সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা পৃথিবীর প্রতিটি ভূখন্ডেই ভিন্ন। কোথাও মানুষ শ্বেতশুভ্র ত্বককে ভাবেন সৌন্দর্য্যের শেষকথা, আবার কেউ হাজার হাজার টাকা খরচা করে ত্বকে “সান কিসড্” লুক আনেন। কেউ চান গোলগাল লক্ষ্মীঠাকুরপানা চেহারা, তেমনি আবার কেউ ভাবেন রোগা না হলে জীবন বৃথা। এই কারণে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির মূল কথাটিই হল খোদার ওপর খোদকারি। ভগবানদত্ত কোনও কিছু নিয়েই যে মানুষ খুশি নয়! নাক, কান, ঠোঁট, ত্বক কোনও কিছুরই স্বাভাবিক রূপ আমাদের পছন্দ নয়। কাঙ্খিত চেহারা পাওয়ার জন্য মানুষ অপারেশন থিয়েটারে অবধি প্রবেশ করতে প্রস্তুত। পুরো পৃথিবী জুড়েই যখন এমন চলছে তখন ভানুয়াতু দ্বীপপুঞ্জের মানুষ সৌন্দর্য্যবৃদ্ধির জন্য নিজেদের মাথাটা টেনেটুনে, চেপেচুপে লম্বা করলে আমি অন্তত কিছু দোষের দেখি না।

আজ্ঞে হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ার পূর্বে অবস্থিত ভানুয়াতু (Vanuatu) দ্বীপপুঞ্জের নাহাইভাষী মানুষ সৌন্দর্য্য বলতে বোঝেন ল্যাংচা শেপের লম্বা আকৃতির মাথা। এঁরা বাস করেন টোমান (Tomman) এবং মালাকুলা (Malakula) দ্বীপে। নাহাইভাষীদের কাছে লম্বা মাথার আবেদন এতটাই বেশি যে তাদের ভাষায় বুদ্ধিমান এবং আকর্ষণীয় চেহারার সমার্থক শব্দটিই হল “লংফালা হিড্” (ইংরিজি অর্থ Long head)।
মাথা লম্বা করার তোড়জোড় শুরু হয় নিতান্তই শিশু বয়সে। কারণ নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। মাথার ক্রেনিয়াম অংশটি একবার শক্ত হয়ে গেলে সব চেষ্টা বৃথা, আবার তা এতটাও নরম যেন না থাকে যাতে শিশুর মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইসব কারণে “হেড বাইন্ডিং” (Head binding)-এর জন্য আদর্শ হল একমাস বয়সের শিশু। মাথা বাঁধা বা “হেড বাইন্ডিং”-এর পদ্ধতিটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। প্রথমে শিশুর মাথায় পোড়া নোভোনাই মোলো ফলের (Candle nut fruit) রস মাখানো হয়। এই রস মাথার হাড় নরম করতে সাহায্য করে এবং শিশুর কোমল ত্বককেও রক্ষা করে। এরপর বাঞ্ছিত শেপ তৈরি করার জন্য মাথায় জড়ানো হয় কলা গাছের ভেতরের নরম বাকল দিয়ে তৈরি ব্যান্ডেজ। এই ব্যান্ডেজের নাম নিয়েনবোবোজিত্ (Ne’Enbobosit)। সবশেষে শিশুর মাথা নুয়েনবাতিয়ের (No’onbat’ar) নামক পাতার টুপি দিয়ে ঢেকে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। শিশুর ছ’মাস বয়স অবধি প্রতিদিন নতুন ব্যান্ডেজ বাঁধা হয় তার মাথায়।

এখানে জানিয়ে রাখি, যে লম্বাটে মাথার প্রতি আকর্ষণ পৃথিবীর আরো অন্য অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা গেছে। পুরাতন মায়া সভ্যতা থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত আফ্রিকার মাংবেতু (Mangbetu) উপজাতি এবং ফ্রান্সের কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে লম্বা মাথার ফ্যাশন বেশ প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়।
মায়ানরা সব ব্যাপারেই ওভার দ্য টপ (পড়ুন বাড়াবাড়ি) কান্ডকারখানা করতে পছন্দ করতেন। মাথা বাঁধার ব্যাপারেও সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। অন্যরা যেখানে মাথায় টুপি পরিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন, সেখানে মায়ানরা দুখানা কাঠের তক্তার মাঝে বাচ্চাকে শুইয়ে, চেপে চেপে তার মাথা লম্বা করতেন। তাছাড়া শিশুদের মাথায় তারা সর্বক্ষণ পরিয়ে রাখতেন ধাতুর পাত ও কাঠের তৈরি মস্তক প্রলম্বন যন্ত্র (Head elongation device-এর বাংলা প্রতিশব্দ)!

মায়ানদের ব্যাপারই আলাদা। সদ্যোজাত বাচ্চাগুলো অবধি কী ভীষণ রকমের রাফ অ্যান্ড টাফ ছিল একবার ভাবুন। আফ্রিকার কঙ্গো উপত্যকাতেও মাংবেতুদের কথা আগেই বলেছি। পরিণত বয়সে তারা লম্বা মাথা আরো লম্বা দেখাতে মাথার পেছনে একটি ছোটো ঝুড়ি বেঁধে ঘুরতেন। তাদের মধ্যেও লম্বা মাথার মানুষের সামাজিক সম্মান ছিল অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
এবার চলুন কারণটা খুঁজে দেখি। অর্থাৎ সৌন্দর্যের সংজ্ঞা যখন আছে, তখন তার পেছনে গ্রহণযোগ্য কারণ থাকতে বাধ্য। যদিও অন্যান্য অনেক ঐতিহাসিক রহস্যের মতো এই ব্যাপারেও নানা মুনির নানা মত রয়েছে। চতুর্থ শতাব্দীর শুরুর দিকে তৈরি বিভিন্ন হুণ সম্রাটদের শিলমোহর বা মুদ্রা দেখে তাদের মধ্যে একটি সাদৃশ্য পাওয়া যায়, এবং সেটা হল, তাদের প্রত্যেকের মাথাই বিসদৃশভাবে লম্বা। আমুদরিয়া নদীর উপত্যকায় খননকার্য চালানোর সময়ও দেখা গেছে যে বিজয়ী কুষাণ বংশের সমস্ত রাজপুরুষদের ছবি বা মূর্তিও এরকম। অন্যদিকে পরাজিত সাকা বংশদ্ভুতদের মূর্তিগুলিতে সাধারণ গোল মাথার পুরুষদের দেখানো হয়েছে। কী বোঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট।

তবে “ডিম আগে না মুরগি আগে”-র মতো সমস্যা এইখানেও রয়েছে। সেটা হল, কোনও দীর্ঘশির সেলিব্রিটি বীরপুরুষকে দেখে তখনকার মানুষ সেই ট্রেন্ড ফলো করছিল না ট্রেন্ড ছিল বলেই বেঁধেছেঁদে তাদের লম্বা মাথা তৈরি করা হত, তা বোঝা মুশকিল। সে যাই হোক, লম্বা মাথার মানুষ মানেই জ্ঞানে, গুণে, শৌর্য্যে, সৌন্দর্য্যে তিনি অন্যদের তুলনায় অনেক উপরে, এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিলেন। বর্তমানে শুধুমাত্র ভানুয়াতু দ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যেই এই প্রথার প্রচলন দেখা যায় এবং এই সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তাঁরা নির্দ্বিধায় জানান, যে লম্বা মাথা না হলে শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি কম হবে, এবং গোল মাথার পুরুষ বা নারীকে তাঁদের সমাজে কুৎসিত বলে বিবেচনা করা হয়। এরপর আর কীই বা বলা যেতে পারে! Things we do in the name of beauty!!!
তথ্যসূত্র: BBC, Rare Historical Photos, Australian Museum
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Tumblr, Pinterest
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।
2 Responses
কত কিছু জানতে পারছি রহস্যে ঘেরা এই পৃথিবীর নানান উপজাতির কথা। কলম চলুক আমরা অপেক্ষায় থাকি সত্যি দিয়ে মোড়া আরো কোনও নতুন উপাখ্যানের চমকদার লেখার।
ধন্যবাদ রুমাদি।