আগের পর্বে শ্রী নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট ছোটবেলার প্রিয় কার্টুন চরিত্রগুলো নিয়ে এসেছিলাম ফুড আর্টের (Food Art) মাধ্যমে।
আজ পাঠকদের জন্য রইল টিনটিন সিরিজের প্রায় সমস্ত উল্লেখযোগ্য চরিত্রদের নিয়ে স্মৃতিকথা— আ ট্রিবিউট টু হার্জ।
টিনটিন
আসছে সে আসছে…
গানটার মধ্যে কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার আছে, তাই না! তেমনই এই গানটা এই ফুড আর্টের সঙ্গেও বেশ যুতসই। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কার কথা বলছি… আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। তাদের কথাই হচ্ছে, যারা ছোটবেলায় চকচকে মোটা কাগজের রঙিন ছবিভর্তি এই এত্তোবড় সাইজের বইটা পেলে আহ্লাদে আটখানা থুড়ি চব্বিশ-খানা হতেন আমার মতো।
বেলজিয়ামের লেখক হার্জ যখন এই প্রোটাগনিস্ট রিপোর্টার তথা ডিটেকটিভ চরিত্রটি সৃষ্টি করেন তখন তার মধ্যে দিয়ে ছোটবেলায় অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যান।
মেধাবী, বুদ্ধিমান, সৎ, সাহসী, নির্লোভ, দয়ালু, ইন্টেলিজেন্ট, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় সাংবাদিক তথা গোয়েন্দা টিনটিন (Tintin)। তার নানা বিষয়ে অন্বেষণের ইচ্ছে, কখনও অন্যায়ের মুখোমুখি হয়ে লড়বার উদ্যম, কখনও অজানাকে জানার আগ্রহ তাকে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ঘুরিয়েছে… এমনকি তার পা পড়েছে চাঁদেও।
এই বইটির বাংলা অনুবাদ বেরোত আনন্দ পাবলিশার্স থেকে, অনুবাদ করতেন খ্যাতনামা কবি শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আমি ছোট থেকেই টিনটিন পড়ার ব্যাপারে পাগল ছিলাম। বাংলা ইংরেজি দুটো ভাষাতেই পড়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বলছি বাংলায় পড়ে আলাদাই মজা পেতাম, একেবারে অন্যরকম সুখ। প্রত্যেকটা রঙিন ছবি মন জুড়ে থাকত। স্কুলের গরমের ছুটিতে সেসব ছবি আঁকতাম আর রং করতাম। আজও যেন প্রত্যেকটা ছবি-গল্প মনে গেঁথে আছে।
আজ থাকল পুরো টিনটিন সিরিজের প্রায় সব মুখ্য চরিত্রগুলো আমার ফুড আর্টের মাধ্যমে।
প্রথমেই রইল টিনটিন ও তার অবিচ্ছেদ্য চিরসঙ্গী কুট্টুস মানে স্নোয়ি।
এটা তৈরি করেছি মশলা পাঁপড় দিয়ে; সঙ্গে নুন, কালোজিরে দিয়ে স্নোয়ি। (Food art)
ঠিক এরকম একটা ছবি টিনটিনের বইয়ের কভার পেজ ছিল।

ক্যাপ্টেন হ্যাডক
“টিনটিন টিভির আওয়াজটা কমাও তো… কাল রাত্রে হলের পার্টিতে বিয়াঙ্কার ওই বিটকেল তারস্বরে গান কানটা একেবারে ঝালাপালা করে দিয়েছে, কানে এখনও তালা। তার ওপর বড়দিনের আনন্দে গোলাপ এনে হাজির করেছে।
ধুত্তরি! কোথায় একটু ভালোমন্দ খাবো তা না, ওদিকে তো নেস্টর একগাদা গ্লাস নিয়ে ভেলকি দেখাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ল আর আমার সব আশায় জল ঢাললো। এদিকে রাত্রে ঘরে ফিরে কোটের পকেটে হাত দিয়ে দেখি সেটি নেই। এদিকে যদ্দুর মনে পড়ছে, হলে মাত্র পাঁচ ঢোঁক খাওয়ার পরও ওটা ভর্তি ছিল বুঝলে! কে খেল কে জানে, কিছু মনে পড়ছিল না।
শেষে অত রাত্রে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তোমার সাইকেল নিয়ে গেলাম দোকানে। সে ব্যাটাগুলো বলে কিনা সব শেষ! যত্ত সব উল্লুক বেল্লিকগুলো মনে হয় আগেই সব সাঁটিয়ে দিয়েছে, কিছুই পড়ে নেই। আজকাল তো আবার বড়দিনে সবাই সেসবে ফল-টল চুবিয়ে কেক বানায়। কেউ কম যাচ্ছে না, দোকান পুরো হাওয়া করে দিয়েছে। এদিকে আমায় কেউ এক পিস কেকও দেয় না! হুহ,তাতে আমার ভারী বয়ে গেল। আমি সারারাত পায়চারি করে আর ক্যালকুলাস সারারাত বই পড়ে রাতটা কাটিয়ে দিলাম।”
এই ভাবনাটা কাল্পনিক, আমার স্বরচিত।
ক্যাপ্টেন হ্যাডককে বানিয়েছি বেগুন, আলু, চাল, (অপরাজিতা ফুল রং দিয়ে ও কিছু ফুড কালার) কলোজিরে ইত্যাদি দিয়ে। (Food art)

বিয়াঙ্কা
সকাল সকাল বাড়ির কাচের জানলা-দরজাগুলো খুলে রাখুন। ফাইন গ্লাসের সেট, ক্রকারি সব খড়ের মধ্যে পুরে বাক্সবন্দি করে খাটের নীচে বা ছাদের ওপর রেখে আসুন। পারলে চশমাটা অবধি খাপে পুরে রেখে দিন যত্নে। কারণ বিখ্যাত Milanese নাইটিঙ্গেল অপেরা সিঙ্গার Bianca Castafiore উচ্চস্বরে, বলা ভালো তারস্বরে তার jewel song দিয়ে সবকিছু এবং আপনার কানটাও ঝালাপালা করতে চলে এসেছেন। তাঁর গানের গুঁতো আবার যারপরনাই বৃদ্ধি পায় টিনটিনের সঙ্গী ক্যাপ্টেন হ্যাডককে দূর থেকে দেখলেই।
আপনারা বরং কান-মাথা চাদর কম্বল দিয়ে ঢেকে ফেলুন।
ছোটবেলার স্মৃতি বিজড়িত টিনটিন সিরিজ-এর অন্যতম কমিকাল নারী চরিত্র বিয়াঙ্কা কাস্টাফিওরেকে নিয়ে এলাম আমার ফুড আর্ট।
বিয়াঙ্কাকে বানিয়েছি আলু, বাঁধাকপি, বিট, বিটের রস, টমেটো, টুটি ফ্রুটি এবং পেঁপে দিয়ে। (Food art)

প্রফেসর ক্যালকুলাস
টিনটিন সিরিজের অন্যতম কমিকাল চরিত্র ফিজিক্সের তিনটি বিষয়ে পি এইচ ডি করা মানবকল্যাণে একটির পর একটি উদ্ভাবনী বস্তুর আবিষ্কর্তা এই সদাভাবুক, অন্যমনস্ক, হাতে পেন্ডুলাম, মাথায় টুপি ব্যক্তিটি। বায়োলজি, কেমিস্ট্রি, আর্কিওলজি, অ্যাস্ট্রোনমি ও সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয়ে অসাধারণ দখল তাঁর। সীমাহীন হাস্যরসের function, had এবং mad- এর differentiation না বোঝা কানে খাটো, কাজে আধপাগল মানুষটি টিনটিনের প্রায় সব অভিযানে ও বিপদে পাশে থেকে integration কী তা ভালোভাবে বুঝিয়েছেন। হাঙর শেপের সাবমেরিন থেকে চন্দ্রযানের খুঁটিনাটি যার আয়ত্তে। মানবকল্যাণে ও ব্যবহারিক জীবনে সায়েন্সের অপরিহার্য্য ভূমিকা নিয়ে তাঁর মাথা খাটানো, ক্যাপ্টেন আর বিয়াঙ্কার সঙ্গে তাঁর মজার chemistry, যা গল্পের টানটান উত্তেজনার মধ্যেও বেদম হাসায়। যাকে ছাড়া টিনটিন সিরিজের চরম সুখ্যাতির probability হয়তো থাকত না, কারণ প্রত্যেকটা চরিত্রের নিজস্ব গুরুত্ব ও মহিমা আছে।
সমস্ত টিনটিন-প্রেমীদের বড়ই প্রিয় অন্যমনস্ক প্রফেসর ক্যালকুলাসও রইলেন বগলে ছাতা আর হাতে পেন্ডুলাম নিয়ে।
প্রফেসরকে বানিয়েছি পেঁপে, আলু, কলোজিরে, বিটের রস এবং নুন দিয়ে। (Food art)

মানিকজোড় বা থমসন অ্যান্ড থম্পসন
টিনটিন সিরিজের সবথেকে মজাদার চরিত্র এই মানিকজোড়। বাকি সব চরিত্রগুলোর বাংলা অনুবাদে একই নাম রাখা হয়েছিল। কেবল যমজ Thomson and Thompson-দের নাম দেওয়া হয় ‘মানিকজোড়’।
এদের বিশেষত্ব ছিল এরা একসঙ্গে আঠার মতো পাশাপাশি চলত, ফলে একজন ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেলে আরেকজনও খেত। সিঁড়ি থেকে নামতে গেলে দুজনে একসঙ্গে সিঁড়ি মিস করে আছাড় খেয়ে পড়ত, দুজনের লাঠি একসাথে উড়ে যেত— মানে যতরকম বিপত্তি আছে সব যেন এদের কপালে। পাঠকের হাসতে হাসতে পেট ফেটে যেত এদের যুগল উদ্ভট কার্যকলাপ দেখে।
আমি ‘মানিকজোড়’-কে বানিয়েছি বেগুন, আলু, গাজর, বিটের রস ও কালোজিরে দিয়ে।

পরিশেষে বলি, টিনটিন আমি আজও পড়ি। মন খারাপ থাকলেও পড়ি, কারণ যে নির্মল আনন্দ হাস্যরস আর বুদ্ধিমত্তার মিশেলে এইসব অভিযানমূলক গোয়েন্দা গল্প লেখা হয়েছিল ও আঁকা হয়েছিল আজও তার পরিপূরক নেই। সাধে কি আর আমাদের ছোটবেলা এত সুন্দর ছিল!
*ফুড আর্টের ছবি: সৌমী সরকার
আঁকা, ফুড আর্ট ও রান্নাবান্না সৌমীর প্যাশন। গাছপালা, প্রকৃতি ভালোবাসেন। যেকোনও সৃজনশীল কাজে আনন্দ পান। বিজ্ঞাপণ ও বিপণন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করেন।
One Response
অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। এরকম আরো অনেক চরিত্র প্রাণ পাক তোমার ফুড আর্টের ছোঁয়ায়।