Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

মুস্তারী বাঈয়ের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ

অভীক চট্টোপাধ্যায়

মার্চ ১৭, ২০২৩

Rabindranath and Mushtari Bai
Rabindranath and Mushtari Bai
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

প্রাচীনকাল থেকেই সারা ভারত সংগীতে জারিত। এ দেশের প্রকৃতি ও মানুষের অন্তরের প্রতি পরতে যেভাবে সুরের উপস্থিতি, তার তুলনা বিশ্বে বিরল। শাস্ত্রীয় সংগীতের অজস্র ঘরানার জন্ম হয়েছে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। যেমন, উত্তরভারতের দিল্লি, আগ্রা, পাঞ্জাব, এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, বেনারস ইত্যাদি আরও অনেক। এসব জায়গার ঘরে ঘরে শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চা চলেছে যুগ যুগ ধরে। জন্ম নিয়েছেন বহু শিল্পী। একই কথা প্রযোজ্য ভারতের অন‍্যান‍্য প্রান্তের ক্ষেত্রেও। এঁদের মধ্যে যেমন অনেকে প্রখ্যাত হয়েছেন, জ‍্যোতিষ্কস্বরূপ অনেকে জ্বলজ্বল করেছেন ভারতের সংগীতাকাশে, তেমনই বহু অসামান‍্য শিল্পী সেইভাবে প্রচারের আলো পাননি, হারিয়ে গেছেন অন্ধকারে।

এই শাস্ত্রীয় সংগীত জগতের একটা বড় অংশ জুড়ে আছেন বাঈজী সম্প্রদায়ের শিল্পীরা। যাঁদের মধ্যে অনেকেরই নাম আমাদের মনে চিরকালের আসন করে নিয়েছে। পাশাপাশি আবার বেশ কিছু প্রতিভাময়ী পাননি তাঁদের উপযুক্ত সমাদর, থেকে গেছেন আড়ালে। এরকমই একজন ছিলেন মুস্তারী বাঈ, যাঁর গানে একবার মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত! কীভাবে ঘটেছিল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা! সে কথায় আসতে গেলে, শুরু করতে হবে একটু আগে থেকে।

Mushtari Bai
মুস্তারী বাঈ

খানদানি উস্তাদি সংগীত ঘরানার অন‍্যতম শহর আগ্রা। অগুনতি কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পীর সুরমূর্ছনায় এখানকার আকাশ বাতাস ভরে থাকত একসময়। শহর থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম ফতিয়াপুর। সেই গ্রামেই থাকতেন মুস্তারী বাঈ। কোঠিতে আসা সংগীতপিপাসু বাবুদের গান শুনিয়ে কোনওমতে দিন গুজরান হত তাঁর। মুস্তারীর রূপের জৌলুশ তেমন ছিল না। তবুও বাবুরা তাঁর কাছে আসতেন অপরূপ সংগীতের টানে। নিজের সত্তায় যে সুর-সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন মুস্তারী, তার কাছে বহিরাবরণ হার মেনে যায়। তাঁর সংগীত যে স্তরের ছিল, সেই তুলনায় জনপ্রিয়তা তিনি প্রায় কিছুই পাননি। তার কারণ, তিনি ছিলেন শান্ত ও অন্তর্মুখী প্রকৃতির। প্রচার চাইতেন না। সংগীতকে আঁকড়ে নিভৃতচারিণী হয়ে থাকাই তাঁর পছন্দ ছিল। এছাড়া, তিনি বেশিদিন পৃথিবীতেও থাকেননি। মূলত অভাবের তাড়নায় তাঁকে ধরাধাম ছাড়তে হয়েছিল অকালে।

শহর থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম ফতিয়াপুর। সেই গ্রামেই থাকতেন মুস্তারী বাঈ। কোঠিতে আসা সংগীতপিপাসু বাবুদের গান শুনিয়ে কোনওমতে দিন গুজরান হত তাঁর। মুস্তারীর রূপের জৌলুশ তেমন ছিল না। তবুও বাবুরা তাঁর কাছে আসতেন অপরূপ সংগীতের টানে।

