Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব

তপন সাহা

জুলাই ৬, ২০২৩

Globalization and Its effects on nature
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

১৭১২ সালে টমাস নিউকমেন বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করার পরবর্তীকালে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অর্থাৎ প্রায় ১৭৫০  সাল থেকে শিল্প বিপ্লবের শুরু বলা হয়। ঐ সময়েই ক্ষুদ্র শিল্প থেকে ক্রমশ দ্রুতহারে বৃহৎ শিল্পের দিকে উৎপাদন  ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। এর অনেক আগে থেকেই শিল্পের কাঁচামাল আহরণ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সারা পৃথিবীতে অনুসন্ধান শুরু করে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় পদার্পণের পরে ঐ অঞ্চলকে উপনিবেশের অধীনে আনা শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ওই সময়কালেই ভাস্কো-দা-গামার জাহাজ-যাত্রা আফ্রিকা-ভারত এই অঞ্চলকে ইউরোপীয়দের দ্বারা উপনিবেশ বানানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিল্প মালিকেরা মুনাফার লক্ষ্যে শিল্প-কারখানা গঠনের মাধ্যমেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটাতে শুরু করল। পুঁজিবাদী দেশগুলি তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে নিজেদের দেশে এবং তাদের অধীনে থাকা উপনিবেশের দেশগুলি থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে শুরু করল। ফলে সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবী জুড়েই সমস্ত ধরনের শক্তির উৎস (কাঠ, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি) সহ অন্যান্য প্রায় সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদগুলি অধিকতর মাত্রায় অযৌক্তিকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। 

শিল্প-বিপ্লবের প্রাথমিক পর্যায়ে শিল্প থেকে দূষিত বায়ু বা জল নির্গত হলেও সেই পরিবেশ দূষণ নিয়ে মানুষ চিন্তিত ছিল না। পৃথিবীর আত্মশুদ্ধিকরণের ক্ষমতা ছিল। জঙ্গল, সমুদ্র ও জলাভূমি দূষিত বায়ু শোষণ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে নির্মল রাখত। দূষিত জল যা সমুদ্র, নদীনালা, জলাশয় ও জলাভূমিতে নিক্ষেপ করা হত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জলে থাকা জলজ উদ্ভিদ সেই দূষিত জলের ক্ষতিকর পদার্থগুলিকে শোষণ করে জলকে দূষণমুক্ত রাখত। কিন্তু দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দূষকের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবী তার আত্মশুদ্ধিকরণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। প্রথম খ্রিষ্টাব্দের ২৫ কোটি জনসংখ্যা ১৮২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০০ কোটি। আর ১৯৩০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটি। অর্থাৎ ১০০ কোটি থেকে ২০০ কোটি হতে লেগেছিল মাত্র ১১০ বছর। তারপর থেকে রকেটগতিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ –এর নভেম্বর মাসে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি। এই ৮০০ কোটির জনসংখ্যার মধ্যে ৭০০ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে গত ২০০ বছরে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু হয়ে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পুঁজিবাদ দুনিয়াব্যাপী তার বিস্তার ঘটিয়েছে, সেই সঙ্গে চরম আকার ধারণ করেছে বায়ু দূষণ ও জল দূষণ।

Water Pollution

ইউরোপ, আমেরিকা সহ অনেক উন্নত দেশে পরিবেশ রক্ষার দিকে নজর না দিয়ে দ্রুতহারে পুঁজিবাদী পথে মুনাফা -কেন্দ্রিক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার ফলে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান সহ প্রায় ৩৯টা শিল্পোন্নত দেশে বায়ুদূষণ, জলদূষণ, শব্দদূষণ, আবর্জনা-দূষণ ইত্যাদি চরম আকার ধারণ করে। বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশগুলিতে অ্যাসিড বৃষ্টি, পুকুর, লেক ও অন্যান্য জলাশয়ে জলদূষণ প্রভৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। অ্যাসিড বৃষ্টির জন্য লেকের মাছের মৃত্যু, মার্বেল পাথরের ইমারত বা রাজপ্রাসাদ্গুলির ক্ষতি শিল্পমালিক ও রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তায় ফেলে দেয়। ঐ সময়ে ১৯৬২ সালে রাচেল কার্সেনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটি পরিবেশের ক্ষতিকর দিকগুলি তুলে ধরে সারা পৃথিবীব্যাপী সারা ফেলে দেয়। এই সময় থেকেই শিল্পোন্নত দেশগুলি দূষণরোধী নানা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে নজর দেয় এবং তার প্রয়োগ করে নিজেদের দেশে দূষণ-মত্রা কমানোর প্রয়াস শুরু করে। শিল্পোন্নত দেশগুলি যাদের দূষণ বেশি, আন্তর্জাতিকভাবে তারা বিশ্বজুড়ে কিছু পরিকল্পনা রূপায়নের চিন্তাভাবনা শুরু করে। এরই ফলশ্রুতি ১৯৭২ সালের স্টকহোম সম্মেলন। ‘স্টকহোম সম্মেলন’ পরিবেশের প্রথম বিশ্ব সম্মেলন হিসাবে শুধু ঐতিহাসিক নয়, তার পাশাপাশি নীতি নির্ধারকদের কাছে একটি মাইলস্টোন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ১৯৭২ সালের আগে মাত্র ১০টি দেশে সরকারের  পরিবেশ বিভাগ বা মন্ত্রক ছিল। ১৯৮২ সালের মধ্যে ১১০টি দেশে জাতীয় ও রাজ্যস্তরে পরিবেশ বিভাগ বা মন্ত্রক গঠিত হয় এবং বিভিন্ন দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নও দ্রুতহারে হতে শুরু হয়। এখন প্রতিটি দেশেই পরিবেশ বিভাগ বা মন্ত্রক আছে।

অ্যাসিড বৃষ্টির জন্য লেকের মাছের মৃত্যু, মার্বেল পাথরের ইমারত বা রাজপ্রাসাদ্গুলির ক্ষতি শিল্পমালিক ও রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তায় ফেলে দেয়। ঐ সময়ে ১৯৬২ সালে রাচেল কার্সেনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটি পরিবেশের ক্ষতিকর দিকগুলি তুলে ধরে সারা পৃথিবীব্যাপী সারা ফেলে দেয়। এই সময় থেকেই শিল্পোন্নত দেশগুলি দূষণরোধী নানা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে নজর দেয় এবং তার প্রয়োগ করে নিজেদের দেশে দূষণ-মত্রা কমানোর প্রয়াস শুরু করে। শিল্পোন্নত দেশগুলি যাদের দূষণ বেশি, আন্তর্জাতিকভাবে তারা বিশ্বজুড়ে কিছু পরিকল্পনা রূপায়নের চিন্তাভাবনা শুরু করে। এরই ফলশ্রুতি ১৯৭২ সালের স্টকহোম সম্মেলন। 

উপনিবেশের কবলে থাকাকালীন আমাদের মতো দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই শোচনীয় ছিল। পরাধীন অবস্থায় আমাদের দেশ থেকে যথেচ্ছভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করা হয়েছে। এই অরণ্য-সম্পদ লুণ্ঠনকে মসৃণ করার জন্য ব্রিটিশরা আমাদের দেশে ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৮৬৫ তৈরি করে বনবাসীদের অরণ্যের অধিকার অনেকটাই হরণ করেছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে আমাদের দেশে ইস্পাত, বিদ্যুৎ, জীবাস্ম জ্বালানি-সহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ভারী শিল্প গড়ে তোলা এবং রেলওয়ে, পরিবহন, নগরায়ণ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা সংস্থা, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদির পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের তৎকালীন শিল্পপতিরা এগিয়ে আসেননি বা তাঁদের ক্ষমতা ছিল না। ভারত সরকার গত শতাব্দীর ’৫০ –’৭০ দশকের মধ্যে সরকারি উদ্যোগে এই ভারী শিল্প ও বিভিন্ন পরিকাঠামো গড়ে তোলে। যদিও কিছু ভারতীয় শিল্পপতি নিজেরাও ভারত সরকারের গড়ে তোলা ভারী শিল্প ও পরিকাঠামোর উপরে ভিত্তি করে কিছু বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলে। এর উপর ভিত্তি করে আবার ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। স্বাধীনতার পরেও খনি, ব্যাঙ্কিং ও কিছু বৃহৎ শিল্প ও পরিষেবাক্ষেত্র বিভিন্ন ব্রিটিশ কোম্পানির অধীনে ছিল। এসবের অনেকগুলিই ভারত সরকার অধিগ্রহণ করে।

Stockholm conference
স্টকহোম সম্মেলন

আমদের দেশে স্বাধীনতার আগে বা পরে ’৮০ –র দশকে ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনার আগে পর্যন্ত যে সমস্ত শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল তার প্রায় কোনটাতেই দূষণরোধী প্রযুক্তি ছিল না। যদিও আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালে জলদূষণ ও ১৯৮১ সালে বায়ুদূষণ নিয়ে আইন প্রণয়ন হয়।

৮০-র দশকের প্রথম দিকে আর্থিক মন্দার কারণে ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি আর্থিক প্রয়োজনে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আই.এম.এফ.ও ও উন্নত দেশগুলির শরণাপন্ন হয়। সেই আর্থিক অনুদান বা ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসাবে উন্নত দেশগুলি কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের উপদেশ দিতে শুরু করে। উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক সহযোগিতার শর্ত হিসাবে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসে মূলত বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণ, ভর্তুকি প্রত্যাহার, কর কাঠামোর পরিবর্তন, পরিষেবা-ক্ষেত্র থেকে সরকারি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার ইত্যাদি ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করতে বলা হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আই.এম.এফ.ও ও উন্নত দেশগুলি থেকে ঋণ বা অনুদান নেওয়ার জন্য কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের শর্ত মেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করে। ’৬০–৭০ দশকে খনি,   ব্যাঙ্কিং, কিছু বৃহৎ শিল্প ও পরিষেবা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রকে সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয় বা তার অনেক কিছুই ভারত সরকার অধিগ্রহণ করে। ’৮০ দশকে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের শর্ত মেনে আবার তার উল্টোদিকে হাঁটা শুরু হয়।

৮০-র দশকের প্রথম দিকে আর্থিক মন্দার কারণে ও আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি আর্থিক প্রয়োজনে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আই.এম.এফ.ও ও উন্নত দেশগুলির শরণাপন্ন হয়। সেই আর্থিক অনুদান বা ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসাবে উন্নত দেশগুলি কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের উপদেশ দিতে শুরু করে। উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক সহযোগিতার শর্ত হিসাবে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। 

কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের নামে শিল্প-কারখানা বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নীকরণ, ব্যাঙ্কিং, ইনস্যুরেন্স, ডাক ও তার ইত্যাদি পরিষেবায় বেসরকারি সংস্থার প্রবেশ, কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস, পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস ও বেসরকারিকরণে উৎসাহ দান, আমদানি ক্ষেত্রে উদারীকরণ ইত্যাদি পদক্ষেপ আমাদের দেশে আশির দশকের শেষ থেকে নেওয়া শুরু হয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও একই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ৯০-এর দশকে বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থা গঠনের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জুড়ে মুক্ত বাণিজ্য, উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণকে বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম নীতি ও আইনি রূপরেখা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসকে শর্ত হিসাবে না রেখে আন্তর্জাতিক স্তরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার আইনি রূপ দেয়। বিশ্বের অনেক দেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল ও যোগদান করতে চায়নি। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এর বিরোধিতা করলেও ১৯৯৫ সালে ভারত সরকার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদান করে। আশির দশকের শেষ থেকে ঋণ বা অনুদান গ্রহণের শর্ত হিসাবে বীজনীতি, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, কৃষিনীতি, আমদানি-রফতানি নীতি, জল নীতি, পেটেন্ট নীতি শ্রম নীতি ইত্যাদি বহুবিধ নীতি গ্রহণ করা হচ্ছিল এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন সংসদ থেকে আইন পাশও করা হচ্ছিল। ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদানের পরবর্তীকালে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ’৯০ দশকের শেষ থেকে বর্তমান ২০২৩ সাল পর্যন্ত, বিশেষভাবে গত দশ বছরে ভারতের খনিজসম্পদ, পাহাড়, জলসম্পদ ও অরণ্য সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাঙ্কিং, ইনস্যুরেন্স, বন্দর, এয়ারপোর্ট, রেল, রাস্তাঘাট সহ সমস্ত সরকারি শিল্পসংস্থাকে বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আগ্রাসীভাবে নানা নীতি ও আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।

Industry Pollution

২০১০ সাল পর্যন্ত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে  যে সমস্ত আইন, নিয়মাবলী (রুলস), ও নোটিফিকেশন করা হয়েছে বা তার সংশোধন করা হয়েছে তা মূলতঃ অধিকাংশই পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিরোধ ও উন্নয়নকে লক্ষ্য রেখেই করা, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলোর প্রয়োগ সঠিকভাবে হয়নি এবং প্রশাসনিক গাফিলতি ও অস্বচ্ছতা ছিল। কিন্তু তার পর থেকে যে পরিবর্তন ও সংশোধন— তা মূলত সমস্ত ক্ষেত্রগুলিকে বেসরকারিকরণ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যেই করা হচ্ছে। এই পরিবর্তন ও সংশোধন করার জন্য বহু ক্ষেত্রে করোনাকালকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ২০২০–র মার্চ থেকে ২০২২-এর মার্চের মধ্যে ৭৪টি গেজেট বিজ্ঞপ্তি, ৪২টি অফিস মেমোরেন্ডাম, ৭টি অফিস সার্কুলার ও কিছু অফিস অর্ডারের মাধ্যমে শুধু Environment (Protection) Act 1986 –এর অধীনে সমস্ত রুলস ও নোটিফিকেশনের ৩৯টা পরিবর্তন ও সংশোধন করেছে।  

এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট ২০০৬ (ইআইএ ২০০৬) নোটিফিকেশনের ২০২০ সংশোধনীতে কর্পোরেটদের দ্বারা পরিবেশ ধ্বংসের ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের সমস্ত রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে। উড়িষ্যা ও ছত্তিসগড়ে আগে খনি থেকে খনিজ সম্পদ নিষ্কাশন, গুজরাটে বন্দর নির্মাণ, বৃহৎ শিল্প ইত্যাদি প্রকল্প রূপায়নের ক্ষেত্রে  কর্পোরেটদের ই আই এ ২০০৬-এর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী অনেক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল এবং বনবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল। ২০২০ সংশোধনীতে বনবাসীদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রে আর তাঁদের কোনও অনুমতিই নিতে হবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক ৩০ জুন, ২০২২-এ জল (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৭৪ ও বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১ –র সংশোধনীর প্রস্তাব দেয়। এই সংশোধনীগুলিকে আইনে রূপান্তর করার জন্যে ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে আশ্চর্যজনকভাবে কোনও আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প-মন্ত্রক লোকসভায় ‘জন বিশ্বাস বিল’ পেশ করে। এই সংশোধনীতে আগে রাজ্য সরকারের যে সমস্ত ক্ষমতা ছিল তার হস্তান্তর করে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে নেয়, যা আমাদের দেশের ফেডারেল কাঠামোর পরিপন্থী। ওই দুটি আইন লঙ্ঘন করলে আগে যে আর্থিক শাস্তির বিধান ছিল তাও লঘু করে দেওয়া হয়। পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন ১৯৮৬- ও বায়ু (দূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ১৯৮১-এর ১৫(২) ধারায় ধারাবাহিক অপরাধের জন্য প্রতিদিন যে আর্থিক জরিমানার বিধান রাখা ছিল, জুলাই ২০২২-এর সংশোধনীতে জন বিশ্বাস বিলে তার পরিমাণ অনেক হ্রাস করা হয়েছে। ডিসেম্বর ২০২২-এর ‘জন বিশ্বাস বিল’ ও জুলাই ২০২২-এর সংশোধনী— এই দুটিতেই বিচারের ব্যবস্থা আদালতের হাত থেকে নিয়ে বিচারকারী কর্মকর্তা হিসাবে কোনও প্রশাসনিক আধিকারিকের হাতে ন্যাস্ত করার কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ সমস্ত নিয়ন্ত্রণ সরকার নিজের হাতে রাখবে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক ‘বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০’-র পরিবর্তন করে জুন, ২০২২-এ ‘বন সংরক্ষণ রুল ২০২২’ নামে একটি সংশোধনীর প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাবে যে বিধানগুলি দেওয়া হয়েছে তার প্রায় সবকটিই অরণ্য ধ্বংসের সহায়ক হবে— যে কোনও ধরনের বনভূমিতে যেখানে বনবাসী উপজাতি বা বনবাসী বা আদিবাসীদের পরম্পরাগত অধিকার আছে, সেই অধিকার হরণ করে সরকার বনাঞ্চলকে অধিগ্রহণ করতে পারবে। যেখানে ২০০৬ সালের অরণ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী কোনও বনভূমিতে অন্য কোনও উদ্দেশ্যে— যেমন খনি, কারখানা, বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প,  রাস্তা ইত্যাদি তৈরির ক্ষেত্রে আদিবাসী-অরণ্যবাসীদের অনুমতি নেওয়া জরুরি। কিন্তু ‘বন সংরক্ষণ রুল ২০২২’ প্রস্তুত করে এ নিয়ম নস্যাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। এই সংশোধনীকে আইনে পরিণত করার জন্য বন সংরক্ষণ বিল ২০২৩ সংসদে পেশ করা হয়েছে।

Forest rule

দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বায়নের লক্ষ্য পূরনের ফসল হিসাবে গুটিকয়েক মানুষের অবিবেচনা প্রসূত ভোগবিলাসবহুল জীবনযাপন জন্যে সারা পৃথিবী জুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের তীব্র সংকট সৃষ্টির সাথে সাথে পরিবেশ দূষন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। আজ পৃথিবীর অস্তিত্বই সংকটের মুখে।  কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধির ফলে প্রাক শিল্পবিপ্লব সময় থেকে ২০২২ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বর্তমানে এটা প্রতিষ্ঠিত যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সিংহভাগই দায়ী হচ্ছে মানুষের সার্বিক কাজকর্মের পদ্ধতি। কলকারখানা, পরিবহন ও অন্যান্য কারণে জীবাস্ম জ্বালানীর ব্যবহারে বাতাসে অতিরিক্ত গ্রিন হাউস গ্যাস  নির্গমন এবং জমির ব্যবহার ও জমির চরিত্রের পরিবর্তনের  ফলে  পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাসের শোষনের ক্ষমতা হ্রাসের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটে চলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমবাহের গলন বৃদ্ধি, সমুদ্র জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি, অসময়ে বৃষ্টি, ঝড়ঝঞ্ঝার সংখ্যা বৃদ্ধি, অল্প সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি, তাপপ্রবাহ, অসময়ে তুষারপাত, বিভিন্ন ঋতু অর্থাৎ শীত, গ্রীষ্ম,বর্ষা, ও  বসন্তের  সময়কালের পরিবর্তন সারা পৃথিবী জুড়েই স্থানবিশেষে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের অভিমত সারা পৃথিবী জুড়ে ঝড়ঝজঞ্ঝার সংখ্যা ও প্রাবল্য বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং তাঁদের আশংকা এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় আরো দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাবে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আই পি সি সি) অভিমত যদি বর্তমান গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধির হার বজায় থাকে তাহলে একবিংশ শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী সেন্টিগেড বা তারও বেশী বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ২.৫ মাইক্রোনের ভাসমান ধূলিকণার জন্য প্রতি বছর কমপক্ষে ৪২ লক্ষমানুষের মৃত্যু ঘটে এবং ১০ মাইক্রোনের ভাসমান ধূলিকণা ও বিভিন্ন প্রকার দূষিত গ্যাসের জন্য আরো ৩৮  লক্ষেরও বেশি মৃত্যু ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট থেকেই জানা যায় পাঁচ বছরের অনুর্ধ্ব কমপক্ষে ১৫ শতাংশ শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে।  ভারতে প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্যে ১২ লক্ষেরও বেশি মানূষের মৃত্যু হয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে ২ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে।    

বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেট কাঁচামাল সংগ্রহ, কারখানা স্থাপন ও বাজার তৈরী জন্যই পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ দূর করা ও মুক্ত বাজার তৈরী করার পদ্ধতির পোশাকি নাম হল বিশ্বায়ন। সাধারন মানুষ অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কবলে পড়ে ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিকভাবে আরো নিম্নগামী হয়েছে, দেশে বেকারত্ব রকেটগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে, অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য বাড়ছে, দেশে অপুষ্টি ও ক্ষুধার্থ মানুষের হার ক্রমশঃ বাড়ছে,  বর্তমানে এই সময়েতেই দেশে ভারতের শীর্ষতম ধনী ১০ জন ব্যক্তির মালিকানায় চলে গেছে দেশের মোট সম্পদের ৫৭ শতাংশ; অর্থনৈতিক বৈষম্যের নীচের দিকে থাকা জনগণের অর্ধেক অংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ১.৩ শতাংশ। কর্পোরেটদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ ও বন সংক্রান্ত আইনগুলির পরিবর্তনের জনবিরোধী এই   প্রয়াসের বিরুদ্ধে সমস্ত অংশের মানুষকে সচেতন করে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে এই আইনগুলি ইতিমধ্যেই প্রয়োগ করার প্রয়াস শুরু হয়েছে যা আগামীতে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির পথকে সুগম করবে এবং আমাদের দেশে পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ধ্বংসলীলা  তরান্বিত হবে।    

তথ্যসূত্র:

১। Globalization and Its Discontent – Josheph   Stigliz, Punlished by Peguin Books.

২। বিশ্বায়নে জমি, জল ও খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন ( একটি প্রবন্ধ) – তপন সাহা, 

                                    এক বিকল্প বিশ্বের সন্ধানে, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত, ২০০৪।

৩। Ecology and Equity – Madhad Gadgil and Ramchandra Guha, Penguin Book, India, 1995.

৪) জল – মানবাধিকার না পণ্য (একটি প্রবন্ধ) – জলের নানা কথা, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত, ২০০৫।

 

 

ছবি সৌজন্য: Pixabay, Rawpixel

Tapan Saha 2020

পরিবেশ বিজ্ঞানী, দীর্ঘদিন ধরে জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও প্রাক্তন সম্পাদক। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কমিটির সহ-সভাপতি।

Picture of তপন সাহা

তপন সাহা

পরিবেশ বিজ্ঞানী, দীর্ঘদিন ধরে জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও প্রাক্তন সম্পাদক। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কমিটির সহ-সভাপতি।
Picture of তপন সাহা

তপন সাহা

পরিবেশ বিজ্ঞানী, দীর্ঘদিন ধরে জনবিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও প্রাক্তন সম্পাদক। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কমিটির সহ-সভাপতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com