এই নাটিকাটির অনুপ্রেরণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সূক্ষ্ম বিচার” নামক হাস্যকৌতুক। প্রথম তিনটি বাক্য অবিকল সেই রচনা থেকেই নেওয়া। কিন্তু তারপর থেকে অন্যরকম। রবীন্দ্রনাথ সেই নাটিকা লিখেছিলেন ১২৯৩ বঙ্গাব্দে, অর্থাৎ ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে, আর বর্তমান নাটিকার ঘটনাকাল বর্তমানকালে, অর্থাৎ ২০২১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। মাঝের সোয়াশো বছরের ব্যবধানে অনেক কিছু বদলে গেছে। প্রথম সংলাপেই যে প্রশ্ন ছিল,“ভালো আছেন?” – সেই প্রশ্নের অর্থই বদলে গেছে। কেননা চারদিকে করোনার তাণ্ডব চলছে। এর মধ্যে রাস্তায় দু’জন প্রৌঢ় ব্যক্তির দেখা। তাঁদের নাম? রবীন্দ্রনাথ এই দুই ব্যক্তির নাম দিয়েছিলেন চণ্ডীচরণ আর কেবলরাম। এই সব নামও এতদিনে অচল হয়ে গেছে। নতুন যুগে তাদের নতুন কোনও নাম আছে।
কিন্তু তাদের মধ্যে কথা কী হল, তা বলার জন্য সেই নামগুলোর তেমন দরকার নেই বোধহয়।
প্রথম ব্যক্তি॥ মশায়, ভালো আছেন?
দ্বিতীয় ব্যক্তি ॥ ‘ভালো আছেন‘ মানে কী?
প্রথম ব্যক্তি॥ অর্থাৎ সুস্থ আছেন?
দ্বিতীয় ব্যক্তি ॥ সুস্থ বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?
প্রথম ব্যক্তি॥ এ প্রশ্নের তো এখন একটাই অর্থ। মানে, বলতে চাইছি, অনেকদিন পরে দেখা হল তো, এর মধ্যে আপনি করোনা আক্রান্ত হননি তো?
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ ও, না, করোনা হয়নি আমার।
প্রথম ব্যক্তি॥ যাক, শুনে আশ্বস্ত হলাম।
প্রথম ব্যক্তি॥ কী শুনে আশ্বস্ত হলেন?
দ্বিতীয় ব্যক্তি।৷ ওই যে বললেন, আপনি সুস্থ আছেন…
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ আমি তো তা বলিনি। বলেছি, আমার করোনা হয়নি।
প্রথম ব্যক্তি॥ ওই একই কথা। চালভাজা আর মুড়ি।
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ যেমন তেমন করে চাল ভাজলেই সেটা মুড়ি হয় না।
প্রথম ব্যক্তি॥ সে আপনি যদি সূক্ষ্ম বিচার করতে চান তো করুন, আমার যা জানবার তা জানা হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ ব্যাপারটা খুব সুক্ষ্ম বিচারের নয়। খুব মোটা দাগের হিসেবও যদি ধরেন, তাহলেও আমি বলতে পারছি না যে আমি সুস্থ আছি। গতকালই ধরা পড়েছে যে আমার রক্তচাপ ভয়ানক বেশি, ডাক্তার বলেছেন বিশ্রাম নিতে।
প্রথম ব্যক্তি॥ তাহলে বিশ্রাম না নিয়ে বেরিয়েছেন কেন?
দ্বিতীয় ব্যক্তি।। ওষুধ কিনতে।
প্রথম ব্যক্তি॥ তবেই দেখুন, ওটা তেমন গুরুতর কিছু নয়। কিন্তু সাবধান, ওষুধের দোকানে অন্যদের কাছ থেকে দূরে দাঁড়াবেন। কার শরীরে করোনা আছে তা তো দেখে বোঝবার উপায় নেই! অনেক সময়ে সে নিজেও জানে না।
দ্বিতীয় ব্যক্তি ॥ হ্যাঁ মশাই, জানি। সে তো গত বছরখানেক ধরেই জানি। এখন আমার মাথায় অন্য চিন্তা।
প্রথম ব্যক্তি॥ এর মধ্যে আবার অন্য চিন্তা আসছে কোত্থেকে? এটাই প্রধান চিন্তা, এটাকে গুরুত্ব না দিলে পস্তাবেন।
দ্বিতীয় ব্যক্তি ॥ আরে, শুধু তো রক্তচাপের ব্যাপার নয়! ডাক্তার এ কথাও বলেছেন যে, এ অবস্থা কতদিন ধরে চলছে তা জানা নেই। তাই ভেতরে অন্য কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ জখম হয়ে থাকতে পারে। চোখ, হার্ট, কিডনি, এসব পরীক্ষা করাতে হবে।
প্রথম ব্যক্তি॥ আচ্ছা, সঙ্গে করোনার টেস্টও কি হবে?
