গল্পটা আমায় শুনিয়েছিলেন বিমলবাবু। পেশায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মানে বেসরকারি গোয়েন্দা। রাসবিহারী মোড়ের কাছাকাছি এজেন্সির ছোট অফিস। “আসলে ওসব শখের গোয়েন্দা-ফোয়েন্দা বলে কিছু হয় না মশাই।” মুচকি হেসে বলেছিলেন প্রৌঢ় মানুষটি। ছোট অফিসঘরে পাতা ছোট টেবিলটার দুদিকে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসা আমরা দুজন। শোনার পর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলাম বিমলবাবুর দিকে। মনের মধ্যে একাধিক প্রশ্নের দোলাচল। তা হলে এতদিন ধরে দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা কাহিনীগুলোয় দুনিয়া কাঁপানো যে সব গোয়েন্দাপ্রবরদের রোমহষর্ক সব কীর্তিকলাপের কথা পড়ে বেড়ে উঠলাম, সেগুলো সবই মিথ্যে? নেহাতই আষাঢ়ে গপ্পো! মুখে উঠেও এল প্রশ্নটা।
জবাবে ফের একবার মুচকি হাসলেন প্রৌঢ় ডিটেকটিভ।
– সত্যি কথা বলতে কি, তাই। ওই যে বইয়ে পড়েন না, সকালবেলা শখের গোয়েন্দার বাড়ির দরজায় কলিং বেল বেজে ওঠে। গোয়েন্দা অথবা তাঁর সহচর দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো কোন ধনী, অভিজাত ব্যক্তি অথবা তাঁর ব্যক্তিগত সচিব। ড্রইংরুমে ডেকে বসানোর পর কথায় কথায় তিনি জানান তাঁদের বাড়িতে একটা রহস্যময় খুন হয়েছে নয়তো বহুমূল্য হিরে-জহরত কিছু খোয়া গেছে। গোয়েন্দামশাই যদি কেসটা নেন তাহলে তাঁরা সবিশেষ বাধিত হবেন। গোয়েন্দা রাজি হলে এরপর একটা হৃষ্টপুষ্ট খাম বা মোটা অঙ্কের চেক অ্যাডভান্স হিসেবে টেবিলের ওপর রেখে বিদায় নেন তাঁরা।
– আবার ওই যে গল্পে দেখেন, এই শখের গোয়েন্দারা থানায় গেলে স্বয়ং বড়বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাদরে আপ্যায়ন করেন, সেপাইকে অর্ডার দিয়ে চা আর চিকেন কাটলেট আনান অথবা যখনতখন দুমদাম গুলি চালিয়ে ওরাই বাঘা বাঘা সব ক্রিমিনালদের মাটিতে পেড়ে ফ্যালেন, ওসব একেবারে আষাঢ়ে গপ্পো। আসলে বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটে না মশাই। একটা কথা খুব ভালো করে জেনে রাখুন। আমাদের মতো প্রাইভেট ডিটেকটিভরা খুন বা চুরির তদন্ত করতে পারে না, ফায়ার আর্মস ক্যারি করতে পারে না, আরো অনেক কিছুই করতে পারে না। ইন রিয়্যালিটি, ওসব করতে গেলে ডিডি, এসবি, আইবি-র মামুরা এসে কানের গোড়ায় ঠাঁটিয়ে দুটো দিয়ে সিধে লক-আপে ঢুকিয়ে দেবে।
– বলি, চুরি, খুন, কোনও কিছুরই তদন্ত করতে পারেন না, তাহলে দিনের শেষে আপনাদের হাতে রইলটা কি!
– পেন্সিল।

ফের মুচকি হেসে অত্যন্ত নির্বিকারভাবে জবাব দিয়েছিলেন বিমলবাবু। তবুও প্রবল বিস্ময়ের ধাক্কায় আমার হাঁ মুখ তখনও বন্ধ হচ্ছে না দেখে নেহাত যেন কিছুটা করুণাবশতই খোলসা করেছিলেন আরো কিছুটা।
– আসলে আমাদের, মানে এই প্রাইভেট ডিটেকটিভদের কাজের এলাকাটা খুব ছোট, বুঝলেন। ধরুন অমৃতা দেবী, একজন হাউজ় ওয়াইফ। তাঁর সন্দেহ হল, তাঁর সফল কর্পোরেট চাকুরে স্বামীটি, ধরা যাক নাম শৌভিক, অফিস ট্যুরের বাহানায় প্রায়ই পাশের কিউবিকলের রিয়াকে নিয়ে লং ড্রাইভে মন্দারমনি চলে যাচ্ছে। অথবা ধরা যাক অসীমবাবু, সরকারি চাকুরে, তাঁর কেমন যেন মনে হতে লাগল, তিনি আপিস বেরলে তাঁর গিন্নির কাছে রোজ দুপুরবেলায় পাড়ার কোন একজন দুপুর ঠাকুরপো আসে। এই ধরনের কেসগুলোই বেসিক্যালি আমরা পাই। ফলো করে ক্লায়েন্টদের রিপোর্ট দেয়া, ডিভোর্স কেসের পেপার মজবুত করতে হেল্প করা, এইসব আর কি…।
– তাহলে খুন, চুরি, ডাকাতি… এধরনের সিরিয়াস ক্রাইমের কেসগুলো সলভ করার অধিকার একমাত্র বিভিন্ন দফতরের পুলিশ অফিসারদেরই?
– অবশ্যই। জবাব দিয়েছিলেন বিমলবাবু। নিজেও আগে পুলিশেই ছিলেন। অবসরের পর এই লাইনে। ফলে ওঁর কাছে কিছুটা বিশদেই জানতে পেরেছিলাম গোটা বিষয়টা।
ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা প্রমাণাদি, রক্তের দাগ, আঙুলের ছাপ ইত্যাদি যেমন অপরাধীকে শনাক্ত অথবা তাকে পাকড়াও করতে সাহায্য করে তেমনি এক্ষেত্রে আর একটি সূত্রের অবদান বা গুরুত্বও অপরিসীম, সম্ভবত সবচেয়ে বেশি, বিশেষত সেইসব পুলিশ আধিকারিকদের কাছে, যারা মাঠে ময়দানে নেমে হাতেকলমে কাজটা করেন। সেটা হল ইনফর্মার বা খবরদাতা। মূলত অপরাধ জগতের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এইসব গুপ্ত খবরদাতারা। এর ফলে বিশেষ কিছু সুযোগসুবিধাও পেয়ে থাকেন তাঁরা। সেটা কী রকম? বলার চেষ্টা করছি এখানে।
ধরা যাক, কোনও আধিকারিকের বিশ্বস্ত এক ইনফর্মার। ওই আধিকারিককে বহু গোপন খবর বা ‘টিপ’ নিয়মিত দিয়ে থাকে সে। সেক্ষেত্রে তার ছোটখাটো অপরাধগুলো দেখেও দেখবেন না সেই আধিকারিক। উল্টে সেইসব কেস থেকে ছাড়িয়ে আনা, এমনকী সেগুলোকে হাল্কা করে দেয়ার চেষ্টাও করবেন। কারণ ওই খবরদাতা তাঁর কাছে সোনার ডিমপাড়া হাঁস। ডিডি, এসবি, আইবি-সহ স্থানীয় থানাগুলোরও বহু আধিকারিকদের পেশাদারী জীবন বা কেরিয়ারের সাফল্য এই ইনফর্মারদের দেয়া খবরের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। ‘যে অফিসারের ইনফর্মার বেস যত ভালো, তার ঝুলিতে প্রমোশন বা মেডেলের সংখ্যাও তত বেশি।’ – পুলিশের অন্দরমহলে নাকি খুব জোর চালু আছে কথাটা।

– ওই যে দেখেন না, খবরের কাগজে লেখা হয়, ‘বিশেষ তথ্যসূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ ওই কুখ্যাত দুষ্কৃতিকে গ্রেফতার করে।’ ওই ‘বিশ্বস্ত সূত্র’ আসলে আর কেউ নয়, একজন গোপন খবর সরবরাহকারী বা ইনফর্মার।
বলেছিলেন বিমলবাবু। ওঁর কাছেই জেনেছিলাম, ইনফর্মারদের খবরপিছু আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করার জন্যও নাকি একটি বিশেষ তহবিল থাকে। এখানে এ ধরনের আর্থিক পুরস্কার ‘টিপ মানি’ বা ‘কমিশন’ আর মুম্বইয়ে ‘কাটিং চায়’ নামে পরিচিত। বিভিন্ন রাজ্য বা স্থান বিশেষে ইনফর্মারদেরও একাধিক সম্ভাষণে সম্ভাষিত করা হয়। যেমন ‘খোঁচড়’, ‘খবরি’, ‘ছুঁচো’, ‘চুহা’ ‘টিকটিকি’, ‘মুখবীর’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ইনফর্মার বা খবরদাতারা কিন্তু রাজনৈতিক জগতেও সমানভাবে সক্রিয়। বিশেষভাবে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল বা তথাকথিত জঙ্গি সংগঠনগুলির ক্ষেত্রে। তবে এক্ষেত্রে অপরাধীদের পরিবর্তে তাদের জায়গা নেয় সেই দল বা সংগঠনের সদস্যরা। বিশেষত যারা পুলিশ বা প্রশাসনের তরফ থেকে আসা কোনওরকম চাপ বা প্রলোভনের সামনে নতিস্বীকার করে, তাদের গোপন খবরদাতায় পরিণত হয়েছে। সেই অগ্নিযুগের বিপ্লবী আমল থেকে শুরু করে সত্তর দশকের নকশাল জমানা, সর্বত্রই এটা সমান সত্যি। অধুনা কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ছত্তিসগড়, সর্বত্রই।
সিনেমার নায়ক গুপ্তচরেরা যখন তখন সুন্দরী নর্মসহচরীদের সান্নিধ্যে আসেন, শয্যাসঙ্গী হন
আসল গোয়েন্দা আর তাদের খবরদাতাদের কথা তো হল। এবার আসুন, একটু গুপ্তচরদের প্রসঙ্গে আসা যাক। গুপ্তচর বলতে যাদের আমরা আমজনতা ‘স্পাই’ নামে জানি আর কি। যারা মূলত তাদের নিজের দেশ তথা রাষ্ট্রের হয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, বিশেষভাবে শত্রু রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত থাকেন। তবে এখানেও সারা দুনিয়া জুড়ে প্রবল জনপ্রিয় অসংখ্য স্পাই থ্রিলার মুভি বা নভেলের নায়ক গুপ্তচরদের সঙ্গে বাস্তবের গুপ্তচরদের আশমান-জমিন ফারাক। বিদেশি স্পাই নভেল বা স্পাই থ্রিলার সিনেমাগুলোর নায়ক গুপ্তচরেরা যখন তখন অসংখ্য সুন্দরী নর্মসহচরীদের সান্নিধ্যে আসেন, তাদের শয্যাসঙ্গী হন অবলীলাক্রমে, বিপক্ষের শত্রুদের একের পর নিকেশ করতে পারেন একাই, তা সে বন্দুকের ডুয়েল বা খালি হাতের মারপ্যাঁচ যাই হোক না কেন, আবার তাদের মোটরগাড়ি নিমেষে হয়ে যেতে পারে জেটপ্লেন বা ডুবোজাহাজ, পৃথিবীর সেরা সেরা বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে বহুমূল্য মদিরার বোতল, দুগ্ধফেনিভ শয্যা আর বলাই বাহুল্য পৃথিবীর সেরা সেরা সুন্দরীরা।
ওই যে গল্পে দেখেন, এই শখের গোয়েন্দারা থানায় গেলে স্বয়ং বড়বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাদরে আপ্যায়ন করেন, সেপাইকে অর্ডার দিয়ে চা আর চিকেন কাটলেট আনান অথবা যখনতখন দুমদাম গুলি চালিয়ে ওরাই বাঘা বাঘা সব ক্রিমিনালদের মাটিতে পেড়ে ফ্যালেন, ওসব একেবারে আষাঢ়ে গপ্পো। আসলে বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটে না মশাই। একটা কথা খুব ভালো করে জেনে রাখুন। আমাদের মতো প্রাইভেট ডিটেকটিভরা খুন বা চুরির তদন্ত করতে পারে না, ফায়ার আর্মস ক্যারি করতে পারে না, আরো অনেক কিছুই করতে পারে না।
এর বিপরীতে বাস্তবের গুপ্তচরদের অবস্থানটা একদম প্রায় উল্টো বলা চলে। এদের মধ্যে অনেকেই একটিও গুলি না চালিয়ে শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। স্রেফ মগজাস্ত্র আর ছলনাকে আশ্রয় করে। এর উজ্জ্বলতম উদহারন মার্গারিটা ফন জোয়েল। সংক্ষেপে মাতাহারি। জন্মসূত্রে ডাচ এই অনিন্দ্যসুন্দরী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান পক্ষের গুপ্তচর হয়ে ফ্রান্সে প্রবেশ করে কীভাবে সেখানকার ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পৌঁছে তার মোহিনী মায়ার জালে তাবড় তাবড় সব প্রশাসনিক কর্তাদের বিবশ করে বহু গোপন তথ্য শত্রুপক্ষ অর্থাৎ জার্মান শিবিরে পাচার করে দিয়েছিলেন, যার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে ৫০ হাজার ফরাসী সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল, সেসব আজ প্রবাদকথায় পরিণত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যুদ্ধে কাইজারের জার্মানির পরাজয় ঘটে। মাতাহারির গোপন কীর্তি যায় ফাঁস হয়ে। অবশেষে ১৯১৮ সালে ফরাসি ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে প্রাণ হারাতে হয় এই লাস্যময়ী সুন্দরী গুপ্তচরকে।
ঠিক এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল একাধিক নাম। কিম ফিলবি, গাই বার্জেস প্রমুখ। এদের মধ্যে কিম ফিলবি, বৃটিশ গুপ্তচর সংস্থা এমআই-সিক্সের সর্বময় কর্তা। তলে তলে ভিড়ে গেছিলেন রুশ গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি শিবিরে এবং সে তথ্য খোদ এমআই-সিক্স বা মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র সদর দফতরে পৌঁছতে পৌঁছতে কেটে গেছিল দীর্ঘ সময়। তাদের অন্যতম সেনাপতি ফিলবি যে আসলে অনেকদিন ধরেই যে একজন কট্টর কম্যুনিস্ট, সেটা আঁচই করতে পারেননি দুই দফতরের বাঘা বাঘা সব আধিকারিকরা। অতঃপর ফিলবির নাগাল পেতে তড়িঘড়ি তৎপর হন তাঁরা। কিন্তু ততক্ষণে শিকলি কেটেছে পাখি। রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন ফিলবি। তন্ন তন্ন তল্লাশি চালিয়েও গোটা আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের কোথাও সন্ধান মেলেনি তাঁর।
মাসকয়েক পরের কথা। মস্কোর লুবিয়াঙ্কা স্ট্রিটে কেজিবি-র (সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা) সদর দফতরে দেখা গেল ফিলবিকে। এর কিছুদিন বাদে সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ লেনিন’-এ ভূষিত হন তিনি। সিআইএ এবং এমআই- সিক্স, এই দুই স্বনামধন্য গুপ্তচর সংস্থার ইতিহাসে চরম কলঙ্কজনক এবং চূড়ান্ত ব্যর্থতার এক ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে কিম ফিলবি– এই নামটি। এর বেশ কিছুকাল বাদে ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে এ দেশে টেস্ট সিরিজ খেলতে এসেছিল ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিম। সে সময় ইডেনের ভিআইপি বক্সে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল এক শেতাঙ্গ বৃদ্ধ ভদ্রলোককে, যাঁর চেহারার সঙ্গে নাকি ফিলবির অদ্ভুত মিল। যদিও প্রমাণ হয়নি কিছুই তবে আদতে ব্রিটিশ হিসাবে ফিলবির ক্রিকেটপ্রেম আর তৎকালীন নেহেরু সরকারের সঙ্গে রুশ সরকারের গভীর সুসম্পর্ক, এই দুই মিলিয়ে সন্দেহের মেঘটা কিঞ্চিৎ ঘনীভূত হয়েছিল বৈকি।

আমাদের এই উপ-মহাদেশে অতটা না হলেও গুপ্তচররা খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন একাধিকবার। যেমন সরবজিত সিং। ভারতের এই নাগরিক গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দীর্ঘকাল বন্দি ছিলেন পাকিস্তানের জেলে। পাক আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা শোনানোর পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনকানুনের টানাপোড়েনে সে রায় কার্যকর হতে কেটে যাচ্ছিল দীর্ঘ সময়। এরই মধ্যে একদিন সহবন্দীদের হাতে মার খেয়ে মারাত্মক জখম অবস্থায় হাসপাতালে যেতে হয় তাঁকে। সেখানে গভীর কোমায় চলে যান তিনি আর কোমাচ্ছন্ন অবস্থাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। এর বিপরীতে ভারতের জেলেও এক পাক বন্দির মৃত্যু হয় এই একই প্রক্রিয়ায়। গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন তিনিও। এঁরা দুজনেই গুপ্তচর ছিলেন কিনা, সেটা নিশ্চিত নয়। কারণ তাঁদের নিজেদের দেশ তাঁদের নাগরিকত্ব অস্বীকার না করলেও তাঁদের গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টা স্বীকার করেনি কখনওই। গুপ্তচরদের ক্ষেত্রে এই অলিখিত আইন পৃথিবীর সর্বত্রই প্রযোজ্য। নির্মম শোনালেও কথাটা একশোভাগ সত্যি।
প্রতিবেদনের শেষ পর্বে আমাদের দেশের এক গুপ্তচরের রোমহষর্ক এক কীর্তিকলাপের কাহিনি শোনাই। দক্ষিণী এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, পেশায় ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ অর্থাৎ ‘রিসার্চ এ্যান্ড এ্যানালিটিক উইং’-এর অভিজ্ঞ গুপ্তচর, নাম ধরা যাক কৃষ্ণ আইয়ার। এহেন আইয়ারের হাতে একদিন অভিনব এক অ্যাসাইনমেন্ট এল। মুম্বই বিস্ফোরণের অন্যতম চক্রী হিসাবে সন্দেহের তীর যার দিকে, সেই মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম কাসকার, কুখ্যাত ডি-কোম্পানির প্রধান দেশ থেকে পালিয়ে প্রথমে দুবাই, পরবর্তীতে আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের করাচিতে।

এহেন দাউদকে চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে হবে। বেশ কয়েকমাস প্রশিক্ষণ দিয়ে আইয়ারকে অতি সঙ্গোপনে পাঠিয়ে দেওয়া হল করাচিতে। তাঁর সামনে একটাই মিশন। অপারেশন দাউদ। সেখানে তাঁর পরিচয়, একজন ধার্মিক মুসলমান। পাঁচ ওয়ক্তের নামাজি। দাউদের ডেরার কাছাকাছি বাসা বাঁধলেন তিনি। পেশায় একজন ফেরিওয়ালা। কিছুদিন বাদে বিশ্বস্ত সূত্রে আইয়ার খবর পেলেন স্হানীয় একটি মসজিদে প্রতি জুম্মাবারে (শুক্রবার, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনার সবচেয়ে পবিত্র দিন) নামাজ পড়তে আসে দাউদ। খবরটা পাওয়ামাত্র শুরু হয়ে গেল ‘অপারেশন দাউদ’ কার্যকর করার পরিকল্পনা। এ মিশনে আইয়ারের সহযোগী ফরিদ তানাশা। ছোটা রাজন গ্যাংয়ের অন্যতম সদস্য।
ছোটা রাজন কে? মহারাষ্ট্রের আর এক ভূমিপুত্র, একদা দাউদের ম্যান ফ্রাইডে। মুম্বই বিস্ফোরণ নিয়ে মতবিরোধের পর দাউদের গ্যাং ছেড়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। নিজের আলাদা গ্যাং খুলে দাউদের প্রধান শত্রু হয়ে ওঠে। নিজের পরিচয় দিত ‘দেশভক্ত’ ডন হিসাবে। এহেন ছোটা রাজনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর ফরিদ তানাশা। রাজনের আদেশ পাওয়ামাত্র সে গোপনে গিয়ে পৌঁছয় করাচিতে। পরিকল্পনা ছিল জুম্মাবারে দাউদ নামাজ পরতে এলে গুলি চালিয়ে হত্যা করে দ্রুত সরে পড়তে হবে অকুস্থল থেকে। হত্যার জন্য প্রয়োজনীয় আগ্নেয়াস্ত্রটি সময়মত পৌঁছে যাবে ফরিদের কাছে। পরিকল্পনামাফিক শুক্রবার ঘটনাস্থলে পৌঁছেও যায় ‘অপারেশন দাউদ’ টিম। কিন্তু একদম শেষ মূহুর্তে প্রশাসনের উচ্চতম মহলের তরফে আইয়ারকে ফোনে জানানো হয়– পরিকল্পনা বাতিল ! মাত্র দু’হাত দুর দিয়ে দাউদকে চলে যেতে দেখেছিলেন বাঘা এই গুপ্তচর। নিজের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কীই বা করার ছিল তাঁর! কেন এরকম ঘটেছিল? কার নির্দেশ এসেছিল? এ সবই এ দেশের গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাসে এক অপার অসীম রহস্য হয়ে রয়ে গেছে আজও।
তথ্যসূত্র – ‘ডোংরি টু দুবাই, সিক্স ডেকেডস অফ মুম্বই মাফিয়া। এস হুসেইন জায়দি। প্রকাশনা – রোলি বুকস।
*ছবি সৌজন্য: E-ir.info, Hindustannewshub, Insider
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।