আফিন্দি বা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলো ৮০০-৯০০ বছর ধরে লোকের মুখে মুখে চলছেই। মোল্লার কাহিনি নিয়ে প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয় তুর্কি ভাষায় ১৮৩৭ সালে। পরে ফরাসি, চিনা, আরবি, রুশ, জার্মান, ফারসি, মায় বাংলা অবধি বহু ভাষায় তা ছড়িয়ে পড়ে। মোল্লার গল্পের সবচেয়ে বড় সংগ্রহটি রুশ ভাষায় লেখা। লেখক খাতিরানোফ। এতে গল্প আছে ১২৩৮টি। তৈমুর বাদশা থেকে বাইডেন— সর্বত্র তার অবাধ গতি। কখনও সে রাজার সহচর, কখনও ভবঘুরে ভিখিরির। গাধা, ঘোড়া, উট, জেট গাড়ি এমনকি মেট্রো চড়েও সে ঘুরে বেড়ায়।
পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বহু দেশই তাকে নিজেদের লোক বলে দাবি করে। এ ব্যপারে সবচেয়ে বড় হকদার তুরস্ক। ওখানে আফিন্দির জন্মদিন পালিত হয় রীতিমতো ঘটাপটা করে। ওখানকার আনাতোলিয়ার আক শেহ্ রে মোল্লার মক্ বরা বা সমাধি-সৌধটি আজও পর্যটকদের দেখানো হয়। কথায় কথায় মোল্লা একদিন বলেছিল, দেশে থাকলে সে নিজেই এর দেখভাল করে। এ ব্যাপারে তার যুক্তি নিতান্তই সরল, “আমার সমাধি যদি আমিই না দেখভাল করি তাহলে আর কে করবে।”

একবার একটা সরু সাঁকোর ওপর খোঁড়া দেবতা শনির মুখোমুখি হয়েছিল আফিন্দি। দুজনেরই তাড়া, কেউ কাউকে পথ ছাড়তে রাজি নয়। শুরু হল কাজিয়া। নেহাত একটা অমরত্বের বর ছিল, তাই তাকে ভস্ম করে দিতে পারেননি শনিদেব। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলেন, “কাজিসাহেবের ছেলে হয়ে অষ্টপ্রহর গাধায় চড়ে ঘুরে বেড়াস, লজ্জা করে না?”
জবাবে মোল্লা বলে, “তুমি যে বউয়ের ঋতু না সামলে এখনে ওখানে চরে বেড়াও তার বেলা?”
“পাঁড় মুখ্যু বলেই তো লোকে তোকে ব্যঙ্গ করে মোল্লা বলে।”
“আল্লা মেহেরবান্! লোকে মোল্লা হওয়ার জন্য কত সাধ্যসাধনা করে, আর আমি কিছু না করেই তা হয়ে গেলাম।”
বিরক্ত শনি এরপর বেশ কড়া করে অভিশাপ দেন আফিন্দিকে। বলেন, “জীবনে তোর লেখাপড়া হবে না। কোথাও থিতু হয়ে বসতে পারবি না। যার জন্য তুই প্রাণপণ চেষ্টা করবি, তা কিছুতেই পাবি না। পরে বিরক্তিতে ছাড়তে চাইবি। যত চাইবি ওটা তত বেশি করে আঁকড়ে ধরবে।”
একগাল হেসে মোল্লা বলে, “যাক, তাহলে তো বেশ সুবিধাই হল। কারণ আমি জিন্দেগিতে অমন কিছু চাইবই না। তার ওপর তোমার বরে ঘোরাঘুরিটা হবে, বাড়তি হিসেবে লেখাপড়াটাও করতে হবে না।”

লটারিতে ২ টাকার টিকিট কেটে ২ কোটি জিতেছে মোল্লা। দোকান মালিক সব কেটেকুটে ১ কোটি ৭৫ লাখ দিয়ে প্রচুর অভিনন্দনের পর সেলফি তুলতে চেয়েছে। এতক্ষণ মন দিয়ে টাকা গুনছিল মোল্লা। গোনা শেষে ছবি তো দূর, রেগে আগুন আফিন্দি। “বোকা পেয়েছ নাকি? হয় পুরো দুই দাও, নাহলে টিকিটের দাম ফেরত দাও।”
অনেকক্ষণ চেঁচামিচির পর ওদের ১ কোটি ৭৫ লাখ ফেরত দিয়ে নিজের ২ টাকা নিয়ে গোঁফে তা দিতে দিতে বলে, “হুঁ হুঁ বাবা, আমায় ঠকানো অত সোজা না।”
***
ফ্রি কচুরি আর লস্যির লোভে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বড়বাজারের ধর্ম মহাসভায় ঢুকে পড়েছে আফিন্দি। ঢুকেই ডজন তিনেক কচুরি আর ৫ গ্লাস ঘোল খেয়ে টানটান শুয়ে পড়েছে মেঝেতে। সভায় তখন স্বামী সোমেশ্বর গলা ফাটিয়ে বলছেন, কাকে বলে ভালো আর কাকে মন্দ তাই নিয়ে। কিন্তু বলবেন কী করে! পেছন থেকে শুরু হয়েছে মোল্লার নাক ডাকা। নাক তো নয়, মনে হচ্ছে ৭/৮ টা বাঘ পরিত্রাহি চ্যাঁচাচ্ছে। বিরক্ত স্বামীজি স্টেজ থেকে নেমে ত্রিশূলের এক খোঁচা মারলেন মোল্লার পেটে। খোঁচা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে মোল্লা।
“নাক ডাকছিলি কেন?”
