দেখতে দেখতে এসে পড়ল বাঙালির জাতীয় উৎসব দুর্গা পুজো। বছরভর সমস্ত বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে এই কয়েকটা দিনের জন্য। আজও জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে হাতে ক্যালেন্ডার পেলেই সবার আগে চোখ চলে যায় নীচের দিকে, সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসের কোন কোন দিনগুলোয় একটানা টানা লাল তারিখ! পুজো শব্দের ম্যাজিক এইখানটাতেই। পুজো নিয়ে আমার ছোটবেলার নানা স্মৃতি আর আমার কল্পনায় রপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দেবীর আদল কয়েকটি ফুড আর্টের (Food Art) মাধ্যমে তুলে ধরলাম এই লেখায়।
আরও পড়ুন- ফুড আর্ট: ছিল প্লেট, হয়ে গেল প্যালেট
ছোটবেলায় পুজোর আনন্দ ছিল সব চেয়ে বেশি,অন্তত আমার। সেই জয়বাবা ফেলুনাথের রুকুর মতো আনন্দ। না, বাড়িতে পুজো হত না, তো কি, পাড়ায় পাড়ায় সার্বজনীন দুর্গোৎসব তো চলছে। এদিকে স্কুল থেকে ফিরে আমার নাচ প্র্যাক্টিস চলছে পুরোদমে। বিজয়ার অনুষ্ঠানে নাচতে হবে না! পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলা এসে গেছে। নতুন জামা কাপড় কেনা হয়ে গেছে। বড়দের দেশ, আনন্দবাজার সব এসে পড়েছে। মামাবাড়ির গাছের নারকেল পাড়া হয়ে গেছে, আশপাশের কাকিমাদের রোদে আলমারি ভরা শাড়ি রোদে মেলা হয়ে গেছে। দুহাত ভরে সবার জন্য পুজোর উপহার কেনা শেষ হতে না হতেই ঢ্যাং কুড় কুড় করে ঢাকের বাদ্যি বেজে গেছে। হ্যালো টেস্টিং করে পাড়ায় পাড়ায় মাইক বসে গেছে। ‘আর কত রাত একা থাকব’ থেকে ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’, ‘দালের মেহেন্দি থেকে আর ডির ‘তুমি কত দূরে’, ইন্দ্রাণী সেন থেকে ইন্দ্রনীল, শ্রীকান্ত আচার্য থেকে লোপামুদ্রা সকলের সব গান একসাথে বাজছে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একটুও বিরক্ত লাগছে না। কারণ তখন আমাদের কাছে ঐটাই পুজো।

কলকাতা তখনও ফ্ল্যাটবাড়ির জাল বিস্তার করেনি চতুর্দিকের শহরতলিতে। থাবা বসায়নি পুকুর বুজিয়ে পাঁচতলার কংক্রিট। সাড়া দেয়নি কেউ পাঁচ কাটা জমিতে ৫০ ঘর আবাসন থাকার হাতছানিতে। তখন যার যেমন কম-বেশি জমি হোক, একতলা বা দোতলা লাল মেঝে বা মোজাইক মেঝে, সামনে একটা বারান্দা, দুটো চারটে টগর, জবা, সুপুরি গাছ থাকতই, পিছনে একচিলতে জমিতে কাঁচা লংকা, বেগুন বা একটা কুমড়োর মাচা। একটু বেশি জমি থাকলে বাড়ির সামনে স্থলপদ্ম, শিউলি, ঝুমকোলতা, স্বর্ণচাঁপা, কামিনী, গন্ধরাজ আর পিছন দিকে দুটো নারকেল গাছ, বাতাবি লেবু গাছ, আম, কাঁঠাল গাছ থাকতই।

শহরতলির শান্ত পাড়ায় ঘুম থেকে উঠে পরা মহালয়ার দিন রাতভোরে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে, অবশ্য আমার সেসবের দরকার পড়ত না। এমনিই জেগে থাকতাম মহা উত্তেজনায়— মা দুগ্গা আসছে। স্কুল ছুটির আসন্ন আনন্দে আর নতুন জামার গন্ধ শুঁকে বিভোর হয়ে থাকতাম মোটামুটি বেশ কয়েকদিন। মা তন্তুজ আর বোম্বে ডাইং-এর বিজ্ঞাপনের পাতায় নজর রাখত। আর দৈনিক খবরের কাগজের পাতা জুড়ে জুতোর বিজ্ঞাপন দেখে মনে মনে ঠিক করে নেওয়া জুতোর ডিজাইন, আহা সেসব দিন আর ফিরবে না। মহালয়ার ভোরে রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই গলা বা দূরদর্শনে মহিষাসুমর্দিনী যেন কখনোই পুরনো হত না। সেদিন আমার অ্যালার্ম দেওয়ার প্রয়োজন হত না।

আশ্বিন মাসে সকালবেলায় উঠে যখন পড়তে বসতাম বাতাসে একটা ঠান্ডার আমেজ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ, তখন দেখতাম সামনের বাড়ির জেঠিমার উঠোনের সামনে শিউলি পড়ে থাকত। দুই হাতের অঞ্জলি ভরে ফুল নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘরে নিয়ে এসে পড়ার টেবিলে কাচের বাটিতে এক আঁজলা জলের মধ্যে রেখে দিতাম। একটা করে জ্যামিতির সম্পাদ্য আর একটু শিউলির সুবাস, একপাতা ভাব সম্প্রসারণ আর এক জানলা নীল আকাশ, একটু অ্যাডিশানাল বায়োলজি আর এক ঝলক দেখে নেওয়া খাটের নীচে নীল সাদা জুতোর বাক্স, একটু বোরিং ইতিহাস বইয়ের পাতা আর অনেকটা ছুটির আনন্দ — সব মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকত। সেই সব দিন বোধহয় আর আসবে না ফিরে। মাঝখান থেকে ফাঁকতালে শিউলির বোঁটার কমলা রং দিয়ে রাফখাতার পিছনে হাবিজাবি আঁকিবুকির ডুডল, গ্র্যাফিটি। যা যায়,তা যায় চিরকালের মতো। সেসব ম্যাজিক দিন তো আর কিছুতেই ফিরবে না।

আমি আবার একটু টম বয় গোছেরও ছিলাম। পাড়ায় প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ল কি পড়ল না, আমার আনন্দ আর ধরে না। স্কুল থেকে ফিরতাম সেসব বাঁশবাঁধা দেখতে দেখতে। কারণ, অষ্টমীর দিন বাবার সঙ্গে কলকাতায় রোদে ঘুরে ঘুরে সাউথের ঠাকুর দেখতে হবে তো! রাত্রে শুধু কলেজস্কোয়্যার, মহম্মদ আলি পার্ক, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার আর শিয়ালদহ অ্যাথলেটিক। বাবার ওই একদিনই ছুটি থাকত আর দশমীর দিন। ক্যাপ বন্দুক এসব আমি জিন্সের স্কার্টের পকেটে নিয়ে ঘুরতাম মাধ্যমিক অবধি। মাঝেমধ্যে ক্যাপের বারুদ-রিল রোদে দিতাম যাতে ফটফট করে সবকটা ফাটে। পঞ্চমী থেকে শুরু হত আমার নতুন জামা পরা। কবে কোনটা পরব তার রুটিনও ঠিক হয়ে যেত আগে থেকেই। পাড়ার বন্ধুরা মিলে পাশের পাড়াগুলোর ঠাকুর দেখতে পারব এই অনুমতি পেয়ে গেছি ততদিনে, আর চিন্তা নেই বড় হয়ে গেছি এমন ভাব।

অষ্টমীর দিন চুলে হেয়ার অ্যান্ড কেয়ার তেল মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে শ্যাম্পু করে দিত মা। নতুন জামা পরে মাথায় ছোট ছোট চুলে নতুন হেয়ার ব্যান্ড পরে পাড়ার মণ্ডপে অঞ্জলি। সামনে এত এত চেয়ারে ভিড় করে পাড়ার ছেলেমেয়েদের আড্ডা। পুজোর চার দিন পাড়ার কাকিমা জেঠিমাদের নিষ্ঠাভরে ঠাকুরের কাজ, ঠাকুরমশাইকে হাতে হাতে সব এগিয়ে দেওয়া— এসব দেখতাম প্রাণভরে আর মাঝেমধ্যে ফল প্রসাদ পেতাম ধূপ, ধুনো, মায়ের আশীর্বাদমাখা।
আমি ছোট থেকেই খুব শান্ত ছিলাম। যখন বেলা বাড়লে আড্ডা গল্প ছেড়ে সবাই স্নান খাওয়ার জন্য বাড়ির দিকে পা বাড়াতো, আমি চুপচাপ ফাঁকা মণ্ডপে মায়ের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে দেখতাম, যেন কথা বলছে। জানি না কেন মনে হত মা বলছে, দুদিন হয়ে গেল আর মাত্র তিনদিন। চোখ ছলছল করত আমার অষ্টমীর পর থেকেই। রোজ যে ফুলের লম্বা লম্বা মালা পরানো হত সব কিছু খুব মন দিয়ে দেখতাম। ভাবতাম এত সর্বাঙ্গসুন্দর কেউ কী করে হয়! এত বিশালাক্ষী, এত সুন্দর কোঁকড়ানো চুল, এমন সুন্দর মুখশ্রী, এমন নিটোল গড়ন, এমন সুন্দর সব কিছু কী করে হয়!

বাড়ি ফিরে খাতায় ছবি এঁকে ফেলতাম প্রতি বছর। তার দশ হাত, নীচে সিংহ, হাতে কত অস্ত্র! কত শক্তিশালী উমা, তবু সে তো আমাদেরই ঘরের মেয়ে। ঈশ্বরদের সকলের কল্পনায় তৈরি তার রূপ, শক্তি পেয়েছে সকল সুরের আশীর্বাদে অসুরকে পরাজিত করতে। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনই তার কাজ। তবেই তো ভালোর জয়, মানবিকতার জয়, ন্যায়ের জয়।
সব শুভত্বের প্রতিনিধি উমা। তাই মহাধুমধামে শুধু দুগ্গা পুজোর পাঁচদিনই নয়, সারা বছর সব উমারা সসম্মানে, আদরে, ভালোবাসায় থাকুক নিজ গৃহে বা স্বামীগৃহে— ফুড আর্টের (Food Art) মাধ্যমে মায়ের প্রতি নিবেদন রইল এটুকুই। সকলের যেন অন্ন বস্ত্র জোটে। মাথা উচুঁ করে সব মেয়েরা যেন বাঁচার সমান অধিকার পায়।সামাজিক অসম্মানের উত্তর যেন তারা নিজ নিজ কাজে দিতে পারে। মা দুগ্গা যেন এই আশীর্বাদটুকু করেন আর সকল দুর্গতিনাশ করে প্রাণভরে যেন আদর করে দেন সবাইকে।
* ফুড আর্ট ও তার ছবি সৌজন্য- লেখক
আঁকা, ফুড আর্ট ও রান্নাবান্না সৌমীর প্যাশন। গাছপালা, প্রকৃতি ভালোবাসেন। যেকোনও সৃজনশীল কাজে আনন্দ পান। বিজ্ঞাপণ ও বিপণন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করেন।