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ জানি না মশাই।
প্রথম ব্যক্তি॥ আমি বলি কী, টেস্ট যখন এতরকম করাবেন, তখন করোনাটাও করিয়ে নিন। বলা তো যায় না…
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ [উত্তেজিত স্বরে] আচ্ছা বেশ, না হয় করাব। বাড়ির সবার জন্যও না হয় করিয়ে নেব, একসঙ্গে অনেকটা কাজ হয়ে যাবে।
প্রথম ব্যক্তি॥ বাড়ির কথা বললেন, ভালো হল। আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। যাক, শুনে বুঝলাম বাড়ির কারুরও করোনা হয়নি তাহলে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি ॥ না মশাই, হয়নি।
প্রথম ব্যক্তি॥ খুব ভালো লাগলো আপনারা সপরিবারে সুস্থ আছেন শুনে। সুস্থ সুখী পরিবার দেখলেও প্রাণটা জুড়ায়, এই করোনার কালে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ সুখী-টুখী আমি বলিনি।
প্রথম ব্যক্তি॥ কেন, সুখের অভাবটা হল কোথায়? আপনি ভালো আছেন, বাড়ির সকলে ভালো আছেন!
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ এই বুঝলেন এতক্ষণের কথায়?
প্রথম ব্যক্তি॥ আপনি তো সেই রকমই বললেন!
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ আমি যা বলেছি আর আপনি যা শুনেছেন তা বোধহয় ঠিক এক নয়। বেশ এইবারে আরো বলি, দেখি এটা যদি আপনার মাথায় ঢোকে। আমার মা মারা গেল গত মাসে।
প্রথম ব্যক্তি॥ করোনায়?
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ না না, বয়স হয়েছিল, হার্টফেল করেছে।
প্রথম ব্যক্তি॥ যাক, শুনে স্বস্তি পেলাম।
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ এর মধ্যে স্বস্তির ব্যাপারটা দেখলেন কোথায়?
প্রথম ব্যক্তি॥ না, মানে, আপনার মা যে করোনামুক্ত জীবন যাপন করতে পেরেছেন, সেটা জেনে ভালো লাগছে।
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ কী জানি, হয়তো আপনার লাগছে। আমি হয়তো খুশি হতাম মা আরো কিছুদিন বাঁচলে।
প্রথম ব্যক্তি॥ সবাই ভালো আছেন, এটা ভেবে আপনার খুশিই হওয়া উচিত ছিল।
দ্বিতীয় ব্যক্তি ॥ কোথায় ভালো? ছেলে তো এখানে থাকে না, ওদের ওখানে পড়ে গিয়ে মাথায় রক্তপাত হলো, আমরা তো যেতেও পারলাম না। আমার বৌয়ের গ্যাসের ব্যথা মাঝে মাঝে এমন বেড়ে উঠছে যে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হচ্ছে। আমার এক মামাতো ভাই রাস্তায় লরির এমন ধাক্কা খেল যে তার একটা পা কেটে বাদ দিয়ে দিতে হল, আমার…
প্রথম ব্যক্তি॥ কিন্তু কারোর করোনা হয়নি,তাই তো?
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ [বিরক্তির স্বরে] না মশাই, করোনা হয়নি।
প্রথম ব্যক্তি॥ যাক, নিশ্চিন্ত! আসলে কী জানেন, হলেও তো জানবার কোনো উপায় নেই। যদিও আপনার বাড়ি আর আমার বাড়ির মধ্যে আর তিনটে মাত্র বাড়ি, দেখাশোনা তো এখন হয়ই না। ওইজন্য চিন্তা করি।
দ্বিতীয় ব্যক্তি॥ [তারস্বরে] চিন্তা করতে হবে না, খবর দেব। প্রতিদিন এসএমএস পাঠাব খবর জানিয়ে, সপ্তাহে সপ্তাহে ফেসবুকে ঘোষণা করব, যদি বলেন তো পুরনো কায়দায় মাসে মাসে একবার করে খবরের কাগজেও নাহয় ব্যক্তিগত কলামে সংক্ষিপ্ত সমাচার বলে ছাপিয়ে দেব। যদি আমার পরিচিত কাউকেও করোনায় ধরে, তাহলেও আপনাকে খবর দেব। এখন আসি- ওষুধ কেনার পরে হার্ট আর কিডনি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রথম ব্যক্তি॥ আসুন। খুব ভালো লাগল আপনাদের খবর শুনে।
পলাশ বরন পাল পেশায় পদার্থবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক। কবি, লেখক ও ভাষাবিদ হিসেবে সমাদৃত। পদার্থবিজ্ঞানের নানান বিষয় ছাড়াও লিখেছেন গল্প, কবিতা ও পপুলার সায়েন্সের বেশ কিছু বই। 'বিজ্ঞান: ব্যক্তি যুক্তি সময় সমাজ', 'নানা দেশ নানা গল্প', 'বিজ্ঞান এবং', 'ধ্বনিমালা বর্ণমালা' ওঁর কিছু প্রকাশিত বই।
One Response
Excellent Palash da.