ফতিয়াপুর গ্রামেই থাকতেন সারেঙ্গি-শিল্পী উস্তাদ কবীর বক্স। এঁরই তালিমে বিকশিত হয়েছিলেন মুস্তারী বাঈ। গাইতেন মূলত খেয়াল। কিন্তু গায়নভঙ্গিতে থাকত না কোনওরকম অতিরিক্ত সুরের কালোয়াতি। প্রাধান্য পেত ভাবধর্মী স্নিগ্ধতা। রাগ-রাগিণীরা শুধুমাত্র ‘সরগম’-এর চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মনের আনন্দ ও আপন খেয়ালে ঝরে পড়ত তাঁর কণ্ঠ থেকে। তাঁর গান শুনে কবিগুরুর মুগ্ধ হবার ঘটনাটিই এরকম অনুমানের প্রধান কারণ। আসা যাক সেই প্রসঙ্গে।

একবারই কলকাতার সৌভাগ্য হয়েছিল মুস্তারীর গান শোনার। তখন বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের বাড়ির অঙ্গনে বসত সংগীতের আসর। যার মধ্যে অনেকগুলিই ছিল নামকরা। সেরকমই একটি ‘লালচাঁদ উৎসব’। প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লালচাঁদ বড়ালের স্মৃতিবাসর হিসেবে এই উৎসবের আয়োজন করতেন তাঁর তিন সংগীতগুণী পুত্র― কিষাণচাঁদ বড়াল (গঙ্গুবাবু), বিষাণচাঁদ বড়াল (জলুবাবু) ও রাইচাঁদ বড়াল (রাইবাবু)। উৎসবটির মেয়াদ মাত্র চার-পাঁচ বছরের, তবু ওরই মধ্যে এক অন‍্য উচ্চতায় উঠেছিল এর গরিমা। শুধু কলকাতা বা বাংলাই নয়, বড়াল ভাইয়েরা উত্তর ভারত ঘুরে, প্রত‍্যেক বছর নিয়ে আসতেন বিভিন্ন অখ‍্যাত প্রতিভাবান শিল্পীদের। সঙ্গে অবশ্যই থাকতেন প্রখ‍্যাতরাও। আসরের শিল্পী-সমাবেশ ছিল দেখার মতো। তিনদিনের এই উৎসবকে ঘিরে প্রতি বছর সাড়া পড়ে যেত কলকাতায়। শুরু হত সকাল থেকে, চলত দুপুর পর্যন্ত। তারপর কিছুক্ষণ বন্ধ থেকে সন্ধেবেলা আবার আরম্ভ হয়ে মধ‍্যরাত পার করে দিত।

Lalchand Baral
প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লালচাঁদ বড়ালের স্মৃতিবাসর হিসেবে এই উৎসবের আয়োজন

১৯৩১ সাল। সেবারের ‘লালচাঁদ উৎসব’-এ জলুবাবু নিয়ে এলেন মুস্তারীকে। কলকাতার সংগীতসমাজে সেসময় সম্পূর্ণ অপরিচিত এই শিল্পী। সবাই উদগ্রীব তাঁর গান শোনার জন‍্য। আসর সংগীতগুণী ও সমঝদারে পরিপূর্ণ। প্রথম সারিতে রয়েছেন― উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, উস্তাদ মুস্তাক হোসেন খাঁ, উস্তাদ আসফাক হোসেন খাঁ, উস্তাদ মজিদ খাঁ, পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী, উস্তাদ বসির খাঁ, সংগীতাচার্য গিরিজাশংকর চক্রবর্তী, সংগীতাচার্য জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, উস্তাদ এনায়েৎ খাঁ, সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে, কবি ও সংগীত-মনীষী কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ নক্ষত্র। এঁদের কেউ এসেছেন গাইতে বা বাজাতে, কেউ বা শুধুই শুনতে। এরকম রত্নখচিত সমাবেশে গাইতে বসলেন মুস্তারী বাঈ। সবাইকে প্রণাম করে শান্ত ও ধীর গলায় প্রথমেই ধরলেন পটদীপ। তাঁর অপূর্ব মিষ্টি কণ্ঠে পরিবেশিত পটদীপের মতো একটি করুণরসের রাগিণী আসরের রূপ মুহূর্তে বদলে দিল। সুরের কারিকুরি দেখানোর লেশমাত্র প্রবণতা নেই। শুধুই ভাবের ঝরনাধারা! এর পর শ্রোতাদের বুকে মুস্তারী ঢেলে দিলেন মালগুঞ্জির মতো আরেকটি বেদনার্ত রাগিণী। স্বর্গীয় সুরমূর্ছনায় আবিষ্ট হয়ে গেলেন সকলে!

