একুশে ফেব্রুয়ারি, ২০১১। ভাষাদিবসের দিন। ডাকবিভাগের চাকরি নিয়ে সেদিনই যেতে হবে বাঁকুড়ার রানিবাঁধে। সেদিন বাস বন্ধ, দোকান বন্ধ, পথে কাকপক্ষীটি নেই। নিজেদের মুখের ভাষাকে মান্যতা দেওয়ার দাবিতে কারা বনধ ডেকেছে। কিশোরী রাধার মতো প্রাণোচ্ছল বন-পাহাড়ের মহারানি সোনার রানিবাঁধ ততদিনে রক্তে লাল। চারিদিকে চাপা আতঙ্ক। হিংসা আর রক্ত নিয়ে সে কী বীভৎস উল্লাস! সরকারপক্ষ বহুজাতিক কোম্পানির কাছে নাকি বিক্রি করে দিচ্ছে বন-জঙ্গল-চাষের জমি। আদিবাসী জনসাধারণ, আজন্মকাল ধরে জঙ্গলকে যারা মা জেনে এসেছে, সেই মা যেন নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তাঁদের কাছে। এর প্রতিবাদে জঙ্গলের কেন্দুপাতা, বাবুই ঘাস আর কুরকুট সংগ্রহ করে বেঁচে থাকা মানুষেরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। কেউ কেউ যোগ দিয়েছে নিষিদ্ধ শিবিরে। মাসের বেশিরভাগ দিন বনধ। জঙ্গলে ঘোরাফেরা বন্ধ, অফিস বন্ধ, বন্ধ দোকানপাট। বাতাসে বারুদের গন্ধ ভাসে। বাতাসে কান পাতলে গুলির শব্দ শোনা যায়। কোথায় হারিয়ে গেছে ধামসা-মাদলের বোল, ঝুমুর, দাঁসাইয়ের সুর। রানিবাঁধের শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতির মতো লোকজীবন ও সংস্কৃতি সেদিন বিপন্ন।
উৎপল পাল কর্মসূত্রে রানিবাঁধের বাসিন্দা। তপন চৌধুরী রানিবাঁধের ভূমিপুত্র। প্রমথ মাহাত ঝুমুরিয়া। ফটিক সহিস বাজনদার। অশোক মাহাত গানের শিক্ষক। একদিন উৎপল পালের বাড়িতে সান্ধ্য-আসর বসেছে। প্রমথ মাহাত গাইছেন—
“রানিবাঁধের বনবাদাড় টাড় টিকর ডুংরি পাহাড়
ও দাদা রানিবাঁধে বসতি আমার
রানিবাঁধে বসতি আমার…”
প্রমথবাবুর গলায় ভেসে উঠল নিজের জন্মভূমির প্রতি বিনম্র ভালোবাসা, আমরা পেলাম প্রত্যন্ত জঙ্গলমহলের দেশজ ভাষার ছবি। সেদিনই ঠিক করলাম এই ভাষা, এই লোকগান, এই সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই আমাদের প্রতিবাদের ভাষা। কবি নির্মল হালদার ঠিক করলেন, পত্রিকার নাম হোক, ‘অহিরা’। ডবল ডিমাই সাইজের মাত্র চার পাতার পত্রিকা। পার্থপ্রতিম দাস নামাঙ্কন করলেন। লোক-গবেষক সাধন মাহাত পত্রিকা ছাপার দায়িত্ব নিলেন। নির্মলদার অলংকরণ দিয়ে শ্রাবণ, ১৪১৯ সালে পথ চলা শুরু হল আমাদের।

আমাদের প্রথম আড্ডাটিকে মনে রেখে অহিরা-র প্রথম সংখ্যায় উৎপল পাল লিখলেন, ঝুমুর প্রসঙ্গে। প্রথম সংখ্যা থেকেই অহিরা-র পাতায় লোকসংস্কৃতি ও কবিতা একই সঙ্গে জায়গা করে নিল। দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখা হল, ‘ঢোকরা/ বিকনা শিল্পগ্রামের কথা’ আর সাধন মাহাতর গবেষণাধর্মী লেখা ‘লোকপুরাণ কপিলামঙ্গল’। বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামের ডোকরা শিল্পীদের সম্মানে পত্রিকা সেজে উঠল তাঁদের হস্তশিল্প দিয়ে। পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির হস্তশিল্প নিয়ে তপন চৌধুরী লিখলেন ‘পাঁচমুড়ার পথে’ এবং শবর জাতির লোকায়ত জীবন এবং সংস্কৃতি নিতে গবেষক প্রশান্ত রক্ষিত লিখলেন ‘শবর চরিত’। এই প্রথম কবিতার বই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু হল।
কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে যেসব লোকশিল্প, লোকগান এবং লোকায়ত জীবন ‘অহিরা’-র বিভিন্ন সংখ্যায় সংখ্যায় সেগুলি নিয়ে লেখা হয়েছে। লোকশিল্প হিসেবে লেখা হয়েছে পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামের ছৌ, বিষ্ণুপুরের দশাবতার তাসের কথা। ঝুমুর, করম, ভাদুগান নিয়ে লেখা হয়েছে। তপন চৌধুরীর সিনি দেবীদের সাতকাহন প্রবন্ধটির পাশাপাশি অংশুমান কর্মকারের সর্প-উৎসব ‘মল্লভূমের ঝাঁপান’ এবং সোমেন মুখোপাধ্যায়ের ‘গরামথান’ প্রবন্ধটির কথা উল্লেখ করতেই হয়।
দ্বিতীয় সংখ্যায় লেখা হল, ‘ঢোকরা/ বিকনা শিল্পগ্রামের কথা’ আর সাধন মাহাতর গবেষণাধর্মী লেখা ‘লোকপুরাণ কপিলামঙ্গল’। বাঁকুড়ার বিকনা গ্রামের ডোকরা শিল্পীদের সম্মানে পত্রিকা সেজে উঠল তাঁদের হস্তশিল্প দিয়ে। পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির হস্তশিল্প নিয়ে তপন চৌধুরী লিখলেন ‘পাঁচমুড়ার পথে’ এবং শবর জাতির লোকায়ত জীবন এবং সংস্কৃতি নিতে গবেষক প্রশান্ত রক্ষিত লিখলেন ‘শবর চরিত’। এই প্রথম কবিতার বই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু হল।
ভাদুকে নিয়ে নানান কিংবদন্তি, নানান লোককথা পুরুলিয়ার মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। এসব নিয়েই অহিরা পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায় আমাকে লিখতে হল ‘ভাদু : রাজকন্যা ও একটি মিথ’। সুভাষ রায় দীর্ঘদিন ধরে মাছানি নৃত্যনাট্য সংগ্রহ করে আসছেন। তিনি এই সংখ্যায় লিখলেন ‘মানভূমের বিলুপ্তপ্রায় নৃত্যনাট্য মাছানি’ নিয়ে। ছাপা হল একটি ‘মাছানির পালা’। এই সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের তিন প্রান্তের অসমবয়স্ক তিন কবি তিনটি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখলেন। নিত্য মালাকার লিখলেন আত্মকথা ‘এই আমি’, মুজিবর আনসারী লিখলেন সুফিদের নিয়ে, ‘ সুফি সত্তা সুন্দর’, হিমালয় জানা লিখলেন ‘কবি ও চিত্রকর’।
ততদিনে পাঠকেরাও এই ক্ষুদ্র পত্রিকাটিকে ভালোবেসেছেন। এদিকে অনেকেই অভিযোগ জানাচ্ছেন যে অহিরা ডবল ডিমাই সাইজের পত্রিকা হওয়ায় সংরক্ষণ করতে পারেন না। তাই অহিরা পত্রিকা এখন কভারসহ ডিমাই সাইজেই ছাপা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অহিরা পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় একটি আখ্যানধর্মী লেখা, দুটি লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ, ভিন্নভাষার দুজন কবির কবিতার অনুবাদ এবং একটি কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ ছাপা হয়। আমরা একটি-দুটি কবিতা ছাপায় কখনোই বিশ্বাসী নই। তাই অহিরা পত্রিকার পাতায় থাকে কম সংখ্যক কবির একটু বেশি সংখ্যক সুনির্বাচিত কবিতা। গতবারের সংখ্যায় প্রদীপ সিংহ লিখেছিলেন কবিতা বিষয়ক দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘মস্তিষ্ক, ব্রহ্মাণ্ড ও কবিতা’। আগামী সংখ্যার জন্য প্রসূন মজুমদার লিখেছেন ‘বিশুদ্ধ কবিতার বঙ্গকথন’। কবি একরাম আলি-কে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যার কাজ চলছে।
আরও পড়ুন: অহিরা: দশাবতার তাসের খোঁজে
অহিরা পত্রিকার অষ্টম সংখ্যায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যাংশের ভাবপ্রয়াস’ করেছিলেন স্বরাজ মিত্র। ১৩টি কবিতায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ১৩টি খণ্ডের ভাবপ্রয়াস। এই সংখ্যাটির জন্য শিল্পী একই রেখে পত্রিকার নামাঙ্কনের পরিবর্তন করতে হয়েছিল। নামাঙ্কনের পাশাপাশি শিল্পী পার্থপ্রতিম দাস অলংকরণও করেছিলেন। এই সংখ্যায় সেলিম মল্লিক লিখেছিলেন কবিতা বিষয়ক গদ্য মৃত্যুঞ্জয়ী কবিতা। অনুবাদ কবিতা এই প্রথম অহিরা পত্রিকার পাতায় জায়গা করে নেয়। স্বর্ণেন্দু সেনগুপ্তের অনুবাদে ছাপা হয় ‘কারাগারে লেখা কবিতা’।
নিত্য মালাকার ষাটের দশকের কবি। মণীন্দ্র গুপ্ত-র কথায় — “ষাটের মধ্যভাগ থেকে তিনি কবিতায় কবিতায় মনোনিবেশ করেছেন। ‘অজ্ঞাতবাস’, অরুণ বসু ও অরুণেশ ঘোষ ঘোষ তাঁর বন্ধু। অতএব নবদ্বীপ ও কোচবিহার, গঙ্গা ও তোর্সা, শাস্ত্র ও অশাস্ত্র তাঁর সবিশেষ পরিচিত।” মৃত্যুর বছর তিনেক আগে অহিরা থেকে তাঁর কবিতার বই ‘নিমব্রহ্ম সরস্বতী’ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সুবাদে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের একান্ত কাছের মানুষ। অহিরা পত্রিকার অষ্টম সংখ্যায় নিত্যদার কোনও কবিতা ছাপা হয়নি। সেই নিয়ে একদিন ফোনে জানালেন, আমরা নাকি তাঁর কবিতা পছন্দ করি না! শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। কথা হল পরের সংখ্যায় তাঁর অনেকগুলি কবিতা ছাপা হবে। আমাদের অনাথ করে দিয়ে ২০১৮ সালের পয়লা আগস্ট নিত্য মালাকার চলে গেলেন। কথা রাখা হল না। তাই নিত্য মালাকারের স্মরণে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হল ‘নিত্য মালাকার স্মারক সংখ্যা’। এই সংখ্যাটি যাতে সংরক্ষণে সুবিধা হয় তাই ডবল ডিমাইয়ের পতিবর্তে ডিমাই সাইজে পত্রিকা ছাপা হল। সেলিম মল্লিকের পরামর্শে পত্রিকাটিকে একটি কভার দেওয়া হল।
অহিরা পত্রিকার অষ্টম সংখ্যায় নিত্যদার কোনও কবিতা ছাপা হয়নি। সেই নিয়ে একদিন ফোনে জানালেন, আমরা নাকি তাঁর কবিতা পছন্দ করি না! শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। কথা হল পরের সংখ্যায় তাঁর অনেকগুলি কবিতা ছাপা হবে। আমাদের অনাথ করে দিয়ে ২০১৮ সালের পয়লা আগস্ট নিত্য মালাকার চলে গেলেন। কথা রাখা হল না। তাই নিত্য মালাকারের স্মরণে ২০১৯ সালে প্রকাশিত হল ‘নিত্য মালাকার স্মারক সংখ্যা’। এই সংখ্যাটি যাতে সংরক্ষণে সুবিধা হয় তাই ডবল ডিমাইয়ের পতিবর্তে ডিমাই সাইজে পত্রিকা ছাপা হল। সেলিম মল্লিকের পরামর্শে পত্রিকাটিকে একটি কভার দেওয়া হল।
দেখতে দেখতে এক দশক পেরিয়ে গেল। বদলি নিয়ে উৎপল পাল এখন চলে গেছেন শ্রীরামপুরে। চাকরি আমায় বরাবরই চরকির মতো ঘোরায়। আপাতত গঙ্গাজলঘাটিতে। তপন চৌধুরী পত্রিকা প্রকাশের চেয়ে গৃহশিক্ষকতা ও সময়সুযোগ পেলে হিমালয় ভ্রমণেই ব্যস্ত, অচিন্ত্য মাজী— সংসার, সন্তান। পত্রিকা নিয়ে সবার সাথেই দরকারি কথাবার্থা হয়। পত্রিকায় পাতার সংখ্যা বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে খরচও বেড়েছে। বিজ্ঞাপনহীন একটি লিটল ম্যাগাজিন চালিয়ে যাওয়াই ক্রমে অসম্ভব হয়ে উঠছে। তবে আমরা মানি, দশক যায়, সংঘ বেঁচে থাকে। (Editorial- Ahira Patrika)
অহিরা
একটি অনিয়মিত লিটল ম্যাগাজিন
সম্পাদনা : উজ্জ্বল মাজী উৎপল পাল তপন চৌধুরী অচিন্ত্য মাজী
ছবি সৌজন্য: অহিরা পত্রিকার ফেসবুক পেজ
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।