শততম জন্মদিনের (২০ জুন ২০২২) প্রেক্ষিতে গৌরকিশোর ঘোষের সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক, দুটো সত্তা নিয়েই গুরুত্বপূর্ণ ও মনোগ্রাহী আলোচনা চলছে। কিন্তু অনালোকিত সমাজের অশ্রুত কাহিনি শোনানো দূরদর্শী এবং সুরসিক সাহিত্যিক নয়, আমার এবারের চর্চার বিষয়, মার্জনা চেয়ে বলি, শুধুই অবিস্মরণীয় সাংবাদিক চিন্তানায়ক গৌরকিশোর।
সাংবাদিক গৌরকিশোরকে নিয়ে আলোচনায় দুটো শব্দ সবচেয়ে বেশি প্রযূক্ত হয়– নির্ভীক আর সচেতন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ এবং ‘দেশ’-এ প্রকাশিত গৌরকিশোরের বহুপঠিত এবং বহু-আলোচিত হুল-ফোটানো সংবাদভাষ্য, বিশ্লেষণ এবং রম্যরচনার কথা ছাড়াও দুটো প্রসঙ্গ বারবার আসে তাঁর এই দুই বিশিষ্টতার উদাহরণ হিসেবে– এক, জরুরি অবস্থায় তিনটি প্রবন্ধ ও সন্তানদের লেখা একটি চিঠিতে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে কারারুদ্ধ হওয়া। দুই, ‘আজকাল’ সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে ব্যাঙ্ক, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক স্বার্থের সম্মিলিত চাপ অগ্রাহ্য করে সোনালি চা বাগানে চলতে থাকা দুর্নীতি আর শ্রমিক শোষণ সম্পর্কে ধারাবাহিক অন্তর্তদন্ত প্রকাশ করে যাওয়া। বঞ্চনা যে শুধু সোনালি চা বাগানে বা চা-শিল্পেই সীমিত নেই, ক্ষোভ যে দার্জিলিং জেলা জুড়ে জনজাতির একটা বিপুল অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, পাহাড় যে ক্রমশ একটা বারুদের স্তূপ হয়ে উঠেছে, মুদ্রিত অক্ষরে সে কথাও প্রথম বলা হয়েছিল গোর্খা আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার অনেক আগে, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ওই ধারাবাহিক অন্তর্তদন্তে, ‘বরফের নিচে আগুন’ শিরোনামে।
দুটো প্রসঙ্গেই অবধারিত উঠে আসে আরও এক সম্পাদক-সাংবাদিক-সাহিত্যিকের কথা, তিনি জ্যোতির্ময় দত্ত। কারণ, জরুরি অবস্থার কঠিন বিরুদ্ধাচরণ করে লেখা গৌরকিশোরের সেই তিনটি নিষিদ্ধ প্রবন্ধ ও সন্তানদের লেখা চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকার ‘রাজনীতি’ সংখ্যায়। এবং, গৌরকিশোরের মতো জ্যোতির্ময়কেও বন্দী করা হয়েছিল জরুরি অবস্থায়। তার কয়েক বছর পরে, ১৯৮১ সালে জ্যোতির্ময় দত্তই সোনালি চা বাগান নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষের সম্পাদনায় সদ্য-প্রকাশিত ‘আজকাল’-এ। শততম জন্মদিনে প্রকাশিত সুলিখিত প্রবন্ধসম্ভার ‘রূপদর্শী গৌরকিশোর’-এ দেখতে পাচ্ছি জ্যোতির্ময়ের একাধিক ছবি, বেশ কয়েকটি রচনায় উঠে এসেছে তাঁর কথা, কিন্তু পাচ্ছি না জ্যোতির্ময়ের নিজের লেখা বা স্মৃতিচারণ। সেই অতৃপ্তি থেকে পৌঁছে গিয়েছিলাম জ্যোতির্ময়-মীনাক্ষীর এখনকার ঠিকানা প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের পাঁচতলায়। কথাবার্তা যা হল, সবই ডিজিটালি রেকর্ডেড এবং সংরক্ষিত। এখানে রইল তারই কিছু নির্বাচিত অংশ।

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী: আপনি কাজ করতেন স্টেটসম্যান-এ, আর গৌরকিশোর আনন্দবাজারে! ঠিক কী করিয়া মিলন হল দোঁহে?
