মহীরুহদের সামনে দাঁড়ালে বোঝা যায় যে আমরা অতি নগণ্য। ঠিক যেমন অনুভূতি হয় মহাসাগরের সামনে দাঁড়ালে, অথবা তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকালে। নিজের রাগ-দুঃখ-সমস্যা সবকিছু বড় তুচ্ছ বলে মনে হয় তখন। গাছের ছায়ায় যেমন প্রাণ জুড়োয়, ঠিক তেমনই তাদের উপস্থিতি মানসিক শক্তি জোগায়। এই ভালোলাগার ব্যাপারটা কিন্তু আমার নেহাৎ আজগুবি বলে কখনও মনে হয়নি। মহাবোধি বৃক্ষের কোলে তথাগতের নির্বাণপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে আপেল গাছের নীচে নিউটনের থিয়োরি অফ গ্র্যাভিটি আবিষ্কারের মতো পৃথিবীর বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে বৃক্ষের সান্নিধ্যে। প্রাচীনকালে মুনিঋষিরাও তপস্যার জন্য বেছে নিতেন বনানীর আঁচল। তপোবনের বুকেই গড়ে উঠেছিল প্রথম পাঠশালা। এমনকি সংসার যাপনের পর বাণপ্রস্থের সময়ও মানুষ ফিরে আসত সেই অরণ্যেরই বুকে। এসব কী শুধুই সমাপতন? গাছেদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? কেন তাদের সংস্পর্শে এলে এই ভালো লাগা, ভালো হওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয় আমাদের বুকে? এমনটা কি হতে পারে যে তারা সত্যিই আমাদের ভালোবাসে? উদ্ভিদও সজীব, তবে তাদের ক্ষেত্রে অনুভূতির প্রকাশ ভিন্ন। জাতি হিসেবে তারা আমাদের তুলনায় লক্ষ-কোটি বছরের প্রবীণ।
উদ্ভিদ কোষের জন্মের ইতিহাসও কিন্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ। সে অনেক অনেক অনেককাল আগেকার কথা। মাতা ধরিত্রী তখন সদ্য টিনএজে পা দিয়েছেন। বয়স যদিও দুই বিলিয়ন পেরিয়ে গেছে তাঁর, ততদিনে। তবুও বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া মেয়ের মতো তাঁর যখন-তখন মুড স্যুয়িং হত। আমাদের চেনাজানা এই শস্যশ্যামলা সর্বংসহা জননীর রূপ তো তিনি ধারণ করেছেন সম্প্রতি, মাত্র কয়েকশো কোটি বছর আগে। আমি যে সময়কার কথা বলছি, সেইসময় পৃথিবী ছিলেন রীতিমতো অ্যাংরি ইয়ং উওম্যান।

অবস্থাটা ভেবে দেখুন। ধরার ত্বকে ব্রণস্বরূপ লক্ষকোটি আগ্নেয়গিরি ফুটছে যখন তখন। এমনকী জলের উপর ভাসতে থাকা মহাদেশগুলোকে কোথায় কীভাবে রাখলে যে বেশ ভালো দেখাবে তাও তিনি ততদিনে ঠিক করে উঠতে পারেননি। অতএব ইচ্ছে মতো কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট করে যখন তখন মহাদেশগুলোকে লেগো ব্লকের মতো সরাচ্ছেন এখানে সেখানে। ভাবুন, এখন একখানা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাত শুরু হলে আমরা আঁতকে উঠি। সুনামি বা সাইক্লোন এলে রব তুলি ত্রাহি মাম, ত্রাহি মাম। আর তখন আকছার মুড়ি-মুড়কির মতো প্রতিদিন সেসব ঘটনা ঘটছে।
বুঝতেই পারছেন যে সেইসময় জীবজন্তু তো দূরের কথা, উদ্ভিদদেরও জন্ম হয়নি। প্রাণী কোষ বা উদ্ভিদ কোষের অস্তিত্ব ছিল না তখন। সাদাসিধে প্রোক্যারিয়ট কোষেদের থেকে একটু উন্নত মানের ইউক্যারিয়ট কোষেদের জন্ম হয়েছে তখন সবে। পেটের ভেতর একখানা আস্ত নিউক্লিয়াস আছে, এই গর্বে ইউক্যারিয়টদের জলে পা পড়ে না (তখন মাটি থোড়াই ছিল!)