বিকেলে রওনা দিলাম উত্তরমুখো। গন্তব্য চন্দরেহ শিবমন্দির। প্রায় তেইশ কিলোমিটার পথ। বানস নদী মাঝে মাঝে দেখা দেয়, মাঝে মাঝে লুকিয়ে পড়ে। শিকারগঞ্জের কাছে বানস নদী শোন নদীতে মিশে যায়। সেখানে ভাওয়র সেন (Bhavar Sen) ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে যাওয়া যায়। পথটি অতি মনোরম। লালমাটি আর সবুজের সমারোহ। শরতের মেঘমুক্ত নীল আকাশ। পথের মাধুর্য গন্তব্যের চেয়ে কিছু কম নয়। খানিক পরে পাহাড়ি ঘোরানো রাস্তা পেলাম। এই পাহাড় বিন্ধ্যপর্বতেরই প্রসারিত বাহু।

ব্রিজ পেরোলাম না। আরেকটু এগিয়ে চন্দরেহ শিবমন্দির। চেদি রাজবংশের কুলগুরু প্রবোধ শিব এই মন্দির ৯৭২ খৃষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন। প্রবোধ শিব ছিলেন মত্তময়ূর শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ। গোলাকৃতি গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ স্থাপিত। গর্ভগৃহের আচ্ছাদনকে বলা হয় বিমান বা শিখর। শিখরের গায়ে চৈত্যর আকারে ছোট ছোট আর্চ (arch) খোদাই করা আছে। মন্দিরের পাশে ভগ্ন দোতলা মঠ। Archaeological Survey of India সযত্নে রক্ষা করে চলেছে এই স্থান। মহাভারতে আমরা চেদিরাজ শিশুপালের উল্লেখ পাই। পরে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে চেদিরাজ্যের উল্লেখ পাই।

বেশ কিছু সিঁড়ি ভেঙে একটা ছোট চাতাল, সেটাতে উঠে মন্দির প্রদক্ষিণ করা যায়। চাতালে একটা ভাঙা মূর্তি আছে, মনে হয় ঘোড়া, কিন্তু তার পা-গুলো আর মুখের অনেকখানি ভাঙা। আরো কিছু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠলে একটা ছোট অন্তরাল, তার উল্টোদিকে গর্ভগৃহের দরজা। দেওয়ালের পাথর কুঁদে নানারকম প্রাণী এবং মানুষের মূর্তি।

পরদিন ভোরবেলা, অন্ধকার থাকতে নিজেদের গাড়ি নিয়ে বেরোলাম।সঙ্গে প্যাক করা আছে কিছু খাবার ও জল। শিরশিরে ঠান্ডায় চোদ্দ কিলোমিটার পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বাদকাডোল গেটের কাছে। চেকিং-এর পর জিপ ছাড়বে। আমাদের কোন জিপ নেই! যারা আগে থেকেই জিপের সঙ্গে কথা বলে বুকিং করেছেন, তাদের জিপ হাজির। মুষড়ে পড়ছি। ভাবতেই পারিনি, সরকারি ওয়েবসাইট (website) থেকে পারমিটের টাকা দিয়ে পুরো জিপ বুকিং করা সত্ত্বেও কোন নিশ্চয়তা নেই! এখানে ভিড় কম বলে সবসময় জীপ থাকে না। গাইডদের তৎপরতায় একটা জিপের ব্যবস্থা হয়েছে। তারই অপেক্ষায় আছি। একজন গাইড আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন।

খোলা জিপে ছয়জন যাত্রী বসতে পারে। দাঁড়ানো জিপগুলো সবাই চলে গেল। এমন সময় ধুলো উড়িয়ে একটি জিপ প্রবেশ করল। ড্রাইভারের স্টিয়ারিং হাতে বসে আছে একজন লম্বা, কালো, রোগাটে, লাল লাল চোখ লোক। আমাদের দেখে ঝকঝকে সাদা দাঁতের ঝলক দেখিয়ে একগাল হেসে বলল, “শো গিয়া থা”। আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে অন্ধকার কেটে গিয়ে চারপাশ নতুন দিনের আলোয় আলোকিত।
ড্রাইভারের নাম ভানু আর গাইডের নাম রামপ্রকাশ। ভানু জানাল, প্রথমে বাফার জোন পেরোব। যে গতিতে ও গাড়ি চালাল, জঙ্গলের মধ্যে অত দ্রুত কেউ চালাতে পারে, ভাবাই যায় না। ভয়ে ভয়ে বলে ফেললাম। ও অভয় দিল কোর জোনে ঢুকে এত জোরে যাবে না।
হঠাৎ ফোন এল, দেখা গেছে ব্যাঘ্রপুঙ্গবকে! ভানু আমাকে বলল, “উও জগাহ থোড়া দূর হ্যায়, জারা পকড়কে বৈঠিয়ে। বসলাম পকড়কে। শুরু হল ভানুর কেরামতি। জঙ্গল দিয়ে যাচ্ছি, না হাইওয়ে দিয়ে”? পাথুরে, এবড়োখেবড়ো, চড়াই-উতরাই – কুছ পরোয়া নেহি, গাড়ি চলেছে হাঁ হাঁ করে। দুটো গাছ বড্ড কাছাকাছি, এবার খাব ধাক্কা, সবাই ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে, কিন্তু গতি একটুও না কমিয়ে আমরা গাছেদের ফাঁক দিয়ে গলে গেলাম!
জঙ্গলের মধ্যে একটা নদী, তাতে নামমাত্র জল। সেখানে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সকালের নরম আলো পাতার ফাঁকে জলের ওপর আলো-আঁধারি রচনা করেছে। ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ অবলীলাক্রমে সেটা পেরিয়ে কোর জোনে প্রবেশ করল। লম্বা লম্বা শালগাছ সোজা উঠে গেছে আকাশ পানে। জঙ্গলে, অন্যান্য গাছও আছে। কোন কোন জায়গায় সূর্যের কিরণ ভূমি স্পর্শ করে না। লাল রুক্ষ মাটি, গাছের গায়ে তার প্রলেপ। জিপ চলে চলে রাস্তা তৈরি হয়েছে। খোলা জায়গায় কোমর সমান ঘাস, বুনো তুলসীর ঝোপ। জিপের চাকায় পিষ্ট হয়ে ফুলের গন্ধ আরও তীব্র। এদিক সেদিক ঘুরছি, দু একটা হরিণ, ময়ূর, বাঁদর চোখে পড়ছে। এক জায়গায় গাড়ি দাঁড়ালো, ব্রেক।

আবার শুরু হল ঘোরা। এক একটি জিপ এক এক দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, যারা বাঘ দেখতে পাবে, তারা বাকি গাইডদের ফোনে খবর দেবে। ভানু জঙ্গলের রাস্তা ছেড়ে জিপ ঢুকিয়ে দিল আন্ডারগ্রোথের মধ্যে। এক মানুষ সমান ঘাস, তার ভেতর বাঘ শুয়ে থাকলে কেউ বুঝতেই পারবে না। আমরা এক জায়গায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। উশখুশ করছি। হঠাৎ ফোন এল, দেখা গেছে ব্যাঘ্রপুঙ্গবকে! ভানু আমাকে বলল, “উও জগাহ থোড়া দূর হ্যায়, জারা পকড়কে বৈঠিয়ে। বসলাম পকড়কে। শুরু হল ভানুর কেরামতি। জঙ্গল দিয়ে যাচ্ছি, না হাইওয়ে দিয়ে”? পাথুরে, এবড়োখেবড়ো, চড়াই-উতরাই – কুছ পরোয়া নেহি, গাড়ি চলেছে হাঁ হাঁ করে। দুটো গাছ বড্ড কাছাকাছি, এবার খাব ধাক্কা, সবাই ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে, কিন্তু গতি একটুও না কমিয়ে আমরা গাছেদের ফাঁক দিয়ে গলে গেলাম! প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছের গুঁড়ি, প্রতিটি গর্ত ওর মুখস্থ।

পথে চোখে পড়ল দুটি হাতি ও তাদের মাহুত। আমাদের গাইড রামপ্রকাশ মাহুতদের সঙ্গে কথা বলে জানল তারাও বাঘের দিকেই যাচ্ছে।
ঝড়ের গতিতে পৌঁছে গেলাম চারধারে জঙ্গলবেষ্টিত একটা ফাঁকা জায়গায়। বাঁ দিকে জঙ্গল, তার ধারে নদী। সেই জঙ্গলে ঝোপের আড়ালে একজোড়া বাঘ আর বাঘিনী পায়চারি করছে। কিছুক্ষণ গরগরানি চলল আর গাছের ফাঁকে হলুদ কালো ডোরাকাটার ঝলক। কিছুক্ষণ পর দুই হাতি এসে হাজির। ইকুয়েশনে হাতি ঢুকে সব ওলোটপালট করে দিল। বাঘিনী বেজায় নার্ভাস হয়ে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে হাতিদুটোকে পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে পালিয়ে গেল। বাঘ খোলা মাঠে বেরিয়ে এল। গায়ে রোদ পিছলে যাচ্ছে, টানটান স্বাস্থ্য, রাজকীয় তার চলাফেরা। একেকবার চলে যায় গাছের আড়ালে, আবার কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে খোলা মাঠে। তারপর দেখি আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। রামপ্রকাশ বেগতিক দেখে ভানুকে বলল গাড়ি সরিয়ে নাও। সবকটা গাড়ি সরে এল পিছন দিকে।
বাঘ চলে যাবার পর হাতিরা কাছে এল। ছোট হাতিটা খুব মিষ্টি, মাথা বাড়িয়ে দিল, ভাবখানা আমায় আদর করে দাও। মাথায়, শুঁড়ে হাত বুলিয়ে আদর করলাম। সে নানাদিকে শুঁড় দুলিয়ে অনেক খেলা দেখাল, ও কী কী পারে। সেলাম ঠুকে টাকা নিয়ে মাহুতরা হাতিদের নিয়ে চলে গেল। আমরা একটা গ্রামের কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাবার ভাগাভাগি করে সবাই মিলে খেয়ে নিলাম। ভানু আর রামপ্রকাশ হাসিমুখে আমাদের ধন্যবাদ গ্রহণ করল।
বাঘ দেখার উত্তেজনা মনের মধ্যে টগবগ করতে করতে হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যেবেলায় প্রাণ ভরে সূর্যাস্ত দেখলাম। নদীতে রঙ প্রথমে সোনালী তারপর লাল। খোলা আকাশে রঙের খেলা। ওই নির্জন, জঙ্গল ঘেরা নদীর তীর, নীড়গামী পাখিদের কলরব, নৌকার দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ, নদীর অবিরাম কলস্বর এক অপূর্ব সঙ্গীত সৃষ্টি করল। ধীরে ধীরে সব শান্ত, স্তব্ধ হল, নদী শুধু তার কলতানে মুখর রইল।
(সমাপ্ত)
বিশেষ তথ্য-
- যাঁরা মধ্য প্রদেশে (Madhya Pradesh) গাড়ি নিয়ে ঘুরবেন, তাঁরা পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, জল আর গাড়ির তেল নিয়ে নেবেন।
ছবি সৌজন্য : লেখক, Wikimedia commons
বিশাখা ঘোষ পেশাগত বাঁধনে বাঁধা অর্থনীতির সঙ্গে। কিন্তু মন চায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, আর অজানা পৃথিবীকে চিনতে। তাতে নিজেকেও তো চেনা হয়। আপনাকে জানাতে তাঁর ভারী কৌতূহল। ছাত্রাবস্থা কেটেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাস আর আইএসআই-তে। এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্য়ালয়ে অধ্যাপনা করেন। ভালোবাসেন আড্ডা মারতে।
One Response
ভালো লেখা