জ্যোতির্ময় দত্ত: (হেসে উঠে) সেটা ষাটের দশকের প্রথমার্ধ। স্টেটসম্যানের তখন বিপুল প্রতিপত্তি, সেখানে যারা লেখেন, সব নাকউঁচু সাহেব। সেই সাহেবদের একটা রেষারেষিও চলে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে। আমি তখন স্টেটসম্যান-এর দুর্মুখ এবং বিশ্বনিন্দুক চলচ্চিত্র সমালোচক। আনন্দবাজারের রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস ‘দ্বীপের নাম টিয়া রং’ থেকে তৈরি একটা সিনেমার খুবই বিরূপ সমালোচনা করেছিলাম আমি স্টেটসম্যান-এ DNTR শিরোনামে। তারপর থেকে আনন্দবাজারের লোকেরা আমাকে দেখলেই অবজ্ঞা আর ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যেতেন।
মীনাক্ষী দত্ত: তুমিও ঠিক তাই করতে ওদের দেখলে!
জ্যোতির্ময় দত্ত: অ্যাঁ? বোধহয় তাই। শুধু গৌরকিশোর ঘোষই দেখেছিলাম ব্যতিক্রম। তাঁর ব্যবহারে তখনও একটা শ্রদ্ধা, স্নেহ আর প্রশ্রয়ের ছোঁয়া ছিল। তার কিছুদিন পর, সাতষট্টি-আটষট্টি নাগাদ, আমি তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি, খবর পেলাম গৌরদা আমেরিকায় আসছেন। একটা গ্রান্ট পেয়েছেন, বেশ কয়েক মাস থাকবেন। আমি লিখলাম, আমরা খুবই খুশি হব আমাদের বাড়িতে কিছুদিন এসে কিছুদিন থাকলে। গৌরদা চলে এলেন, আর থাকলেন বেশ কিছুদিন। মীনাক্ষী তখন গেছে নিউ ইয়র্কে, দীপক (মজুমদার) আর সুপ্রিয়ার বাড়িতে। দীপক পড়াত কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। আমি আর গৌরদা সারাদিন নিরবচ্ছিন্ন কথা বলে গেছি। গৌরদা বলছেন তাঁর বাবার কথা, ছেলেবেলার কথা, মেলে ধরছেন নিজেকে। এমনও হয়েছে যে, কথা বলতে বলতে রান্না চাপাতেও ভুলে গেছি। রাস্তার ধার থেকে একটা বড় তরমুজ কিনেছিলাম, অগত্যা সেটা খেয়েই আমরা চালিয়ে নিয়েছি। গৌরদাকে আয়ওয়ার পোয়েট্রি ওয়র্কশপ, নিউ ইয়র্কে দীপকের বাড়ি, আরও নানা জায়গায় নিয়ে গিয়েছি তখন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে তো দীপককে ঘিরে একটা গোষ্ঠী বা চক্রই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কত রকম লোক যে আসত সেখানে! তাদের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল গৌরদার। এসবের মধ্যে দিয়ে আমাদের সম্পর্কটা বেশ মজবুত হয়ে উঠেছিল।
ধ্রুবজ্যোতি নন্দী: একলাফে আমরা বেশ কয়েক বছর এগিয়ে যাই। ১৯৭৫ সাল। আপনি দেশে ফিরে এসেছেন, ‘কলকাতা’ পত্রিকা বার করছেন, আপনিই তাঁর সম্পাদক। দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কয়েক মাসের মধ্যে বেরলো সেই পত্রিকার ‘রাজনীতি’ সংখ্যা। তাতে ছাপা হল গৌরকিশোরের তিনটি প্রবন্ধ, যার জন্যে গৌরকিশোর এবং আপনাকে, দু’জনকেই জেলে পোরা হল। এটা কী করে হয়েছিল?