“আজ্ঞে নাক কি কোনওদিন কারও কথা শুনে ডাকে?”
“খুব তো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলি, যা নিয়ে কথা হচ্ছিল তা বুঝি তোর জানা?”
“হ্যাঁ মহারাজ। তাই একটু যোগনিদ্রা দিয়ে নিচ্ছিলাম।”
“তাই বুঝি!” ব্যঙ্গের সুরে বললেন স্বামী সোমেশ্বর— “তাহলে বল দিকি, কাকে বলে ভালো, আর কাকে মন্দ? আমরাও একটু জ্ঞান লাভ করি।”
একগাল হেসে মাথা-টাথা চুলকে মোল্লা বলে, “আজ্ঞে, বড়বাজারে যা বিকোয় তাই ভালো— তা সে ধর্মই হোক বা আফিং। আর বেচতে জানলে সবই বিকোয়, কাজেই এখন মন্দ বলে তো কিছু হয় না।”

মোল্লার বাবা কাজিসাহেবের প্রতিবেশী আইবুড়ো সুন্দরী মরিয়ামের পেট ফুলে ঢাক। কেচ্ছার মজায় পাড়াপড়শির নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছে। প্রশ্ন একটাই, ‘কে করল?’ মরিয়াম জবাব দিতে রাজি নয়। যথাকালে ফুটফুটে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে সে। তার বাপ বলেছে, “হয় তুই এর বাপের নাম বলবি, না হলে ফেলে আসব দূর পাহাড়ে, শকুনদের আড্ডায়।” মরিয়া মরিয়াম বলে বসেছে কাজিসাহেবের নাম। শুনে তো সব হাঁ। “মেয়ের বয়সি”…”ভাবাই যায় না”… “মরিয়ামকে দেখে ইয়েদের-ই নিয়ত টলে যায় আর এ তো…” …”এ তো দিনে কাজি, রাতে পাজি!”… “না রে ভাই, দিনে বাপ রাতে ঠাপ।”
শুরু হয় ঘোঁট পাকানো। ঠিক হয় সামনের জুম্মায় সব দল বেঁধে যাবে কাজিসাহেবের বাড়ি। যাবে তো, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ঠিক হয়, সবচেয়ে বুড়ো আব্বাসচাচা বলবে কথাটা। জুম্মার দিন পুরো পাড়া হাজির কাজিসাহেবের বাড়ির সামনে। কড়া নাড়েন চাচা। দরজা খোলেন খোদ কাজি। তাঁকে দেখে অনেক আমতা আমতা করে চাচা বলেন, “মরিয়াম বলছে এই বাচ্চার বাবা নাকি আপনি?”
‘ও! তাই বুঝি!’ বলে, সবাইকে চুপ করিয়ে বাচ্চাসহ মরিয়ামকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যান কাজিসাহেব।
এর মাস ছয়েক পর, কাজিসাহেব তখন একঘরে, টিটকিরির চোটে মোল্লারও মুখ দেখানো মুশকিল। আর পারল না মরিয়াম। ভরা বাজারে চিৎকার করে বলল সে মিথ্যা বলেছে। বাচ্চার বাবা কাজি নন, রুটি কারখানার জোসেফ।
জোসেফ মেনেও নেয় কথাটা। তারপর দুজনে ক্ষমা চাইতে আসে কাজির বাড়ি। সব শুনে একটু হেসে কাজি বলেন, “ও তাই বুঝি!”

কোমরে বাঁধা বাড়ির চাবি খুলে পড়েছে অন্ধকার গলিতে। এক ছুটে মোল্লা হাজির আলো ঝলমলে বড় রাস্তায়। শুরু করেছে চাবি খোঁজা। তা দেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে পাহারাদার— “কিছু হারালো নাকি মোল্লাসাহেব?”
“আর বলবেন না! বাড়ির চাবিটা।”
“সে কি! আপনাকে আজ এপথে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।”
“আসিইনি তো দেখবেন কী করে?”
“তাহলে?”
“আসছিলাম ভাঙা পাঁচিলের ধার দিয়ে, তখনই চাবিটা টুপ করে খসে পড়ল অন্ধকার গলিতে।”
“তাহলে এখানে খুঁজছেন কেন?”
“কোথায় খুঁজব?” খিঁচিয়ে ওঠে মোল্লা… “এই আলোভরা রাস্তাতেই যা পাচ্ছি না, তা কি না পাব ওই অন্ধকার গলিতে?”
***
কাজিসাহেবের সঙ্গে রাজধানী থেকে আক্ শেহর চলেছে আফিন্দি। পথে পড়ল একটা নালা। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক পরমা সুন্দরী। ওপারে যাবে, কিন্তু কিছুতেই পেরোতে পারছে না। শুনে কাজিসাহেব তাকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন ওপারে। পেছন পেছন গেল মোল্লা। কাজটা তার একদম পছন্দ হয়নি। কিন্তু একে বাপ, তায় বয়েসে বড়, তাই চুপ করেই ছিল। ঘণ্টাখনেক মুখ বন্ধ করে চলার পর আর পারলো না। বলল, “কাজটা কি ভালো হল বাবা?”
“কোন কাজ?”
“অজানা অচেনা একটা মেয়েকে ঝপ করে কোলে তুলে নিলে?”
একটু হেসে কাজি বললেন, “আমি তো নামিয়ে দিয়েছি ঘণ্টাখানেক আগেই, তুমি তো দেখছি এখনও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ।
***
মোল্লা তখন ক্রীতদাস, খাটনির চোটে প্রাণ যায় যায়। সে জানে, মরে গেলে আর কাজ করতে হয় না। ‘কিন্তু মরেছি যে বুঝব কী করে?’ অনেক ভেবেও কোনও রাস্তা না পেয়ে পরিচিত এক বদ্যিকে শুধিয়েছে মোল্লা।
“এ তো ভীষণ সোজা! যেই দেখবি হাত পা বরফের মতো ঠান্ডা, বুঝবি খেল খতম পয়সা হজম।”
তারপর থেকে প্রায়ই গায়ে হাত দিয়ে দেখে মোল্লা। কোথায় কী, ঠান্ডার নামগন্ধ নেই। এইভাবে বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শীত এল। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় কাঠ কাটতে গেল মোল্লা, সঙ্গী বলতে একটা গাধা। কাঠ কাটছে আর বরফ পড়ছে ঝুপঝাপ। হঠাৎ গায়ে হাত দিয়ে দেখে শরীর হিম ঠান্ডা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মোল্লা, “যাক, বাঁচা গেল। এতদিনে মরলাম।”
(সমাপ্ত)
ছবি সৌজন্য: Facebook, Wikipedia, Free stock
গৌতম সেনগুপ্তের লেখালেখির বয়স প্রায় ৫০ বছর। কবিতা দিয়ে শুরু, এরপর গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ- সাহিত্যের একাধিক শাখাতেই তাঁর অবাধ বিচরণ।
৫টি স্বতন্ত্র গল্পের বই ছাড়াও রয়েছে গল্প সমগ্র ও উপন্যাস সংগ্রহ।.
অনুবাদ করেছেন ২টি দলিত উপন্যাস ও কলম্বিয় সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ইন্টারভিউ।
তাঁর গল্প অনুবাদ হয়েছে ইংরাজি, তামিল ও হিন্দি ভাষায়।
সম্মাননা: কথা পুরস্কার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার।