“আশ্বিনের শারদ প্রাতে/ বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির,/ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা,/প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমনবার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে ওঠে…”।।
বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্রর কণ্ঠে এই পাঠ শুনেই তো মহালয়ার দিন থেকে পূজার উৎসবের শুরু। গত ক’বছর আমরা যে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ‘কেয়ার আনলিমিটেড’এর অফুরান স্নেহচ্ছায়ার সংস্পর্শে এসেছি, তাদের কাছে পুজো আসে এক স্বতঃস্ফূর্ত –অনাবিল আনন্দের বার্তা নিয়ে।
যে কলকাতা একদিন ছিল তারুণ্যের প্রতীক সে কলকাতা বেশ কিছুদিন হল পরিণত হয়েছে এক বৃদ্ধাবাসে। বেশির ভাগ বহুতল আবাসনে আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়ির আশ্রয়ে যাঁরা নিরবচ্ছিন্ন আরামে থাকেন তাঁদের অনেকেরই বয়স সত্তর-আশির কোঠা পেরিয়েছে। পুত্র, কন্যা হয় বিদেশে, নয়তো বা অন্য রাজ্যে কর্মরত। কেন তাঁরা এ শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়।
ছেলেমেয়েরাও জানেন তাঁরা বাবা মাকে জাগতিক সুখ দিতে সমর্থ হলেও তাঁদের নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব দূর করতে অক্ষম। সপ্তাহান্তে ভিডিও কল করেও ওঁদের মনের খোরাক যোগানো সম্ভব হচ্ছে না। শারীরিকভাবে ঠিক থাকলেও তাঁরা অনেকেই হয়ে পড়ছেন বিষণ্ণতার শিকার। এই দুর্দিনে মরুভূমিতে ওয়েসিসের মতো আবির্ভাব সূর্যাশীষ গুপ্তর পরিচালনায়, একটি সুযোগ্য টিম নিয়ে গঠিত ‘কেয়ার আনলিমিটেড’-এর। এঁরা যে শুধু তাঁদের সদস্যদের স্বাস্থ্য, তাঁদের ব্যাঙ্কের কাজকর্ম, সহায়ক চালনা, প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো দৈনন্দিন কাজকর্মে সাহায্য করেন তাইই নয়, সারা বছর নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের মনের খোরাক যেমন যোগান, তেমনি তাঁদের বিবিধ উপায়ে আনন্দদানও করে থাকেন।

এমনই একটি অনুষ্ঠান হল ‘পূজা পরিক্রমা’– চতুর্থীর দিন সকালে অপেক্ষাকৃত সক্ষম সদস্যদের নিয়ে গাড়িতে করে ঠাকুর দেখা (Durga Puja for senior citizens)। করোনার জন্য মাঝে দু’বছর সম্ভব না হলেও, গত বছর থেকে জোর উদ্যমে নতুন করে আবার শুরু হয়েছে। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এবারে পূজা পরিক্রমায় প্রায় ৩৫-৪০ জন সদস্য যোগ দিয়েছেন। চতুর্থীর দিন মাঝ সকালে এগারোটা গাড়িতে করে যাত্রা শুরু হল। স্মার্ট ফোনে ‘জুম’এর সাহায্যে দলনেতা সূর্য এবং তার সহযোগী দেয়া পুরো কনভয়কে সঠিকভাবে পরিচালনা করে এগিয়ে নিয়ে চলল। কে পিছিয়ে পড়ল, কে দল-ছুট হল সব দিকে নজর ওদের। প্রতি গাড়িতে একজন করে কর্মী সঙ্গে আমরা বুড়োবুড়িরা। প্রথম স্টপ একডালিয়ার পুজো মণ্ডপ। কয়েক দশক বাদে এক বিঘৎ দূর থেকে এই বিখ্যাত পুজোর প্রতিমা দর্শন করলাম। সত্যি কথা বলতে কী প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম। এই আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে যে সেই ছোটবেলার মতো ঠাকুর দর্শন করতে পারব, স্বপ্নেও ভাবিনি। পার্থক্য একটাই, তখন বাবামায়ের হাত ধরে ভিড় ঠেলে ঠাকুর দেখতাম, এবার সাত সকালে সূর্যর ব্যবস্থাপনায় প্রায় ফাঁকা মণ্ডপে নিরিবিলিতে প্রতিমা দর্শন। কী আনন্দ কী আনন্দ এই ভুবনে!
এর পরের গন্তব্য সিংহী পার্ক। রাস্তার ওপরেই পুজো মণ্ডপ। তাই গাড়িতে বসেই প্রতিমা দর্শন। আকর্ষণ কী শুধু প্রতিমার? প্রতিমা দেখব না মণ্ডপ দেখব! নানান বৈচিত্রে ভরপুর সব মণ্ডপ! কোথাও বাঁশের ঝাড় দিয়ে মণ্ডপ, কোথাও আবার গামছা দিয়ে সাজানো। হিন্দুস্থান পার্কের এক মণ্ডপ তৈরি হয়েছে কেদার নাথের মন্দিরের আকারে। মন্দিরের প্রবেশমুখে বিশাল শিবের মুর্তি। যে ক’টি মূর্তি দেখলাম, সব ক’টিতেই সাবেকিয়ানার ছাপ তাই আমাদের মতো প্রবীণদের চোখে তা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ঠেকেছে। গাড়িতে প্যাকেট করে দেওয়া ছিল খুচখাচ মুখ চালাবার জন্য বিস্কুট, চিঁড়ে ভাজা, চিপস আর তৃষ্ণা মেটাবার জন্য জল। সব দিকে নজর সূর্যদের। গাড়িতে যেতে যেতে দুই বন্ধু সবটাই সদ্ব্যবহার করে ফেললাম।

পথে পড়ল কালিঘাটের পটুয়াপাড়া। সেখানে এখনও বেশ কিছু দুর্গা মূর্তি রয়েছে অসম্পূর্ণ অবস্থায়। রয়েছে লক্ষ্মী-কার্তিকের মূর্তির কাঠামোও। আজ চতুর্থী। কে নেবে এই অসম্পূর্ণ মূর্তিগুলি? পটুয়ারা কি পারবে পুজোর আগে কাজ শেষ করতে? এই সব সাত-পাঁচ চিন্তাও আসছিল মনের মধ্যে।
এবার যাত্রা ২৩ পল্লির দিকে। সেখানে অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি দুর্গা মূর্তি দর্শন। এই মূর্তিটি ১৯৮৫ সালে তৈরি করেছিলেন বারাণসীর এক শিল্পী। সেই মূর্তিই প্রতি বছর নিষ্ঠা সহকারে পূজিত হয়। ভারি সুন্দর সেই মূর্তি। বারবার দেখেও আশা মেটে না। পরিক্রমা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এবারে মুদিয়ালির ঠাকুর দর্শন। এই প্রতিমার খ্যাতিও কম নয়। সব দিকে ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড টাঙানো। তবে বিশেষ অনুমতি মেলায় আমাদের গাড়িগুলি ঢুকতে পারল। সুতরাং গাড়িতে বসেই মুদিয়ালির অসাধারণ প্রতিমা দর্শন। ততক্ষণে গাড়িতে বসেই আমরা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত।
এবারে একটা টি-ব্রেক না হলে চলছিল না। প্রতিবারের মতো এবারেও কলকাতার নামী শেফ রংগন নিয়োগীর বালিগঞ্জ গার্ডেনসের পুজোতে গিয়ে পরিক্রমা শেষ। হাত পা ছড়িয়ে একটু বসে, গরম গরম চা পান আর অবশ্যই ফোটো সেশন। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে ১টা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এবারে আমাদের গন্তব্য ক্যালকাটা পাই রেস্তোরাঁ। ভালোই ভুরিভোজের আয়োজন ছিল। তার সঙ্গে গান, কবিতা পাঠ। আর সব শেষ প্রাপ্তি একটি করে শারদীয়া সন্দেশ ১৪২৯। “আসছে বছর আবার হবে” এই সদিচ্ছা মনে নিয়ে যে যার ঘরে ফেরা। অনেকটা অক্সিজেন, অপার স্নেহের আকর কেয়ার আনলিমিটেডের অনেকটা ভালোবাসা নিয়ে বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে আমরা এবার ঘরমুখো হলাম। মনে সেই গান, “বাজল তোমার আলোর বেণু/মাতলো রে ভুবন……”।
ছবি সৌজন্য: আলপনা ঘোষ ও কেয়ার আনলিমিটেড
পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি বই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।