। বোকাসোকা, ভালোমানুষ প্রোক্যারিয়টদের তারা কোষ বলে মনেই করত না। এর মধ্যে একদিন হয়েছে কী, ইউক্যারিয়টদের পাড়ায় বাইরে একটা বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো ছোকরা ইউক্যারিয়ট সন্ধ্যেবেলায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার পকেটে নেই পয়সা অথচ পেটে প্রচন্ড খিদে। কী খাই, কী খাই ভাবতে ভাবতে সে দেখল, তার অ্যান্টেনার সামনে নিরীহ খুদে একটা সবুজ সায়ানোব্যাকটেরিয়া চরে বেড়াচ্ছে। বেচারা ইউক্যারিয়টের পেটে খিদে থাকলে কী হয়, তার জন্ম উচ্চবংশে। সায়ানোব্যাকটেরিয়া অতি নিম্মস্তরের প্রাণ। ইউক্যারিয়টের চোদ্দোপুরুষে কেউ অত বিচ্ছিরি জিনিস খায়নি। কিন্তু খিদের জ্বালায় তার তখন প্রাণ অস্থির। ছোকরা ভাবলে, আশেপাশে কেউ যখন নেই, তখন দেখিই না একটুখানি খেয়ে। বলা তো যায় না, ভালোও তো হতে পারে। অতএব ব্যাকটেরিয়াটাকে না ধুয়েই ধরে সে টপ করে ফুচকার মতো মুখে পুরে দিল। তারপর দুবার চিবিয়েই তার চক্ষুস্থির। ও বাবা! এত দেখি দারুণ মুখরোচক জিনিস। তারপর আর তাকে পায় কে! সে টপাটপ ব্যাকটেরিয়া ধরছে আর খাচ্ছে। ধরছে আর খাচ্ছে।
এরপর তার দেখাদেখি অন্যান্য ইউক্যারিয়টরাও সবুজ ব্যাকটেরিয়া ধরে খেতে শুরু করল। সায়ানোব্যাকটেরিয়ারা দেখল, এ তো ভারী বিপদ। ইউক্যারিয়ট ব্যাটারা এতদিন নিচুবংশ বলে হোক না হোক তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত বটে। তবে জ্যান্ত ধরে খাওয়ার মতো দুর্মতি তাদের এতদিন হয়নি। আগে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হত, কিন্তু এবার সবেধন প্রাণটি টানাহ্যাঁচড়া শুরু হল। তারা তখন জ্বালাময়ী ভাষায় এমন অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করল। কিন্তু তাদের কথা শুনবে কে? আপনি যখন কেএফসি-তে গিয়ে তরিবৎ করে মুরগির ঠ্যাং চিবোন, তখন কি সে ব্যাপারে মুরগিদের মতামতের তোয়াক্কা কখনও করেন? এমনি করে দেখতে দেখতে আরো দু’শো মিলিয়ন বছর কেটে গেল।
সায়ানোব্যাকটেরিয়াদের রাজামশাই তখন ভেবেচিন্তে জব্বর একখানা বুদ্ধি বাতলে দিলেন, যাতে সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না। তিনি একজন মাতব্বর ইউক্যারিয়টকে ধরে বাবা-বাছা বলে, মাথায়-টাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বাপু হে, তোমাদের পেট ভরানো নিয়ে হল কথা। সেজন্য ধরে ধরে আমাদের খাওয়ার প্রয়োজন কী? বরং আমাদের রাঁধুনি হিসেবে চাকরিতে বহাল করে দিলেই হয়।“
মাতব্বর ইউক্যারিয়ট নিজের অ্যান্টেনা নাড়িয়ে বলল, “যত্ত সব আজগুবি কথা। তা আবার হয় নাকি?” কেন হবে না শুনি? খাবার তৈরি হওয়া নিয়ে হল কথা। তা বাপু, সে দায়িত্ব আমরাই নিচ্ছি। আমরা তোমাদের সঙ্গেই থাকব। রেঁধেবেড়ে দেব। নিজেরাও খাব, তোমাদেরও খাওয়াব। তার বিনিময়ে তোমরা শুধু আমাদের আশ্রয় দাও, আর দিব্যি কেটে বলো যে আজ থেকে তোমরা আমাদের রক্ষাকর্তা হলে। অত্যন্ত চমকপ্রদ প্রস্তাব, তাতে সন্দেহ নেই। ইউক্যারিয়ট ভাবল, বাহ্। বুদ্ধিটা তো খারাপ নয়। খেতে খেতে সবুজ ব্যাকটেরিয়া একদিন শেষ হয়ে যেতেই পারে। তখন বিপদ হবে আমাদেরই। তার চাইতে এই ভালো। শুধু আশ্রয়ের বদলে জীবনভর খেতে পেলে মন্দ কী! সে ভেবেচিন্তে বললে, “বেশ, তবে সেই কথাই থাক। তোমরা তবে আজ থেকে আমাদের সঙ্গেই থাকো। তোমরাও বাঁচো, আমরাও বাঁচি।“

ব্যস্, এই হল উদ্ভিদ কোষের জন্মকথা। ক্লোরোফিল কণা ধারণকারী রাঁধুনী সবুজ ব্যাকটেরিয়া এবং তাদের কত্তাবাবু ইউক্যারিয়ট কোষের সমন্বয়েই তৈরি হয় ভবিষ্যতের উদ্ভিদ কোষ। প্রাণী কোষ তৈরি হয়েছে এর অনেক অনেক পরে। একটু ভেবে দেখলেই বুঝবেন যে উদ্ভিদেরা হল প্রকৃত অর্থেই এই গ্রহের বয়োঃজ্যেষ্ঠ। তারা অবলা বা অবোলা কোনওটাই নয়। বরং উল্টোটা সত্যি। তাদের শিকড়ের ভাষা, তাদের সংস্কৃতি বুঝতে পারার মতো উন্নত আমরা এখনও হইনি; আর অবলা হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ফল দিয়ে, ছায়া দিয়ে, বুকের কোটরে অসহায় পশুপাখিদের আশ্রয় দিয়ে মায়ের মতো রক্ষা করে যারা, তারা অবলা, একথা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য! টর্নেডোর বা সাইক্লোনের সঙ্গে বৃক্ষদের লড়াই যারা নিজের চোখে দেখেছেন, তারা জানেন তাদের শক্তি কতখানি।
আসলে ভুলটা বারবার আমরাই করি। মানুষ মাত্রেই বল অর্থাৎ শক্তির বহিঃপ্রকাশ বলতে বোঝে শুধু ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। আমাদের প্রতিটি সভ্যতার বিজয়স্তম্ভই তো অন্য কোনও পরাজিত জাতির বুকের হাড় দিয়ে গড়ে উঠেছে। বাতাসে কান পাতলে আজও তাদের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাওয়া যায়। প্রাণীজগৎ অধিকার নিয়ে যুদ্ধ করে। নারীর অধিকার, নগরীর অধিকার, মাটির অধিকার, মৃত্যুর অধিকার। তাই উদ্ভিদ জগতের নিঃশব্দ সৃষ্টির সাধনা আমাদের স্থুলচোখে সহজে ধরা পড়ে না।
বুঝতেই পারছেন যে সেইসময় জীবজন্তু তো দূরের কথা, উদ্ভিদদেরও জন্ম হয়নি। প্রাণী কোষ বা উদ্ভিদ কোষের অস্তিত্ব ছিল না তখন। সাদাসিধে প্রোক্যারিয়ট কোষেদের থেকে একটু উন্নত মানের ইউক্যারিয়ট কোষেদের জন্ম হয়েছে তখন সবে। পেটের ভেতর একখানা আস্ত নিউক্লিয়াস আছে, এই গর্বে ইউক্যারিয়টদের জলে পা পড়ে না (তখন মাটি থোড়াই ছিল!)। বোকাসোকা, ভালোমানুষ প্রোক্যারিয়টদের তারা কোষ বলে মনেই করত না।
মানুষের সমাজেও দেখবেন ভালো মানুষ, ভালো সমাজ বা ভালো সংস্কৃতির প্রধান পরিচয় হল সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা। ইংরেজিতে যাকে বলে কমপ্যাশন। সত্যিকারের উন্নত দেশগুলিতে বেশিরভাগ মানুষ পশুপাখি এবং গাছপালাকে নগরায়ণের পরিপন্থী নয়, বরং সুস্থ নগরায়ণের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ধরেন। সেখানে মানুষ নগরায়ণের নামে নির্বিচারে সবুজের ঘাড় মটকে দেয় না। শক্ত কংক্রিটের চাদর আর চোখ জুড়নো ঘাসেঢাকা জমি নির্বিবাদে থাকে পাশাপাশি। বরং উল্টো কান্ড দেখা যায়। মানুষ বসবাস করতে শুরু করলে বড় গাছ লাগিয়ে, বাগান তৈরি করে তারা রুক্ষ শুষ্ক ভূমিকেও সুজলাসুফলা বানিয়ে তোলে। কোনও একটি জায়গায় ট্যুরিস্টের আনাগোনা বেড়ে গেলে সেখানে সরকার বাহাদুর যেমন নিরাপদ রাস্তাঘাট তৈরি করে দেন, তেমনি কড়া আইনও জারি করেন যাতে সেখানকার অরণ্য এবং পশুসম্পদ কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তাই বলছি, কমপ্যাশনের বিচার করলে দেখবেন যে উদ্ভিদেরা আমাদের চাইতে অনেক বেশি উন্নত জাতি। সেইজন্যই বোধহয় কোনও প্রতিদানের প্রত্যাশা না করেই তারা ভালোবাসতে শেখায়। আমাদের শত অন্যায় তারা ক্ষমার চোখে দেখে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যে তারা হয়তো আমাদের নিতান্ত বালখিল্য ভাবে। বৃদ্ধ যেমন শিশুর সব দুষ্টুমি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে, গাছেরাও হয়তো তেমনিই ভাবে যে দূর এই মানুষ জাতিটা নিতান্ত শিশু বইতো নয়, ওদের ওপর কি রাগ করলে চলে?
ছবি সৌজন্য: Pixabay and Wkimedia Commons
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।
2 Responses
কী ভালো লেখাটা। আর একটু হয় না?
অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম যেটা যেমন সত্যিই তেমনই বাস্তব। অনেক অনেক ভালোবাসা ও শুভকামনা রইলো। আরও এমন লেখা চাই।