গত ২০২২ এর ২২ মে আমি এভারেস্ট শৃঙ্গ (Everest) এবং ২৪ মে চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ লোৎসেতে (Lhotse) অক্সিজেন ছাড়াই আরোহণ করি। আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন আমার মা স্কুলের ‘কিশলয়’ বইয়ে তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারির ‘এভারেস্ট বিজয়’ গল্পটা পড়িয়েছিলেন। ওঁরা কত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এভারেস্টের খাড়া পাথরের দেওয়াল, খাড়াই বরফের দেওয়াল বেয়ে উঠে যাচ্ছেন, সেই বর্ণনা আমার মনে গভীর দাগ কাটে, আমার মনে হতে থাকে আমি যেন সেখানে পৌঁছে গেছি এবং ওঁদের সঙ্গে এভারেস্ট আরোহণ করছি। তখন থেকেই মনে হতে থাকে পর্বাতারোহণই আমার জীবন। এটা ছাড়া আমি বাঁচব না। তখন আমি পাহাড়ে যাওয়ার জন্য বায়না করতে শুরু করি।
সেই পাঁচ বছর বয়সে আমরা প্রথম নেপাল যাই এবং অন্নপূর্ণা-চূড়া দেখি। তারপর ছ’বছর বয়স থেকে বাবা-মার সঙ্গে হিমালয়ে ট্রেকিংয়ে যাওয়া শুরু করি। কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ, অমরনাথ, বৈষ্ণদেবী, সান্দাকফু, ফালুট ট্রেকিং করতে যাই। সেসময় পাহাড়ে গেলে আমার এত আনন্দ হত যে, আমি সেই পাহাড়ের অধিক উচ্চতায়, কম অক্সিজেনের জায়গাগুলোয় দুর্গম চড়াই দিয়ে দৌড়তে শুরু করতাম। তারপর মা-বাবাকে খুঁজে না পেয়ে আবার পেছনে খুঁজতে আসতাম। খুঁজে পেয়ে গেলে আবার সামনে দৌড়তে থাকতাম। তাছাড়াও আশেপাশের যে খাড়াই পাথরের দেওয়াগুলো, সেগুলো বেয়ে ওঠানামা করতাম। এগুলো মনের আনন্দে করতে করতে নিজের অজান্তেই আমার হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস পর্বতারোহণের উপযোগী হিসেবে তৈরি হতে থেকেছে।
আরও পড়ুন: এভারেস্ট অভিযানের একাল সেকাল ও মেয়েরা
অক্সিজেন ছাড়া উঁচু পর্বতে ওঠার জন্য আলাদা ট্রেনিংয়ের দরকার পড়ে, কিন্তু সেই ট্রেনিং ছাড়াই আমি বিনা অক্সিজেনে পর্বতশৃঙ্গ অভিযান করতে পেরেছি। ২০১৮ সালে যখন পৃথিবীর অষ্টম উচ্চতম শৃঙ্গ মানাসলু অভিযানে যাই, সেখানে একজন বিদেশি পর্বতারোহীর সঙ্গে আলাপ হয়, তিনি অক্সিজেন ছাড়া আট হাজার মিটারের উপরে কিছু শৃঙ্গ আরোহণ করেছেন। তার আগে অবশ্য তিনি বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বিশেষ রকমের চেম্বার তৈরি করে তার মধ্যে অক্সিজেন ও বাতাসের চাপ কমিয়ে, পাহাড়ের উপর যে পরিবেশ থাকে সেটা কৃত্তিম ভাবে তৈরি করে তার মধ্যে ট্রেনিং, প্র্যাক্টিস, খাওয়াদাওয়া, ঘুমনো সব কিছু করতেন।
এত ট্রেনিং করে আসার পরও মানাসলু অভিযানের অধিক উচ্চতায় তাঁর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ৮৬, আমার সেখানে ট্রেনিং ছাড়াই ৯৭-৯৮। অন্যান্য যেসব পর্বতারোহীরা অক্সিজেন নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের ৫০-এর নীচে। আট হাজার মিটার উচ্চতায় এত কম অক্সিজেন যে, কোনও প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষের পক্ষে তো বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়। ওই দুর্গম দেওয়াল বেয়ে ওঠা তো দূরের কথা! সে কারণেই আট হাজার মিটার উপরে পৃথিবীতে যে চোদ্দটি পর্বতশৃঙ্গ আছে, সেগুলোয় অক্সিজেন ছাড়া অরোহণ করতে পারাটা খুবই দুরূহ চ্যালেঞ্জ। আমরা ৩ এপ্রিল বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলাম, আর্থিক সমস্যায়র জন্য আমার অনেকটা দেরী হয়েছিল।
