আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০]
ভগবান দর্শন ও কিছু উপদেশ প্রাপ্তি
“আমি ভগবানকে দেখেছি। তাঁর নাম শচীন তেন্ডুলকর।” টুইট করেছিলেন, না কোনও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ঠিক মনে পড়ছে না। বক্তব্যটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার এককালের ডাকসাইটে ওপেনার ম্যাথিউ হেডেনের। মন থেকে বলেছিলেন নাকি জম্পেশ আই পি এল কন্ট্র্যাক্ট হাতাবার তালে বলেছিলেন নিশ্চিত নই। আমরা যদি চলি ডালে ডালে তো সাহেবরা চলে পাতায় পাতায়। আমিও অবশ্য ভগবানকে দেখেছি। তাঁর নাম সাধন চন্দ্র দত্ত। আমার একসময়ের বছর চারেকের কর্মক্ষেত্র ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টসের কর্ণধার। প্রতিষ্ঠানটির আমজনতা ওঁকে এই নামেই উল্লেখ করতেন। নামটির উৎস জানা নেই। এক হতে পারে উনি সবার চাকরির ভাগ্যবিধাতা ছিলেন। দুই, ওনাকে সচরাচর চোখে দেখা যেত না।***
কলকাতা অফিসে আড়াই বছর ছিলাম, ১৯৮০-র মাঝামাঝি নাগাদ শুরু করে ১৯৮৩-র শুরু অবধি। কোনোদিনও সামনাসামনি দেখিনি ওঁকে। অন্তরাল থেকে পৃথিবী-জোড়া সাম্রাজ্য পরিচালনা করত সেই সময়ে বছর ষাটেক বয়সের বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির এই স্নাতক। আমেরিকার কুলজিয়ান কর্পোরেশনের অভিজ্ঞতা এবং নিজের ব্যবসা বুদ্ধির পুঁজি সম্বল করে সাধনবাবু পত্তন করেন ডেভেলপমেন্ট কনসালটান্টসের। আমি থাকাকালীন দেশে বিদেশে প্রায় ১৫০০ ইঞ্জিনিয়ার কাজ করতেন এই প্রতিষ্ঠানে। আমি সেই সময়ে ডিসিপিএল-এর তরফ থেকে লিবিয়াতে কর্মরত। বেশ রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল একদিন। অফিসের গাড়ির একটা কনভয় আমাদের জনা বিশেক ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে চলল এক অজানা স্থানে। সেটি ছিল একটি বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) হোটেল— স্থানীয় নাম ‘ইদি হোটেল’। উগান্ডার কুখ্যাত একনায়ক ইদি আমিন নাকি এখানে দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে ছিলেন কর্নেল গাদ্দাফির সহায়তায়। রতনে রতন চিনেছিল!
***
পরবর্তী জীবনে দীর্ঘ প্রবাসে কথাগুলি মনে রেখেছি। মনে হয় কিছুটা সফলও হয়েছি। একদিন কথায় কথায় এক সাহেব সহকর্মী ডামিয়ান ও’রুর্ক বলেছিলেন: “Sid , when I look at you and most others from your country, it’s like chalk and cheese!” বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম। কারণ দুটো। এক, নিজের প্রশংসা শুনে। দুই, নিজের দেশবাসীর সম্বন্ধে এক স্থানীয় মানুষের ধারণা জেনে। যাঁরা ক্রিকেট ভালবাসেন, অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং কোচ ড্যারেন লেহম্যানের চেহারাটা যদি মনে করেন ডামিয়ানের সঙ্গে ৮০ শতাংশ মিলে যাবে। অত্যন্ত সজ্জন এবং আমুদে মানুষ। আমরা এখনও বছরে বার কয়েক কোনও রেস্তোরাঁতে বসে আড্ডা দিই সময় করে। সম্প্রতি বড় রকম হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন কাজ থেকে দূরে আছেন।
পূর্ব ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের সম্প্রদায়কে নানাভাবে সাহায্য করেন— গ্রীকদের বা ক্রোয়েশিয়ানদের ঝাঁ চকচকে ক্লাবগুলোর পিছনে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য। সফল ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভারতীয় গোষ্ঠীর জন্য এধরণের কোনও সাহায্য প্রদানের ঘটনা বিরল।আমরা নিজের দেশের নিন্দে করেই থাকি। চুরি-ডাকাতি, তোলাবাজি, নানা ধরণের অসভ্যতা নিত্যকার খবরে প্রাধান্য পায়। আমার ধারণা এসবের অন্তর্নিহিত কারণ দারিদ্র এবং আইনের শাসন ও সামাজিক মূলধনের অভাব। বড়লোকদের চুরির কারণ অবশ্য অন্য। স্রেফ লোভ। অভাবে চুরি ক্ষমা করা যায়। কিন্তু বিদেশে বিত্তশালী ভারতীয় মানুষদের চুরি ও নীচতা যখন দেখি খুব লজ্জা লাগে। আর খবরে যখন ভারতীয়দের বধু নির্যাতন বা অসহায় বৃদ্ধকে জুতোপেটা করার খবর পাই মুখ লুকানোর জায়গা পাই না।
