Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

অনুবাদ গল্প: তিনটে আঙুল (অন্তিম পর্ব)

তৃষ্ণা বসাক

জুলাই ৩, ২০২৩

E Santosh Kumar Story-translation Final part
E Santosh Kumar Story-translation Final part
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বেশিরভাগ টেবিল ফাঁকা হয়ে গেছে। বেয়ারারা একধারে দাঁড়িয়ে অধৈর্য্যভাবে অপেক্ষা করছে আমরা কখন উঠব। হঠাৎ মনাই উঠে দাঁড়াল আর প্রচণ্ড জোরে আমার শার্টের দু’কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

‘লেখক! পমেরিনিয়ান কুকুর কোথাকার! তুমি, তোমরা কী মহান সাহিত্য রচনা করছ? লেখার জন্যে জীবনের কী অন্তর্দৃষ্টি আছে তোমাদের? অন্যের উচ্ছিষ্ট খুঁটে লেখা? নাকি চুরি করে যেসব যৌনমিলন দেখেছ সেসবের গ্রাফিক বর্ণনা দিচ্ছ?’

আমি ওর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলাম, ওর কাটা আঙুলের প্রান্ত আমার হাতে বসে যাচ্ছিল।

‘একটা গোটা প্রজন্ম ভরা হিজড়ে, যাদের বাস্তব জীবন দেখার কোনও অভিজ্ঞতা নেই…’ হাত সরিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল সে।

আমি বিল দিতে বললাম।

***

বারের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনাই ডাইনে বাঁয়ে দুলছিল। আমি তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম, কিন্ত ভারসাম্য না রাখতে পেরে বারবার মাছের মতো পিছলে যাচ্ছিল সে।

‘আমাকে ক্ষমা করো’ বেরিয়ে আসার পর সে বলল। ‘আমি একরাশ ফালতু কথা বলেছি। প্লিজ এসব সিরিয়াসলি নিও না। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’

‘কোনও ব্যাপার না।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কোথায় থাকো?’

সে পকেট থেকে একটা পার্স বার করে তার মধ্যে থেকে একটা ময়লা ভিজিটিং কার্ড বার করল।

এতে লেখা ঠিকানাটা একটা দূরের শহরের। আমি অনুমান করলাম, এটা নিশ্চয়ই ওর আগের বাড়ির ঠিকানা। আমি ওকে কার্ডটা ফেরত দিয়ে বললাম ‘এটা তো পুরনো কার্ড!’

‘ওহ, আমি কি তোমাকে পুরনো কার্ডটা দিলাম? সরি, এখানকার ঠিকানা লেখা কার্ড নেই’ সে বারের শেষ ধাপে পা ঠুকে বলল।

‘আমি তোমার ঠিকানা জানি।’ ভুল টাইপ করা সার্টিফিকেটের কথা মনে পড়ল আমার। বললাম ‘ ৩০৩ কাল্লার লেন, তাই না?’

মনাই আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাল। আমি ওর ঠিকানা মনে রেখেছি দেখে ও খুব অবাক হয়েছে মনে হল।

Image 1

জায়গাটা খুব দূরে না। কিন্তু ওদিকের শেষ বাস কিছুক্ষণ আগে ছেড়ে চলে গেছে।

আমি একটা অটো রিকশা থামিয়ে যাহোক করে মনাইকে ঠেলে তুলে দিলাম। রিকশাটা রাস্তার হলুদ আলোর নীচ দিয়ে একটা নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেই আমার মনে সারাদিনের ঘটনাগুলো একটা সিনেমার মতো ভিড় করে এল। এগুলো কি আমার কল্পনা ছিল? হয়তো এসব কিছুই ঘটেনি। আমার গল্প বেরোয়নি। মনাই, যে এখন অবধি একটাও ভুল করেনি, সে সব সার্টিফিকেটে নিজের নাম টাইপ করতেই পারে না। আর আমরা কোনও বারে যাইনি—- আমি যেন একটা চিত্রনাট্য ভাবছিলাম।

মনাইয়ের কাঁপা শরীর বারবার আমার শরীরে ঘসে যাচ্ছিল। ও অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল।

আমরা কাল্লার লেনে পৌঁছনোর পরেও তার মেজাজের কোনও পরিবর্তন হল না। যখন অটো ড্রাইভার আমাদের নামতে বলল, তখনই বুঝলাম এসে গেছি।

