Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

একানড়ে (পর্ব ১)

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

নভেম্বর ১০, ২০২০

Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

হিম ভোরবেলা দোতলার ঘরে টুনুর ঘুম ভেঙে গেলে সে শুনতে পেল কুয়ো থেকে বিশ্বমামার বালতি করে জল তোলা এবং ঝড়াস ঝড়াস স্নানের শব্দ, যার সঙ্গে সঙ্গত রেখে একটা গুনগুনে গান বিশ্বমামার গলা থেকে বেরিয়ে চরাচর মথিত করে দিচ্ছে, আস্তে আস্তে বাগানের আকন্দ শিরীষ পেয়ারাগাছের ডাল বেয়ে উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে পাতলা অন্ধকার চাদরের গায়ে, পাশের ধু ধু মাঠের পুরোটা এবং সেটা পেরিয়ে ওপারের যে জঙ্গল, সেটুকুও অধিকার করে নেবার জন্য। টুনু চোখ বুজেই বুঝতে পারল, মাঠের মধ্যে, দূরে যে একঠেঙে তালগাছ, তার গা বেয়ে সাপের মতো বেড় দিয়ে গানটা উঠছে। লক্ষ্মীপুজো চলে গেছে কয়েকদিন আগে, শেষরাত্রের দ্রবীভূত বাতাস শৈত্যে ম্লান। টুনু উঠে জানালাটা খুলল, যদিও ভয়ে ভয়ে। পাশের ঘরে দাদু দিদা ঘুমোচ্ছে। জানালা খোলার আওয়াজ কানে গেলে বকুনি নির্ঘাত, কারণ হিম লাগলে টনসিল বাড়বে। তবুও লোভীর মতো টুনু মাঝে মাঝে জিভ দিয়ে ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে নেয়, প্রাণপণে জানালার গ্রিলের গায়ে গাল চেপে নির্জন মাঠের অন্ধকারকে ছুরির মতো ফালাফালা করতে চায়। প্রতি ভোরবেলা তার মনে হয় দূরের জঙ্গলের মধ্যে যে একটি প্রাচীন গম্বুজ, কুয়াশা ভেদ করে সেটিকে দেখতে পাবে। চুপচুপে নিমগাছ, মরা কাক, ভারি হাওয়া, সবকিছুই ভিজে পাঁউরুটির মতো ফুলে সবজেটে হয়ে থাকে। কার্তিকের ভোরে একলা তালগাছ পেরিয়ে দৃষ্টি কিছুতেই জঙ্গলের দিকে যেতে পারে না, তার আগেই চোখ বারবার চলে যায় ঝাপসা ছাতার মতো মাথাটির দিকে, আর মনে হয় গা বেয়ে কেন্নোর দল গুটিগুটি উঠছে। বুকের মধ্যে হিম হয়ে যায়, হিসি পায় বারবার। 

[the_ad id=”266919″]

চোখে পড়ল, সেই ছেলেগুলো এত ভোরে আবার মাঠে চলে এসেছে। টুনু জানালা বন্ধ করে খাটে এসে আবার শুয়ে পড়ল। হালকা ঘাম দিচ্ছে বদ্ধ ঘরের ভেতর। জানালা খুলে গতকাল দেখেছিল, বিশ্বমামা বাগানের এক কোনায় যে চিলতে ঘরটিতে থাকে, তার দালানে বউকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। তখন হা হা নির্জন দুপুর ছিল। কেউ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে তাদের দেখবে না, সেই ভরসায় নিশ্চুপ বাগান মুখে নিয়ে বিশ্বমামা তার বউয়ের ধবধবে খোলা বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। তাদের দশ মাসের বাচ্চাটি, গুবলু, চোখ খুলে তাকিয়ে ছিল নরম পাউডার পাফের সূর্যের দিকে। একবার হাত তুলে ‘অ’ ‘অ’ করল, আর বিশ্বমামার বউ এক ঝটকায় সরে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে উঠে বসল যখন, টুনু তাড়াতাড়ি সরে এসেছিল, তার মনে হচ্ছিল দূরের তালগাছটি জানালায় এসে টোকা দিলে বুকের মধ্যে যেরকম ট্রেন চলতে শুরু করবে, সেরকম ধকধক। 

তাদের কাউকে কাউকে তালগাছ বেয়ে উঠতে দেখে লোভ লেগেছিল, একদিন সকাল এগারোটা নাগাদ মাঠে ঘুরতে ঘুরতে তালগাছটার কাছে এসে কী ভেবে দুটো পা দিয়ে জড়িয়েও ধরেছিল গাছের গুঁড়ি, এবং হাতের বেড় দিয়ে সবে ব্যালেন্স করছে, একটা বিকট চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উলটে পড়ল টুনু।

ছেলেগুলো এত ভোরবেলা কী করতে এসেছে? তাল কুড়োতে? খেজুর রস? এই সময়েই খেজুর রস হয়, পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলাতে পড়েছে। ছেলেগুলো তার থেকে বয়সে একটু বড়ই হবে, দেওয়ালে আটকানো ছোটমামার যে ছবি, সেই বয়সের। ছোটমামা রোগা ছিল, কোঁকড়া চুল। অনেকটা যেন তোপসের মতো দেখতে। আচমকা রাগ ধরে গেল তার। বস্তুত জ্ঞান হবার পর এই প্রথম মামাবাড়িতে এসেছে, তাদের আসানসোলের সরু গলির দুই কামরার শরিকি বাসার মধ্যে থাকতে থাকতেই এই বিশাল ভগ্ন বাড়ি, বিশ্বমামার বউয়ের বুকের মতো খোলা আকাশ, ঝুঁজকো জঙ্গল আর রাত হলেই অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁদের আওয়াজ, এসবের গল্প যখনই মায়ের কাছে শুনেছে, রক্ত ছলাত্‍ করে বুকের মধ্যে লাফিয়ে উঠেছে তার। মা বলেছিল দিদা কত ভালবাসে তাকে, কত আদরযত্ন করবে! কিন্তু দিদা সারাদিন অন্যমনস্কের মতো জানালার গরাদ চেপে দাঁড়িয়ে থাকে কখন ছোটমামা আসবে। খালি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, আর সন্ধ্যের অন্ধকারে হাঁফ ধরা গলায়, ‘টুনু, রাতবিরেতে মাঠের ধারে যেও না সোনা আমার!’ কেন যাবে না সে? নয় বছর হয়ে গেল, বাচ্চা ছেলে নাকি? আগের সপ্তাহে তো যা হল, আরও সাঙ্ঘাতিক। 

টুনু রোজ দেখছিল কয়েকটা ছেলে তালগাছটার চারপাশে খেলাধুলো করে। ভোরবেলা আসে মাঝে মাঝে, আবার সন্ধেবেলাও। তাদের কাউকে কাউকে তালগাছ বেয়ে উঠতে দেখে লোভ লেগেছিল, একদিন সকাল এগারোটা নাগাদ মাঠে ঘুরতে ঘুরতে তালগাছটার কাছে এসে কী ভেবে দুটো পা দিয়ে জড়িয়েও ধরেছিল গাছের গুঁড়ি, এবং হাতের বেড় দিয়ে সবে ব্যালেন্স করছে, একটা বিকট চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উলটে পড়ল টুনু। শুয়ে শুয়েই দেখল, পাগলের মতো দৌড়ে আসছে দিদা, তাকে জড়িয়ে ধরে ঠাস করে থাপ্পড় মারল গালে, তারপর দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বিকৃত গলায় চিৎকার করল এমন যাতে দুই কষ বেয়ে ফেনা গড়িয়ে আসে, ‘কোন সাহসে তুই গাছে উঠছিলি? বল, কোন সাহসে? কিছু হয়ে গেলে  তোর মায়ের কাছে  মুখ  দেখাব কেমন করে?’ 

[the_ad id=”270084″]

হতভম্ব টুনুর গলা দিয়ে কথা সরছিল না, ‘আমি তো…আমি উঠতাম না… এমনি দেখছিলাম… ‘ 

ততক্ষণে হন্তদন্ত হয়ে দাদু আর বিশ্বমামা দৌড়ে এসেছে। দিদাকে কোনও মতে ছাড়িয়ে নিল, কিন্তু তখনও উন্মাদের মতো চিৎকার করছে দিদা, ‘তালগাছে  উঠলে আমার মরা মুখ দেখবি টুনু! আমার মাথার দিব্যি!’ 