আসর সংগীতগুণী ও সমঝদারে পরিপূর্ণ। প্রথম সারিতে রয়েছেন― উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, উস্তাদ মুস্তাক হোসেন খাঁ, উস্তাদ আসফাক হোসেন খাঁ, উস্তাদ মজিদ খাঁ, পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী, উস্তাদ বসির খাঁ, সংগীতাচার্য গিরিজাশংকর চক্রবর্তী, সংগীতাচার্য জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, উস্তাদ এনায়েৎ খাঁ, সংগীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে, কবি ও সংগীত-মনীষী কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ নক্ষত্র। এঁদের কেউ এসেছেন গাইতে বা বাজাতে, কেউ বা শুধুই শুনতে। এরকম রত্নখচিত সমাবেশে গাইতে বসলেন মুস্তারী বাঈ।

গান শেষ হল। সারা আসর স্তব্ধ। এবার গাইবেন ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’ উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ। তাঁকে অনুরোধ করা হল পরিবেশনের জন‍্যে। কিন্তু তিনি বললেন, “আজ আপনারা গাইতে বলবেন না।… এ গানের পর আজ আর কোনও গান দরকারই নেই। আমি অন্তত এ আসরে এখন গাইতে পারব না। আর কারও যদি সে হিম্মত থাকে, সে বসুক এসে আসরে।” কে বলছেন এ কথা! ভারতবিখ‍্যাত ফৈয়াজ খাঁ! উদ‍্যোক্তা থেকে শুরু করে আসরে উপস্থিত সবাই হতভম্ব! এর পর বাকি শিল্পীরাও বললেন একই কথা। কেউই আর গাইতে চান না। এরকম অপরূপ গানের পর আর গান হয় না। মুস্তারীর তো মাটিতে মিশে যাবার মতো অবস্থা। কী বলছেন এইসব মহান শিল্পীরা! তিনি এবার ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ফৈয়াজ খাঁ-র দুটো পা ধরে বললেন, “এ কী কথা বলছেন খাঁ সাহেব? আমার গানের জন্যে গাইবেন না আপনি?… আপনার কাছে আমি কী? আপনার তুল‍্য গুণী পথ দেখিয়েছেন, তাই আপনাদের আশীর্বাদে আমরা করে খাই। আপনি এমন করে বলবেন না।” মুস্তারীর মাথায় হাত দিয়ে উস্তাদজি বললেন,”…তোমার গান শুনে চোখের জল আমি আটকাতে পারিনি। এতক্ষণ শুধু কেঁদেছি। আমার গলা বসে গেছে কেঁদে কেঁদে। গান গাইব কী!” আরও বললেন, তাঁর মনে হয়, শুধু গায়করাই নন, যন্ত্রসংগীতশিল্পীরাও এরকম গানের পর আর কেউ বাজাতে চাইবেন না। ঠিক তাই-ই হল। বীণাশিল্পী উস্তাদ মজিদ খাঁ ও সেতারশিল্পী উস্তাদ এনায়েৎ খাঁ-ও একই কথা বললেন। তাঁরাও আর বাজাতে চান না। কারণ তাঁদের মতে, “সুর-সৃষ্টির চূড়ান্ত হয়ে গেছে আজ। এ আসরে আর কোনও গুণীর বাজাতে বা গাইতে মেজাজ বসতে পারে না।”