জ্যোতির্ময় দত্ত: আমি তখন দেশে ফিরে ‘কলকাতা’ পত্রিকা বার করছি, আর নৌকো নিয়ে ভেসে পড়ার স্বপ্ন দেখছি। গঙ্গার মোহনায় তৈরি হচ্ছে আমার নৌকো। সেখানেই ছোট একটা মাটির বাড়ি তৈরি করে আমি থাকি। মীনাক্ষী পড়াচ্ছে সাউথ পয়েন্টে। রাজনীতিতে আমার কোনও উৎসাহই নেই। হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ (আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ইংরেজি দৈনিক; বন্ধ করে দেওয়া হয় ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ চালু হওয়ার আগে) প্রতি সপ্তাহে দুটো কলাম লিখি। তাতে প্রকৃতি, পরিবেশ, সংস্কৃতি, সবই থাকে কিন্তু রাজনীতি একেবারেই না। কলাম শুরু করার আগেই আমি সে কথা বলে রেখেছিলুম। কিন্তু এমার্জেন্সি চালু হওয়ার পর থেকে দেখছিলুম, যারা এতকাল শুধু রাজনীতি নিয়েই লিখতেন, তাঁরা প্রায় সবাই এখন ফুল, পাখি, নদী, পাহাড় নিয়ে লেখায় কাগজ ভরিয়ে দিচ্ছেন।
সেটা তো ইন্টারনেট, ই-মেলের যুগ নয়, তাই লেখা জমা দিতে আমাকে সপ্তাহে দু’বার কলকাতায় আসতে হত। এক দিন লেখা জমা দিয়ে আমি আর স্টেটসম্যান-এর হামদি বে গল্প করছি, হামদি জিজ্ঞেস করল, এমার্জেন্সি যে জারি হল, এখন কী করবে ভাবছ? বললুম, আমার সঙ্গে রাজনীতির তো কোনও সম্পর্ক নেই! আমি যেমন নদীর ধারে কুঁড়েঘরে থেকে জীবন নিয়ে একটা পরীক্ষা করছি, তা-ই চলবে। যারা সম্পাদকীয় লেখেন, রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছুই যাঁরা কোনওদিন লিখলেন না, তাঁরা ভাবুন কী করবেন। শুনে হামদি মন্তব্য করল, এইভাবেই তো ইন্টেলেকচুয়ালরা দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।

হামদির কথাটা আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। প্রায় সারা রাত জেগে আমি বাংলা আর ইংরেজিতে খুব গরম গরম শব্দ ব্যবহার করে দুটো বিবৃতি লিখে ফেললুম। উদ্দেশ্য, আরও অনেককে সই করিয়ে সেগুলো বুদ্ধিজীবীদের যৌথ বিবৃতি হিসেবে প্রকাশ করা। কিন্তু সই করাতে গিয়ে দেখি, কেউ রাজি নয়। সবাই ভয় পাচ্ছে। ভীষণ ভয়। ‘কৃত্তিবাস’-এর সভায় আমার কথা পুরোটা না শুনেই থামিয়ে দেওয়া হল। ‘এসব বাজে জিনিস করার জায়গা এটা নয়’, বলে শরৎ মুখোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রায় ঘাড় ধরে আমাকে সেখান থেকে বার করে দিয়েছিলেন। দু-দিন পরে পকেটে সেই বিবৃতি নিয়ে গেলুম আনন্দবাজার অফিসে। সেখানেও একই অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ কবিতায় যেমন অজাতশত্রুর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বুদ্ধ-আরাধনায় স্থিরপ্রতিজ্ঞ শ্রীমতীর ডাক “শুনি ঘরে ঘরে কেহ পায় ভয়, কেহ দেয় তারে গালি”, আমার অভিজ্ঞতাও সেই রকম। শুধু গৌরকিশোর ঘোষ কাগজটা চার ভাঁজ করে বুক পকেটে পুরে বললেন, ‘কাল এসো তুমি। আজ আমি একটু ভাবি।’
পরের দিন গেলাম যখন, গৌরদা অনেক কথাই বলছেন, কিন্তু সেই বিবৃতিতে সই করার ব্যাপারে কিচ্ছু না। অধৈর্য হয়ে শেষটায় জিজ্ঞেস করলুম যখন, গৌরদা বললেন, শোনো, ওতে কিছু হবে না। ক’শো, ক’হাজার ছাপবে তুমি? তার বেশিরভাগই তো ওরা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেবে। লাভ কিছুই হবে না, শুধু তোমাকে পুলিস সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করবে, হেনস্থা করবে। কিন্তু তুমি অন্য একটা কাজ করতে পারো। আমার যে তিনটে লেখা সিদ্ধার্থ রায়ের সেন্সর দফতর আটকে দিয়েছে, নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো একসঙ্গে ছেপে বার করার সাহস আছে তোমার?