কোনদিকে যাব না বুঝতে পেরে আমি কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারপাশে কেউ নেই। সেই অন্ধকার আর রাস্তার মৃদু আলোতে চোখ সয়ে যাওয়ার পর, কয়েকটা রাস্তা আর বাড়ির নম্বর বুঝতে পারলাম। একটা সরু গলির মুখে হোঁচট খেলাম আমি, সেখানে একটা বোর্ডে লেখা ৩০৩। এক হাতে মনাইকে ধরে ছিলাম, যে গোটা রাস্তাটা হোঁচট খেতে খেতে আসছিল।

রাস্তটা এত সরু যে দুজন লোক কোনওরকমে পাশাপাশি চলতে পারে। আমরা কয়েকটা কাঠের তক্তাওয়ালা দোকানের মতো কাঠামো পেরিয়ে গেলাম। কোনও আলো নেই। দুটো কুকুর রাস্তায় শুয়ে আমাদের দিকে উদাসভাবে তাকাল, কোন শব্দ না করেই একটু সরল।   

আরও কিছুটা যাবার পর আমার ভয় হল আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি না। মনাই এখনও পাথরের মতো নিঃশব্দ। এভাবে আরও কিছুটা যাওয়ার পর আমি দেখতে পেলাম একটা ঘরের কাঠের তক্তার ফাঁক দিয়ে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

মনাই আমার দিকে তীব্র চোখে তাকাল। ওর ক্লান্ত চোখ থেকে যেন আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল।

পরক্ষণেই সে আমার হাত ছাড়িয়ে ঘরটার কাঠের তক্তার ওপর ঘা দিতে শুরু করল। সজোরে তিন চারটে ঘা দিয়ে সে সামনে বসে পড়ল। বুঝলাম, আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি।

কিন্তু অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য চারদিকে। কেউ দরজা-ধাক্কা শুনেছে বলে মনে হল না। মনাই নিচু গলায় বলল, ‘ভেতরে অন্য কেউ আছে। এইজন্যে দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে।’ সে নিজের কান খাড়া করল। ‘দেখ দেখ, আঁকা থেমে গেছে। এবার রং-তুলি তুলে রাখা হচ্ছে। ওই যে কাপড়ের খসখসের শব্দ।’ মন্ত্র বলার মতো সে ফিসফিস করছিল।

আমি বুঝতে পারছিলাম না সে কী বলছে!

Image 2

একটু পর দরজা খুলে গেল।

দেখা গেল বিস্ময়ের তখনও বাকি। যে নারী দরজা খুললেন, মনে হল একজন দেবী। মনে হল, তাঁর চোখ থেকে যে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে তাতে আমার চোখ বুজে গেছে। এত সুন্দর মেয়ে আমি আগে কক্ষনও কাউকে দেখিনি। এ সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এরকম একটা মেয়ে মনাইয়ের মতো কর্কশ আর ফসিল ধরনের লোকের সঙ্গে আছে! পুরো ব্যাপারটার মধ্যেই যেন একটা ভয়ানক অসংগতি। একে নারী বলা যায় না।  সত্যি বলতে কি, সে একটা মেয়ে, বালিকা। ফ্যাকাশে যে শাড়িটা সে পরে আছে, তা তার উপযুক্ত নয়। কানের দুটো ছোট চাপা দুল ছাড়া শরীরে আর কোনও অলংকার নেই। মেয়েটির উন্মুক্ত ঘাড় মরালীর কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। একটা দুর্বোধ্য ঈর্ষা আমার মধ্যে জ্বলে উঠল, আমার মন জ্বলেপুড়ে গেল।

ওর সঙ্গে একটাও কথা না বলে মনাই সোজা ছোট ঘরগুলোতে ঢুকে গেল, যেন কিছু তল্লাশি করবে। ওর শীর্ণ শরীর ডাইনে বাঁয়ে দুলছিল।

‘আমি মনাইয়ের একজন সহকর্মী।’ আমি ক্ষমাপ্রার্থনার ভঙ্গিতে দেবীকে বললাম।

‘আচায়া মদ খেয়েছে, তাই না?’ সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল। ‘ডাক্তার মদ খেতে মানা করেছেন।’

‘আমি জানতাম না’ — মাথা নামিয়ে নিলাম। ওর জ্যোতির্বলয় থেকে বেরিয়ে যেতে পেরে আমার হালকা লাগছিল।

‘পেছনের দরজা খোলা’— মনাই ওর তল্লাশি শেষ করে ফিরেছে। কাঁপা গলায় বলল, ‘রঙের চিহ্ন আছে। ওরা পালিয়ে গেছে। আমি এক মুহূর্ত দেরি করে ফেললাম’