সেই পাঁচ বছর বয়সে আমরা প্রথম নেপাল যাই এবং অন্নপূর্ণা-চূড়া দেখি। তারপর ছ’বছর বয়স থেকে বাবা-মার সঙ্গে হিমালয়ে ট্রেকিংয়ে যাওয়া শুরু করি। কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ, অমরনাথ, বৈষ্ণদেবী, সান্দাকফু, ফালুট ট্রেকিং করতে যাই। সেসময় পাহাড়ে গেলে আমার এত আনন্দ হত যে, আমি সেই পাহাড়ের অধিক উচ্চতায়, কম অক্সিরজেনের জায়গাগুলোয় দুর্গম চড়াই দিয়ে দৌড়তে শুরু করতাম।
পিয়ালি বসাক
যখন বেসক্যাম্পে পৌঁছলাম, ওখান থেকে আমাদের প্রথম রুট ওপেনিং শুরু হল। মানে, আমরা একেবারে সরাসরি চূড়ায় উঠতে পারি না। একের পর এক ধাপ পেরিয়ে যেতে হয়। তারপর আবার নীচে চলে আসতে হয়, তারপর আবার আমাদের লোড-ফেরি করতে হয়। ওখানে মাইনাস ৫০-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। জামাকাপড়, জ্যাকেটে পাঁচ-ছ’টা লেয়ার থাকে, বিউটেন গ্যাস বার্নার, খাবারদাবার, পর্বতারোহণের সরঞ্জামাদি- এই সব মিলিয়ে ১৭ কেজি ওজন নিয়ে আবার ধাপে ধাপে উপরের ক্যাম্পে লোড ফেরি করতে হয়। এই দুর্গম বরফ ও পাথরের খাড়াই দেওয়াল বেয়ে আরোহণ করতে করতে হাঁপিয়ে গেলেও একটুও বিশ্রাম নেওয়ার উপায় নেই, গলা শুকিয়ে গেলে জল খাওয়ার উপায় নেই, খিদে পেলে খাওয়ার উপায় নেই, দম ফুরিয়ে হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে আসতে চাইলেও বড় বড় ফাটল লাফিয়ে পেরিয়ে, উঁচু বরফের দেওয়া বেয়ে দৌড়ে দৌড়ে আরোহণ করে পালাতে হয়েছে, কারণ কখন যে বরফের দেওয়াল উপর থেকে অথবা যেটার উপর দাঁড়িয়ে আছি, সেটাই ভেঙে পড়বে কেউ জানে না। কিছু কিছু ফাটলে ল্যাডার বা মই লাগানো হয়, কিন্তু সেটা একেবারে খুম্বু আইসফলের নীচের দিকে। বেশি উপরে মই নিয়েও যাওয়া যায় না। আমাদের অভিযান অনেক দেরিতে শুরু হওয়ার কারণ, বরফের দেওয়াল এত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল যে, সমস্ত মই তুষারধসে তলিয়ে গিয়েছিল। তাই অনেক বড় বড় ফাটল আমাদের লাফিয়ে পেরোনো ছাড়া উপায় ছিল না।
বেসক্যাম্প থেকে ক্যাম্প-১ যেতে খুম্বু আইসফল পেরোতে হয়। এটা এতই বিপজ্জনক, যে, বহু পর্বতারোহী শেরপার মৃত্যু ঘটে ওখানে। আমার আর্থিক সমস্যার কারণে এভারেস্ট-চূড়ায় আরোহণের অনুমতি পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়। মে মাস যতই শেষের দিকে যেতে থাকে, গ্রীষ্ম যত বাড়তে থাকে, খুম্বু আইসফলের অস্থিরিতা ও ফাটল তত বাড়তে থাকে। তখন চারদিকে ১০০-১৫০ বা আরও বেশি ফুট উঁচু উঁচু নড়বড়ে বরফের দেওয়াল ভর্তি। আমরা যখন খুম্বু আইসফল বেয়ে ওঠানামা করছিলাম, আমাদের কিছু দূরেই উঁচু উঁচু বরফের দেওয়াল ভেঙে পড়ে তুষারধস নামছিল। যে-বরফের দেওয়ালের উপর দাঁড়িয়ে আছি সেটাই হয়তো কাঁপছে, ফাটল ধরার আওয়াজ আসছে, আর কিছুক্ষণ পর সেটাই ভেঙে পড়বে। এখানে চারদিক হাজার হাজার ফুট গভীর ফাটলে ভরা, যে কোনও মুহূর্তে অসতর্ক হলে বা ব্যালেন্স টলে গেলে হাজার হাজার ফুট গভীর ফাটলে তলিয়ে যেতে হবে।

