সাহেবদের গর্বের ক্যালকাটা ক্লাবের সঙ্গে মোহনবাগানের একটি ম্যাচ চলছিল, মোহনবাগান মাঠে। কিন্তু দেখা গেল ম্যাচ রেফারি ক্লেইটন সাহেব পক্ষপাতিত্ব করেই চলেছেন। কারণ, মোহনবাগানের ফুটবলাররা বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে গেলেই তিনি বাঁশি বাজিয়ে দিচ্ছেন। পরপর কয়েকবার এমন ঘটনা দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন গোষ্ঠ পাল। দলের সকলে মিলে তাঁর সঙ্গে মাঠে শুয়ে পরে। কিন্তু সেকালে ব্রিটিশ প্রভাবিত আইএফএ, গোষ্ঠ পালের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির পরিকল্পনা করে। প্রতিবাদে তিনি খেলা থেকে অবসর নিয়ে নেন। এমনই শক্ত শিরদাঁড়ার মানুষ ছিলেন প্রবাদপ্রতিম খেলোয়াড় গোষ্ঠ পাল। (Gostha Pal)
১৮৯৬ সালের ২০ আগস্ট বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর সাব ডিভিশনের ভোজেশ্বর গ্রামে গোষ্ঠ পালের জন্ম। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শ্যামলাল পালের একমাত্র সন্তানের খেলাধুলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ দেখে ওঁর পরিবার ছেলেকে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বিবেকানন্দের লেখা পড়ে তিনি উৎসাহিত হন ফুটবলে। স্কুলজীবন কেটেছে কলকাতার সারদাচরণ এরিয়ান ইন্সটিটিউশনে। কুমোরটুলি ক্লাবের হয়ে তিনি প্রথম মাঠে নামেন, মাত্র ১১ বছর বয়সে, ১৯০৭ সালে। সেই সময় একদিন মোহনবাগানের খেলোয়াড় রাজেন সেনের নজরে পরে তাঁর খেলা। তিনিই এরপর ওঁকে নিয়ে আসেন মোহনবাগানে, ১৯১২ সালে। পরের বছর থেকে একটানা ২৩ বছর খেলেছিলেন মোহনবাগান ক্লাবে। সেইজন্য এই ক্লাবকে তিনি ‘মা’ সম্বোধন করতেন। অধিনায়ক ছিলেন পাঁচ বছর।
সে সময় রক্ষণভাগে গোষ্ঠ পালের আগ্রাসী মনোভাবকে বেশ ভয়ই পেত ব্রিটিশ ফুটবলাররা। ভারতীয় ফুটবল দল যখন ১৯২৪-এ বিদেশের মাটিতে প্রথম খেলতে যায় সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন গোষ্ঠ পাল। হারকিউলিস কাপে খেলার সময়, ১৯২০তে ইস্টবেঙ্গল তাঁকে ‘হায়ার’ করে নিয়ে যায় একবারই এবং ইস্টবেঙ্গল সেইবার চ্যাম্পিয়ন হয়। ‘রাইট ব্যাক’ পজ়িশনে খেলতেন তিনি। ফুটবল ছাড়াও তিনি ক্রিকেট, হকি এবং টেনিসও খেলেছিলেন। আনন্দমোহন রায় পরিচালিত ‘গৌরীশঙ্কর’ নির্বাক চলচ্চিত্রে এক বিপ্লবীর ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন গোষ্ঠ পাল। তাঁর খেলা দেখার জন্য মোহনবাগান মাঠে যেতেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। (Gostha Pal)
ক্রীড়া সাংবাদিক-সাহিত্যিক: মতি নন্দী
ক্যালকাটা ক্লাব ছাড়াও সে সময়ের প্রায় সমস্ত দল যেমন, হাইল্যান্ড ইনফ্যান্ট্রি, মিডলসেক্স, লিস্টার্স, নর্থ স্ট্যাফোর্ড- ইত্যাদির বিরদ্ধে গোষ্ঠ পাল তীব্র প্রতিরোধ তৈরি করে লড়াই চালিয়ে গেছেন মাঠে। তখন তিনি ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খালি পায়ে খেলতেন। মাঝ মাঠ থেকে তাঁর লম্বা নিখুঁত কিক্, বিপক্ষ খেলোয়াড়দের বিভ্রান্ত করে বল ট্যাকেল করার ক্ষমতা এবং পায়ে বল নিয়ে সহযোগী খেলোয়াড়দের নির্ভুল বল পাস করা- এই সমস্ত গুণপনা দেখে দৈনিক ‘দি ইংলিশ ম্যান’ পত্রিকার এক সাংবাদিক তাঁকে ‘দুর্ভেদ্য চিনের প্রাচীর’ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই থেকে তিনি ফুটবল মাঠের ‘চাইনিজ় ওয়াল’ নামেই বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন। সেজন্য প্রথম আলাপের সময় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ও, তুমিই তা হলে সেই চিনের প্রাচীর!’ (Gostha Pal)
দেশের প্রথম ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে গোষ্ঠ পাল ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ পান, ১৯৬২তে। পদ্মশ্রী সম্মান নিতে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। লেখকের পরনে গলাবন্ধ কোট। ধুতি পরা গোষ্ঠ পালকে দেখে বিস্মিত তারাশঙ্কর জানতে চান তিনি কোট পড়েননি কেন! গোষ্ঠবাবু বলেন, ‘ধুতি পাঞ্জাবিতে যদি খেতাব না পাওয়া যায়, নেব না, ফিরে যাব।’ রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের কানে গেলে তিনি জানান, গোষ্ঠবাবুর এই পোশাকে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তীব্র দেশাত্মবোধের জন্য ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘চৌধুরী’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। (Gostha Pal)
তাঁর সম্মানে ভারতীয় ডাকবিভাগ থেকে একটি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। মোহনবাগান ক্লাব ২০০৪-এ তাঁকে মরণোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মান প্রদান করে। মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুর ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে তাঁর নামে নামাঙ্কিত ‘গোষ্ঠ পাল সংগ্রহশালা’। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক খেলোয়াড় মানুষটির অমলিন স্মৃতি। তাঁর নামে মোহনবাগান ক্লাবের পাশের রাস্তাটি এখন ‘গোষ্ঠ পাল সরণি’। এখানেই খালি পায়ে বল নিয়ে দাঁড়িয়ে গোষ্ঠ পাল– এমনই পূর্ণাবয়ব মূর্তিটি স্থাপিত হয় ১৯৮৪ সালে। নিজের শর্তেই উন্নত শির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের এই চিনের প্রাচীর।
আজও ইডেন উদ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর পূর্ণাবয়ব মূর্তির দিকে তাকিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। (Gostha Pal)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।