সে বিরামহীন কাঁপছিল।

‘বাঁচিয়ে দিলে ওকে, তাই না?’ ওর স্বর প্রতিহিংসাপূর্ণ। তারপর সে মেয়েটির শাড়ির আঁচল টেনে পরীক্ষা করতে লাগল।

দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদছিল মেয়েটা।

‘কাকে খুঁজছ মনাই?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। সে একটা ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসল।

‘তুমি কিছুই জানো না। আমি বলেছি না, তোমাদের লেখায় কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তাই আমি এগুলোকে ট্র্যাশ বলি।’

এবার আর অপমানিত বোধ করলাম না। ততক্ষণে গল্প প্রকাশিত হবার উত্তেজনা আমার মধ্যে থিতিয়ে গেছে।

মনাই তখনও খোঁজ চালিয়ে যেতে লাগল। ঘৃণাভরা চোখ নিয়ে মেয়েটির কান্না দেখছিল সে।

‘তুমি কাঁদছ!’ সে চিৎকার করে বলল ‘দারুণ অভিনয়!’

Image 6

আমি ওখান থেকে চলে আসব বলে পেছন ফিরতেই মনাই তার আঙুল কাটা বাঁ হাত দিয়ে থামাল আমায়।

‘চলে যাচ্ছ নাকি, ও লেখক? তুমি সহজেই আমাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে পারো। আমি একটা উপন্যাসের মেটিরিয়াল… হাহাহা’ সে জোরে জোরে হাসতে লাগল।

‘কিন্তু আমি একজন খারাপ শিল্পী। আমাকে নিয়ে লেখা গল্পটাও বাজে হবে’ সে একটা পেনসিল নিয়ে আমার দিয়ে তাকিয়ে আঁকতে শুরু করল।

একটু পরেই স্কেচটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। এ তো আমার স্কেচ! আমি অবাক হয়ে গেলাম। সামান্য কয়েকটা রেখার টানেই আমাকে সে যথেষ্ট ঠিকঠাক এঁকেছে, তাও আবার এত অল্প সময়ে।

‘ওকে তুমি চেনো, চেনো না?’ সে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী উত্তর দেব! যে মেয়েটাকে আজই প্রথম দেখছি তাকে কীভাবে চিনব? মনাই ততক্ষণে আবার আরেকটা কাগজে আঁকতে শুরু করেছে।

‘তুমি এই ঠিকানা জানতে, এই ঘরটাও। কত নির্ভুলভাবে তুমি এখানে নিয়ে এলে’ সে প্রতিহিংসার হাসি হাসছিল। ‘রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত তোমাকে চেনে। তাই ওরা একবারও ডাকেনি। ছিঃ… আমি কী বোকা!’ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আজ কেন যে ওর সঙ্গে বারে ঢুকলাম, ভেবে নিজেকেই অভিশাপ দিচ্ছিলাম আমি।

‘ভেবো না। অনেক লোক এখানে আসে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে। এতে আমি আশ্চর্য হইনি। কিন্ত আমি যখনই বাস ধরে হঠাৎ দুপুরে এখানে এসে পড়ি, সেইসব লোকেরা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

Image 3

আমি ভয়ংকর ভেঙে পড়ছিলাম। এত রাতে ওর সঙ্গে এখানে আসা একেবারেই উচিত হয়নি।

‘তুমি আর তোমার মতো লোকেরা ভাবো যে লোকে এখানে আসে ওর কামনায়। বোকার মরণ! এটাই লেখকদের নিয়ে সমস্যা। শোবার ঘরে উঁকি মারছে সব! জীবনের সত্যিকারের অভিজ্ঞতা নেই…’ একটা বিদ্রূপের হাসি হাসল সে। ‘কিন্তু সত্যি সেটা নয়। লোকেরা, বিরাট সব শিল্পীরা এখানে আসে ওর ছবি আঁকতে। আমি জানি। আমিও একসময় শিল্পী ছিলাম।’

ঘরের আবছা আলোয় মেয়েটি দুহাতে মুখ ঢেকে তখনও কাঁদছে, ঠিক যেন কোনও জাদু মূর্তির মতো। কী করে সে এই লোকটার সঙ্গে একঘরে থাকে, সে এক রহস্য!