ভয়ের চোটে টুনু কেঁদে ফেলল ভ্যাঁ করে। দাদু জড়িয়ে ধরল, ততক্ষণে বিশ্বমামা দিদাকে ধরে বাড়ি। দিদার আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, চোখ লাল, মাথার চুলগুলোর কুণ্ডলী হাওয়াতে উড়ছিল আর মনে হচ্ছিল কিলবিলে সাপ। এতই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল টুনু, তার সঙ্গে দলা পাকিয়ে গলার কাছে অভিমান, বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদল। দাদু খেতে ডাকল, বিশ্বমামা খেতে ডাকল, গেল না। দুপুর অনেকটা গড়াবার পর যখন সূর্য নুয়ে পড়েছে জঙ্গলের মাথায়, দিদা তার ঘরে আসল। টুনু জোরসে দুই চোখ বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে, আর দিদা তখন তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কত আদর, ‘সোনা ছেলে আমার’, ‘এমন করে না বাবা’, কিন্তু টুনু কিছুতেই চোখ খুলবে না, বরং দৌড়ে পালিয়ে চলে যাবে আসানসোল। তখন সেই দুপুরবেলা দিদা তাকে একানড়ের গল্প বলেছিল। 

‘ওই তালগাছ, ওটার মাথায় থাকে।’ চোখ বড় বড় করে ফিসফিসিয়ে বলছিল দিদা, ‘হাতে একটা বস্তা। বস্তায় করে নুন জমিয়ে রাখে, আর সেখানে ছোট ছোট বাচ্চাদের কান রেখে দেয়। যে বাড়ির জানলা খোলা পায়, তালগাছের মাথা থেকে এক লাফে সেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে সট করে। তারপর যেসব ছোট ছেলেরা শুয়ে থাকে, ছুরি দিয়ে এক কোপে তাদের কান কেটে নেয়। একানড়ের বড় বড় দাঁত, ভাঁটার মতো চোখ গোল গোল। রাতে শুনবি, সি সি আওয়াজ করে।’ 

[the_ad id=”270084″]

টুনু কাঁপছিল হালকা, চাইছিল দিদার কোলের কাছে আরেকটু সরে আসতে, কিন্তু দিদা যেন তাকে ভুলে গিয়ে শুধু নিজের গল্পেই ডুবে গেছে তখন, ‘খিদে পেলে নুনে জারানো কান খায়। শুধু মাঝে মাঝে নেমে আসে, তারপর  হেঁটে হেঁটে ওই যে জঙ্গলের মাথায় গম্বুজ ওখানে চলে যায়। ওই গম্বুজের গা ঘেঁষে নদী চলে গেছে, যেখান থেকে মাছ  তুলে এনে একানড়ে শুকুতে দেয় গম্বুজের মাথায়। তারপর  সেই শুঁটকি মাছ  আগুনে পুড়িয়ে খায়। মাঝে মাঝেই  বাতাসে শুঁটকি মাছপোড়ার গন্ধ ভেসে আসে, তখন  আমরা বুঝি যে একানড়ের খিদে পেয়েছে।’ 

‘দিদা?’ 

‘উঁ?’ যেন গভীর ঘুমের মধ্যে থেকে দিদা জেগে উঠল। 

‘আমার ভয় লাগছে’। 

‘ভয়? আমারও ভয় লাগে।’ দিদার গলায় পৌষের রাত ভর করেছিল। অন্যমনস্কের মতো উঠে জানালার কাছে গেল,  ‘খেতে আয় টুনু। মাছের ঝোল জুড়িয়ে গেল।’ কিন্তু নিজে দাঁড়িয়ে আছে জানালার শিক দু’হাতে চেপে। টুনু খেল কি খেল না, ভুলে গেছে আবারও। ছোটমামা আসবে বলে অপেক্ষায়। দিদা, যার রাধারানী নামটা সবাই ভুলে গেছিল, বিয়ের পর ভুবন মাস্টারের বউ, এরপর ছয় বছর মাম্পির মা, তারপর বারো বছর মাম্পি আর মাম্পির ভাইয়ের মা, তারপর থেকে আবার শুধুই মাম্পির মা, কুড়ি বছর আগের এক শীতার্ত সন্ধেবেলা থেকেই তার যে ছেলের বয়স বারো বছর থেকে আর বাড়ল না, নামটাও যেন সবাই ভুলে গেছে, সেই দিদা পথ চেয়ে বসে থাকে সারাদিন। আর এখন সেই ছেলেটাই দিদাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে টুনুর কথা। টুনু ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবল, ছোটমামাকে সে ভালবাসবে না, কিছুতেই না। 

Author Sakyajit Bhattacharya

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

Picture of শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
Picture of শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৮২ সালে কলকাতায়। প্রথম গল্প বেরিয়েছিল পরিকথা পত্রিকায়, ২০০৩ সালে। এ পর্যন্ত লিখেছেন সাতটি উপন্যাস ও প্রায় চল্লিশটি ছোটগল্প। মূলত লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর লেখালেখির জায়গা। এ পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস