প্লে’-তে বিশুদ্ধ নারীত্বের মডেল রূপে মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করতেন। মাদার মেরির ছবি আঁকতেন এক মনে ডুবে। এই চরিত্রটি আস্তে আস্তে একটা স্থায়ীভাব নিয়ে তাঁর মনে বাসা বাঁধে, যার পরিণতি গড়ায় ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’-এ।
এই পরিস্থিতি থেকে বারবারাকে মুক্তি দিতে ‘লিভিং নিউজপেপার’ নাট্যধারায় কাজ করাতে শুরু করেন মোরিনো। এবার তিনি তাঁকে এক পতিতার চরিত্রে অভিনয় করান। কারণ মোরিনো মনে করতেন, পতিতা হিসাবে বারবারা যখন নতুন নতুন সঙ্গীদের মুখোমুখী হবে, তখন তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে অন্য কোনও সৃষ্টিশীলতার সম্ভাবনা। আমরা বিষয়টিকে বড্ড একবগ্গা দেখি— তাই পতিতার কাছে যারা আসে, তাদের খদ্দেরের বদলে সঙ্গী ভাবতেই পারি না, আর এটাও ভাবতে পারি না বিভিন্ন মানুষের একটা সাংস্কৃতিক অবচেতন আছে। যাই হোক, মোরিনো এইভাবে ভাবতে পেরেছিলেন। কার্যত সফলও হয়েছিল তাঁর এই প্রয়াস। বারবারা পতিতা চরিত্রটিতে স্বতস্ফূর্ততার সঙ্গে সৃজনশীল অভিনয়ের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে ‘হিস্ট্রায়নিক নিউরোসিস’ রোগ থেকে মুক্ত করেছিলেন নিজেকে।

থিয়েটার ও বৈবাহিক মনস্তত্ত্ব
মোরিনো তাঁর এই নাট্যচর্চার এক পর্যায়ে বারবারার স্বামী জর্জকেই অংশগ্রহণ করান জনৈক খদ্দেরের চরিত্রে। এর ফলে ওরা দুজনে চমৎকার এক চিত্র দৃশ্যায়িত করে থাকেন; যা ছিল হৃদয়গ্রাহী বা প্যশনেট তো বটেই। পরবর্তীতে মোরিনো এই অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে বিবাহিত দম্পতিদের ওপর প্রয়োগ করে ‘ম্যারাইটাল থেরাপি’। থিয়েটারের সেই কাঠামো হয়ে উঠেছিল থেরাপির ফলপ্রসূ কৌশল; যা একই সঙ্গে অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের উপর কার্যকরী প্রয়োগ সাফল্য এনে দেয়।
মোরিনো মনস্থির করেছিলেন থিয়েটারের এই প্রতিবিধানমূলক কাঠামোর পরিচর্যাই হবে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এই ধারার নাট্যক্রিয়া একই সঙ্গে অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের ওপর একটি থেরাপটিক অভিঘাত সৃষ্টি করবে। সমালোচকেরা এই পর্যায়টিকে ‘মোরিনোর ডিপ ইন্টেলেকচুযা়ল ন্যাচারাল ক্যাথারসিস’ অভিধা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
ভিয়েনার বীজ জন্ম নিল আমেরিকায়
১৯২৬ সালে মোরিনো ভিয়েনা ছেড়ে চলে যান আমেরিকায়। মূলত আমেরিকাতেই তিনি তাঁর নাট্য চিন্তাগুলোর চূড়ান্ত বিকাশ ঘটান। তাঁর নিজের কথায়— ‘সাইকোড্রামা কনসিভ করেছিল ভিয়েনায় কিন্তু জন্মগ্রহণ করেছিল আমেরিকায়।’
আলোচ্য ‘থিয়েটার অব স্পনটিনিউটি’ তথা সাইকোড্রামার অনুশীলন প্রক্রিয়ায় যূথবদ্ধ শিল্পের প্রকাশ দেখা যায়। যেখানে দর্শক ও অভিনয়শিল্পীকে আলাদা না করে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই ঘটে ভাবের বিমোক্ষণ বা ক্যাথারসিস। এটা কখনওই প্রচলিত থিয়েটার চর্চায় সম্ভব নয়।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতায় শিল্পীর সৃজনশীলতার পূর্ণ বিকাশ প্রচলিত থিয়েটারে ঘটে। দর্শকের ক্যাথারসিস হয় বটে, কিন্তু স্বয়ং শিল্পী তা কতটুকু উপলব্ধি করতে পারে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এই বৈপরিত্যের উপরে উঠে মোরিনো তাঁর নিজস্ব গবেষণায় যে স্বতস্ফূর্ত থিয়েটারের ভুবন সৃষ্টি করেন; তা বর্তমান বিশ্বে নানারূপে সমৃদ্ধ হয়ে- মনোবিশ্লেষক নাটক বা ব্যাপক অর্থে থেরাপটিক নাট্যক্রিয়া হিসাবে সফলভাবে চর্চিত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে সাইকোড্রামা হল সংকটের কার্যকারণ খোঁজার মধ্যে দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত চরিত্রাভিনয়ের বিশেষ এক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া অংশগ্রহণকারীদের শরীর, মন ও অন্তরাত্মাকে প্রসন্ন এবং শান্ত করে তোলে,পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি করে এবং সম্মিলিতভাবে জীবন অন্বেষণের উপায় প্রতিষ্ঠা করে। পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের নানা চরিত্রের বা ব্যক্তির সঙ্গে স্বতস্ফূর্ত ও যৌক্তিক জীবনাচারের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক এই প্রক্রিয়া।
প্রথাগত থিয়েটারের নির্দেশকের মতোই, একজন সঞ্চালকের তত্ত্বাবধানে চলে সাইকোড্রামার প্রয়োগ প্রক্রিয়া। তবে শাসক নয়, সহায়ক হিসাবে থাকেন সেই সঞ্চালক। প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন— কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রোটাগোনিস্ট, সহযোগী চরিত্র বা ওগজিলিআরি ইগো এবং দর্শক। সুনির্দিষ্ট মঞ্চ ও দর্শকাসন এই প্রক্রিয়ায় অনিবার্য না হলেও; স্বাস্থ্যকরভাবে অংশগ্রহণকারীদের সহ-অবস্থান উপযোগী একটি কার্যক্ষেত্র অত্যাবশ্যক।

এই জাতীয় নাটকের মূলে থাকেন একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রোটাগোনিস্ট (স্বতঃসফূর্তভাবে যিনি ব্যক্তি জীবনের কোনও বিশেষ মুহূর্ত বা ঘটনা উপস্থাপন করে থাকেন) নাট্যক্রিয়ায় জীবনের সত্যকে তুলে ধরার জন্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে থেকেই এক বা একাধিক সহযোগী চরিত্রও ওগজিলিআরি ইগো-র সহযোগিতা নিয়ে থাকে। কখনও কখনও ‘ইনার ভয়েস’ রূপে কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রোটাগোনিষ্ট অনুভূতিগুলোকে প্রাণ দিতে তথা ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ায় অংশ নিতে, সহযোগী চরিত্র বা ওগজিলিআরি ইগোদের ব্যবহার করে থাকে। ওগজিলিআরি ইগো বা সহযোগী চরিত্র ‘ডাবল’ হিসাবে কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রোটাগোনিস্টের অন্তরাত্মার বিভিন্ন সত্তা হিসাবেও ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে সাইকোড্রামায়। (যেমন ধরুন; আমাদের বাংলায় পঞ্চম বৈদিক প্রযোজিত ‘কারুবাসনা’য়— হেম চরিত্রটি)
তাৎক্ষণিক ও স্বতস্ফূর্ত এই নাট্যাভিনয়ের শেষে দর্শক উপস্থাপিত নাট্যক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে জন্ম নেওয়া অভিজ্ঞতার ঐক্য-অনৈক্য, মিল-অমিল প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে শেয়ার করে থাকেন। এই পর্বে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করে সমষ্টির মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে এক ধরনের দলগত উপলব্ধির জন্ম হয়। তাই সাইকোড্রামা গ্রুপ সাইকোথেরাপি হিসাবেও স্বীকৃত।
সঞ্চালক তথা নির্দেশক সম্পূর্ণ প্রয়োগ প্রক্রিয়াটির নেতৃত্ব দেন বটে; তবে শুধুমাত্র অনুঘটক হিসাবে, পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি অনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সাইকোড্রামার সেশন বা অধিবেশনটি সম্পন্ন হয়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা দৈহিক মানসিক অথবা উভয়ের সমন্বয়ে নানান নাট্যক্রিয়া সম্পাদন করে থাকেন। সত্যিকার অর্থে পরিচালিত দৃশ্যগুলির মধ্যে দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের স্বতস্ফূর্ততা ও সৃজনশীলতাকেই তুলে ধরা হয়।

ওয়ার্ম আপ বা প্রস্তুতিমূলক এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সঞ্চালক অংশগ্রহণকারীদের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াটি সুসম্পন্ন করতে চুক্তিবদ্ধ করান।
যার মধ্যে প্রধানতম হল—
ক) স্বেচ্ছায় স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বা ভলেন্টারী পার্টিসিপেশান— যেহেতু সাইকোড্রামার প্রয়োগ প্রক্রিয়া ব্যক্তির স্বতস্ফূর্ততা ও সৃজনশীলতার ওপর নির্ভরশীল, তাই ব্যক্তির স্বাধীন মত প্রকাশ এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কাউকে এই বিষয়ে প্রণোদনা বা উৎসাহ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারবে না। বিষয়টি একেবারেই একান্ত এবং স্বতন্ত্রভাবে ঘটবে। আর তার জন্য সকলে একমত হওয়া এবং তা অনুসরণ করা আবশ্যক।