‘কেউ আঁকাটা শেষ করতে পারেনি। আমি তার আগেই এসে গেছি। যদি কেউ ক্যানভাসে ওকে পুরো ধরতে পারে, সেটা পৃথিবীর সেরা আঁকা হবে। সুন্দর নগ্নিকা যক্ষিনী। আমার কথা যদি বলো, আমি সব শেষ করে দিয়েছি। সব কটাই।’ সে ফিসফিস করে চলল।

সে এতক্ষণ নিজের ছবি আঁকছিল। হঠাৎ রাগে ছবিটা টুকরো টুকরো করে ফেলল মনাই।

‘লোকে আমাকে এইভাবে ছিঁড়ে ফেলেছে।’ হাত নাড়িয়ে সে হিংস্রভাবে চিৎকার করে উঠল। ‘ন্যুড আঁকা একজন শিল্পীর এক্তিয়ারে পড়ে। কোনও ডাক্তার, কোনও শুয়োরের অধিকার নেই তা আটকায়।’

আমার মনে হল মনাইয়ের কাছ থেকে এইমুহূর্তে ছুটে পালাই। কিন্তু একটা অশ্লীল কাহিনির অসাধারণ উন্মোচন শোনার বাজে ঘৃণ্য ইচ্ছেও জেগে উঠছিল আমার মধ্যে।

Image 4

‘ওর জীবন একটা পুরনো ছবি, যা বহু লোক ছিঁড়ে টুকরো করেছে’ মনাই বলল। ‘শেষ পর্যন্ত আমি ওকে উদ্ধার করলাম, ধৈর্য ধরে ধরে টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে… কিন্তু কোনও মানবিক করুণা থেকে নয়, মনে রেখো…’ জোরে হেসে উঠল সে। ‘কোনও শিল্পীরই কারও জন্যে সহানুভূতি থাকে না, নিজের ওপর ছাড়া। আমি শুধু ওর ছবি আঁকব বলে ওর দায়িত্ব নিয়েছি।’

‘আমি সপ্তার পর সপ্তা ওর ছবি এঁকে গেছি, একটা নিখুঁত ন্যুড আঁকব বলে। ও আমার সামনে দিন-রাত নগ্ন হয়ে বসে থেকেছে। ওর সঙ্গে শোয়া কখনোই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমার লক্ষ্য ছিল ওর ছবি আঁকা। অনেকেই ওর সঙ্গে শুয়েছে। কিন্তু আমি একাই সেই সময় ওর ছবি এঁকেছি। এটা সেই সময় যখন মাত্র একশ টাকা পেলেই একশ জন পোজ দিতে রাজি ছিল। আমি নিজেই কত এঁকেছি। যতসব ট্র্যাশ। কিন্তু ওর ছবি আঁকার সময় নিজেকে কেমন ব্যর্থ মনে হত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শুধরে নিয়ে আর একটু টাচ আপ করে আমি নিখুঁত ছবি আঁকতে পারব। একটা অসহ্য ব্যর্থতার বোধ আমাকে পেড়ে ফেলল। নিজের ভুলের জন্যে নিজেকেই শাস্তি দিলাম আমি। এইরকম।’ সে নিজের  কাটা আঙুল-শুদ্ধ বাঁ হাতটা তুলে ধরল। তারপর হাতের তালু দিয়ে দরজার পাল্লায় ধমাস করে মারল।

‘আমার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন রক্ত পড়ছিল। হ্যাঁ রক্ত। মেঝেময় রক্ত। ছেনির ডগায় রক্ত, কাটা আঙুলগুলোয় রক্ত, হাতের তালুতে রক্ত। রক্ত মাখা কাপড় যেন লাল সিল্কের মতো। আমার নিজের রক্তের গন্ধ, কী ঠান্ডা অনুভূতি! হুঃ! কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। আমি তখনও ওকে আঁকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কোথায় সে? আমি ওকে খুঁজছিলাম। দেওয়ালে ওর নাম লিখলাম রক্ত দিয়ে। যেন নিজেকে বলি দিয়ে ওকে লুব্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। নগ্নিকা। জানো তো, ওরা সবাই ভয় পেয়েছিল যে আমি ছবিটা শেষ করে ফেলব। দেমাকি হিংসুটে শিল্পীর দল! সেটা বন্ধ করতেই ওরা আমাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে দিল।

