যাঁর কথা আমার জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে আছে, যাঁকে ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে – সে খোকারমা পিসি। সহজ করে বললে বলতে হয়, তিনিই আমায় কোলে পিঠে করে বড় করেছেন। আঁধারঘন দিনে কোলে-কাঁখে নিয়ে শাক তুলেছেন, মাছ কুটেছেন, রান্না করেছেন। সেই কাঠের জ্বাল ঠেলা উনোনের পাশটিতে বসে বসে আমি দেখেছি কেমন করে পাতালফোঁড় রাঁধে মানুষ। কেমন করে শ্মশানকলি পাখি ডাকলে ভর সন্ধ্যেয় উনোনে লোহা পোড়া দিতে হয়। ভূত পেত্নি আর জোছনা ঢালা পুকুরের গল্প আমার মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল যে, সে ওই খোকারমা পিসি। পোষাকি নাম কুমুদিনী। সে নাম সে নিজেই ভুলেছিল বোধহয় বহুদিন। দেশান্তরী মানুষ যেমন করে তার শৈশবের দালান, কলমিলতার আলপনা ফেলে এসেছে। নামখানাও তেমনই বোধহয়। খোয়া গেছে কবেই। তবু, মনের মধ্যে সে আলপনার নিত্য চলাচল। তাই না, খোকারমা পিসি নদীর গল্প বলে, মাছের গল্প বলে। আমি এক গাল ভাত মুখে নিয়ে সেসব শুনতে শুনতে তন্ময়ে বিভোর হই। সেই যে কবে ইলিশ আর হরিণের দৌড় প্রতিযোগিতা হল, হেরে গিয়ে হরিণ আর কী করে এক টুকরো মাংসই কেটে দিল খেলার শর্ত মতো। তাই না ইলিশের পেটের নীচে অমন মেটে রঙের পোচ! এমন কত যে গল্প। সেসব গল্পের জাদুতে এমন এক একটা বর্ষার দিনে আচমকা মেঘ নামিয়ে আনতে পারত সে। কী অপূর্ব তাঁর রান্না। সুপুরির খোলে কেমন চিকণ করে ঢেঁকি শাক কুচিয়ে নিচ্ছে দেখ। মানুষের রান্নায় কি আর অমন স্বাদ হয়! সে যেন ফেরেস্তার ওম মাখা। সে রান্না যে খেয়েছে, তারিফ না করে সে পারেনি। উদ্বাস্তু মানুষের আর কীইবা সম্বল! স্বাদকোরকখানি সে কেবল আগলে রাখতে শিখেছিল বুকের ওমে।
আজ অনেক দূরে বসে বসে কেবলই ভাবি, মানুষের তারিফ ছাড়া আরও কিছু কি পাওনা ছিল না তাঁর? ছিল বোধহয়। পৃথিবীর ইতিহাসে খোকারমা পিসির কথা কেইবা মনে রাখবে? অথচ এমিলি মেগেটকে (Emily Meggett) আমরা মনে রেখেছি অনেকেই! সেও তো এক রকমের উদ্বাস্তু মানুষই। প্রথম প্রজন্মের উদ্বাস্তু না হলেও তাঁর পূর্বজরা আমেরিকায় এসেছিলেন সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে। তাদের শ্রম, কৃষিজ্ঞান এবং আরও আরও অধিতবিদ্যার বিনিময়ে তাঁদের জুটেছিল বঞ্চনা। সে গল্প সকলেই জানেন কম বেশি। এই উদ্বাস্তু সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকে কৌমের নানা স্বর। সে প্রজন্মকে শেখায় ঝুড়ি বুনতে, দেশঘরের রান্না করতে, নীলচাষের খুঁটিনাটি। এমিলি মেগেটরা ছিলেন গুল্লাহ বা গুল্লাহ গিচি (Gullah Geechee) সম্প্রদায়ের মানুষ। পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে (সেনেগাল, গিনি, সিয়েরা লিয়ন ইত্যাদি) ছড়িয়ে আছে ওঁদের জাতিসত্তা। বিচ্ছিন্ন হয়ে আমেরিকার বুকে বেড়ে উঠল যারা, তারা বুকের ওমে বাঁচিয়ে রাখল ভাষার কাঠামো, লোকগল্পের বুনন আর রান্নার গন্ধটু্কু। জর্জিয়া অথবা সাউথ ক্যারোলিনার (South Carolina) গলিপথে ওকরা (ঢ্যাঁড়স) স্যুপের (okra soup) গন্ধ পেলে আপনি টের পাবেন সে রান্নায় নিশ্চিত কোনও গুল্লাহ গিচির মানুষের ছোঁয়া আছে। সে গন্ধ আপনাকে পৌঁছে দিতে পারে এমিলি মেগেটের জীবনের খুব কাছাকছি। আসলে ঠিক সেখানেই আমরা পৌঁছতে চাইছি।