এই ভাবে আরোহণ করতে করতে আমরা ওয়েস্টার্ন ক্যুম, খাড়াই বরফের দেওয়াল, ওভারহ্যাং (উল্টো দিকে ঝোলা ৯০ ডিগ্রির চেয়ে বেশি ঢাল) পেরিয়ে, ইয়েলো ব্যান্ডের খাড়াই হলুদ পাথরের দেওয়াল পেরিয়ে, খাড়াই লোৎসে ফেসের বরফের দেওয়াল পেরিয়ে, ক্যাম্প ১,২,৩ হয়ে ক্যাম্প ৪-এ পৌঁছতে সক্ষম হই। এটাই এভারেস্ট অভিযানে শেষ ক্যাম্প- আট হাজার মিটার অর্থাৎ ২৬ হাজার ফুট উচ্চতায় সাউথ কল।
তখনও আমার এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণের পারমিশান তৈরি হয়নি। সেই রাত সাউথ কলে কাটাই, এর মধ্যে আমার শেরপা স্যারের অক্সিজেন মাস্ক খারাপ থাকায়, অক্সিজেনের অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নীচে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আমার অক্সিজেন ছাড়া কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না, অত অধিক উচ্চতাতে, ডেথ জোনেও আমি ভালো ছিলাম ও বেশি বেশি খেতাম। পরদিন শীর্ষ আরোহণের অনুমতিপত্র তৈরি হতে আমরা সাউথ কল থেকে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ শুরু করি।
আবহাওয়ার রিপোর্ট খুব ভালো না হলেও, মোটামুটি ভালোই থাকবে জানিয়েছিল। আমি ও আমার শেরপা, দাওয়া স্যার রাত আটটা নাগাদ আরোহণ শুরু করি। আমি যেহেতু অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ করব, সেটা এমনিতেই বিপজ্জনক, ফলে আবহাওয়া সম্পূর্ণ ভালো হলে, ১০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার মধ্যে হাওয়ার বেগ থাকলে অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্টে আরোহণের চেষ্টা করা সম্ভব। তার বেশি জোরে হাওয়া চললে কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেই অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট আরোহণের চেষ্টা করা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না, কারণ এটাই আমার স্বপ্ন। সেই জন্যই এত কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে এসেছি। এভারেস্টের তুষারঝড় থেকে কোনও কোনও পর্বতারোহী কৃত্তিম অক্সিজেন নিয়েও বেঁচে ফিরতে পারেননি, তাই নেপালের সংস্থাও আমাকে নিয়ে খুবই ভয়ে ছিল। আরেক জন শেরপা স্যারকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে তবেই আমাকে উপরে আরোহণ করার অনুমতি দিয়েছিল, যাতে আপাতকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে, একে অপরকে মানসিক জোর জুগিয়ে নীচে ফিরে আসতে পারি। কারণ আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা চলছেই।

নেপালের সংস্থার ভয়টাই সত্যি হয়েছিল। আমরা আরোহণ শুরু করি বেশ হাওয়ার মধ্যেই এবং তা বাড়তে বাড়তে তুষারঝড়ের রূপ নেয়, আমাদের ওয়াকিটকিতে জানানো হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে নেমে আসতে, কারণ টানা পাঁচদিন ভয়ঙ্কর তুষারঝড় চলবে। রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়, সারা পৃথিবীর যত পর্বতারোহী ছিলেন সবাই নীচে ফেরত চলে যান। তাঁড়া সবাই কৃত্রিম অক্সিজেনের সাহায্য নিয়েই আরোহণ করছিলেন, তবুও তাঁরা তুষারঝড়ের কষ্ট সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু আমি তখনও সহ্য করতে পারছিলাম, অক্সিজেন ছাড়া আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। আমার পরিস্থিতি আমার আয়ত্তেই ছিল। ছয় বছর বয়স থেকে পর্বতারোহণের শুরু। কত অভাব, কষ্ট, ত্যাগের মধ্য দিয়ে মা-বাবা আমাকে বড় করেছেন! শিক্ষক-শিক্ষিকা কত কষ্ট করে বড় করেছেন! যাঁরা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, দেশে নাম আরও উঁচু জায়গায় যাবে, সেই আশায় তাঁদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েও আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি আর্থিক সাহায্য রোটারি ইন্টারন্যাশনাল করেছে। এঁদের সবার কথা মনে করে অনেকটাই মনের জোর পাচ্ছিলাম। শারীরিক ভাবে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না, ব্যালকনি পেরিয়ে এভাবে সারা রাত বরফের পাথরের খাড়াই দেওয়াল আরোহণ করতে করতে সকালে আমরা সাউথ সামিট পেরিয়ে হিলারি স্টেপে পৌঁছে যাই। পুরো সময়টা জল বা খাবার খেতে পারিনি তুষারঝড়ের কারণে।

ছয় বছর বয়স থেকে হিমালয়ের বিভিন্ন দুর্গম তীর্থক্ষেত্রগুলোর অধিক উচ্চতাতে কম অক্সিজেনে খাড়াই চড়াই বেয়ে দৌড়াদৌড়ি, খাড়াই পাথরের দেওয়াল বেয়ে ওঠানামা, নয় বছর বয়স থেকে অপূর্ব চক্রবর্তী স্যারের হাত ধরে রক ক্লাইম্বিং শেখা, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে বেসিক কোর্স, ২০০৮-এ অ্যাডভান্স কোর্স, প্রি-এভারেস্ট ট্রেনিং ২০১০-১, ৬,০০০-৭,০০০ মিটারের পাঁচ-ছ’টা শৃঙ্গ অভিযান- যার মধ্যে ২০১৩-য় ভাগীরথী ২ অভিযানে আমরা চূড়ার কাছাকাছি প্রায় ৬,০০০ মিটার উচ্চতায় আরোহণ করতে করতে ক্লাউড বার্স্টের দুর্ঘটনায় পড়ি। সেই মেঘভাঙা বৃষ্টিতে উত্তরাখণ্ড ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। নিকষ কালো অন্ধকারে মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকানো, মেঘগর্জন, তুষারধসের গর্জন, কোমর-বুক সমান বরফ, চার দিন জল নেই-খাওয়া নেই-ঘুম নেই, লুকোনো বরফফাটল ভরা গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার পেরিয়ে নেমে আসা, ভুজবাসা থেকে তীর্থযাত্রীদের নামিয়ে এনে উত্তরকাশী পর্যন্ত হেঁটে নেমে আসা- এই সমস্ত অভিজ্ঞতা অনেক কাজে এসেছিল।
২০১৮ সালে মানাসলু অভিযানে অক্সিজেন মাস্ক খারাপ হওয়ায় অক্সিজেন মাস্ক খুলে খুলে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়েও মানাসলু আরোহণ করে সাফল্য পেয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতাও অক্সিজেন ছাড়া এভারেস্ট আরোহণের ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছে।
২০১৯-এ এভারেস্ট আরোহণের সময় সামান্য আর্থিক সমস্যার জন্য কিছু অসৎ মানুষের বাধায় এভারেস্টের চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছেও আমাকে ফেরত আসতে হয়। সেসময় আমার মুখে ঘুষি মারা হয়, বরফের দেওয়া থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়, অক্সিজেন মাস্ক ভেঙে দেওয়া হয়। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। তবে অন্যান্য শেরপারা এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন এবং আমাকে সমর্থন করেন। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া, প্রায় খাবার ছাড়া, জল ছাড়া সেবার এভারেস্টের চূড়ার কাছকাছি পৌঁছনো, সাউথ কলে রাত কাটানো সুস্থ অবস্থায় নেমে আসা০ এগুলো আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করেছিল। কিন্তু এত কষ্টের পরেও সেবার এভারেস্ট অভিযানের সাড়ে ১৯ লক্ষ টাকা পুরোপুরি নষ্ট হয়।

২০২১-এ প্রথম ভারতীয় হিসেবে অক্সিজেন ছাড়া পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ ধৌলিগিরি আরোহণ করেছিলাম। সেবার করোনার জ্বর-সর্দি-বমি-পেটের অসুখের উপসর্গ নিয়ে, ১২-১৩ দিন না খেয়ে থাকা অবস্থায় ধৌলগিরি বেসক্যাম্পে পৌঁছই। তারপর সেখানে সুস্থ হয়ে অক্সিজেন ছাড়া ধৌলগিরির শীর্ষে আরোহণ করি। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ২০,০০০ ফুট উচ্চতায় তিন দিন সম্পূর্ণ একা কাটিয়েছিলাম তুষারঝড়ের মধ্যে। মোট পাঁচ দিন ক্যাম্প ২-তে থেকে অ্যাক্লাইমেটাইজেশন ছাড়াই ওখান থেকে ক্যাম্প ৩, সামিট ক্যাম্প হয়ে অক্সিজেন ছাড়া ধৌলগিরি-শিখরে আরোহণ আমাকে পর্বতে যে-কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি করে দেয়।
এই সমস্ত অভিজ্ঞতার জোরেই ৮,৭৫০ মিটার (২৮,০০০ ফুট) উচ্চতা অবধি অক্সিজেন ছাড়াই পৌঁছে যাই। হিলারি স্টেপে পরপর পাঁচটি পাথরের খাড়াই দেওয়াল ছিল, ২৪-২৫ হাজার ফুট খাড়াই নীচে নেমে গেছে। কাঁচের মতো মসৃণ। ক্রাম্পন (জুতোর কাঁটা) লাগানোর মতো কোনও খাঁজ নেই। সেখানে পর্বতারোহীদের প্রাণহীন দেহ যেন জীবন্ত! তুষারঝড় ধাক্কা মেরে আমাদের তিন জনকে ফেলে দিচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে আমার কোনও শারীরিক অসুবিধা না হওয়া সত্ত্বেও শেরপা স্যার জোর করায় আমাকে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হল, কারণ এভারেস্টের তুষারঝড় থেকে অক্সিজেন নিয়েও তখনও পর্যন্ত কেউ বেঁচে ফিরতে পারেননি, সেই ভয়টা সবার মনের মধ্যেই সারাক্ষণ ছিল।
২০১৯-এ এভারেস্ট আরোহণের সময় সামান্য আর্থিক সমস্যার জন্য কিছু অসৎ মানুষের বাধায় এভারেস্টের চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছেও আমাকে ফেরত আসতে হয়। সেসময় আমার মুখে ঘুষি মারা হয়, বরফের দেওয়া থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়, অক্সিজেন মাস্ক ভেঙে দেওয়া হয়। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। তবে অন্যান্য শেরপারা এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন এবং আমাকে সমর্থন করেন।
পিয়ালি বসাক
আমরা সকাল ন’টায় এভারেস্টের চূড়াতে পৌঁছই, আমাদের দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে ছবি-ভিডিও তুলে তাড়াতাড়ি নামা শুরু করি। দিনের বেলাতেও রাতের মতো অন্ধকার, মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সানগ্লাসের উপর বরফ কংক্রিটের মতো জমে গেছে, পরিষ্কার করা যায়নি। তুষারঝড় ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে। ওঠার সময় দু’পা উঠলে তিন পা নেমে যাচ্ছিলাম। আর নামার সময় পড়ে গেলে ওঠা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে, ভসভসে বরফে ক্রমশ নীচে ঢুকে যাচ্ছি, খালু চোখে তুষারঝড়ের ঝাপটায় চোখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে।
নীচে নামার সময়ই পর্বত অভিযানে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা, মৃত্যু ঘটে। সেখানে এরকম ভয়াবহ তুষারঝড়ের মধ্যে আমরা সন্ধ্যা ৬’টায় ক্যাম্প ৪ সাউথ কলে পৌঁছই। সাউথ কল তখন ধ্বংসস্তুপ, কোনও জনপ্রাণী নেই। সমস্ত তাঁবু ছেঁড়া-ফাটা, ভাঙা। ছেঁড়া তাঁবুতেই আমরা আশ্রয় নিই।