শুয়োরদের লেখা ওষুধ আর ট্যাবলেট খেতে বাধ্য করল। কিন্তু বন্দি অবস্থাতেও আমি ওর ছবি এঁকে চললাম। আমার মনের ক্যানভাসে! বলিনি তোমাকে,? কিন্তু ও একটা যক্ষিনী। হাজার চেষ্টা করেও সার্থকভাবে ওর ছবি আঁকতে পারিনি আমি। শেষ অব্দি হেরে গেলাম। একটা মথের মতো প্রদীপের আলোয় পুড়ে গেলাম।’ কথার তোড়ে মনাই হাঁফাচ্ছিল।

‘আমি হেরে গেলাম। কিন্তু তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না। বিজয়ীর থেকে হেরো লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। আমি একটা জন্তুর মতো অ্যাকাউন্টসের কাজ করে আর তর্জনী দিয়ে টাইপ করে বেঁচে থাকব। কিন্তু একটা কথা, কাউকে আমি ওর ছবি এঁকে মহান শিল্পী হতে দেব না।‘ সে ভীতিপ্রদভাবে থেমে গেল।

‘কেউ যদি ওর ছবি আঁকে আমি তাকে কিমা বাড়িয়ে ছেড়ে দেব। যেমন ওরা আমার হাল করেছে।’

সে আবার বাম হাতের তালু দিয়ে দরজায় ধাক্কা মারল।

পাশের ঘরে কেউ নড়াচড়া করছিল।

Image 5

ওখানে আর একমুহূর্ত থাকিনি আমি। ফেরার পথেও গলির কুকুরদুটো উঠে আমার রাস্তা করে দিল। যখন রাস্তায় উঠলাম পেছনে শুনতে পেলাম কিছু ছুঁড়ে ফেলার শব্দ।

 

পরের দিন মনাই অফিসে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। সে এমন ভাব করল যেন আগের রাতে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি।

‘আমার কিছু টাকার দরকার’ সে বলে ‘আমি কাজ করে শোধ করে দেব। খুব আর্জেন্ট। ওষুধ কিনতে হবে।’

সে যত চাইল তার অর্ধেক দিলাম আমি।

সন্ধেবেলা সে আবার ফিরে এল। বেহেড মাতাল হয়ে। যখন বললাম আর টাকা দেব না, আমার ওপর চেঁচাতে লাগল।‘

‘আমি জানি ওই মেয়েটার ওপর তোমার নজর আছে। আঁকার জন্যে না, লেখার জন্যে। ওকে ফুটিয়ে তুলবে, শুয়োর কোথাকার।’ আমার কিছু পরিচিত মানুষ ডিপোজিট করার জন্যে এসেছিল, আমি খেপে গেলাম।

‘একদম বাজে বকবে না’ চেঁচিয়ে বললাম আমি।

‘দুনিয়ায় বাজে কথা বলে কিছু হয় না, বন্ধু। সব কিছুরই নিজস্ব ব্যবহার আছে।‘ সে হাসল ‘কে ওর দিকে চোখ দেয়নি?’

‘এইরকম ভাবে চললে তোমার আর এখানে আসার দরকার নেই’ আমি বললাম।

সে কিছুক্ষণ মনস্থির করতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর চলে গেল।

সে রাতের পর মনাই আর ফিরে আসেনি। কদিন পর দয়াল ইনভেস্টরের একটা ছোট বিজ্ঞাপন বেরোয় স্থানীয় কাগজে। ‘খ্যাতনামা একটি আর্থিক সংস্থায় অভিজ্ঞ টাইপিস্ট চাই।’

ঘটনাটাকে ‘একটা পাণ্ডুলিপির উপসংহার’ ভেবে নিয়েছিলাম আমি।

আস্তে আস্তে অন্য পত্রপত্রিকাতেও আমার গল্প বেরোতে লাগল। কিন্তু মনাই যেমন বলেছিল, গল্প সংকলন করার কোনও আগ্রহ বোধ করিনি আমি। সেই সময় ছোটগল্পের কোনো প্রকাশক ছিল না। ছোট উপন্যাস যেটা সে কিনেছিল,সেটা আমার ওই চাকরি ছাড়ার পর লেখা। সত্যি বলতে কি, অনেক বছর পর। যখন এটা লিখি, মনাইয়ের কথা আমার মাথাতেও ছিল না। সেইরকম আমার সেই পুরনো অফিস, তার

পরিবেশটাও ভুলে গেছিলাম। দুজন বুড়ো মিস্ত্রিকে নিয়ে লেখা ওই উপন্যাসটা।

Drunk Man
সন্ধেবেলা সে আবার ফিরে এল। বেহেড মাতাল হয়ে।

চুক্তির তিন বছর শেষ হতে আমি ঐ চাকরিটা ছেড়ে দিই। তারপর কিছুদিন বেকার থাকার পর এই শহরেই আর একটা কম্পানিতে ঢুকি। সেই হস্তরেখাবিদ আমার সম্পর্কে যা যা বলেছিলেন, সব মিলে গেছে।

হয়তো তিনি তেমন কিছুই উল্লেখ করেছিলেন যা স্রেফ কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই বলা যায়। হয়তো এগুলোর তেমন তাৎপর্যও নেই। তিনি আমার সাহিত্যজীবন নিয়ে কিছুই বলেননি।

যাই হোক, অনেক বছর পরে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন বেরোল, যা তাঁর ভবিষ্যৎবাণীকে মিলিয়ে দিল।

রিজার্ভ ব্যাংক নন-ব্যাংকিং ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত সংস্থার একটা তালিকাও প্রকাশ করেছিল, একটা বিজ্ঞপ্তির আকারে।

সমস্ত খবরের কাগজেই এটা গুরুত্ব-সহকারে ছাপা হয়েছিল, তার মধ্যে খুব ছোট হরফে ছাপা দয়াল ইনভেস্টরের নামটা খেয়াল করেছিলাম আমি।

কেবিনে বসে আমি চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করলাম না। আসছি বলে ওখান থেকে আমি আমার সিটে ফিরে এলাম আর যেই চিঠিটা খুললাম, আমার মনে পড়ে গেল মনাই বলেছিল, উপন্যাসেরজন্য সে খুবই ভালো উপাদান

একটা বড় গল্পের এপিলগ হিসেবে চিঠিটা পড়ার চেষ্টা করলাম। বড় নয়, মাত্র কয়েক লাইনের চিঠি, সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা।

 

প্রিয় বন্ধু,

তুমি আমাকে মনে রেখেছ এই আশায় এই চিঠি লিখছি। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করে আমাদের বন্ধুত্ব নতুন করে শুরু করতে এসেছিলাম। তুমি যে উপন্যাসটা লিখেছ তার জন্য আমার আনন্দ জানাতেও। উপন্যাসটা খুঁজে বার করে পড়েছি আমি। আশা করেছিলাম যে এ,ই বৃদ্ধ শিল্পী অন্তত একটা অকিঞ্চিৎকর চরিত্র হিসেবেও তোমার উপন্যাসে আসবে। কিন্তু তা আসেনি। পরের উপন্যাসে অবশ্যই আমাকে রেখো, অন্তত ছোটখাট কোনও চরিত্রে। আমি কিছুদিন ছুটিতে আছি। এখানে সেটাকে বলা হয় প্যারোল।

তোমার কি মনে নেই? সেই যে আমার হাতে রক্তের গন্ধ… সেই রক্তই আমাকে এখানে আবার নিয়ে এসেছে।
হ্যাঁ সেই বুড়ি আমার হাতে রক্তের গন্ধ পেয়েছিল— অন্যের রক্ত। সেই জন্যেই সে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

সে যখন রক্তের মধ্যে পড়েছিল তার মুখে এক আশ্চর্য শান্তি। সেই দৃশ্য সন্দেহাতীতভাবে অনেক বিখ্যাত নুড ছবিকে ছাপিয়ে গেছিল। ভেনাসের ছবির মতো, এক অলৌকিক সৌন্দর্য বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তার মধ্যে থেকে। স্লিপিং বিউটির মতো ঘুমিয়ে ছিল সে।

নগ্ন হয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত, এর থেকে হৃদয়ভাঙা দৃশ্য আর হয় না। সেই প্রথমবার ওর জন্যে আমার করুণা হচ্ছিল। সত্যিই, বড় নিষ্পাপ ছিল সে।

 

তোমার

জোসেফ  মনাই

 

যখন তার নামের জায়গায় পৌঁছলাম, সেই তিনটে কাটা আঙুল আমার স্মৃতিতে মাছের মতো ঘাই মারছিল।

আর সেই ছোট কাগজটা কাঁপছিল, যেন ঝোড়ো হাওয়া বইছে।

 

*মূল কাহিনি: ই সন্তোষ কুমার

*অলঙ্করণ: মৃণাল শীল
*ছবি সৌজন্য: Shutterstock

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

Picture of তৃষ্ণা বসাক

তৃষ্ণা বসাক

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
Picture of তৃষ্ণা বসাক

তৃষ্ণা বসাক

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com