ইউটিউবে একটি ভিডিও পেলাম। এতে সাধনবাবুর বিষয়ে অনেক অজানা কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য পেলাম। লিঙ্ক দিলাম।
দেশে থাকতে অনেকেরই এই ধরণের বৈভব কল্পনার অতীত ছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে অনেক সাধারণ মেধার মানুষ এখানে দাপটে করে খাচ্ছেন। অধিকাংশই সাধন বাবুর উপরোক্ত সদুপদেশ গুলি মেনে চলেন । কিছু অসৎ এবং লোভী মানুষের জন্যই সমস্টিগতভাবে আমরা stereotyped হয়ে যাই। এইসব খবর শুনলে ২০০৮ সালে ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত দত্তসাহেব শুনলে খুব দুঃখ পেতেন।***
ভগবানকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। যতটা শুনেছি – তিনি ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে অসাধারণ ছিলেন। তবে ওরকম অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ার প্রচুর ছিলেন তখনও, এখনো আছেন। দত্ত সাহেবের চোখধাঁধানো সাফল্যের কারণ অন্য – ভাল প্রযুক্তিবিদ হওয়া ছাড়াও ওঁর ব্যবসাবুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ণ। ব্যবসা করতে গেলে সরকারকে খুশি রাখতে হয়। উঁচু মহলে সংযোগ থাকাটাও জরুরী। তৎকালীন বাম সরকারের মন্ত্রী এবং পরবর্তীকালের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর স্ত্রী মীরাদেবী আমাদের লাইব্রেরীতে কাজ করতেন। একবার সময়মত বই ফেরত না দেওয়াতে জোর বকুনি খেয়েছিলাম মীরাদেবীর কাছে। এছাড়া বহু উচ্চপদস্থ প্রাক্তন সরকারী চাকুরেদের উপদেষ্টা রূপে দেখেছিলাম। যতটা না প্রযুক্তিগত উপদেশ দিতেন তার চেয়ে মনে হয় এঁরা ঢের বেশী কাজে আসতেন বড় কাজ ধরতে। সফল লোকেদের ঈর্ষা করার মানুষেরও অভাব হয়না। প্রমানবিহীন কুৎসা রটাতেও পয়সা লাগেনা। এক উচ্চপদস্থ পরিচিত মানুষ দাবী করেছিলেন, সাধনবাবু নাকি তাঁকে এক ব্যাগভর্তি টাকা উৎকোচ হিসাবে দিতে চেষ্টা করেছিলেন একটা বড় কাজ পাবার জন্য। এই অভিযোগ সত্যি হতেও পারে, না-ও হতে পারে। হয়তো স্রেফ ঈর্ষাপ্রসূত কল্পনা গোটা ব্যাপারটা। তবে ব্যবসা করতে গেলে অনেক কাদাই ঘাঁটতে হয় ইচ্ছে না থাকলেও। যে খেলার যা নিয়ম। জলে নামলে চুল ভেজাতেই হয়। এই ধরণের মানুষকে দেখেছি অনেক সময়ে আপাত নিষ্ঠুর হতে। শুনেছি সাধনবাবু কিছু কর্মচারীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন নি – একজন উচ্চপদস্থ সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার নাকি মেজাজ হারিয়ে কাজ ছেড়ে যাবার সময়ে জনসমক্ষে শাপ শাপান্ত করে গিয়েছিলেন। শত্রুও ছিল নিশ্চয়ই। ওঁর ড্রাইভার তথা দেহরক্ষী জলেশ্বর নামে মানুষটির চেহারা ছিল ভয় ধরানো। শুনেছিলাম তৎকালীন কংগ্রেসী নেতা প্রফুল্লকান্তি (শত) ঘোষের সুপারিশে নাকি এই জলেশ্বরের নিয়োগ। কথায় বলে, আদার ব্যাপারীদের জাহাজের খোঁজ রাখার দরকার কি? আমি হলেম সেই আদা বেচা মানুষ, বহু দূরের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটির এক অনুরাগী মাত্র। যিনি নারায়ণ মূর্তির বহু আগে আমেরিকা তথা বিশ্বের বহু দেশে ভারতীয় প্রযুক্তির ধ্বজা উড়িয়েছিলেন। তাঁর চরিত্রের বা জীবনের কিছু অন্ধকার দিক থেকে থাকলেও তা নিয়ে আমার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। ওঁর জীবনী কেউ লিখেছে বলে আমার জানা নেই। ইন্টারনেটেও ‘মানুষ সাধন দত্ত’ র বিষয়ে বিশেষ তথ্য পেলাম না। জীবিত থাকলে বয়স প্রায় একশ হত। ওঁর সমসাময়িক বা কাছের মানুষরা অধিকাংশই প্রয়াত, বা আশির ঊর্ধে । ওনার আর্কিটেক্ট কন্যা শান্তা দেবী এখন প্রতিষ্ঠানটি কর্ণধার। ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, থাকলে কিছু অজানা তথ্য জানতে চেষ্টা করতাম এই মহীরূহসম ব্যক্তিত্বের সম্বন্ধে। আজকের বেহাল পশ্চিমবঙ্গে শ খানেক সাধন দত্ত থাকলে রাজ্যের চেহারা অন্যরকম হত।পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২১ ফেব্রুয়ারি,২০২৩
ছবি সৌজন্য: StoreNorskeLeksikon, Wikimediaজন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।