সাতষট্টি-আটষট্টি নাগাদ, আমি তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছি, খবর পেলাম গৌরদা আমেরিকায় আসছেন। একটা গ্রান্ট পেয়েছেন, বেশ কয়েক মাস থাকবেন। আমি লিখলাম, আমরা খুবই খুশি হব আমাদের বাড়িতে কিছুদিন এসে কিছুদিন থাকলে। গৌরদা চলে এলেন, আর থাকলেন বেশ কিছুদিন। …আমি আর গৌরদা সারাদিন নিরবচ্ছিন্ন কথা বলে গেছি। গৌরদা বলছেন তাঁর বাবার কথা, ছেলেবেলার কথা, মেলে ধরছেন নিজেকে।
বাড়ি ফিরে মীনাক্ষীর মতামত চাইতে কিছুক্ষণ ভেবে মীনাক্ষী বলল, তোমার মন যা চাইছে তা-ই করো। পরের দিন গৌরদাকে গিয়ে বললুম, যো হুকুম। যে প্রেস থেকে তখন ‘কলকাতা’ পত্রিকা ছাপা হত, লেখার কপি পাঠানো হল সেখানে। সেন্সরের ‘নট পাসড’ ছাপ-মারা তিনটে লেখা, তার সঙ্গে ‘কলকাতা’-র জন্যে বিশেষ লেখা ‘পিতার পত্র’। দুটো ফর্মা কম্পোজ করার পর কম্পোজিটরের সন্দেহ হল, এখন এ জিনিস ছাপা উচিত হবে কি? তিনি ছুটলেন প্রেস মালিকের কাছে। মালিক এক নজরেই যা বোঝার বুঝলেন এবং আমাকে জানিয়ে দিলেন, তাঁর প্রেসে আর ‘কলকাতা’ ছাপা সম্ভব নয়। এগিয়ে এলেন শম্ভু রক্ষিত। তিনি গোপনে বাকিটা কম্পোজ করে দেওয়ার পর ছাপার উপযুক্ত প্রেসের সন্ধান শুরু হল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেল বর্ধমানের ছেলে আজিজুর রহমানকে। আজিজুরের গ্রামের ছাপাখানার ট্রেডল মেশিনে ছেপে ‘কলকাতা’ পত্রিকার ‘রাজনীতি’ সংখ্যা ছড়িয়ে দেওয়া হল বিভিন্ন স্টলে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়ে গেল সেই সংখ্যা। গৌরদা বললেন, ‘আমার বয়স হয়েছে, হার্টের অবস্থাও ভালো নয়। আমি কোথাও যাচ্ছি না, বাড়িতেই থাকছি। ধরতে হলে ওরা আমাকে বাড়ি থেকেই ধরুক। কিন্তু তোমার বয়স কম, পালিয়ে পালিয়ে থাকতে পারবে, তুমি আজই আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যাও।’
সেই পরামর্শ মতো আমি বাড়ি ছাড়লুম। কিন্তু যেখানেই যাই, দু-রাতের বেশি এক জায়গায় থাকি না। কী করে না কী করে পুলিশ ঠিক খবর পেয়ে যায়, তিন দিনের মাথায় আমাকে সেখানে খুঁজতে আসে। আমার কলকাতার বাড়িতে অবশ্য প্রায় রোজই আসে রাত তিনটে, সাড়ে তিনটে, কি চারটে নাগাদ। লন্ডভন্ড করে খোঁজাখুঁজি করে। মীনাক্ষী, তিতির (কঙ্কাবতী দত্ত, কন্যা), গোগোর (মল্লিনাথ দত্ত, পুত্র) জীবন অতিষ্ঠ। কিন্তু কোনও অসম্মান কি দুর্ব্যবহার করেনি কখনও। এদিকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই মুখ ফিরিয়েছে, এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে।
