রাত সাড়ে নটা বাজল। কনসালটেন্সিতে আসা শেষ রোগীটি চলে যেতেই ডাক্তার সুজাত গুপ্ত হাসপাতালের ন’তলায় তাঁর চেম্বারের সহায়কদের বললেন সমস্ত বড় আলো নিভিয়ে বাড়ি চলে যেতে। অন্ধকার ঘরে টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে একটা জার্নাল খুলে পড়তে শুরু করলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে ঢুকলেন চিকিৎসা-জগতের বাইরে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন মানুষ অলোকেশ গুহ বিশ্বাস। অনেক দিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বর্ষীয়ান অলোকেশের ঠান্ডা মাথার খাতির করেন সুজাত। পরামর্শ নেন নানা ব্যাপারে। মিতভাষী অলোকেশের শরীরের ভাষায় আত্মবিশ্বাস অতি প্রকট। একটা চেয়ার টেনে বসে দু’টো হাত জড়ো করে টেবিলের ওপর রাখলেন অলোকেশ। জার্নালটা বন্ধ করে সুজাত উদগ্রীব হয়ে তাকালেন তাঁর মুখের দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, “রাজি হল?”
– হয়নি। তোমার কন্ট্রিবিউশনের কথা হিসেব করে যথেষ্ট আকর্ষণীয় প্রস্তাবই দেওয়া হয়েছিল। এখানে চাকরি করে যা মাইনে পায়, তার ডবলের চেয়েও বেশি টাকার অফার। কিন্তু শুনলই না ভালো করে। শুরুতেই না বলে দিল।
– কেন?
– বলল, আই লিগ খেলার জন্যে ওর এমন তাড়াহুড়ো নেই যে কাশ্মীর ছুটতে হবে। তাছাড়া কাশ্মীর খুব গোছানো টিম। ওদের এক নম্বর গোলকিপার রানা ভাট ইন্ডিয়া টিমে রেগুলার। আমাকে কলকাতা থেকে নিয়ে গিয়ে গোটা সিজন সাইডলাইনে বসিয়ে রেখে ওরা যে পরের বছর নতুন ট্যালেন্ট খুঁজবে না, তার কোনও গ্যারান্টি আছে? কলকাতার ময়দান, ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে যাব কেন?
অলোকেশের উত্তর শুনে চুপ করে গেলেন সুজাত। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভেবে প্রশ্ন করলেন, “তাহলে প্ল্যান এ-তে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা নেই আর?”
প্রশ্নটার জন্যে যেন তৈরিই ছিলেন অলোকেশ। আত্মবিশ্বাসী গলায় বললেন, “কোনও সম্ভাবনা নেই, তা বলা যাবে না। দেখতে হবে ওর ব্যাঙ্কই ওকে রাঁচি, পটনা বা ভুবনেশ্বরে বদলি করতে পারে কিনা। কিন্তু সেটা তো রাতারাতি হবে না। এ কাজের ঠিক লোককে খুঁজে বার করতে একটু সময় লাগবেই। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।”
– অপেক্ষা করার সময় নেই, অলোকেশদা। আমি তো দেখছি ব্যাপারটা দিনে দিনে ডিফিকাল্ট হয়ে উঠছে। এখন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে এরপর হয়ত কিছু করার সুযোগই থাকবে না। অপেক্ষা করার কথা ভুলে গিয়ে আপনি তাড়াতাড়ি প্ল্যান বি-র কাজে নেমে পড়ুন।
– প্ল্যান বি শুরু করার করার আগে তোমাকে দু’বার নয়, দু’শো বার ভাবতে বলব। মনে আছে নিশ্চয়, আগের বার দু’ দু’টো প্রাণ চলে গিয়েছিল আমাদের হিসেবের একদম বাইরে!
– দু’টো…?!
– তোমার মায়ের মৃত্যুটাকেই বা এর থেকে বাদ দিই কী করে?
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সুজাত। মায়ের মৃত্যুর দায় কি পরোক্ষে সুজাতর ওপরেই চাপাতে চাইছেন অলোকেশদা? না, তা কী করে সম্ভব? অলোকেশদা নিজেই তো সব ঠিক করেছিলেন। তবু অলোকেশ নিজেই এই অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গ তোলায় অত্যন্ত বিরক্ত হলেন সুজাত। গলায় একরাশ বিদ্রূপ ঢেলে বললেন, “তাহলে অলোকেশদা, আপনার মতে আমার কী করা উচিত? পারিবারিক মর্যাদার কথা তো এখন মুখে আনাও পাপ। অন্তত মেয়েটার দিক থেকেই ভাবুন। সে তার নিজের শিক্ষা, নিজের কেরিয়ার, নিজের সম্ভাবনা, নিজের ভবিষ্যতের কথা একটুও না-ভেবে একটার পর একটা ভুল করবে। কখনও ফিল্ম টেকনিশিয়ান, কখনও ফুটবল প্লেয়ার ধরে ঝুলে পড়তে চাইবে। আর আমি, মধ্যবিত্ত জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা গন্ডি কেটে বেরোনোর সব অহঙ্কার মাটিতে মিশিয়ে বলব, হ্যাঁ হ্যাঁ, তা-ই করো। এই জন্যেই তো তোমার সেরা পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছি, সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছি, আদরে ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছি, পৃথিবীর এতগুলো দেশ দেখিয়েছি, দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে…”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অলোকেশের থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন সুজাত। তাঁর নির্ভরতার শেষ জমিটুকুও যেন সরে যাচ্ছে পায়ের তলা থেকে!
– ফুটবল খেলে কিন্তু এ দেশেও অনেকে এখন মধ্যবিত্ত জীবনের সীমানা পেরোচ্ছে সুজাত।
অলোকেশকে কথা শেষ করতে দেওয়ার ধৈর্যও সুজাত ধরে রাখতে পারলেন না। ঝাঁপিয়ে পড়লেন উত্তেজিত গলায়, “টাকা পয়সার কথা কি আমি কোনও দিন বলেছি অলোকেশদা? অনেক ফিল্ম টেকনিশিয়ান আছে যারা আমার চেয়ে বেশি রোজগার করে। এরকম অনেক ফুটবলারও নিশ্চয়ই আছে। আমি কি সে সব জানি না? কিন্তু মিডিয়োক্রিটির যে জগৎ, তাকে আপনারা মধ্যবিত্ত বলেন না? যেখানে সব চাওয়া-পাওয়া মাঝারি মাপের? এরা সব সেই জগতের লোক। আর ঠিক সেইখানেই আমার আপত্তি। আপনি একটা ফিল্মমেকার দেখান, যার স্বপ্ন অস্কার পাওয়া। কি একটা ফুটবলার আনুন যার স্বপ্ন ইংল্যান্ড-স্পেন-জার্মানির লিগে খেলা – আমি তাকে মাথায় করে রাখব।”
অলোকেশের প্রতিক্রিয়া বুঝে নিতে একটু থামলেন সুজাত। অলোকেশ কোনও কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সুজাত নিজেই কথা শুরু করলেন আবার। বললেন, “আচ্ছা, আমি যদি আশা করি, আমার মেয়ে এমন একটা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাবে যার দুনিয়াটা কলকাতা বা ভারতের গন্ডিতে বাঁধা নয়, যে সত্যিকারের দুনিয়াদারি করার স্বপ্ন দেখে, সেটা কি খুব বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে আপনার? সে শিক্ষক হোক, বিজ্ঞানী হোক, অর্থনীতিবিদ, লেখক, শিল্পী, উকিল, ব্যবসায়ী, ফিল্মমেকার, ফুটবলার, দর্জি কি রাঁধুনি – যা কিছু, আমার কোনও আপত্তি নেই। বিদেশি ক্লাবের হয়ে বিদেশের মাঠে নামার স্বপ্ন দেখার সাহস রাখে আপনার এই ফুটবলার? রাখলে আই লিগের টিমে ঢোকার সুযোগটাকেই বড় করে দেখত, অনিশ্চয়তাটা নয়। চুপ করে কী ভাবছেন অলোকেশদা, ভুল বলছি, বাজে বকছি?”
একটানা কথাগুলো বলে থামলেন সুজাত। অলোকেশ তখনও কোনও উত্তর না দিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সুজাত চোখ সরিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গেলেন ওয়াশ রুমের দিকে। ফিরে এসে দেখলেন, অলোকেশ তেমনই সুস্থিত ভঙ্গিতে অপেক্ষা করছেন। ওঠার সময় তাঁর হাত দু’টো টেবিলের যেখানে রাখা ছিল, এখনও ঠিক সেখানেই রাখা। গলায় আবার ঠাট্টার সুর এনে সুজাত বললেন, “হল আপনার দু’শো বার ভাবা? এবার কি প্ল্যান বি নিয়ে কথা বলব আমরা?”
– তাছাড়া তো উপায় নেই সুজাত!
এতক্ষণের সব বিদ্রূপের উত্তর দিতে গম্ভীর গলায় মুখ খুললেন অলোকেশ। “তুমি মনে করছ মেয়েকে সমস্ত স্বাধীনতা দিচ্ছ তুমি। অথচ বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে, ওই স্বাধীনতাটুকু ছাড়া মেয়েকে আর সব কিছু দিতেই তুমি তৈরি। এর চেয়ে বেশি বলার অধিকার আমার নেই। কারণ, তুমি বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ এবং সফল মানুষ। তুমি যেটা দেখতে পাচ্ছ না, তোমাকে সেটা দেখানোর ক্ষমতা আমার অন্তত নেই। তাই ও বিষয়ে আলোচনার কী দরকার? তুমি প্ল্যান বি তৈরি রাখতে বলেছিলে। আমার কাজ সেটা নিখুঁত করে বানানো। এবার শুনে বলো, সেটা তোমার পছন্দ কিনা।”
ন’তলার বড় বড় জানলার বাইরে তখন সল্ট লেকের আধো আলো আধো ছায়া। আর, ঘরের মধ্যে একা ল্যাম্পের নরম আলোয় মস্ত একটা টেবিলের দু’দিকে শক্ত দুটো গম্ভীর মুখ অনেকক্ষণ ধরে নানা পরিকল্পনা, নানা দেনাপাওনার হিসেব-নিকেশ শেষ করে যখন বেরোল একসঙ্গে, নারকেল-সুপুরি গাছের মাথার ওপর দিয়ে নিঃসঙ্গ একটা মনখারাপ চাঁদ তখন বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মেঘমিছিলের দুরন্তপনায়। নিচের রাস্তায় সারি সারি ল্যাম্পপোস্টের আলোর চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল দেখাছে ছুটে যাওয়া গাড়ির টেললাইটের রক্তিম মরীচিকা।
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।