নেপালের সংস্থা ভেবেছিল, আমাদের মরমর অবস্থা, ওঁরা আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে নেমে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি নীচে না নেমে ওখান থেকেই আবার পৃথিবীর চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ লোৎসে আরোহণের সিদ্ধান্ত নিই। আমার তুষার-অন্ধত্ব, চোখের যন্ত্রণা ছাড়া আর কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না। চূড়ায় আরোহণ, নেমে আসা, এতগুলো ঘণ্টা তুষারঝড়ের কারণে জল না খাওয়া, খাবার না খাওয়ার জন্য প্রচণ্ড খিদেতেষ্টা পেয়েছিল। পৌঁছেই খাওয়াদাওয়া করে নিই। রাতে ঘুমিয়ে সকাল থেকে আবার সারাদিন, সন্ধ্যা অবধি বেশি বেশি করে খেতে থাকি। রাত আটটায় তুষারঝড়ের মধ্যেই আমরা তিন জন লোৎসে শৃঙ্গে রুট ওপেন করতে করতে আরোহণ করতে থাকি। তুষারঝড়ের মধ্যে সারা রাত আরোহণ করে পরিদিন সকাল ন’টায় লোৎসে-চূড়াতে পৌঁছে, ছবি-ভিডিও তুলে তুষারঝড়ের মধ্যেই নামতে থাকি।

একটানা প্রবল তুষারঝড় চলছিল। বরফের খাড়াই দেওয়াল বেয়ে বরফের বিশাল ঝরনা নামছিল, আর আমরা বরফের খাড়াই দেওয়াল বেয়ে নামার সময় সেই ঝরনার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিলাম। আমাদের মাথার উপর দিয়ে, সারা শরীরের উপর দিয়েই সেই বিশাল বরফের ঝরনা নামছিল, কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, বরফের দেওয়ালও ফাটলে ভর্তি, এই পরিস্থিতিতে কোথায় পায়ের ক্রাম্পন গাঁথছি কিছুই আন্দাজ করতে পারছিলাম না। প্রতি মুহূর্তেই ভয় যে এই পদক্ষেপেই হয়তো কোনও ফাটলের অতলে তলিয়ে যাব। নামতে নামতে এক জায়গায় বরফের দেওয়া থেকে অ্যাঙ্কারও খুলে ছিটকে বেরিয়ে যায়। এখানেই শেরপা স্যারের অভিজ্ঞতা কাজে আসে, উনি অ্যাঙ্কার খোলার আওয়াজ বুঝতে পেরে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সাবধান করে দেন। স্যারের পরামর্শ মতো আমরা সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের বাঁচানোর মতো জায়গায় পজিশন নিয়ে নিই ও প্রাণে বেঁচে যাই। এভাবে খুব সতর্ক ভাবে ওই দুর্ঘম অসীম হিমালয় থেকে আমরা নামতে থাকি।
একসময় অন্ধকার হয়ে যায়। সেই অন্ধকারে ভয়ংকর খুম্বু আইসফলের বিরাট ফাটল, জানপ্রাণ দিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে, বরফের দেওয়াল ভেঙে পড়া পেরিয়ে অবশেষে পাঁচ দিনের টানা তুষারঝড়ের মধ্যে পৃথিবীর দুটো উচ্চতম চুড়া আরোহণ করে, ক্যাম্প ৪,৩,২,১ হয়ে বেসক্যাম্পে পৌঁছই। মানুষের ভালোবাসা, আশীর্বাদ, হিমালয়ের আশীর্বাদ এবং আশৈশব নিজের স্বপ্ন সফল করার আদম্য লড়াইটাই এই দুর্গম অভিযাত্রাকেও সফল করেছে আর অক্ষত অবস্থায় সবার মাঝে ফিরে আসাও সম্ভব করেছে। আরও বড় কোনও অভিযানে, আরও বেশি অভিজ্ঞতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে তৈরিও করে দিয়েছে।
ছবি সৌজন্য: লেখক
ছেলেবেলা থেকেই নেশা পর্বতারোহণ। আদতে চন্দননগরের বাসিন্দা। মায়ের কাছে এডমণ্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের গল্প শুনে পাহাড়ে যাওয়ার বায়না। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিযাত্রী, যিনি অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টের প্রায় শীর্ষ পর্যন্ত ও বিনা অক্সিজেনে লোৎসে শৃঙ্গ আরোহণ করেন।
One Response
You are an inspiration to entire nation.. Hats off