মীনাক্ষী দত্ত: হ্যাঁ, সবাই নয়, প্রায় সবাই। দিল্লি থেকে আমার স্কুল, মানে সাউথ পয়েন্টের প্রতিষ্ঠাতা সতীকান্ত গুহকে কোনও মন্ত্রী বা সাংসদ চিঠি দিয়েছিলেন, জ্যোতির্ময় দত্তের স্ত্রী মীনাক্ষী দত্তকে এখুনি বরখাস্ত করুন বলে। সতীকান্ত গুহ সেই চিঠির কথা জানিয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমি যতদিন আছি, তোমাকে কেউ এই স্কুল থেকে সরাতে পারবে না। স্টেটসম্যান অফিস থেকে প্রতি মাসের একটা নির্দিষ্ট তারিখে পাঁচশো টাকা গোপনে পাঠিয়ে দেওয়া হত আমাদের বাড়িতে। আর, মাসে পাঁচশো করে টাকা পাঠাত সুনীল, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেটাও গোপনে।
জ্যোতির্ময় দত্ত: আমি তো বাড়িছাড়া, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, এদিকে গৌরদাকে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। তাঁকে রাখা হল প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলে, তারপর কিছুদিন হার্টের অসুখের চিকিৎসার জন্যে এসএসকেএম হাসপাতালে। এক বছরেরও বেশি বন্দি করে রেখেছিল গৌরদাকে। কিন্তু আমাকে ধরার ব্যাপারে, আমার মনে হচ্ছিল, পুলিস যেন একটু ঢিলেই দিচ্ছে। এইরকম সময় কেরল থেকে ‘কলকাতা’-র ‘রাজনীতি’ সংখ্যার ইংরেজি আর মালয়ালম অনুবাদ বেরিয়ে গেল, পৌঁছে গেল দিল্লিতে। বিষয়টা সঞ্জয় গান্ধীর নজরে আনা হতেই তিনি সিদ্ধার্থশঙ্করের কাছে জানতে চাইলেন, এর সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? কেন, হয়নি কেন? রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পুলিশকর্তাদের তলব করলেন সিদ্ধার্থ। বলেছিলেন, একটা অ্যাপলিটিকাল লোক দিনের পর দিন আপনাদের চোখ এড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় কী করে! শুনেছি, আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্যে সরকারের তরফ থেকে একটা পুরস্কারও নাকি ঘোষণা করা হয়েছিল। ব্যস, এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পেশাল ব্রাঞ্চ। প্রথমে শেয়ালদা স্টেশন থেকে শম্ভুকে (রক্ষিত), তারপর হাওড়ার ঘুসুড়ি থেকে আমাকে। একটা লজঝড়ে ব্ল্যাক মারিয়া প্রায় সারা রাত কখনও চলে কখনও থেমে সকাল বেলা হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছল লর্ড সিনহা রোডে স্পেশাল ব্রাঞ্চের দফতরে। [ক্রমশ]
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৭ জুলাই ২০২২
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
3 Responses
ধ্রুব, খুব ভাল লাগছে।
খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। খুব ভালো লাগলো।
খুব আগ্রহ নিয়ে পড়া হোলো । পরবর্তী লেখার জন্য অপেক্ষা য রইলাম ।