খ) অন্যের মতামতের ওপর মন্তব্য-নিরপেক্ষ থাকা এবং নিরপত্তা বিধান করা অর্থাৎ ননজাজমেন্টাল রেসপেক্ট ও সেফটি— অংশগ্রহণকারীদের আচরণ ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নিরপেক্ষ থেকে তারা পরস্পরের উপস্থাপনা বা মতামতের প্রতি মনোযোগী হবে এবং মতামত কিংবা অনুভূতির প্রতি নিরপেক্ষ মন্তব্যহীন অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে। এতে ব্যক্তি নিজের আবেগ ও অনুভূতি সঠিক ও কার্যকরভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়। সর্বোপরি বিশেষভাবে সজাগ ও সচেষ্ট থাকতে হবে যেন অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। দলের কেউ যেন নিরাপত্তাহীনতা অনুভব না করে। এই নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি তিনটি স্তরে নিশ্চিত করা জরুরি।
১। সামাজিক নিরাপত্তা
২। মানসিক নিরাপত্তা
৩। শারীরিক নিরাপত্তা
গ) গোপনীয়তা বা কনফিডেনশিয়ালিটি : সাইকোড্রামায় কেন্দ্রীয় চরিত্র বা প্রেটাগোনিস্টের পাশাপাশি অন্য অংশগ্রহণকারীদেরও ব্যক্তিগত জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা উঠে আসে। সেটা দলের বাইরে প্রকাশ পাবে না; এমন নিশ্চয়তা বিধানের নিমিত্তে সকল অংশগ্রহণকারী চুক্তিবদ্ধ হন। ব্যক্তি তার একাধিক ব্যক্তিসত্ত্বাকে এবং ব্যক্তিগত আনন্দ-কষ্ট দলের সামনে উপস্থাপনে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। কার্যত এই ক্ষেত্রে ব্যক্তির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে সামষ্টিক অস্তিত্বের আবহ ব্যক্তিকে একা তাড়িত না করে দলের মধ্যে প্রবাহিত হয়। গোপনীয়তার অঙ্গীকার ব্যক্তি বা সমষ্টিকে জাগিয়ে রাখে, প্রণোদনা যোগায় তার বা তাদের অন্তরাত্মাকে উন্মোচিত করতে।

উল্লিখিত কৌশলসমূহ সংযোগ ব্যক্তির সহযোগী মনোভাব বা সম্পূরক আচরণ বা ভূমিকাকে সামাজিক, শারীরিক ও অন্তর্নিহিত অভিপ্রায়ের বিবেচনায় চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটানোর সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। যে সুযোগ ব্যক্তিকে তার মধ্যে অন্তর্গত রোল বা ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করার অভিপ্রায় তৈরি করে। এই রোল বা ভূমিকা মূলতঃ তিন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-
- সোমাটিক রোল- ব্যক্তির জৈবিক প্রবৃত্তি থেকে সৃষ্ট ভূমিকা বা সত্ত্বাকেই সোমাটিক রোল বলা হয়।
- সোশ্যাল রোল- কাজের সম্পকর্, পেশাগত সম্পর্ক এবং সামাজিক সম্পর্কের বিবেচনায় ব্যক্তির মধ্যে যে- ভূমিকা বা অবস্থা ও অবস্থান সৃষ্টি হয়; তাই সোশ্যাল রোল।
- সাইকোড্রামাটিক রোল- কল্পনার জগৎ এবং স্বপ্নজগৎ থেকে অর্থাৎ ব্যক্তির অন্তর্গত বিশ্ব থেকে যে সকল ভূমিকার আবির্ভাব ঘটে তাই সাইকোড্রামাটিক রোল।
আলোচ্য রোল বা ভূমিকাসমূহ ব্যক্তির মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে এবং সেই রোলসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত যে বিপর্যস্ত পরিবেশ বা পরিস্থিতির জন্ম দেয়; সঞ্চালকের তত্ত্বাবধানে তা থেকে উত্তরণের পথ পরিক্রমাই মূলত সাইকোড্রামাটিক এপ্রোচে সম্পন্ন হয়।
সাইকোড্রামাটিক এপ্রোচের মূল শর্ত হচ্ছে স্বতঃস্ফূতর্তাকে এই ক্ষেত্রে ব্যাখ্য করা হয়ে থাকে এভাবেঃ ‘পুরানো পরিস্থিতির প্রতি একটি নতুন সাড়া’ অথবা ‘নতুন পরিস্থিতির প্রতি একটি যথার্থ সাড়া’ রূপে।
সৃজনশীল শিল্পের মানবগুণাবলীর কথা আমাদের দেশেও যদি ভাবা হত, তাহলে সমাজের মধ্যে ঢুকে পড়া ক্যানসারের মতো ডিপপ্রেসন থেকে জনগণ অনেকটাই মুক্তি পেতে পারতো।
তথ্যঋণ: ১। ‘Theater of Spontaneity
Book’
২। ‘Autobiography of a Genius’
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Wikimedia Commons, Facebook, Pxhere, কারুবাসনার ফেসবুক পেজ
পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউটে বর্তমানে পাঠরত।
থিয়েটার, শিল্প ও কবিতা-র ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন।
One Response
লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো। ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য খুবই উপযোগী লেখা।