বর্ষা হোক বা না হোক, খিচুড়ি (Khichdi) খাওয়া যেতেই পারে যে কোনওদিন, যে কোনও সময়। আম্মা কখনও কখনও সকালের নাশতায় খিচুড়ি রাঁধতেন। পাতলা খিচুড়ি, যাকে কলকাতার মানুষ বলেন, ‘ল্যাটকা’। এই খিচুড়ি (Khichdi) রান্নায় কোনও বিশেষত্ব নেই, নেই কোনও তরিবত। আতপ চাল আর মুগ বা মুসুর ডাল মিশিয়ে এক হাঁড়ি পানি দিয়ে বসিয়ে দাও, সঙ্গে নুন-হলুদ। ইচ্ছে হলে দুইখান তেজপাতা। এই তেজপাতা দিলেও হয়, না দিলেও ক্ষতি নেই। চালেডালে ফুটে, জ্বাল হয়ে আপনা থেকেই তোয়ের হয় এই খিচুড়ি (Khichdi)। চালডাল আধসেদ্ধ হয়ে এলে একটু আদাবাটা যা কিনা দিলেও হয়। না দিলেও ক্ষতি নেই।
গরম খিচুড়ি ঠান্ডা করার জন্য হাতে করে থালা একটু ঘুরিয়ে নিতাম, যাতে করে স্যুপ প্লেটের কানায় খিচুড়ির একটা পরত পড়ত। খিচুড়ির সেই পরতকে আঙুলে করে তুলে খেতাম। এভাবেই বারে বারে থালা ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়া হত খিচুড়ি।
খিচুড়ি হয়ে এলে তেল বা ঘিতে পেঁয়াজ ভেজে বাগাড় দিতেন আম্মা। তবে সেও যে খুব করে ঘি বা পেঁয়াজ পড়ত, তা নয়। এই বাগাড় হত নামমাত্র। একেবারেই না দিলেই নয় বলে দেওয়া। ঢলঢলে খিচুড়ি থালায় বেড়ে দিতেন আম্মা, উপরে ছড়িয়ে দিতেন খানিকটা গাওয়া ঘি। এইটুকু স্পেশাল। চিনেমাটির যে থালায় আম্মা খিচুড়ি বাড়তেন, সেই থালাকে পরে আমরা চিনতে পারব স্যুপ প্লেট বলে। চওড়া কানার অগভীর এক বোলের মতো দেখতে সেই থালা।
আরও পড়ুন:হালিম খেয়ে জালিম হল দুনিয়া
গরম খিচুড়ি ঠান্ডা করার জন্য হাতে করে থালা একটু ঘুরিয়ে নিতাম, যাতে করে স্যুপ প্লেটের কানায় খিচুড়ির একটা পরত পড়ত। খিচুড়ির সেই পরতকে আঙুলে করে তুলে খেতাম। এভাবেই বারে বারে থালা ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খাওয়া হত খিচুড়ি। আর হ্যাঁ। এই খিচুড়ি খেতে কোনও ভাজাভুজো লাগত না আমাদের। উপরে ঘি ছড়িয়ে এমনি এমনিই খেতাম সেই খিচুড়ি। নিজেদের খেতের চালের সেই খিচুড়িতে সোঁদা গন্ধ থাকত একটা। তাতে মিশত ভাজা পেঁয়াজ আর গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ। নির্ভেজাল সেই চাল আর ডালে আঠাল হত সেই খিচুড়ি। স্বাদের কথা কী কব! অমৃতের তুলনা হতে পারে সেই স্বাদের সঙ্গে।

আম্মার হাতের আর এক মাস্টারপিস ছিল ভুনা খিচুড়ি। বাড়িতে মেহমান এলে বা ঈদে-চাঁদে অথবা কোনও বিশেষ দিনে সকালের নাশতায় আম্মা করতেন এই খিচুড়ি। পরে আমার চাচি-ফুফুদেরকেও এই ভুনা রান্না করতে দেখেছি। এই ভুনা খিচুড়ি আম্মা করতেন যথেষ্ট তরিবতের সঙ্গে। খাসা বা চিনিগুঁড়া চালে মুগ বা মুসুর ডাল। ঘিয়ে ভাজা পেঁয়াজে ভুনা হত চালডাল। তেজপাতা, নুন-হলুদ আর আদাবাটায় ঝুরঝুরে করে ভুনতে হয় চালডাল। মাপমতো গরম জল দিয়ে ঢেকে রাখতে হয় যতক্ষণ না টগবগ করে ফুটে ওঠে খিচুড়ি। জলে টান ধরলে গ্যাস ধিমে করে দমে দিয়ে দিতে হয় হাঁড়ি।

ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে দু-তিন পদের ভাজা, মাছের আয়োজন করতেন আম্মা। কখনও বা মাংস। অতি সূক্ষ ঝিরিকাটা আলুর ভাজা, যাতে চেরা কাঁচামরিচের ছড়াছড়ি। খিচুড়ির সঙ্গে ডিমভাজা অবধারিত বিধায় সবার পাতেই জায়গা করে নিত। থাকত বেহেশতি স্বাদের সুবিখ্যাত অষ্টগ্রামের পনির ভাজা— যাকে পরে আমরা চিনতে পারব কটেজ চিজ বলে। এইসবের সঙ্গে থাকত কোনও একটা মাছের ঝাল, আমরা যাকে বলি— বিরান। এই নাশতা দস্তরখানে সাজিয়ে দিলে পরে খেতে বসে গল্প করা বা কোনও রকম আলোচনায় কেউ যায় না। নিবিষ্ট মনে সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত থাকে। সে এক দেখারও বিষয় বটে।

দুপুরে ভাতের বদলে আমরা যারা বাংলাদেশের গ্রামে ও গঞ্জ-শহরে বড় হয়েছি তারা কখনও খিচুড়ি খাইনি। সে যতই ঘনঘোর বরিষা হোক বা গভীর নিম্নচাপের অসময়ের বৃষ্টি। বৃষ্টি পড়লে খিচুড়ি খাওয়া শহুরে ফ্যাশান। আমার মা ছিলেন নিতান্ত অজ গ্রামের মানুষ। শহুরে ফ্যাশান জানতেন না, জানতেও চাননি। নিজের মতো করে নিজের নিয়মে চলতেন। খিচুড়ি বলতে দু-রকম খিচুড়িই জানতেন। পাতলা খিচুড়ি আর ভুনা খিচুড়ি। পাতলা খিচুড়ি যেনতেন চাল-ডালের। আর ভুনা খিচুড়ি স্পেশাল। এই স্পেশাল খিচুড়িকে কদাচিত ভুনা পুলাও-ও বলতেন আম্মা। আম্মার এই স্পেশাল খিচুড়ি যখন আমার হেঁশেলে হয়, তখন আমি তাতে যোগ করি মাংস। খাসি অথবা গরু।

আম্মার মতোই তরিবত করে রান্না করি এই খিচুড়ি। তবে মাংস যোগ হয় বলে দুটো ধাপে রান্না হয় এই খিচুড়ি। যে সমস্ত মশলা এমনি রান্নায় পড়ে, তার সবই দিয়ে কষিয়ে রাঁধতে হয় মাংস। তেলের উপর একদম ভুনা ভুনা করে। বাদবাকি প্রক্রিয়া এক। চালডাল আচ্ছাসে ঝরঝরে করে ঘিয়ে ভেজে মাপমতো গরম জল দিয়ে তবে দিতে হয় ভুনা মাংস। সঙ্গে আস্ত কাঁচামরিচ খানকতক। টগবগ করে খিচুড়ি ফুটে উঠলে আঁচ কমিয়ে দিয়ে দমে দিয়ে দিতে হয়। মাংসের খিচুড়ির সঙ্গে নিতে হয় ঝিরিকাটা শসা-টম্যাট-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচের স্যালাড আর ডিমের অমলেট।
ভ্যাপসা গরম। তাপমাত্রা দিনের বেলায় আটতিরিশ হলেও ফিলস লাইক হয় আটচল্লিশ। হাঁসফাঁস অবস্থা। এই গরমে পাতলা খিচুড়ি খাওয়ার কোনও বাসনা হওয়ার কথা নয়, হলও না। আমি ভাবলাম সবজি আর মাংসের মিলিঝুলি খিচুড়ির কথা। খিচুড়ি বসাতে গিয়ে খেয়াল হল চালের সঙ্গে ডাল মেশাইনি! দিলাম একমুঠো মুসুর ডাল।
ইদানীং রাতের খাবারে মাংস খাওয়াটা অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। রুটি আর একটা মাংসের ঝোল। মুরগি বা খাসি নাকি গরু- সে যাই হোক না কেন। সঙ্গে রুটি। মাংস ছাড়া অন্য কিছু খেতে ইচ্ছেই করে না। সেদিন যেমন রাতের জন্যে রান্না কিছু ছিল না আর কি করব সে নিয়ে কিছু ভেবেও রাখিনি। এখন মুরগির ঝোল হবে, রুটি হবে, তবে হবে রাতের খাওয়া! দুই পদ করার মতো সময় আর এনার্জি দুয়েরই অভাব বোধ হওয়ায় ঝটপট চাল ভিজালাম। বর্ধমানের নাদানঘাটের জৈবচাষের গোবিন্দভোগ চাল। ফ্রিজে সবজির ঝুড়ি থেকে বেরুল দুটো কাঁকরোল, খানকয়েক পটল, দুটো গাজর আর কয়েকটা বিনস।
ভ্যাপসা গরম। তাপমাত্রা দিনের বেলায় আটতিরিশ হলেও ফিলস লাইক হয় আটচল্লিশ। হাঁসফাঁস অবস্থা। এই গরমে পাতলা খিচুড়ি খাওয়ার কোনও বাসনা হওয়ার কথা নয়, হলও না। আমি ভাবলাম সবজি আর মাংসের মিলিঝুলি খিচুড়ির কথা। খিচুড়ি বসাতে গিয়ে খেয়াল হল চালের সঙ্গে ডাল মেশাইনি! দিলাম একমুঠো মুসুর ডাল।
কড়াইয়ে অল্প ঘি গরম করে সবজি আর মুরগি একসঙ্গে দিয়ে খানিক ভাজাভাজা হয়ে এলে তাতে পড়ল এক চিমটি গোটা জিরে, হলুদ, লবণ, গ্রেট করা আদারসুন, গোটা এবং থেঁতো করা কাঁচালংকা আর সামান্য ধনেগুঁড়ো। উপর থেকে পড়ল ঘানিতে ভাঙা সর্ষের তেল।
চালডাল আর মাপমতো জলে তোয়ের হল চটজলদির মুরগির ভুনা খিচুড়ি। সঙ্গে লাগে শুধু ঝিরিঝিরি করে কাটা শসা-টম্যাটো-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচের স্যালাড অথবা শুকনো কুলে গুড় দিয়ে জ্বাল দেওয়া টকমিষ্টি কুলের সিরা।

কুলের সিরা প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ঢাকায় ‘স্বাদ’ নামের এক রেস্তোঁরার কথা, তারা বিখ্যাত ভুনা খিচুড়ির জন্যে। তাদের খিচুড়িতে মাংস থাকে খুব অল্প, ছোট ছোট টুকরোয় কাটা। এই খিচুড়ির পাতে তাঁরা দেন শুকনো কুলের আঁটোসাটো টকমিষ্টি আচার। ঢাকা শহরের কুখ্যাত জ্যাম ঠেলে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ স্বাদের খিচুড়ি খেতে যান লালমাটিয়া। আমরাও গিয়েছি বার কতক। তবে সে এখনও টিকে কিনা জানা নেই। তবে খিচুড়ি টিকে যায়। একেকটি দোকান স্বল্প সময়ের জন্যে এসেও স্বাদ বদল ঘটিয়ে যায় মানুষের। এইসব খিচুড়ি অতীব সুস্বাদু। অতীব স্বাস্থ্যকর— যেমন আর সব খিচুড়ি হয়।
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
জন্ম সিলেটে এবং বড় হওয়া বাংলাদেশে। ১৯৮৬ সাল থেকে ভারতের বাসিন্দা। হেঁশেলই তাঁর হাতিয়ার, আশ্রয়। হেঁশেল ঘিরেই তাঁর লেখালেখি। 'অতঃপর অন্তঃপুরে' এবং 'স্বাদ সঞ্চয়িতা' তাঁর প্রকাশিত বই।