Mushtari bai

এইসব অত‍্যাশ্চর্য ব‍্যাপার যখন চলছে, তখন ঘটল সেরা অভাবনীয় ঘটনাটি। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, সেই সময় বড়াল-বাড়ির ছোটকর্তা সংগীতগুণী রাইচাঁদ বড়াল কলকাতা বেতারের সংগীতবিভাগে কর্মরত ছিলেন। সেই ১৯৩১ সালে, কলকাতা বেতারের বয়স চার বছর। রাইবাবুর উদ‍্যোগেই বলা যায়, ‘লালচাঁদ উৎসব’-এর সন্ধেবেলার পুরো আসরটি তিনদিন ধরে বেতারে সরাসরি সম্প্রচারিত হত। সেদিনও হচ্ছিল। মুস্তারীর গান শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বাড়ির ভেতর থেকে একজন এসে রাইবাবুকে বললেন, একটি ফোন এসেছে। তাঁকে চাইছেন। রাইবাবু ফোন ধরতেই ওপারের মানুষটি জানালেন তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে বলছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথা বলতে চান। ফোনের সংযোগে এলেন কবিগুরু। রাইবাবুকে বললেন,”কে এই দেবী? যিনি এখন তোমার ওখানে গান গাইলেন?” সব বললেন রাইচাঁদ। শুনে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া― “এ তো অপূর্ব কণ্ঠ! এমন গান বিশেষ শোনা যায় না। আমি অভিভূত হয়েছি এঁর গান শুনে। আর একদিন আমি ভালো করে শুনতে চাই, সামনে বসে। কীভাবে তা হতে পারে, একটু ব‍্যবস্থা কর।” তখন কবি ছিলেন কলকাতার বাড়িতে। সেখানেই রেডিও মারফত শুনেছিলেন মুস্তারীর গান। তারই ফলস্বরূপ ঐ ফোন।

আরও পড়ুন: মানবমিলনের প্রতীক কাজী নজরুল ইসলাম

রবীন্দ্রনাথের কথা শুনে বড়াল-বাড়িতে সাড়া পড়ে গেল। মুস্তারী কিছুদিন কলকাতায় থাকবেন। রবীন্দ্রনাথও এবার বেশ কয়েকদিনের জন‍্যে এসেছেন শহরে। রাইচাঁদ ও তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু, তখনকার একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হরিপদ চট্টোপাধ্যায় মিলে ঠিক করলেন এরই মধ্যে একদিন জোড়াসাঁকোয় গিয়ে কবিকে গান শোনাবেন মুস্তারী। এসব শুনে মুস্তারীর মনও উৎসাহে ভরে উঠেছে। প্রাণ দিয়ে অনুশীলন করে যাচ্ছেন। হঠাৎ রাইবাবু ও হরিপদবাবুর মাথায় খেলে গেল এক অভিনব ভাবনা। তাঁরা ভাবলেন, কবির সামনে মুস্তারী অন‍্যান‍্য গানের সঙ্গে যদি দুটো রবীন্দ্রসংগীতও পরিবেশন করেন, তাহলে দারুণ এক ব‍্যাপার হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দুজনেই লেগে পড়লেন তাঁকে রবীন্দ্রনাথের গান শেখাতে। গান ঠিক হল, কলাবতী রাগের “আজি দখিন দুয়ার খোলা…” এবং আড়ানা রাগে খেয়াল অঙ্গের “মন্দিরে মম কে আসিলে…”। গানদুটির অপূর্ব সুরবিন‍্যাসে পাগল হয়ে গেলেন মুস্তারী। ক্রমশ সুরের সঙ্গে যেন নাড়ির সংযোগ হতে লাগল। তাঁর মতো অসামান্য প্রতিভাময়ীর কাছে গানের সুর-তাল-লয় আয়ত্তে আসতে আর কতটুকু সময় লাগবে? কিন্তু কথা? রাইবাবু ও হরিপদবাবুর কাছে আত্মমগ্ন হয়ে এবার বাণীর অর্থ ও মর্ম বুঝতে লাগলেন মুস্তারী। বুঝছেন আর অনুভূতিতে মিশিয়ে নিচ্ছেন। কী আকুল সুরসাধনা! অবশেষে সর্ব অর্থে গানদুটি মিশে গেল তাঁর সত্তায়। এবার আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

হঠাৎ রাইবাবু ও হরিপদবাবুর মাথায় খেলে গেল এক অভিনব ভাবনা। তাঁরা ভাবলেন, কবির সামনে মুস্তারী অন‍্যান‍্য গানের সঙ্গে যদি দুটো রবীন্দ্রসংগীতও পরিবেশন করেন, তাহলে দারুণ এক ব‍্যাপার হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। দুজনেই লেগে পড়লেন তাঁকে রবীন্দ্রনাথের গান শেখাতে। গান ঠিক হল, কলাবতী রাগের “আজি দখিন দুয়ার খোলা…” এবং আড়ানা রাগে খেয়াল অঙ্গের “মন্দিরে মম কে আসিলে…”। গানদুটির অপূর্ব সুরবিন‍্যাসে পাগল হয়ে গেলেন মুস্তারী।

কিন্তু এল না… অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসে গান শোনানো হল না মুস্তারীর। কারণ, হঠাৎ একটা কাজে কবিকে চলে যেতে হল শান্তিনিকেতনে। সেখানে গিয়ে তো আর শোনানো সম্ভব নয়। খুবই হতাশ হলেন মুস্তারী। একই অবস্থা রাইবাবু, হরিপদবাবুরও। পরক্ষণেই তাঁরা ভাবলেন এই অভিনব উপস্থাপন কলকাতার মানুষ শুনতে পাবেন না? তা কি হয়? এদিকে, মুস্তারীর আগ্রা ফিরে যাওয়ার সময়ও ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তাই তড়িঘড়ি তাঁর একটি একক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল স্টার থিয়েটারে।

Rabindranath Tagore

স্টার-এ সেদিন তিলধারণের জায়গা নেই। ততদিনে মুস্তারীর গানের কথা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতায়। বহু মানুষ আগ্রহী তাঁর গান শোনার জন‍্যে। ফলে, বিখ‍্যাত থেকে অখ‍্যাত সংগীতপিপাসুতে ভরে উঠেছে প্রেক্ষাগৃহ। সামনে বসে রয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে ও কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু, রাইবাবু আর হরিপদবাবু ছাড়া আর কেউ জানেন না, এই আসরে অন‍্যান‍্য গানের সঙ্গে মুস্তারী রবীন্দ্রসংগীতও গাইবেন। প্রথমে কয়েকটি খেয়াল গেয়ে মুস্তারী ধরলেন, “আজি দখিন দুয়ার খোলা…” এবং তার পরেই “মন্দিরে মম কে আসিলে…”। শ্রোতারা একইসঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্ময়ে হতবাক! বাংলা উচ্চারণে সামান্য খামতি থাকলেও, অপূর্ব পরিবেশনে ঢাকা পড়ে গেল সব। রবীন্দ্রনাথের গানকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিশিয়ে যেন এক অপরূপ অন্তর-সংগীত সেদিন নিবেদন করেছিলেন মুস্তারী বাঈ। এখানেই প্রমাণ হয়, এরকম মাপের শিল্পীদের কাছে প্রথামাফিক শিক্ষা বা ভাষা, কোনওকিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

সেদিন উপস্থিত সবাই একটা কথাই ভাবছিলেন। এতদিন কোথায় ছিলেন এই কিন্নরী? সেদিন দর্শকাসনে ছিলেন কলকাতার অনেক নামকরা বাঈজীরাও। মুস্তারীর গান শুনে তাঁরা যেমন মুগ্ধ, তেমনই আবার আশঙ্কিতও। কারণ, মুস্তারী পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়লে তো তাঁদের অনেকের গানই ম্লান হয়ে যাবে!

ততদিনে মুস্তারীর গানের কথা ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতায়। বহু মানুষ আগ্রহী তাঁর গান শোনার জন‍্যে। ফলে, বিখ‍্যাত থেকে অখ‍্যাত সংগীতপিপাসুতে ভরে উঠেছে প্রেক্ষাগৃহ। সামনে বসে রয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে ও কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু, রাইবাবু আর হরিপদবাবু ছাড়া আর কেউ জানেন না, এই আসরে অন‍্যান‍্য গানের সঙ্গে মুস্তারী রবীন্দ্রসংগীতও গাইবেন। প্রথমে কয়েকটি খেয়াল গেয়ে মুস্তারী ধরলেন, “আজি দখিন দুয়ার খোলা…” এবং তার পরেই “মন্দিরে মম কে আসিলে…”। শ্রোতারা একইসঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্ময়ে হতবাক!

কিন্তু, তা ঘটেনি। মুস্তারী বাঈ ফিরে গেলেন আগ্রায়। তাঁর আফশোস রয়ে গেল, কবিগুরুকে গান শোনানো হল না বলে। ফিরে গেলেও কলকাতার সংগীতমহল তাঁকে ভুলতে পারেনি। এর বছর দুয়েক পর, ‘লালচাঁদ উৎসব’-এ আবারও মুস্তারীকে আনার চেষ্টা করা হয়। সেইমতো আমন্ত্রণের চিঠি যায়। কয়েকদিনের মধ‍্যেই এর প্রত‍্যুত্তরে মুস্তারীর কোঠি থেকে একটা টেলিগ্রাম আসে। তা থেকে জানা গেল, মুস্তারী বাঈ আর ইহলোকে নেই। টিবি-তে আক্রান্ত হয়ে তাঁর প্রয়াণ ঘটেছে। এর পর আর কী কিছু বলার থাকে! বোঝাই যাচ্ছে, এই সুরলোকবাসিনীকে দারিদ্র‍্যের শিকার হয়ে, অপুষ্টিজনিত কারণে যক্ষ্মার আঘাতে অকালে চলে যেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সহ বিরাট মাপের সংগীতগুণীরা যাঁর গান একবার শুনেই উদ্বেলিত হয়েছিলেন, তাঁর জীবনের এরকম মর্মান্তিক পরিণতি কি মেনে নেওয়া যায়? ভারতীয় সংগীতে এ ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি।

শেষে আসে কিছু ব‍্যক্তিগত অনুমান। রেডিয়োতে মুস্তারীর গান শুনে রবীন্দ্রনাথ ফোনে রাইচাঁদকে তাঁর কথার এক জায়গায় বলেছিলেন, “এমন গান বিশেষ শোনা যায় না।” এটা কি শুধু প্রশংসার আবেগে বলা একটি বাক‍্য? তেমনটা মনে হয় না। কারণ, এর বহু বছর আগে, ১৮৮১ সালের ১৯ এপ্রিল বেথুন সোসাইটিতে তাঁর দেওয়া ‘সঙ্গীত ও ভাব’ শীর্ষক ভাষণের এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমাদের সঙ্গীত যখন জীবন্ত ছিল, তখন ভাবের প্রতি যেরূপ মনোযোগ দেওয়া হইত, যখন আমাদের রাগরাগিণীর বিভিন্ন ভাবব‍্যঞ্জক চিত্র পর্যন্ত ছিল, তখন স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, আমাদের দেশে রাগরাগিণী ভাবের সেবাতেই নিযুক্ত ছিল। সে দিন গিয়াছে। কিন্তু আবার কি আসিবে না?” এ থেকে মনে হয়, সেদিন মুস্তারীর কণ্ঠে রাগের ভাবধর্মী প্রকাশ শুনে কবি তাঁর সংগীতভাবনারই রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন। যুগের নিরিখে যা ছিল তাঁর কাছে অপ্রত‍্যাশিত। তাই হয়তো বলেছিলেন, “এমন গান বিশেষ শোনা যায় না।”
সংগীতাকাশ থেকে খসে পড়া এই মাপের সুরপ্রতিমাকে যেভাবে অকালে চলে যেতে হল, তা ভাবলে লজ্জা, যন্ত্রণা, আফশোস― সব একসঙ্গে এসে আছড়ে পড়ে হৃদয়ে।

 

 

 

 

তথ‍্যঋণ :

১) সঙ্গীতের আসরে― দিলীপকুমার মুখোপাধ‍্যায়
২) রবীন্দ্র রচনাবলী ১৪ খণ্ড(শতবার্ষিকী সংস্করণ)

 

ছবি সৌজন্য: Encyclopedia Britannica

Author Avik Chattopadhyay

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

Picture of অভীক চট্টোপাধ্যায়

অভীক চট্টোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।
Picture of অভীক চট্টোপাধ্যায়

অভীক চট্টোপাধ্যায়

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

2 Responses

  1. বেশ তথ্যবহুল ও মনোজ্ঞ বর্ণন। লেখককে অভিনন্দন অনেক ধন্যবাদ। একটা ছোট্ট অনুরোধ করছি – মুস্তারী বাঈয়ের কোনও রেকর্ড পাওয়া গেলে তা বাংলা লাইভে আপলোড করা সম্ভব কি? এই নিবন্ধটি পড়ে কৌতূহল দমন করতে পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com