একটা খেটে খাওয়া পরিবারে এমিলির জন্ম। সময় তখন ১৯৩২। একটু বড় হতেই উপার্জনের চেষ্টা শুরু হয়। অর্থবান সাদা মানুষদের বাড়িতে বাচ্চা দেখার কাজ। এই দিয়েই এমিলির শুরু। কিন্তু অত কম মাইনেতে কি মানুষের পোষায়? এমিলির মা চেয়েছিলেন মেয়ে বরং খেত খামারের কাজে হাত লাগাক। তাতে বরং পারিশ্রমিক আরেকটু বেশি। মায়ের কথা এমিলির যে খুব পছন্দ হয়েছিল তা নয়। তাই বড়লোকদের বাড়িতে রান্নার কাজ শুরু করে সে। আমি তো সে রান্না খাইনি কখনও কিন্তু নিশ্চয়ই সে রান্নাও খোকারমা পিসির মতোই সুস্বাদু। নইলে কেনই বা একই বাড়িতে পঁয়তাল্লিশ বছর কাজ করবেন তিনি! পশ্চিম আফ্রিকার রান্নাই (West African cuisine) বেশিরভাগ। উদ্বাস্তু ক্রীতদাসদের বুকে আর স্বাদকোরকে সঞ্চিত ছিল সেসব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সে রান্নাই শিখেছে। সেই রান্নাতেই এমিলির হাতযশ। মাছ, ঢ্যাঁড়স, শাক সবজি, ভাত জীবনের উত্তাপে মোড়া খাদ্য প্রকরণ যত। সেই সহজাত খাদ্যাভাসের সঙ্গে আমেরিকান রান্নাকেও মেলাতে পেরেছিলেন এমিলি। শুধু তো এমিলি নয়, সারা পৃথিবীর অভিপ্রয়াণের গল্পেই এই সংযুক্তির আর বিনিময়ের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। গুল্লাহ গিচি মানুষদের রান্না আর যাপনের গল্প প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বায়নের আগ্রাসনে। সেই খাণ্ডবদাহনের সামনে দাঁড়িয়ে এমিলি একখানা রান্নার বই লিখতে পেরেছিলেন অন্তত। আমেরিকান নয়, গুল্লাহ গিচি রান্নার বই – Gullah Geechee Home Cooking: Recipes from the Matriarch of Edisto Island। ২০২২-এ এই বই যখন লিখছেন এমিলি তখন ওঁর বয়স ঊননব্বই। আর এক বছরের মধ্যেই এই পৃথিবী ছেড়ে ওঁকে চলে যেতে হবে। কী আশ্চর্য প্রাণশক্তি মানুষের। এমিলির সঙ্গে একজন আমেরিকান সহলেখক ছিলেন বটে, তিনি মুখ্যত সাহায্যকারী।

এরকম একখানা বই তো কেবল দিনগত পাপক্ষয়ের মতো একটেরে রান্নাঘরের গল্প শোনায় না। বরং কতই না ইতিহাসের রঙ ছুঁয়ে যেতে চায় সে। এমিলি যখন বেন ওয়েফারস (Benne wafers), সুইট লিটল কুকিজ (Sweet little cookies) বানান তখন আপাত ভাবে মনে হয় এ আর এমন কী! তিল (benne) ছড়িয়ে কুকি বা ওয়েফার তো আমেরিকানরা বানিয়েই থাকেন। অথচ দেখুন ভাবতে অবাক লাগে আজ, এই তিল নেটিভ আমেরিকান শস্য নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে স্বদেশ থেকে বয়ে আনা তিলের বীজ মনিবদের চোখ এড়িয়ে চাষ করতেন পশ্চিম উপকূলীয় আফ্রিকানরা। তিল যে তাদের ভারী পছন্দের! কেউ বা ফেলে এসেছে তার পুকুর ভরা মাছ, গাছ ভর্তি ফল পাকুড়– কারওর বা মনের মধ্যে ছায়া ফেলে গেছে তিলফুলের গন্ধ। লুকিয়ে লুকিয়ে তিলের চাষ করেছেন তারা দিনের পর দিন। বীজ থেকে বীজ, এমন করে বেড়ে উঠেছে তিলের চাষ। কত কত বছরের আশ্রয়ে। এমিলির বইটিকে আমার তাই বুকের ওমে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। কেবলই মনে হয়, এমন একখানা বই তো খোকারমা পিসিও লিখতে পারত। অক্ষরজ্ঞান না থাকুক তাঁর, সবাই কি আর লিখতে পড়তে জানে! যে মানুষ আদার বাদাড় ঘুরে শাক চিনতে শিখেছে, বনজ কুসুমের চিকিৎসা বিদ্যা আয়ত্ত করেছে, রান্নার খুঁটিনাটি থেকে ধাত্রীবিদ্যায় যিনি পারঙ্গম তাঁকে আমার ইচ্ছে করে এমিলি মেগেটের পাশটিতে বসিয়ে দেখতে। সে উপায় নেই, জানি। তবু, ইচ্ছে করতে ক্ষতি কী!
Images courtesy: Southern fork
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।