মৃণাল সেনকে আমি মৃণালদা বলেই ডেকে এসেছি আজীবন, তাই এই লেখাতেও সেই সম্বোধনটা বজায় রাখলাম। আশা করি এতে পাঠকের রসভঙ্গ হবে না। মৃণালদা ছিলেন দারুণ আড্ডাবাজ আর বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। ওঁর বাড়িতে, শুটিঙে এবং অন্যত্র কত যে আড্ডা দিয়েছি, আর কত রকমের বিষয় সেইসব আড্ডায় আমরা ছুঁয়ে গেছি, তার হিসেব কষা অসম্ভব। আজকের লেখায় তাই মৃণালদা’র একজন বিশেষ বন্ধুর কথা লিখব– নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।
আরও পড়ুন: এক বাঙালি গুপ্তচরের গল্প
মৃণালদা’র সঙ্গে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের প্রথম দেখা হয় ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। দু’জনেই সে বছর জুরির ভূমিকা পালন করতে গেছেন। ততদিনে মৃণালদা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচ্যুড’ পড়ে ফেলেছেন এবং মুগ্ধ হয়েছেন। জুরির সদস্য হিসেবে সেবার দুজনের প্রচুর আলাপ আলোচনা চলেছিল; প্রথম আলাপ থেকে বন্ধুত্বে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এর কয়েকমাস পরেই, ২১ অক্টোবরে মার্কেজের নোবেল জয়ের ঘোষণা করা হয়।

পরের সাক্ষাৎ ১৯৮৮ সালে। এবার হাভানা ফিল্ম স্কুলের শিক্ষকের ভূমিকায়। কিউবার হাভানা শহরে এই ফিল্ম স্কুলের সঙ্গে গোড়া থেকেই যুক্ত ছিলেন মার্কেজ। মৃণালদাও কিছুদিন পড়িয়েছিলেন ওখানে। এই দ্বিতীয় মোলাকাতে বন্ধুত্ব গাঢ় হয় দু’জনের। ততদিনে মার্কেজও মৃণালদার ছবি দেখে ফেলেছেন এবং পছন্দও করেছেন।
কয়েক বছর পরে কলকাতার এক আলোচনায় মৃণালদা বলেছিলেন মার্কেজ ওঁকে অনুরোধ করেন মার্কেজের যেকোনও একটি বই অথবা গল্প (‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচ্যুড’ বাদ দিয়ে) নিয়ে সিনেমা করতে। কিন্তু মৃণালদা রাজি হননি। কারণ মার্কেজের বইয়ের স্বত্ব কিনতে যত টাকা লাগবে, তাতে একটা গোটা সিনেমা বানিয়ে ফেলবেন মৃণাল দা। সে কথা বলেওছিলেন মার্কেজকে এবং তখন তিনি একেবারে বিনামূল্যে দিতেও তৈরি ছিলেন এবং তাতে মৃণালদা বলেন “করতে পারি, তবে দুটো শর্তে। প্রথম শর্ত হল, তুমি স্ক্রিপ্ট দেখতে পাবে না এবং শুটিং-এ আসতে পারবে না। এবং দ্বিতীয়, সিনেমাটা দেখার পর আত্মহত্যা করতে পারবে না। এতে রাজি থাকলে বল।”

এর বেশ কিছুদিন পর একদিন মৃণালদার বাড়ি গেছি। আড্ডা চলছে। হঠাৎ মার্কেজের প্রসঙ্গ উঠতে বলেছিলেন, তিনি যে ধরনের ছবি করেন, ওঁর ছবির যা ভাষা, তা ঠিক মার্কেজের লেখার সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা দু‘জনেই যেহেতু মার্কেজ-ভক্ত, এবং ততদিনে প্রকাশিত সব লেখাই পড়েছি, সেদিন আমরা একটা মজার খেলায় মেতেছিলাম। মার্কেজের একের পর এক গল্প ধরে ধরে হিসেব করেছিলাম এর মধ্যে কোন গল্পটা ঠিক মৃণালদার ছবির স্টাইলের সঙ্গে মানানসই। সত্যি বলতে কী, এমন কোনও বই/গল্প খুঁজে পাইনি।
আগামীকাল মৃণালদার শতবর্ষ। ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস। শুনলাম কিছুদিন আগেই মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিচ্যুড’ এখন একটি দীর্ঘ নেটফ্লিক্স সিরিজ।
ছবি সৌজন্য:
মার্কেজ ও মৃণাল সেন- কুণাল সেন
মৃণাল সেনের অন্য দু’টি ছবি: সঞ্জিত চৌধুরী
সঞ্জিত চৌধুরীর জন্ম কলতাতায় এবং লেখাপড়া সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। পেশায় আলোকচিত্রী এবং পরিচালক সঞ্জীত একজন প্রিন্ট ও গ্লাস নেগেটিভ সংগ্রাহকও। ওঁর ছবি দেশে বিদেশে একাধিক প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি একজন বিশিষ্ট খাদ্যবিশারদ ও রন্ধন ইতিহাসবিদ হিসেবেও সুবিদিত।