গৌরিকুণ্ড থেকে গাড়িতে উখিমঠ হয়ে পৌঁছলুম উনিয়ানি। পরিষ্কার রাস্তা। সামনে মাঝে মাঝে নীলাকাশে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বরফে ঢাকা হিমশিখর। এক সময় গাড়ির রাস্তা শেষ হয়, এবার পদব্রজে। রাস্তা নেই,ভেঙে নেমে গেছে। কাদা আর ঝুরোপাথর কুচি। তার ওপর দিয়েই আক্ষরিক অর্থে চার হাত পায়ে উঠে আসি সুস্থ পথে। একটু হাঁফ ছেড়ে এগিয়ে যাই রাশি গ্রামের দিকে। পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আমাদের আশ্রয়দাতা লালার ঘরে মালপত্র রেখে রাস্তার ওপর গাছের গুঁড়ি দিয়ে বানানো টেবিল চেয়ারে বসি। এসে যায় গরম খিচুড়ি আর পাঁপড়। পাহাড়ের কোলের মধ্যে, প্রকৃতির ব্যালকনিতে বসে, চৌখাম্বাকে সাক্ষী রেখে সে এক অলৌকিক ভোজন। দুপুর শেষ হয়েছে অনেক আগেই, বিকালও প্রায় শেষের পথে, এইবেলা একটু গ্রাম পরিক্রমা করে নিই। এখানে রয়েছে বহু প্রাচীন কালেশ্বরী মন্দির। দেবীকে প্রণাম জানিয়ে ফিরে আসি আস্তানায়।
পরদিন আবার যাত্রা। মালবাহকদের সাথে এ বার দুটি খচ্চরও জুটে যায়। ভাবি ভালোই হলো, দুপা ক্লান্ত হলে চার পায়ের ভরসা। গৌন্ডার গ্রামের পথে এগিয়ে চলি। পথে পড়ে বিশাল ঝর্না। পাশের পাহাড় চূড়া থেকে ঝামরে নেমে এসে মিশে যাচ্ছে অনেক নীচে মধুগঙ্গায়। গৌন্ডারে পৌঁছে এক ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে অল্প বিশ্রাম। এবার কিছুটা উৎরাই পথে যাব বাণতোলি। এখানে মধুগঙ্গা এসে মিলেছে কেদারগঙ্গার সাথে। চারিদিক নিস্তব্ধ। ধ্যানমগ্ন গিরিরাজের পদতলে দুই সখির মিলনের গুঞ্জরিত স্বর কেবল শোনা যায়। এই বাণতোলিতেই হিমালয়প্রাণ শ্রদ্ধেয় উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর পাহাড়ি ডেরা। আমরা দেখলাম অতীব ভগ্নদশাপ্রাপ্ত একটি জরাজীর্ণ কুটিরের আভাস। তাঁর চরণে প্রনাম জানিয়ে এগিয়ে চলি। পেরিয়ে যাই খাটারা গ্রাম। আসে নানু। এখানে পাওয়ার হোটেলে সামান্য দ্বিপ্রাহরিক আহার, বিশ্রাম। আবার চলা।
পথ বেশ চড়াই, মাঝে মাঝে চার হাত-পায়ের সাহায্য নিতে হচ্ছে। কিছুটা চড়াই ভাঙার পর পথ মোটামুটি সরল হয়ে আসে। পৌঁছে যাই কুনচটি। আবার হালকা চড়াই । পথ প্রশস্ত নয় তবে পথরেখা পরিষ্কার, ভুল করার যো নেই। হঠাৎ কী বিপত্তি! হু হু করে কোথা থেকে মেঘ ছুটে আসে, পথ ঝাপসা হয়ে যায়। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু চলা থামানোর তো উপায় নেই। অগত্যা মেঘের সমুদ্রে সাঁতার দিতে দিতে এগিয়ে যাই। এক সময়ে রাস্তা শেষ। পাশে টিনের ফলকে লেখা, “মদমহেশ্বরে আপনাকে স্বাগত।”
নিসর্গ দেখে মুখের কথা বন্ধ হয়ে আসে। এক অবিনশ্বর আত্মা যেন চালিয়ে নিয়ে চলেছে গোটা পৃথিবীকে। চন্দ্রতপনের আরাধ্য দেবতা আপ্যায়ন করছে সামান্য মানব কে। চারিদিকে ঘন সবুজ জঙ্গলাকীর্ণ উত্তুঙ্গ পর্বতমালা। মাঝে প্রশস্ত সমতলের একদিকে মদমহেশ্বরের মন্দির, নির্বাক ইতিহাস। অন্যদিকে কিছু বাড়িঘর। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে উপত্যকায়। মন্দিরে বেজে ওঠে সান্ধ্যপূজার ঘন্টাধ্বনি। প্রদীপ প্রজ্জলিত গর্ভগৃহে আলো আঁধারি পরিবেশ। আমরা শীতল সিক্ত মেঝেতে আসন পেতে বসি। পুরোহিত গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণে আরত্রিক করতে থাকেন। সমস্ত উপত্যকা জুড়ে ধ্বনিত হতে থাকে সেই মন্দ্রস্বরে উচ্চারিত স্তোত্র আর গভীর ঘন্টাধ্বনি।
পরদিন খুব ভোরে রওনা হই বুড়া-মদমহেশ্বরের পথে। পথরেখা তেমন কিছু নেই, পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যাওয়া। ছোকরা মালবাহকের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত পৌঁছই। যেন আদিগন্তবিস্তৃত এক উন্মুক্ত প্রান্তর। একদিকে নীচে মেঘের সমুদ্র, অন্যদিকে স্বমহিমায় বিরাজিত চৌখাম্বা পর্বতশৃঙ্গ। তার পিছনে কাকভুশন্ডি। মধ্যে একটি ছোট্ট জলাশয়। তার পাশে পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে তৈরি এক অকিঞ্চিৎকর দেবালয়। সেখানেই প্রণাম করি। হঠাৎ মনে হল, ঐ তো শিব পার্বতী চৌখাম্বায় বিশ্রামরত আর কাকভুশন্ডি তাঁদের জানাচ্ছে পার্থিব ঘটনাবলী। পুরাণ, কল্পকথা, প্রকৃতি, সত্য সব একাকার হয়ে যায় মূহুর্তে। ঘন্টাধ্বনিতে সম্বিৎ ফেরে, পূজার সময় চলে যাচ্ছে, তবে এতক্ষণ কি করছিলাম? পূজা নয়? যাই হোক প্রথামাফিক পূজাপাঠ সেরে, মন্দির পরিক্রমা করে, নিচে নামতে থাকি। আজ রাত লালার আশ্রয়ে থেকে কাল সোজা চোপতা।
চোপতাকে অনেকে ভারতের সুইৎজারল্যান্ড বলে থাকেন। ছড়ানো উপত্যকা, গড়ানো বুগিয়ালের ঢাল, রঙিন পাহাড়ি ঘর বাড়ি, দিগন্তে ১৮০ ডিগ্রী হিমালয়ের শৃঙ্গমালার মিছিল, সব মিলিয়ে যেন বিদেশি পোস্টকার্ড। কিন্তু আমরা পৌঁছে দেখি সব মেঘে ঢাকা। অনুভব করলাম কিন্তু চাক্ষুষ করলাম না। পায়ে পায়ে খুঁজে গিয়ে ঢুকি বিখ্যাত সব হিমালয়প্রেমীদের কাছের মানুষ মঙ্গলদাদার আস্তানায়। কী সহজ, সাধারণ, স্বাভাবিক অথচ কী আন্তরিক আপ্যায়ন তাঁর এবং তাঁর সহধর্মিনীর। বললেন খেতে তিনি দেবেন কিন্তু থাকার ব্যবস্থা নেই। অবশ্য হাঁকডাক করে ব্যবস্থা তিনিই করে দিলেন উল্টোদিকের হোটেলবাড়িতে।

পরদিন অন্ধকার থাকতে বেড়িয়ে পরি আমরা। এবার গন্তব্য তুঙ্গনাথ। পিচরাস্তার থেকে দু তিন ধাপ সিঁড়ি উঠে তোরণ, সেখানে ঘন্টা বাজিয়ে চলা শুরু। আবছা আলোয় কংক্রিটের চওড়া রাস্তা দৃশ্যমান। বাঁ দিকে গড়ানে বুগিয়াল নেমে গেছে নিচের দিকে আর ডান হাতে পাহাড়ের ঢালে ঘন রডোডেন্ড্রনের বন। অল্প পথ কিন্তু ক্রমাগত উঠে যাওয়া- একটু কষ্টকর চড়াই। চলতে চলতে বাঁ দিকের দিগন্তে চোখ যায়। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। অলৌকিক দৃশ্য। গাড়োয়াল হিমালয়ের বিখ্যাত সব শৃঙ্গরাজি সারিবদ্ধভাবে দৃশ্যমান। কয়েকটির চূড়ায় প্রথম আলোর চরণচিহ্ণ। আমাদের বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে পথের পাশের ঝুপড়ি দোকান থেকে এক প্রবীণ এগিয়ে আসেন। চিনিয়ে দেন, ওই হল কেদার, ওই যে কেদারডোম, ওটা চৌখাম্বা, আরেকটু দূরে হাতিপর্বত, ওই যে ত্রিশূল ইত্যাদি।
অপরূপ সে দৃশ্য়ের সামনে স্তব্ধতা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার থাকে না। খানিক থেমে এগিয়ে চলি। পাহাড়ের যা নিয়ম। চলতে চলতে এক সময় দূর থেকে মন্দিরের চূড়া চোখে পড়ে। শক্তি তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মন্দিরের আভাস শরীরে যেন নতুন বল সঞ্চার করে। ওই তো আমাদের কাঙ্ক্ষিত দেবস্থান! ক্লান্ত শরীরে সন্তুষ্ট চিত্তে তুঙ্গনাথের দ্বারপ্রান্তে পৌছাই। চন্দ্রনাথ পর্বতের পাদদেশে মন্দির। চিরাচরিত উত্তরাখন্ড শৈলিতে নির্মিত। প্রথামাফিক পূজাপাঠ সাঙ্গ করে মন্দির পরিক্রমা করতে গিয়ে দেখি সেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দিরের মধ্যে পঞ্চকেদারের কাল্পনিক মূর্তি। যাঁরা পথশ্রমে অক্ষম, তাঁরা যাতে তুঙ্গনাথে এসেই পঞ্চকেদার দর্শন করতে পারেন, তাই এই অভিনব ব্যবস্থা।
এ দিকে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া খারাপ হতে থাকে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চোপতায় ফিরে আসি। সেখানে কিন্তু রোড ঝলমল করছে! পাহাড়ের এ এক অদ্ভুত নিয়ম! রাতে অবশ্য চোপতাতেও প্রবল বৃষ্টি নামে। বুঝতে পারি রুদ্রনাথ বিরূপ। এই আবহাওয়ায় কি সে পথে যাওয়া যাবে? পরের কিস্তিতে শোনাব সেই কাহিনি।
পেশায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী। নেশা বহুল। গ্রুপ থিয়েটার, পাখির ছবি তোলা আর পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ তার মধ্য়ে তিন। খেপে ওঠেন সহজে। হেসে ওঠেন গরজে! খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন। আর পছন্দ টেলিভিশন দেখা!
One Response
দারুন লেখাটা।